Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কেভ অব দ্য ক্রিস্টালস: বিস্ময়কর এক গুহা

“এটা ক্রিস্টালের সিস্টিন চ্যাপেল”, ভূবিজ্ঞানী গার্সিয়া রুইজ তার দলের সাথে কেভ অব দ্য ক্রিস্টালস-এ নিজেদের গবেষণা সম্পন্ন করে এসে এরকমই বলেন। মেক্সিকোর চিহুয়াহুয়ার নেইকার ভূগর্ভে অবস্থিত এই গুহা। আঞ্চলিক ভাষায় একে ‘লা কুয়েভা ডে লস ক্রিস্টালস’ বলা হয়। প্রাকৃতিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় স্ফটিকের খনি দেখতে চাইলে এই গুহাই সেই আশা পূরণ করতে পারে। তবে ব্যাপার হলো, এই গুহায় প্রবেশ করা এবং বের হওয়া দুটোই বেশ কষ্টসাধ্য এবং বিপজ্জনক। অর্থাৎ গুহাটা হচ্ছে বেশ ভয়াবহ সুন্দর!

কেভ অব দ্য ক্রিস্টালসের অবস্থান; Image source: Beautifulworld.com

আবিষ্কার

১৭৯৪ সালে তারাহুমারা নামক ভারতীয় এক গোষ্ঠী চিহুয়াহুয়ায় রুপা সংবলিত একটি গুহার সন্ধান পায়। সেটা ছিল কেভ অব দ্য ক্রিস্টালসের উপরের অংশ নেইকা মাইন। এখানে রুপা ছাড়া সোনা এবং জিঙ্কেরও অনেক প্রাকৃতিক খনি ছিল। মেক্সিকান বিপ্লবের সময় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক নিয়মেই প্রচুর খনির সৃষ্টি হয় এই স্থানে। বিপ্লবকারীদের তখন নিজেদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থের প্রয়োজন হয় এবং তাদের মনে লোভও ভর করে। তাই বিভিন্ন বিপ্লবী দল অবৈধভাবে ও জোর করে গুহার মালিকদের কাছ থেকে খনির ভাগ চায়।

এই নিয়ে মালিক এবং বিপ্লবীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাঁধে, যার ফলে একজন মারা যান। এরই জের ধরে ১৯১১-১২ সাল পর্যন্ত এখানে খনি থেকে উত্তোলন বন্ধ থাকে। বন্ধের আগে ‘কেভ অব দ্য সোয়ার্ডস’ আবিষ্কৃত হয়। এরই সূত্র ধরে পরবর্তীতে কেভ অব দ্য ক্রিস্টালসের খোঁজও পাওয়া যায়।

কেভ অব দ্য ক্রিস্টালসের আবিষ্কার খুব বেশি পুরনো নয়। মাত্র ১৮ বছর আগে ২০০০ সালের এপ্রিল মাসে জুয়ান এবং পেদ্রো সানচেজ নামের দুই ভাই নতুন একটি সুড়ঙ্গ খনন করার সময় আকস্মিকভাবে ক্রিস্টালে ভরা একটি গুহা খুঁজে পান। জুয়ান এবং পেদ্রো ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াস পেনোলিস’ নামের একটি কোম্পানির জন্য কাজ করতেন। সেই সুবাদে তারা বাকি শ্রমিকদের সাথে নেইকা মাইনে কেভ অব দ্য সোয়ার্ডসের খনির খোঁজে যায়। বাকিরা যখন ব্যস্ত ছিলো, তখন এই দুই ভাই মূল্যবান ক্রিস্টালের বিশাল এক ভাণ্ডারের সন্ধান পান। এই আবিষ্কারের পরপরই তারা নেইকা মাইনের কাজে থাকা ভারপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার রবার্টো গঞ্জালেজকে সেই সম্পর্কে অবগত করেন। আবিষ্কারটির গুরুত্ব বুঝতে পেরে রবার্টো সাথে সাথেই কাজ বন্ধ করে দেন।

কেভ অব দ্য ক্রিস্টালস; Image source: Beautifulworld.com

তবুও গুহাটির প্রাকৃতিক সম্পদের কিছুটা ক্ষতি হয়। কারণ অনেক শ্রমিকই এত দামি এবং আকর্ষণীয় জিনিস দেখে নিজেদের লোভ সামলাতে পারেনি। তাই এলোপাথাড়ি বিশাল ক্রিস্টালগুলো গুহার দেওয়াল ও মেঝে থেকে জোর করে বের করার এবং ভাঙার চেষ্টা করে। এজন্য গুহাটির প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষতি হয়। পরবর্তীতে পেনোলিস ইন্ডাস্ট্রি গুহার প্রবেশপথে লোহার দরজা স্থাপন করে, যাতে সম্পদের কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হয়।

তবে একজন শ্রমিক এর কিছুদিন পর আবারও সেই গুহায় চুরির উদ্দেশ্যে প্রবেশ করে। কিন্তু অক্সিজেনের অভাবে সেখানেই মারা যায় এবং গুহার উচ্চ তাপমাত্রার কারণে তার লাশ প্রায় সিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। এক প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, সেই শ্রমিকের লাশ দেখে মনে হচ্ছিলো ওভেনে কোনো খাবার তৈরি করা হয়েছে।

প্রায় বাস্কেটবল কোর্টের সমান

কেভ অব দ্য ক্রিস্টালস চুনাপাথরে ঘেরা অশ্বখুরের মতো একটি গুহা, যার দৈর্ঘ্য ৯০ ফুট এবং প্রস্থ ৩০ ফুট। এর পুরো মেঝে ক্রিস্টাল দিয়ে তৈরি। এর উজ্জ্বল সাদা রঙ একে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। ভূবিজ্ঞানী গার্সিয়া রুইজ বলেন, “এই বিশ্বে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে খনির পৃথিবী নিজেকে এত সুন্দরভাবে প্রকাশ করেছে।

ইতিহাস

নেইকা গুহার নয়শ ফুট নিচে এই সাদা পাথরের মেক্সিকান মরুভূমি অবস্থিত। সাদা পাথর বা ক্রিস্টালগুলো আসলে সেলেনাইট বা ক্যালসিয়াম সালফেট। জিপসামের স্ফটিক সেলেনাইট তার এই নামটি পেয়েছে চন্দ্রের গ্রিক দেবী সেলেনের নামানুসারে। এর আকর্ষণীয় রঙ এবং বিভিন্ন পৌরাণিক বিশ্বাসের দরুণই এসব স্ফটিকের নাম এরকম।

জিপসামের স্ফটিক; Image source: Soulmakes.com

ক্রিস্টালগুলো তাদের বিশালাকারের জন্যই নয়, বরং বিশুদ্ধ গঠনের জন্যও কিছুটা অস্বাভাবিক। নেইকার এই গুহায় একসময় গরম লবণাক্ত পানির প্রবাহ ছিল, যা ঘন ঘন সংগ্রহের কারণে ১৯৮৫ সালে দুর্ভাগ্যবশত বন্ধ হয়ে যায়। এখন বিজ্ঞানীরা এসকল পাথর পরীক্ষা করে এদের আসল বয়স ও গঠন সম্পর্কে আরও নিখুঁতভাবে বোঝার চেষ্টা করছেন।

ধারণা করা হচ্ছে, গুহাটি তৈরি হয়েছে প্রায় পাঁচ লক্ষ বছর আগে। ভূমি থেকে প্রায় ২-৩ মাইল (৩-৫ কিলোমিটার ) নিচে ম্যাগমার প্রবাহ ছিল। যখন এই গুহার ম্যাগমার সাথে ভূগর্ভের পানি মেশা শুরু করে, তখন এদের পারস্পরিক প্রভাবের কারণেই মূলত এই ক্রিস্টাল তৈরি হতে থাকে। আসলে সেই স্থানের ভূগর্ভস্থ পানিতে প্রচুর জিপসাম ছিল, যা ম্যাগমার তাপে বিক্রিয়া করে এবং স্বচ্ছ সেলেনাইট ক্রিস্টাল সৃষ্টি করে।

গুহাটি থেকে প্রাপ্ত সেলেনাইট; Image source: allthatisinteresting.com

যেহেতু গুহাটি ম্যাগমার প্রবাহের উপরই অবস্থিত, যা ভূগর্ভের কেন্দ্র থেকে আসে, তাই স্বাভাবিকভাবেই সেখানে তাপমাত্রা খুব বেশি থাকে। সত্যি বলতে, আপনি যত প্রস্তুতি নিয়েই যান না কেন, সেই গুহায় কোনো মানুষের পক্ষে কয়েক মিনিটের বেশি থাকা সম্ভব নয়।

কেভ অব দ্য ক্রিস্টালস কয়েকটি কক্ষে বিভক্ত। এর মূল কক্ষের তাপমাত্রা ১৫০ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা ৬৫.৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। অন্যান্য অংশে সাধারণত ১০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা ৩৭.৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকে। আরও ঝামেলার বিষয় হচ্ছে, সেখানে আর্দ্রতা সবসময়ই প্রায় শতভাগ থাকে। অর্থাৎ ব্যাপারটা হচ্ছে, কাঁটা গায়ে নুনের ছিটা। একে তো অস্বাভাবিক গরম, এর উপর একদম পানিশূন্য পরিবেশ। এমন অবস্থায় ঐ গুহায় কোনো উপযুক্ত প্রস্তুতি না নিয়ে যাওয়া এবং মৃত্যুকে নিজ হাতে বরণ করে নেয়া একই কথা।

কীভাবে প্রবেশ করবেন

প্রবেশের জন্য বিশেষ পোশাক; Image source: allthatisinteresting.com

এখানে প্রবেশের সময় অবশ্যই আপনাকে নিজের শরীর ঠাণ্ডা রাখার জন্য বিশেষ একটি পোশাক পরতে হবে। পোশাকের ভেতরটা মূলত বিশেষ ধরনের ঠাণ্ডা দ্রব্যের প্যাকেট দিয়ে ভরা থাকে এবং সাথে ছোট একটা ব্যাগ থাকে। এর মধ্যে একটি যন্ত্র থাকে, যা দিয়ে গুহায় প্রবেশকারী এই গরম আবহাওয়ায় শ্বাস নিতে পারে। এছাড়া হেলমেট, বিশেষ টর্চলাইট, রাবারের জুতা এবং গ্লাভস পরতে হয়। তবে এত কিছুর পরও এখানে কোনো মানুষ ৪৫ মিনিটের বেশি থাকতে পারে না।

উচ্চ তাপমাত্রা এবং অত্যাধিক আর্দ্রতার কারণে শরীর পানিশূন্য হয়ে যায়। একজন মানুষ গুহায় প্রবেশ করলে তার শরীর থেকেই পরিবেশ পানি শুষে নিতে চায়। এজন্য শরীর ও মস্তিষ্কের কাজে ব্যাঘাত ঘটে। ফলশ্রুতিতে এই গুহার পিচ্ছিল রাস্তায় চলাফেরা করা কিংবা বড় বড় ধারালো ক্রিস্টালের হাত থেকে বাঁচা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

গুহার পিচ্ছিল ও বিপজ্জনক রাস্তা; Image source: Stormchaser.com

ঠিকমতো প্রস্তুতি নিয়ে একজন পর্যটককে অবশ্যই ভারপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের সহায়তায় গুহাটিতে যাওয়ার জন্য ট্রাক ঠিক করতে হবে। ট্রাকটি তাকে নিয়ে যাবে মূল খনির সুড়ঙ্গ রাম্পা সান ফ্রান্সিস্কোর ভেতর দিয়ে। সুড়ঙ্গটি প্রায় অর্ধেক মাইল লম্বা। এর শেষ মাথায় রয়েছে লোহার দরজাটি, যার মাধ্যমে কেভ অব দ্য ক্রিস্টালসে প্রবেশ করা যায়। সুড়ঙ্গ দিয়ে যাওয়ার সময় আস্তে আস্তে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে এবং নারীদের চেহারা উজ্জ্বল দেখাতে শুরু করে। আরেকটি মজার বিষয় হলো, ক্রিস্টালগুলোর মূল উপাদান সেলেনাইট প্রায় কয়েক হাজার বছর আগে গুঁড়া করে সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা রূপচর্চায় ব্যবহার করতেন।

ছোট এক টুকরো ঝকঝকে সাদা পাথর দেখলেই আমরা বেশ খুশি হয়ে যাই। অবাক লাগে এর ঝলক এবং উজ্জ্বল রঙ দেখলে। সেখানে এই কেভ অব দ্য ক্রিস্টালস যে সকলকে অবাক করতে সফল হয় তা আলাদা করে কিছু বলার দরকার পড়ে না।

ফিচার ইমেজ: Youtube.com

Related Articles