বেতনের অংকটা একেবারে কম নয় জাহিদের। পঞ্চাশ হাজারের ঘর পার করা আকর্ষণীয় বেতনটা মাস পার হলেই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে আসে তার। আর তারপর, তিন সপ্তাহ না যেতেই প্রায় গোটা বেতন খরচ করে হাপিত্যেশ করতে থাকে সে। মাসের শেষ সপ্তাহটা নিজেকে গরীব বলেই মেনে নিতে হয় ষাট হাজার টাকা বেতন পাওয়া কর্পোরেট চাকরিজীবী জাহিদের।
ওদিকে আফতাবের ব্যাপারটাও অনেকটা তেমনই। ব্যবসার টাকায় জীবিকা নির্বাহ করছে সে, লাভ-ক্ষতি মিলিয়ে কাজ তার মন্দ যায় না। কিন্তু ব্যবসায় লাভের চেয়ে বিনিয়োগ বেশি হচ্ছে। লাভ আসছে বটে, কিন্তু সে টাকা জমা রাখতে পারছে না, আবার ব্যবসার কাজেই লাগাচ্ছে। তো দিনের শেষে লাভের ঘর অনেকটাই ফাঁকা থেকে যায়।
বুঝে গেছেন নিশ্চয়, কাদের কথা বলতে চলেছি? হ্যাঁ, এই প্রতিবেদনে কথা হতে যাচ্ছে সেসব মানুষদের নিয়ে, যাদের অতিরিক্ত খরুচে স্বভাব একরকম আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টাকাকে হাতের ময়লা ভেবে যারা একেবারেই হাতে রাখতে চাইছে না, আর তারপর কখনো খুব প্রয়োজনের মুহূর্তে “আমি এত গরীব কেন” ভেবে বুক চাপড়াচ্ছে!
নিজের উদার হাতে কিছুটা রাশ লাগাতে চান? খরুচে স্বভাব নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন? তারই কিছু উপায় বলে দেয়া হবে এখানে। তবে অবশ্যই, সবার আগে নিজের অত্যধিক খরচের কারণ জানা চাই, ক্ষেত্রগুলো নিশ্চিত করা চাই। তবেই আপনি এই অত্যধিক খরচকে কমাবেন কেমন করে, সেই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
টাইম ডট কমের এক প্রতিবেদনে কিছু কৌশল বলা হয়েছে বেশি খরচের রাশ টানার।
বাজেট মেনে চলুন। নিজের খরচের একটা বাজেট অবশ্যই তৈরি করুন, খুব বেশি প্রয়োজন না থাকলেও। এবং সেটা মেনে চলার চেষ্টা করুন। আপনার হাতে কী পরিমাণ অর্থ আছে বা দুদিন পর থাকবে, আর আপনি এর মাঝে কোন কোন খাতে কত খরচ করতে পারেন, প্রতিটা জিনিসের স্পষ্ট হিসাব রাখুন নিজের কাছে। বাজেট মেনে চলা আপনাকে চিন্তামুক্ত রাখতেও সাহায্য করবে। নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে বাজেট পুনরায় পরীক্ষা করুন, খরচের খাতগুলো লক্ষ্য করুন। মাসের এক-তৃতীয়াংশে এই কাজটা করতে পারেন।
নগদ অর্থ বেশি ব্যবহার করুন। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে টাকা উড়িয়ে দেয়া বড় সহজ। আপনি স্রেফ কার্ডটা দিলেন, আর বিল নেয়ার লোক সেটা সোয়াইপ করলো, ব্যাস শেষ! এই সহজ পদ্ধতিটাই আপনাকে মাসের শেষ সপ্তাহে বড় বেশি গরীব বানিয়ে রাখছে, তা জানেন তো? লোকজন বাড়তি খরচগুলো করার আগে দুবার ভাবে না, কেননা তাদের কাছে কার্ড আছে। আর তাই কার্ড ব্যবহার করে নিজেদের সর্বস্ব লুটিয়ে দেয়া মানুষদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বেশি করে ক্যাশ টাকা সাথে রাখার।
ব্যাংক থেকে কয়েকদিনের খরচের টাকা একেবারে তুলে নিন। টাকাগুলো রাখুন আলাদা আলাদা খামে। খামের গায়ে সেই টাকাটা খরচের খাত উল্লেখ করা থাকতে পারে। অর্থাৎ ‘খাবার’, ‘যাতায়াত’, ‘সিনেমা’, ‘বই’, ‘বেড়ানো’ ইত্যাদি খামে আপনার সেসব কাজের জন্য রাখা টাকা জমা করুন। যে খাতের খরচ, সেই লেবেলযুক্ত খাম থেকেই টাকা নিন প্রয়োজন হলে। আর অবশ্যই, কঠোরভাবে চেষ্টা করুন এক খাতের জন্য রাখা টাকা অন্য খাতে খরচ না করতে। ‘সিনেমা’ খামের টাকা ফুরিয়ে গেলেই ‘খাবার’ নামক খামে হাত দেবেন না যেন!
উইকিহাউ ডট কমের আরেক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আরো কিছু পরামর্শ। যা আপনার অধিক খরচাপাতির স্বভাবে লাগাম দিতে সহায়ক হতে পারে।
প্রয়োজনের বাইরে কোন খাতসমূহে প্রায়ই বাড়তি খরচ হচ্ছে? প্রতি মাসেই অনেকগুলো টাকা ঢালছেন অযথাই, সেসব জায়গা চিহ্নিত করুন। বিনোদনের জন্য সমস্ত অর্থ ব্যয় করে দরকারের একটা বিল মেটাতে পারছেন না, এমনটাও কি হচ্ছে প্রায়ই?
কোন কোন জিনিস কিনে বসে আছেন যেগুলো ব্যবহার করছেন না, খুঁজে দেখুন। আর নতুন কেনাকাটার আগে এবার তাহলে সত্যিই ভাবুন, যা কিনতে যাচ্ছেন তা আদৌ ব্যবহার করবেন কি না? এমনিই রেখে দেয়ার মতো জিনিস কিনে খরচাপাতি বাড়ানোটা স্রেফ বোকামি।
বছরের সিকিভাগে নিজের খরচের খাতা পুনরায় নিরীক্ষণ করুন। গত তিন মাসে অ্যাকাউন্টের টাকা কোথায় গেছে, কোন খাতে কেমন খরচ করেছেন, দেখুন একবার। এবং প্রতিটা খুঁটিনাটি বিষয়ের নোট রাখুন, অন্তত চেষ্টা করুন রাখার।
যেকোনো ক্ষেত্রে দাম চুকানোর বিলের রশিদ সংরক্ষণ করুন। তাতে হিসাব মেলানো সহজ হবে পরবর্তীতে। এক্ষেত্রে পরামর্শ দেয়া হয় ক্যাশ টাকার বদলে কার্ড ব্যবহারের, কেননা এতে আপনার খরচের নথিপত্র সহজেই পাওয়া সম্ভব।
ছুটির দিনটায় আজ ঘোরার জন্য বেছে নিয়েছেন শপিংমল। সাবধান কিন্তু! টাকা আর সময়, দুটোই হাতে নিয়ে বেরিয়ে তো পড়বেন, ফিরে যেন হাতটা পুরো খালি না লাগে! কেনাকাটা করতে যাওয়ার আগে নিজেকে কঠিন লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিন। অন্তত অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার বেলা এই কথাটা মানুন। পছন্দ হলো, টাকা আছে, ব্যাস নিয়ে নিলাম মানিব্যাগটা। আর তারপর? মাসের শেষে মানিব্যাগে ‘মানি’ কই পাচ্ছেন?
অনলাইন শপিং করার অভ্যাস করতে পারেন, হতে পারে এতে প্রতিটা জিনিসের দামের প্রতি খেয়াল রাখা আর হিসাব মাথায় রাখার কাজটা সহজ হবে।
আজকেই হুদা বিউটির ব্রাউন এডিশনটা কিনে বাড়ি ফিরলেন। লিপস্টিকের কয়েকটা শেডের এই সেটটা মন ভালো করার মতো একটা ব্যাপার এই মুহূর্তে। বন্ধুর ইনবক্স এলো, লা রিভে ছাড় এসে গেছে, কবে যাচ্ছেন তার সঙ্গে? এই রে, মুশকিল হয়ে গেলো কি? ছাড় মানেই কিছুটা অল্প টাকায় বেশি কেনাকাটা, এই লোভ যে সামলানো বড় দায়! তাই ছাড়ের ফাঁদে পা দেয়ার আগে যত বেশি সম্ভব ভাবুন। কেবলমাত্র ‘সেল’ নামক লোভনীয় বিষয়টা কারো কেনাকাটার কারণ কেন হবে? কেনাকাটার বেলা ছাড়কে ছাড় দেবেন না। লোভ সংবরণ করুন। নিজেকে দুটি প্রশ্ন করবেন সবসময়, যা কিনতে চাচ্ছেন তা কি আসলেই আপনার প্রয়োজন? আর, জিনিসটা কি আপনার সাধ্যের সীমায় আছে?
নিত্যদিন ক্রেডিট কার্ড সঙ্গে রাখতেই হবে, তা জরুরি নয়। কার্ডটা বাড়িতেও রেখে যান কখনো। সেই দিনের জন্য প্রয়োজনের নির্ধারিত পরিমাণ টাকা নিয়ে বের হন।
খাবারের অভ্যাস বাড়িতেই হোক বেশি। তাছাড়া ঘরের খাবার অধিক স্বাস্থ্যকর তো বটেই। অফিসেও লাঞ্চবক্স বাসা থেকে নিয়ে যান। এই অভ্যাস করুন, প্রতিদিন না হলেও প্রায়ই। নিত্য বাইরের খাবারে যে খরচা করছেন, তা কি খুব বাড়াবাড়ি হচ্ছে না?
মাসখানেকের জন্য নিজের খরচাপাতির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি রাখুন। ব্রতের মতো পালন করুন ব্যাপারটা। এই মাসটা কেবলই খুব দরকারের জিনিস কিনবেন, প্রয়োজনের খাতেই টাকা খরচ করবেন আর অপ্রয়োজনের খরচগুলো বাদ দেবেন। খরচ করুন তাতে যা আপনার দরকার, তাতে না যা আপনি চাচ্ছেন। দেখুন তো, কতটুক পারেন!
ছেলেবেলার টাকা জমানোর অভ্যাসটা নতুন করে গড়ে তুলুন। টাকা জমানোর অভ্যাস ছিলোই না কখনো? আরো ভালো! তাহলে এবার অভ্যাস তৈরি করুন কিছুটা সঞ্চয়ের। হোক তা একটা মাটিরই ব্যাংক, পেটফোলা। সঞ্চয়ের স্বভাব বাড়লে খরচের হাত আপনা থেকেই নিয়ন্ত্রণ পেতে পারে।
তো, আপাতত এই কয়টি উপায় অবলম্বন করে দেখুন দেখি উদার দুই হাতকে একটু হিসেবি করা যায় কি না!
ফিচার ইমেজ: The Tiny Life