পরনে লম্বা ড্রেপ জ্যাকেটের সাথে ড্রেইনপাইপ ট্রাউজার, গলায় ঝোলানো বোলো টাই, পায়ে গলানো ব্রোথেল-ক্রিপার্সের জুতো আর চুলে কুইফ-কাটিং। ওদিকে মস্তিষ্কে, হৃদপিণ্ডে আর ধমনীতে কেবলই রক এন্ড রোল। বলছি লন্ডনের টেডি বয়দের কথা। ফ্যাশন, অ্যাটিচিউড আর সঙ্গীতকে যারা উপজীব্য করেছিলো ব্রিটেনের প্রথম সাংস্কৃতিক বিদ্রোহের।
টিন এজার হিসেবে আলাদাভাবে সমাজের কাছে নিজেদের তুলে ধরতে চেয়েছিলো তারা। সাংস্কৃতিকভাবে এগিয়ে সমাজের প্রচলিত স্তরবিন্যাসের মূলে প্রচণ্ড আঘাত করতে চেয়েছিলো এই শহুরে গরিব-ফুলবাবুরা। মড, রকার, পাঙ্ক ইত্যাদি সাংস্কৃতিক-বিদ্রোহীদের সাথে টেডদের অহম-সংঘাত থাকলেও এদের সকলকে কিন্তু অগ্রজ হিসেবে পথ দেখিয়েছে টেডরাই। তাই ব্রিটেনের সাংস্কৃতিক গৃহযুদ্ধ নিয়ে সিরিজের প্রথম পর্বেই থাকছে এই টেডদের কথাই।
দর্জির হাতে ফিউশন: অভিজাত মধ্যবিত্তের নয়া ফ্যাশন
ব্রিটেনের রাজা দ্বিতীয় এডওয়ার্ডের আমলে পোশাকের একটা নতুন ধারা জন্ম নিয়েছিলো। শহুরে অভিজাতেরা এ ধারার অনুসরণপূর্বক নিজেদের ভেতর ‘এডওয়ার্ডিয়ান সোসাইটি‘ নামে একটা গোষ্ঠীই বানিয়ে ফেলেছিলো। এ চওড়া বক্ষ-পশ্চাতের সাথে সরু কোমরের অবয়ব ফোটানো হতো, ছেলেরা চাপা ট্রাউজার আর শার্টের ওপর চাপাতো ঢিলে-লম্বা জ্যাকেট। ১৯০১ থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগপর্যন্ত ছিলো এ ঘরানার জোয়ার।
এ ঘরানার পুনর্জন্ম হয় ‘৪০ এর শেষ দিকে লন্ডনের স্যাভাইল রো’র হার্ডি অ্যামিসের মতো অভিজাত দর্জিদের হাতে। নতুন-পুরনোর মিশেলে এডওয়ার্ডিয়ান ঘরানায় তৈরি হয় নতুন পোশাকি ধারা। মূলত লন্ডনের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মাঝেই ছিলো নয়া এডওয়ার্ডিয়ান ধারার ব্যপ্তি। তখন অবধি এটি ছিলো খাঁটি ব্রিটিশ নিজস্বতায় পূর্ণ- বুটলেস টাই (চিকন ফিতে আর ক্লিপওয়ালা), ব্যাকব্রাশ করা চুল, চাপানো ‘ড্রেইনপাইপ’ ট্রাউজার আর সাথে লম্বা জ্যাকেট।
নিম্নবিত্তের হাতে ‘শুচিতা’ নষ্ট: নিজেদের পোশাক ত্যাগ করলো অভিজাতেরা
এরপর হুট করেই দক্ষিণ ও পূর্ব লন্ডনের শ্রমিক এলাকার তরুণরা এ ধারার অনুসরণ শুরু করে। স্বাভাবিকভাবেই ধারাটিকে তারা গ্রহণ করেছিলো তাদের নিজের মতো করে, এনেছিলো সুবিধেমতো সংস্কার। ওয়েস্টকোটের জায়গায় পরতো গাঢ় রঙের লম্বা ড্রেপ জ্যাকেট। পাজামা একটু ছোট করে বানাতো তারা, যাতে উজ্জ্বল রঙের মোজা দেখা যায়। এরপর আবার ব্রিটিশ বিশুদ্ধতার মধ্যে তারা পুরে দিলো মাভেরিক, বোলো টাইয়ের মতো আদি-আমেরিকান সংস্কৃতি। মধ্যবিত্তের তাতে আঁতে ঘা লেগে গেলো। শুদ্র পৈতা পরলে বামুনের সহ্য হবে কেন? ‘কৌলিন্য’ যখন নষ্টই হলো নয়া এডওয়ার্ডিয়ান ধারার, তখন মধ্যবিত্তরা সিদ্ধান্ত নিলো এ ধারা পরিত্যাগ করার। সেই থেকে নয়া এডওয়ার্ডিয়ান পোশাকধারী নিম্নবিত্ত তরুণদের কড়া বিদ্রুপকারীতে পরিণত হয় সাবেক-এডওয়ার্ডিয়ান মধ্যবিত্তরাই।
কীভাবে এলো টেডি বয়?
ওপরের অনুচ্ছেদটি পড়ে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, নয়া-এডওয়ার্ডিয়ান ধারার এই নতুন শ্রমজীবী অনুসারীরাই হলো টেডি বয়। কিন্তু টেডি বয়/বয়েজ পরিভাষাটির জন্ম আসলে আরো পরে। ১৯৫৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ডেইলি এক্সপ্রেসের এক শিরোনামে ‘এডওয়ার্ডিয়ান’ শব্দটির বদলে প্রথমবারের মতো ‘টেডি বয়’ ব্যবহৃত হয়। নতুন পরিভাষা হিসেবে তা ছিলো ছোট, সহজ ও চিত্তাকর্ষক। অনেকে আবার বলেন, শব্দটি আসলে ডেইলি এক্সপ্রেসের আমদানি না। বরং আগে থেকেই নাকি ‘গরিব এডওয়ার্ডিয়ান’দের গার্লফ্রেন্ডরা বয়ফ্রেন্ডদের ‘টেডি বয়’ ডাকতো। তার আগে ‘কোশ বয়েজ’ নামেও পরিচিত ছিলেন টেডি বয়রা।
টেডি বয়দের আদলে জন্ম নেয় টেডি গার্লও। পেন্সিল স্কার্ট, হোবল স্কার্ট, মোড়ানো জিন্সের প্যান্ট, পাতলা চপ্পল, আমেরিকান টরেডর প্যান্ট, মখমলের কলারওয়ালা সুতি জ্যাকেট, কুলি হ্যাটস ইত্যাদি পরতো। সাথে চুলে দিত ‘পনিটেইল’ সাজ। টেডি বয়, গার্ল উভয়েরই পছন্দ চকচকে পরিপাটি অক্সফোর্ডস, সুয়েড/ব্রোথেল-ক্রিপার্স জুতো। এসবের দাম কম ছিলো না। পোশাকের ‘স্ট্যান্ডার্ড’ মেনে চলতে কয়েক সপ্তাহের বেতন খরচ হয়ে যেত তাদের। অনেক সময় মাসিক কিস্তিতেও কাপড়চোপড় কিনত তারা।
আলোচনায় টেডরা
১৯৫৩ সালের জুলাইতে দুই কিশোর গ্যাংয়ের বচসায় ছুরিকাঘাতে প্রাণ যায় জন বেকলি নামের কিশোরের। ঘটনাক্রমে হত্যাকারীরা ছিলো ‘টেডি বয়’। পরদিন মিররে শিরোনাম হলো, “Flick Knives, Dance Music, Edwardian Suits”।
গণমাধ্যমে প্রথমবারের মতো দুর্বৃত্তপনার সাথে পোশাককে মেলানো হলো। এমনকি লন্ডনের ম্যাজিস্ট্রেট নাম ধরেই বললেন,
“এই টেডি বয় গ্যাংগুলোকে ধ্বংস করতে হবে।”
এমনিতেই টেডি বয় সংস্কৃতির ব্যাপ্তি যেহেতু শ্রমজীবী এলাকার তরুণদের হাত ধরে, তাই ঢালাওভাবে বাঁকাচোখে দেখা হত টেডি বয়দের। সেখানে এমন ঘটনার পর বাবা-মার কাছে সন্তানের ‘টেডি বয়’ হওয়াটাই হয়ে গেলো ট্যাবু! এসব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়েই নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখেছিলেন টেডি বয়রা। ১৯৫৪ সালে টটেনহ্যামের ‘মেক্কা রয়্যাল ড্যান্স হল’-এ টেডি বয়রা ঘোষণা দেন-
“এই নির্বোধ দুনিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের পোশাকই হলো আমাদের জবাব।”
উল্লেখ্য, টেডসহ ব্রিটেনের সকল সাংস্কৃতিক বিদ্রোহীগোষ্ঠীই মূলধারার পৃথিবীকে ‘Dull’-ই মনে করত। যা-ই হোক, জবাব আরো সুদৃঢ় করতেই কি না, টেডিরা ১৯৫৬ সালের আগস্টে এসেক্সে চালু করলেন ‘বেস্ট ড্রেসড টেড কনটেস্ট’। সেই প্রতিযোগিতায় জিতলেন বিশ বছর বয়সী জনৈক সবজিবিক্রেতা তরুণ।
মধ্যবিত্তদের আচরণ ও শ্রেণীবৈষম্যের পথ ধরে যে টেডি বয়েজের উদ্ভব, তা আগেই জেনেছেন। এসব কারণেই একটা ফ্যাশন প্রথমে রূপ নিলো তরুণ বিদ্রোহের, যে বিদ্রোহ বহুকাল ধরে টিকে থাকা সামাজিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে। ফ্যাশনেরও গভীর রাজনীতি আছে, তা প্রমাণ হলো টেডি বয়েজ আন্দোলনে। প্রলেতারিয়েত তরুণ-যুবাদের নিরেট একটি আত্মপরিচয় পাইয়ে দিলো টেডি বয়েজ। হীনম্মন্যতা আর জীবনের গ্লানি হারিয়ে গেলো এক নিমিষে। পরবর্তীতে অবশ্য এ ফ্যাশন হয়েছিলো অনেকটাই সার্বজনীন।
রক এন্ড রোল যখন উন্মাদনার একটি নাম
১৯৫৫ বিল হ্যালি ও তার কমেটসের হাত ধরে আমেরিকান ঘরানার রক এন্ড রোল সঙ্গীতের রাজত্ব শুরু হয় ব্রিটেনে। একে প্রথমেই লুফে নিয়েছিলো টেডি বয়রা। পোশাকের সঙ্গে ‘টেডি বয় ধর্ম’ এর প্রধান স্তম্ভই হয়ে গেলো রক-ভক্তি। যদিও তাদের পোশাকের বেশ কিছু দিক জ্যাজ তারকাদের ফ্যাশন থেকেই অনুপ্রাণিত ছিলো। চুলের সাজ, গায়ের পোশাকের সাথে বুঁদ হয়ে থাকবার নতুন শূরা হিসেবে তারা পেলো রক এন্ড রোল। এরপর তো টেডদের আত্মপরিচয়ের সাথে রককে আলাদা করা সম্ভবই ছিলো না। লন্ডনে তখন রক মানে টেড, টেড মানেই রক।
রক আর ফ্যাশন যখন দুর্বৃত্তপনার হাতিয়ার
টেডি বয়রা বেশ বেয়াড়াও ছিলো বটে তারা। এমনিও গ্যাং বানিয়ে চলতেন। প্রত্যেক গ্যাংয়ের ইউনিফর্ম হিসেবে ছিলো বিশেষ রঙের মোজা বা জ্যাকেট। পকেটে রাখতেন ছুরি কিংবা ক্ষুর। ১৯৫৬ সালে দক্ষিণ লন্ডনের ট্রোক্যাডেরো সিনেমা হলে ‘ব্ল্যাকবোর্ড জাঙ্গল’ ছবির প্রিমিয়ার চলছিলো। ক্লাইম্যাক্সে ছিলো ‘রক এরাউন্ড দ্য ক্লক’ শিরোনামে একটা রক গান। টেডি বয়রা কি আর স্থির থাকে! প্রেমিকা সমেত সিটে, মঞ্চে, গ্যালারিতে উদ্দাম নৃত্য শুরু করলো তারা। তাদের নিবৃত্ত করতে এলেন হল কর্মীরা। আরো তেতে গেলেন টেডি বয়রা। ব্যস, ছুরি দিয়ে কেটেকুটে শেষ করলেন হলের সব সিট। এরপর তো হল মালিকেরা এদের বর্জন শুরু করলেন। আরো বেড়ে গেলো টেডি বয়দের দুর্বৃত্তপনা। মন্ত্রী, এমপি, পুলিশসহ শহর-কর্তৃপক্ষ একরকম যুদ্ধই ঘোষণা করলেন এদের বিরুদ্ধে। ইভটিজিং, ছুরি নিয়ে ভীতি প্রদর্শন থেকে শুরু করে অস্ত্র মহড়ার অভিযোগ অবধি এলো। যদিও টেডদের অভিযোগ ছিলো, গণমাধ্যম অতিরঞ্জিতভাবেই বিমাতাসুলভ আচরণ করছে।
নেতিবাচক কাজ যে টেডি বয়রা করেনি, মোটেই না। তবে ঢালাওভাবে তাদের দোষারোপ করা হচ্ছিলো এটাও সত্যি। টেডি বয়দের দাবিমতে, বাহারি কাটিংওয়ালা চুলের কেউ অপরাধ করলেই নাকি তাকে লোকে ‘টেড’ বানিয়ে দিত! এই ‘স্টেরিওটাইপ’ এর বিরুদ্ধে দাঁড়ায় লন্ডনের আইনজীবী সমাজ। ১৯৫৮ সালের ৩১ অক্টোবর ন্যাশনাল এডভোকেট অ্যাসোসিয়েশন সিদ্ধান্ত নেন, সহিংসতার জন্য ঢালাওভাবে টেডিদের দায়ী না করে যাতে প্রকৃত অপরাধীদের দিকেই আঙুল তোলা হয়, এ ব্যাপারটি তারা দেখবেন।
এসেছে নতুন শিশু…
মাত্র কয়েকটি বছর একচ্ছত্র রাজত্ব করলো টেডি বয়রা। ১৯৫৮ এর দিকে তরুণদের মধ্যে ইতালিয়ান পোশাকধারার চল তৈরি হয়। ঢোলা ওয়েস্টকোট, জ্যাকেটের বদলে নচড ল্যাপেলযুক্ত স্লিম-ফিট স্যুট অথবা ছোট বাম-ফ্রিজার জ্যাকেট আর চাপানো প্যান্ট। পোশাকের মডার্নিস্ট ধারা বলা হয় যাকে। ওদিকে রকের বদলে বাজার দখল করতে থাকে জ্যাজ আর পপ সঙ্গীত। এসবের পেছনে তৎকালীন ব্রিটেনের নয়া ক্যারিবীয় অভিবাসীদের প্রভাব ছিলো। একটু গোঁড়া টেডি বয়রা এদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করতেন। দু’পক্ষই ছিলেন শ্রমজীবী শ্রেণীভুক্ত। কিন্তু আফ্রো-ক্যারিবীয় সম্প্রদায় যেহেতু কালো, তাই গায়ের রঙের ‘শ্রেয়তা’র গুণে তাদের পেটানোকে হালাল বানালো টেডরা। নটিং হিলে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন হয়েছিলো। শ্রেণীভেদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে যদি বর্ণভেদকেই উসকে দেয়া হয়, তবে লাভ হলো কী?
যা-ই হোক, ষাটের শুরুতেই প্রায় ঝিমিয়েই পড়ে টেডি বয়রা। অনেকেই বিয়েথা করে বনে যান আদর্শ সংসারী। এরপরই মূলত শুরু হয় নাটকীয় মেরুকরণ। রকপাগল টেডি বয়দের অনেকেই যোগ দেন লেদার জ্যাকেট পরিহিত ‘রকার’দের দলে। রকের প্রতি ভালোবাসায় তারা উভয়ে ছিলো অভিন্ন। এই রকাররা ছিলেন চরম বেপরোয়া, চলতেন একগাদা মোটরবাইক নিয়ে। ওদিকে কেতাদুরস্ত মডার্নিস্টরা পোশাকের সাথে জ্যাজপ্রীতিকে মিশিয়ে গঠন করে নতুন আরেকটি সাবকালচার- ‘মড’। পোশাকে ফুলবাবু হলেও স্বভাবে তারাও ছিলেন বেপরোয়া, ঝাঁকবেধে স্কুটার নিয়ে মহড়া দিতেন এলাকায়। অল্প সময়ের ব্যবধানে এই দুই সাবকালচার তথা কাল্ট পরিণত হয় একে অপরের চোখের বিষে। ১৯৬৪ সালে তো দাঙ্গাই বেঁধে যায়। শুরু হয় এক ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক দ্বৈরথ: রকার বনাম মড, রক কালচার বনাম মডার্নিস্ট কালচার।
টেডি বয়দের একসময় পুনর্জাগরণ ঘটে। তখন তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো পাঙ্করা। অথচ এরা অভিন্ন ‘রক’ পরিবারের সদস্য ছিলো। এমনকি রক্যাবিলি নামক রক জনরার ভক্তদের সাথেও তৈরি হয় টেডদের দ্বন্দ্ব। রকদের পুনর্জন্ম, পাঙ্কদের পরিচয় ও নতুন দ্বৈরথ এবং রক্যাবিলির সাথে দ্বন্দ্ব নিয়েই থাকবে পরের কিস্তির লেখাটি। ধারাবাহিকভাবে পরবর্তীতে আসবে মড বনাম রকার।
ফিচার ইমেজ: bensherman.com.au