প্রশান্ত বিকেলের উজ্জ্বল সূর্যরশ্মি মেঘমুক্ত আকাশ থেকে ছুটে এসে আটলান্টিকের জলে আছড়ে পড়ছে। সাগরের অশান্ত ঢেউ সেই সূর্যের আকর্ষণে উত্তাল হয়ে উঠে ফের শান্ত হয়ে যায়। উজ্জ্বল দিনে সাগর জলে ভেসে বেড়ানো জলযান থেকে কয়েক মাইল দূরে তাকালেও সবকিছু কেমন পরিষ্কার হয়ে ধরা দিচ্ছে। অস্পষ্ট হলেও উপলদ্ধি করার মতো পরিষ্কার সব।
তীর থেকে সবচেয়ে দূরের নৌকা থেকে একজন ডুবুরি চোখে গগলস লাগিয়ে ঝুপ করে সাগর জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। জলপৃষ্ঠ ভেদ করে গভীরে যাওয়া মাত্রই দিনের সেই উজ্জ্বল আলো কোথায় যেন নেই হয়ে গেলো। উজ্জ্বল সোনালী রঙের বদলে আসন গ্রহণ করলো নীলচে অন্ধকার। এর মাঝে ডুবুরি সাঁতরে এগিয়ে যাচ্ছেন আরো গভীরে। সেখানে আলোর উপস্থিতি একদমই কম।
খালি চোখে সাঁতার কাটা দুরূহ। ডুবুরি এবার গগলসের সাথে যুক্ত থাকা আলো বৈদ্যুতিক আলো জ্বালিয়ে নিলেন। আলোর সাহায্যে খুব সাবধানে ধীরে ধীরে সাঁতার কাটছেন তিনি। ঠিক তখন ডুবুরির ১০০ মিটার সামনে একটি বেলুগা তিমির দেখা মিললো। শান্ত স্বভাবের বেলুগা তিমি এই অন্ধকারেও বেশ সাবলীলভাবে সাঁতার কেটে এগিয়ে চলেছে। বেশ দক্ষতার সাথে এটি সামনে প্রতিবন্ধক হিসেবে থাকা পাথরকে এড়িয়ে চললো। ডুবুরি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো সেই তিমির দিকে। ততক্ষণে সেটি তর তর করে সাঁতার কেটে এগিয়ে যাচ্ছে তার শিকারের দিকে। খুব দ্রুত আঁধারে মিলিয়ে গেলো সব।
সাগর জলের অন্ধকার দুনিয়ায় তিমি, ডলফিনসহ সকল শিকারী প্রাণীরা যে পরিষ্কার দেখতে পায়, তা কিন্তু নয়। এদের চোখের আকার খুব উন্নত নয়। বরং কিছু কিছু প্রাণীর চোখের আকার দেহের তুলনায় বেশ ছোট, যা দিয়ে পরিষ্কার আলোতে দেখাও কষ্টকর হয়ে থাকে। যেমন- নীল তিমির কথাই ধরা যাক। দেহের আকারে প্রাণীজগতের সবচেয়ে প্রথমে যাদের নাম আসবে, তাদের চোখও কিন্তু অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র। তবে এর মানে এই নয় যে, সাগরজলে সকল প্রাণীর চোখ অনুন্নত ধরনের হবে। অনেক প্রাণীর চোখ আকারে এবং ক্ষমতায় বেশ উন্নত ধরনের। এবার প্রশ্ন হচ্ছে, যাদের চোখের ক্ষমতা ভালো নয়, তারা কীভাবে জলের নিচে পরিষ্কার দেখতে পায়? কীভাবে আঁধার জলেও নিজের শিকারের পিছে ছুটে চলে অদম্য গতিতে? এর উত্তর হচ্ছে, শব্দ। এরা শব্দের সাহায্যে সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পায় বলে এদের কোনো অসুবিধা হয় না। আর শব্দ ব্যবহার করে প্রাণীর পথচলার বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে ইকোলোকেশন (Echolocation)।
ইকোলোকেশন শব্দটিকে ভাঙলে আমরা দুটি ইংরেজি শব্দ পাই- Echo (প্রতিধ্বনি) এবং Location (অবস্থান)। প্রতিধ্বনির সাহায্যে কোনো বস্তুর অবস্থান নির্ণয় করার নামই ইকোলোকেশন। এর সাহায্যে একটি প্রাণী অন্ধকারে চলাচল করতে পারে, পথে প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে চলতে পারে ও শিকার ধরতে পারে। এমনকি কিছু প্রাণী নিজেদের দলের সদস্যদের চিনতেও প্রতিধ্বনি ব্যবহার করে থাকে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সাগর জলের প্রাণীরা ঘোলাটে পানিতে খুব সহজেই সাঁতার কাটতে পারে।
পুরো পদ্ধতিটি আমাদের ব্যবহৃত রাডার কিংবা সোনারের (Sonar) ন্যায়। এই পদ্ধতি ব্যবহারকারী প্রাণীরা উচ্চ তরঙ্গের শব্দ উৎপন্ন করে। এই শব্দ তরঙ্গ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং পথে কোনো প্রতিবন্ধকতা কিংবা বস্তুর সাথে সংঘর্ষ হলে সেটি প্রতিধ্বনি হিসেবে পুনরায় প্রাণীর নিকট ফিরে আসে। জেনে রাখা ভালো, শুধু জলচর প্রাণীরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করে না। ডাঙায় বাস করা বাদুরও একই পদ্ধতি ব্যবহার করে রাতে চলাফেরা করে থাকে। প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী ডোনাল্ড গ্রিফিন সর্বপ্রথম নিশাচর বাদুরের মাঝে এই বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করেন। তিনি সর্বপ্রথম ইকোলোকেশন শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।
এবার জানা যাক প্রাণীরা কীভাবে উচ্চ তরঙ্গের শব্দ উৎপন্ন করে থাকে। ডলফিন এবং দাঁতালো তিমিসহ সেটাশিয়ার বর্গের প্রাণীরা নিজেদের নাসারন্ধ্রের ভেতর সংরক্ষিত বাতাসকে পেশীর সাহায্যে বহুগুণে সংকুচিত করতে পারে। এর ফলে সংকুচিত বায়ু নাক থেকে কপালে অবস্থিত বিশেষ চর্বিস্তরে স্থানান্তারিত হয়। কপালে অবস্থিত সেই চর্বিস্তরের নাম মেলন। মেলন চর্বিস্তর চমৎকারভাবে সেই সংকুচিত বায়ুকে শব্দ তরঙ্গে রূপান্তরিত করতে পারে।
বিজ্ঞানীরা জানান, লেন্সের সাহায্যে যেমন আমরা আলোকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে কেন্দ্রীভূত করতে পারি, ঠিক তেমনই সেটাশিয়ানরা মেলন চর্বিস্তরের সাহায্যে শব্দকে কোনো নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত করতে পারে। অর্থাৎ, মেলন অনেকটা শব্দের ‘লেন্স’ হিসেবে কাজ করে। ডলফিন থেকে উৎপন্ন সেই শব্দ যাত্রাপতে কোনো বস্তুতে বাধাপ্রাপ্ত হলে তা প্রতিফলিত হয়ে পুনরায় প্রাণীর কাছে ফিরে আসে। এবার ডলফিনরা সেই প্রতিধ্বনিকে নিজের নিম্ন চোয়ালে অবস্থিত হাড় দিয়ে গ্রহণ করে। সেখান থেকে তা ডলফিনের অন্তঃকর্ণে গিয়ে পৌঁছায়। ইকোলোকেশনে উৎপন্ন শব্দ এবং এর প্রতিধ্বনি এতটাই জোরালো হয় যে স্বয়ং তিমি, ডলফিনদেরও অতিরিক্ত পর্দা দ্বারা সেই শব্দ থেকে নিজেদের কানকে সুরক্ষিত রাখতে হয়।
এবার ডলফিনরা ফিরে আসা প্রতিধ্বনি বিশ্লেষণের মাধ্যমে বাধাদানকারী বস্তুর আকার, দূরত্ব, গতিবিধি, ঘনত্ব ইত্যাদি বুঝতে পারে। ইকোলোকেশন পদ্ধতি ব্যবহার করে ডলফিনরা প্রায় ১০০ গজ দূরে অবস্থিত একটি টেনিস বলের মতো ছোট বস্তুর অবস্থান পর্যন্ত নির্ণয় করতে পারে। প্রতিটি ডলফিন এবং তিমি প্রজাতি ও দলভেদে ভিন্ন তরঙ্গের শব্দ উৎপন্ন করে থাকে। ফলে এরা অন্য প্রাণীর শব্দতরঙ্গ শ্রবণের মাধ্যমে নিজের দলের সদস্য থেকে অন্যদের আলাদা করতে পারে। আমাদের যেমন ফাহিম, জাকারিয়া ইত্যাদি নাম থাকে, তেমনি এদের থাকে বিভিন্ন তরঙ্গের শব্দ।
ওদিকে বাদুড়রাও ইকোলোকেশন ব্যবহার করে থাকে এবং এদের শব্দ উৎপাদন প্রক্রিয়া ডলফিন ও তিমিদের থেকে আলাদা। বাদুড়রা নিজেদের স্বরতন্ত্রীর সাহায্যে শব্দ উৎপন্ন করে থাকে। উৎপন্ন শব্দ তরঙ্গ বাদুরের মুখ দিয়ে নির্গত হয়ে বাদুরের চলার পথে ছড়িয়ে পড়ে। বাদুররা বেশ উচ্চ তরঙ্গের শব্দ উৎপন্ন করে থাকে। একে চিৎকার বললেও ভুল হবে না। সৌভাগ্যক্রমে, আমরা এদের চিৎকার শুনতে পাই না। কারণ, ইকোলোকেশনের জন্য উৎপন্ন ধ্বনির তরঙ্গ আমাদের শ্রবণসীমার বাইরে থাকায় তা আমরা শুনতে পাই না। বিজ্ঞানীদের হিসাবমতে, বাদুড় প্রায় ১৪০ ডেসিবেলের ঊর্ধ্বে শব্দ উৎপন্ন করতে পারে। কোনো স্থান থেকে ৩০ মিটার দূরে অবস্থিত একটি জেট ইঞ্জিন থেকেও অনুরূপ শব্দ উৎপন্ন হয়ে থাকে। ফিরে আসা প্রতিধ্বনির সাহায্যে বাদুড়রা প্রায় ৫ মিটার দূরে অবস্থিত যেকোনো পতঙ্গের অস্তিত্ব টের পায়। এরা ইকোলোকেশনের সাহায্যে প্রস্থে মানুষের চুলের সমান সূক্ষ্ম তার পর্যন্ত উপেক্ষা করতে পারে।
শিকারের নিকটে চলে আসলে বাদুর শব্দের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। এর মাধ্যমে এরা শিকারের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করতে পারে। এত উচ্চ তরঙ্গের প্রতিধ্বনি থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে বাদুর ইকোলোকেশনের সময় তার মধ্যকর্ণ বন্ধ করে রাখে। ডলফিনদের ন্যায় বাদুররাও প্রজাতিভেদে ভিন্ন তরঙ্গ ব্যবহার করে থাকে।
বাদুড়, তিমি, ডলফিন ছাড়াও হাতিরা ইকোলোকেশন ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু এদের ইকোলোকেশন ব্যবহারের উদ্দেশ্য কিছুটা ভিন্ন। এরা পূর্ণ বয়সে পদার্পণের পর নিজের পছন্দের সঙ্গীকে আহ্বান করার জন্য বেশ নিচু তরঙ্গের ধ্বনি উৎপন্ন করতে পারে। এই তরঙ্গ আমাদের শ্রবণসীমার চেয়ে নিচে থাকায় আমরা তা শুনতে পাই না।
আপনারা জেনে অবাক হবেন, স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মাঝে আরো একটি প্রাণী এই ইকোলোকেশন ব্যবহার করতে পারে। আর সেই প্রাণীর নাম মানুষ। বিশেষ করে অন্ধ ব্যক্তিরা কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে প্রাণীদের ন্যায় ইকোলোকেশন পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারে। বিজ্ঞানীরা গবেষণায় জানতে পেরেছেন, অন্ধ ব্যক্তিরা জিহ্বার সাহায্যে ‘ক্লিক’ শব্দ করে তার প্রতিধ্বনি শুনে পথের অবস্থা বুঝতে পারেন। এ সময় এদের মস্তিষ্কের দর্শনের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত স্নায়ুগুলো সক্রিয় থাকে এবং প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে, যা দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
ইকোলোকেশন ব্যবহার করা অন্ধ ব্যক্তির সংখ্যাও নগণ্য। ওল্ড ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা বেন আণ্ডারউড নামক এক বালক ইকোলোকেশন ব্যবহার করে পথ চলা মানুষদের মধ্যে একজন। বিস্ময় বালক বেন ইকোলোকেশন ব্যবহার করে সাইকেল পর্যন্ত চালাতে পারে। শহরের পথে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলা বেনের সাইকেল যেন এক নতুন বিপ্লবের ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে। যদিও মানুষের ক্ষেত্রে ইকোলোকেশন আয়ত্ত করা চাট্টিখানি কথা নয়, তবুও এর মাধ্যমে অন্ধ ব্যক্তিরা খুব সহজের পথ চলাচল করতে পারবেন বলে মনে করেন গবেষকগণ।
পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি প্রাণীর মাঝে লুকিয়ে আছে হাজারো অজানা বৈচিত্র। এদের মধ্যে ইকোলোকেশন এক বিস্ময়ের নাম। প্রথমদিকে তা শুধু বাদুড়ের মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল ভাবা হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে তা জলচর প্রাণীদের মাঝে আবিষ্কার হতে থাকে। জলের ডলফিন, ডাঙার হাতি এবং বাদুরের পর যখন বেন আণ্ডারউড ইকোলোকেশন ব্যবহার করে তাক লাগিয়ে দিলেন, তখন বিজ্ঞানীরা ইকোলোকেশন নিয়ে নতুন করে উঠে পড়ে লেগেছেন। হয়তো এর মাঝেই লুকিয়ে আছে অন্ধত্বের নিরাময়। সেটি সত্যি কি না, তা অদূর ভবিষ্যতেই জানা যাবে।
ফিচার ইমেজ: The Earth