Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বনসাই: খর্বাকৃতির গাছের ইতিহাস ও শিল্প

বাগান করা বা গাছের পরিচর্যা করা মানুষের একটা খুব সাধারণ শখ। ছোটবেলায় স্কুলের রচনায় ‘বাগান করা’ নিয়ে রচনা/অনুচ্ছেদ লেখেননি, এমন মানুষ পাওয়া দুষ্করই বটে! এমনকি অনেকেই আছেন যারা দুর্লভ প্রজাতির গাছ নিজেদের সংগ্রহে রাখতে ভালবাসেন। কিন্তু বিশাল বড় বড় আকৃতির গাছকে ছোট আকারে পরিণত করে সেটাকে টবে সাজিয়ে রাখাও যে একটা শখ বা শিল্প, এ ব্যাপারটা কি একটু উদ্ভট না?

বলছিলাম বনসাই গাছের কথা। বনসাই শব্দটি সম্ভবত অনেকের কাছেই পরিচিত। বাংলাদেশের বেশ কিছু মানুষ বনসাই শিল্পে আগ্রহী, যারা নিজেরা বনসাই তৈরি করে বাসায় সাজিয়ে রাখেন। আবার অনেকে বাহারি দোকান থেকে মনোরম বনসাই কিনে বারান্দায় কী ঘরের কোনার শোভা বর্ধন করেন। ছোট এই বামনাকারের গাছ তৈরির পেছনেও কিন্তু রয়েছে বেশ একটা জমাট ইতিহাস।

মেপল গাছের একটি বনসাই; Source: FivePrime

বনসাই (বানজাই বা বনজাই) শব্দটি একটি জাপানি শব্দ, যার বাংলা করলে অর্থ দাঁড়ায় ‘জীবন্ত ভাস্কর্য’। স্বাভাবিকভাবে তাই বনসাইকে জাপানে উদ্ভূত একটি শিল্প বলে মনে হতেই পারে। কিন্তু খুব অবাক করা ব্যাপার হলো, বনসাইয়ের প্রচলন আসলে শুরু হয় চীন দেশে। প্রায় ২০০০ বছরেরও বেশি সময় আগে থেকে চৈনিক সাম্রাজ্যের সময়ে সেখানকার লোকজন ছোট ছোট পাত্রে খর্বাকৃতির গাছ চাষের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে জাপানি জেন বৌদ্ধগোষ্ঠী একে আরও উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যায়। চলুন দেখে আসা যাক বনসাই শিল্পের আদ্যপ্রান্ত।

চীনদেশে বনসাইয়ের ইতিহাস

যে দেশের মানুষের ফুল আর উদ্যানের প্রতি বরাবর দুর্বলতা, সে দেশে বনসাইয়ের মতন একটা শিল্পের আবিষ্কার কাকতালীয় কিছু নয়, বরঞ্চ এটাই স্বাভাবিক। তবে বনসাইয়ের আবির্ভাব নিয়ে অনেক চমকপ্রদ কিছু ধারণা রয়েছে চীনাদের মধ্যে।

তাও ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস:

অনেককাল আগে চীনের আকাশসমান উঁচু পাহাড়গুলোতে ছোট ছোট কিছু গাছের জন্ম হতো। আকারে ছোট হলেও সেগুলোর চেহারা বড় বড় গাছের মতোই। সংগ্রহ করা প্রায় অসাধ্য বিধায় এই গাছগুলো ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। তখনকার চীনের ‘তাও’ ধর্মাবলম্বীরা মনে করতেন, যদি মানুষের হাত দিয়ে বৃহদাকার গাছের অতিক্ষুদ্র প্রতিরূপ তৈরি করা যায়, তাতে এর মধ্যে একধরনের অতিপ্রাকৃতিক শক্তি এসে জমা হবে। এভাবে ধীরে ধীরে প্রচলন হলো ‘পেনজাই’ বা ‘পোনজাই’ শিল্পের।

তাও ধর্মাবলম্বীদের চোখে গোটা জগৎ; Source: Uplift Connect

‘পেন’ বা ‘প্যান’ মানে হলো একধরনের বারকোশ, ইংরেজিতে যাকে আমরা ট্রে বলে জানি। তবে এই বিশেষ ট্রে তৈরি হত সাধারণ মাটি বা পোড়ামাটি দিয়ে। প্রায় ৫০০০ বছরেরও বেশি আগে চীনারা মৃৎশিল্পে অনেক এগিয়ে যায় অন্যদের তুলনায়। চৈনিক ‘পেনজাই’ শব্দের মানে দাঁড়ায় ট্রে-তে চাষ করা বৃক্ষ। ছোট ছোট ট্রে-তে বামনাকৃতির গাছ বৃদ্ধির সাথে সেখানে পাথর, মাটি আর ঘাস দিয়ে ছোটখাট একটি ভূদৃশ্যের অবতারণা করা হতো।

চীনারা ইচ্ছে করেই বনসাই গাছগুলোকে এমনভাবে বাঁধতেন আর ছাঁটাই করতেন যেন এগুলো দেখে বয়স্ক মনে হয়। সত্যিই, মোচড়ানো চামড়া আর সর্পিল শেকড়-বাকড় দেখে বনসাইকে মনে হয় অশীতিপর বৃদ্ধের তোবড়ানো গাল। অনেকে আবার মনে করেন, তাও ধর্মের লোকেরা ইচ্ছাকৃতভাবে গাছের ডালপালা, কান্ড আর শেকড়ের গঠন এভাবে তৈরি করেন, যেন তা চীনদেশের পৌরাণিক ড্রাগন, সাপ ও অন্যান্য জীবের সাথে মিলে যায়। অবশ্য অনেকের ধারণা, বনসাইয়ের এমন মোচড়ানো আকৃতি নাকি আসলে ইয়োগা বা যোগব্যায়ামের বিভিন্ন কসরতের সঙ্গে মিলিয়ে বানানো হয়েছে।

রাজপুত্রের সমাধির অলঙ্করণ

চীনদেশে বনসাইয়ের উদ্ভাবনের প্রথম চিত্রিত প্রমাণ হিসেবে একটি চমকপ্রদ জিনিস আবিষ্কৃত হয়। আর সেটি হলো ক্রাউন প্রিন্স ঝাং হুই এর সমাধিতে অলঙ্করণ হিসেবে আঁকা একটি ছবি, যেখানে দেখা যায় সমাধির প্রাচীরচিত্রে সুন্দর ছবির মাধ্যমে বর্ণিত আছে- মন্দিরের নারীসেবিকারা ছোট ছোট ট্রেতে করে গাছ, পাথর আর মাটি সম্বলিত পেনজাই হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

চীনা রমণীদের হাতে বনসাই বা পেনজাই; Source: Bonsai Empire

চীনাদের সেই প্রাচীনকাল থেকে ‘মিনিয়েচার’ বা কোনো বৃহদাকার জিনিসকে ছোট আকার দেওয়ার প্রতি একধরনের মুগ্ধতা ছিল। কাজেই তারা যে বনসাইয়ের প্রতি সবার আগে আকৃষ্ট হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এছাড়া প্রায় ২৩০০ বছরেরও বেশি আগে চীনাদের ‘ফাইভ এজেন্ট থিওরি’ (পানি, আগুন, কাঠ, ধাতু ও মাটি) থেকে উৎসাহিত হয়ে প্রকৃতির এমন বামন রূপ তৈরির এই বুদ্ধি তাদের মাথায় আসে বলেও অনেকের ধারণা। এছাড়া সেই দেশের পুরোহিতরা নাকি প্রকৃতিকে মন্দিরের ভেতরে নিয়ে আসতে চাইতেন, তাই বড় বড় গাছের বনসাই তৈরি করে তা মন্দিরের প্রাঙ্গণে সাজিয়ে রাখা হত।

কিন্তু একটি ব্যাপার নিশ্চিত যে, চীনেই সর্বপ্রথম বনসাই তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার হয়। পরবর্তীতে এই শিল্পটি ছড়িয়ে যায় জাপান, ভিয়েতনাম, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। তারা পরবর্তীতে বনসাই শিল্পকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যায়।

অনিন্দ্যসুন্দর একটি বনসাই; Source: Homesthetics

জাপানে বনসাইয়ের ইতিহাস

ধারণা করা হয়, বনসাই গাছের চীন থেকে জাপান যাত্রাটি পুরোপুরিই ধর্মীয় কারণে। মতান্তরে, আজ থেকে প্রায় ১২০০ বছর আগে হান রাজবংশের শাসনামলে চীনা সন্ন্যাসী বা ভিক্ষুরা জাপানে দেশান্তরী হন। সেসময়ে তারা নিজেদের সাথে পবিত্র উপহার হিসেবে ছোট ছোট বনসাই গাছ নিয়ে যান এবং উপহার হিসেবে সেগুলো জাপানের সন্ন্যাসীদের দেন। জাপানিরা বরাবরই চীনাদের গুণমুগ্ধ ছিল, এবারেও তার ব্যতিক্রম হলো না। তারা দ্রুত বনসাই বানানোর কায়দা-কানুন শিখে ফেললো।

‘কামাকুরা’ যুগে জাপানিদের বনসাই পদ্ধতির প্রচলন; Source: Japan Experience

সময়ের সাথে ধীরে ধীরে বনসাইকে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে ভাবা হতে লাগলো। বনসাই নিয়ে বিভিন্ন জাপানি লোকগাথাও রয়েছে। এর মাঝে অতি বিখ্যাত একটি গল্প এক দিগ্বিজয়ী সামুরাই যোদ্ধাকে নিয়ে, যে তার সংগ্রহের সর্বশেষ তিনটি বনসাই গাছকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে একজন শীতার্ত ভিক্ষুকে একটু উষ্ণতা দেবার জন্যে। এই লোকগাথাটি নিয়ে পরবর্তীতে থিয়েটারে নাটক হয়, এছাড়া গল্পটি ছবির মধ্য দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অঙ্কিত হয়।

মধ্যযুগের দিকে জাপানের সব ধরনের মানুষের মাঝে বনসাই বেশ জনপ্রিয় হয়ে গেল। ফলে বনসাই শিল্পীদের কদর রাতারাতি বেড়ে গেল সেখানে। এদিকে তখন অনেকে নিজেরাই বনসাই তৈরি করতে লাগলো ঘরে বসেই, আবার নিজেদের সংগ্রহের বনসাই দিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজনও করলো অনেকে।

জাপানের বিখ্যাত সাকুরা গাছের একটি বনসাই; Source: Bonsai Tree Gardener

১৬০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ধীরে ধীরে এই খর্বাকৃতি গাছের খবর বাকি পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। বিভিন্ন দেশের বণিকরা জাপানে ব্যাবসা করতে এসে বনসাই গাছ দেখে অভিভূত হয়ে পড়ল। ১৭০০ সালের শেষের দিকে জাপানিরা বনসাই গাছ নিয়ে দেশব্যাপী বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করতে লাগলো, লন্ডন আর ভিয়েনার মত বড় বড় শহরগুলোতে এটি নিয়ে হৈ চৈ পড়ে গেল। ১৮০৬ সালের দিকে ইংল্যান্ডের রানী শার্লটে উপহার হিসেবে জাপানের তরফ থেকে সুন্দর একটি বনসাই গাছ পেলেন। এভাবেই জাপানিদের বনসাই ধীরে ধীরে বাকি দুনিয়াতে ছড়িয়ে গেল।

বনসাই তৈরির প্রাচীন পদ্ধতি

জাপানিরা বনসাই তৈরির জন্য প্রথমদিকে কেবল কিছু নির্দিষ্ট ফুল ও ফলের গাছ বেছে নিত, আর কয়েক প্রজাতির পাইন। খর্বাকৃতির গাছ তৈরির অনেক গোপন ও অদ্ভুত অনেক কৌশলই ছিল তাদের, যা ধীরে ধীরে তারা প্রকাশ করে। ছোট একটি চারাগাছকে একদম শুরু থেকেই নির্দিষ্ট পাত্র বা ট্রে তে নিয়ে তার পরিচর্যা শুরু হয়। বনসাই গাছের সর্পিল আকৃতি ধারণ করানোর জন্য এর শেকড়, কান্ড আর ডালপালাকে মুচড়ে দেওয়া হয়, ফলে আস্তে আস্তে সেটি বাঁকানো আকৃতিতে চলে আসে। আবার মাঝে মাঝে ডালপালা আর শেকড়কে দড়ি ও বাঁশের সাহায্যে মাটির সাথে বেঁধে দেওয়া হয়, ফলে গাছটি ওভাবেই বেড়ে ওঠে। মাঝে মাঝে ইচ্ছেমত শাখা-প্রশাখা তৈরি করতে গাছের এখানে সেখানে কলম করা হয়।

বনসাইয়ের পরিচর্যা করছেন একজন শিল্পী; Source: Getty Image

আরেকটি খুব অদ্ভুত পদ্ধতি জাপানি বনসাই শিল্পীরা ব্যবহার করতো, আর তা হলো উইপোকা। গাছ নরম থাকতে তারা সেখানে উইপোকা ছেড়ে দিত। পোকার সংখ্যা কয়েকদিনেই বেড়ে গেলে তারা গাছের উপরে বিভিন্ন জায়গায় সুবিধামত মিষ্টি জাতীয় তরলের আস্তর লাগিয়ে দিত। মিষ্টির লোভে পোকারা তখন গাছের অংশটুকুও খেয়ে ফেলত, ফলে গাছের বিভিন্ন জায়গায় গর্ত তৈরি হত। নিজেদের পছন্দমতো গর্ত ও ফাঁপা স্থান তৈরি হয়ে গেলে শিল্পীরা পোকাগুলোকে গাছ থেকে বের করে ফেলতেন। এরপর আস্তে আস্তে নিজে থেকেই গাছটির ক্ষত সেরে যেত। গাছটির নতুন চেহারা আর ছালবাকলগুলো সহ দেখতে তখন একে একদম বয়স্ক একটি গাছের মতোই লাগতো। 

পৃথিবীর সবচেয়ে পুরানো বনসাইগুলোর একটি; Source: Youtube

 বনসাই গাছের উৎপত্তি চীনে হলেও জাপানিরা এই শিল্পকে অনেকখানি আপন করে নিয়েছে। ছোট আকৃতির এই গাছগুলো তাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্ববাহী। নতুন বছরের শুরুতে একে অপরকে এটি দিয়ে তারা স্বাগত জানায়, এই গাছ তাদের পবিত্রতার প্রতীক। বর্তমানে বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশেই বনসাইকে শোভাবর্ধনকারী হিসেবে ঘরে রাখা হয়। এমনকি আমাদের দেশেও বর্তমানে বনসাই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। 

ফিচার ইমেজ: Getty Image

Related Articles