পাঁচ মাস পরই শুরু হবে ওয়ানডে বিশ্বকাপের দ্বাদশ আসর। ইংল্যান্ডের মাটিতে দেড় মাসব্যাপী চলবে এই বিশ্বকাপ। ধীরে ধীরে এই মহাযজ্ঞের পরিকল্পনা, ভাবনার জগতে প্রবেশ করছে দলগুলো। ভারসাম্যপূর্ণ দল তৈরি, সেরা কম্বিনেশন খোঁজা, ইনফর্ম পারফরমারদের পরিচর্যা, দলের মাঝে আত্মবিশ্বাস সঞ্চার করা, সবাইকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার দিকে নজর দিচ্ছে টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণেচ্ছু ১০টি দল।
চলমান ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজই দেশের মাটিতে বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশের শেষ ওয়ানডে সিরিজ। তারপর ফেব্রুয়ারি-মার্চে নিউজিল্যান্ড সফরে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলবে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজে অংশ নিবে টাইগাররা।
বাংলাদেশের বিশ্বকাপ ভাবনা কিংবা কম্বিনেশন খোঁজার চেষ্টা নাকি এখন নিউজিল্যান্ড সফর থেকেই শুরু হবে, এমনকি প্রস্তুতিও শুরু হবে নিউজিল্যান্ড থেকে। কারণ ইংল্যান্ডের সঙ্গে কন্ডিশন, উইকেটে কিছুটা হলেও মিল পাওয়া যাবে। মাশরাফি বিন মুর্তজার বক্তব্য এমনই। দেশের উইকেটে বিশ্বকাপের আদর্শ প্রস্তুতি সম্ভব নয় বলেই মনে করেন ওয়ানডে অধিনায়ক।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সিরিজপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে গত ৮ ডিসেম্বর মাশরাফি বিশ্বকাপের প্রস্তুতির বিষয়ে বলেছেন,
‘আমার কাছে মনে হয়, আমরা যা চাই এখানকার উইকেট সেটা দিতে পারবে না। এটা আমার ব্যক্তিগত মত। এই মাটিতে এটা অসম্ভব। ইংল্যান্ড কিংবা নিউজিল্যান্ড উইকেটের সঙ্গে মেলানো সম্ভব নয়। হয়তো চট্টগ্রাম কিংবা সিলেটে সিমিলারিটি পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু মিরপুরে এটা সম্ভব নয়। আমার কাছে মনে হয়, বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নিউজিল্যান্ড থেকেই ভালো নেওয়া যাবে। উইকেট, কন্ডিশন, আউটফিল্ড সবকিছু মোটামুটি একই রকম থাকবে। এখান থেকে যেটা ইতিবাচক হতে পারে, জিতে গিয়ে নিউজিল্যান্ডে আত্মবিশ্বাস নিয়ে যাওয়া।’
প্রস্তুতির প্রশ্নে অধিনায়কের যুক্তির সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ কম। তবে উইন্ডিজদের বিরুদ্ধে সিরিজে বাংলাদেশ দলের পরিকল্পনা, একাদশ গঠনে এটা স্পষ্ট, বিশ্বকাপের জন্য একটা সঠিক কম্বিনেশন গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে।
সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে বাংলাদেশের একাদশে ছিলেন চার ওপেনার; যেখানে টপ অর্ডারে ব্যাটিং করেছেন তামিম ইকবাল, লিটন দাস এবং ইমরুল কায়েস, সৌম্য খেলেছেন ছয়ে। এই বাঁহাতিকে দিয়ে পেস বোলিং অলরাউন্ডারের অভাব পূরণের ভাবনা ছিল টিম ম্যানেজমেন্টের। যদিও ম্যাচে সেটির প্রয়োজন পড়েনি, কারণ স্বীকৃত পাঁচ বোলারই প্রতিপক্ষকে চাপে রাখতে সমর্থ হয়েছেন। পেস বিভাগে মাশরাফির পাশাপাশি মুস্তাফিজুর রহমান, রুবেল হোসেন ছিলেন। স্পিনে সাকিব আল হাসান ও মেহেদী হাসান মিরাজ। এই পাঁচজনের বাইরে কোনো বোলার কাজে লাগাননি মাশরাফি।
এটা অনস্বীকার্য যে, তারা পাঁচজনই ওয়ানডেতে এখন বাংলাদেশের মূল বোলার। ছন্দে থাকলে প্রতিপক্ষের জন্য সবসময় ভীতির কারণ তারা। এর বাইরে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও দলের প্রয়োজনে হাত ঘুরাতে সক্ষম। সাকিব পাঁচে, সৌম্য ছয়-সাতে খেললে দলের ব্যাটিংটাও পোক্ত থাকে। আবার বোলিংয়ে পাঁচ বোলারের বাইরেও দুজন থাকেন যাদেরকে ব্যবহার করা সম্ভব।
প্রথম ওয়ানডের এই কম্বিনেশন দেশের মাটিতে সফল হয়েছে। কিন্তু দেশের বাইরে তা কতটা কার্যকর হবে? মাশরাফির কথায় স্পষ্ট, এই কম্বিনেশন নিয়ে বিশ্বকাপ পরিকল্পনার ছায়া রয়েছে। কারণ ইংল্যান্ডে বেশিরভাগ সময় পেস বোলিং খেলতে হবে। ছয়-সাতে ব্যাট করা সৌম্য পেস বোলিংটা ভালো খেলেন। তার হাতে শটসও রয়েছে অনেক। তাই ওপেনিং বা নিচে তাকে কাজে লাগানো যাবে। একইভাবে লিটনকেও উপরে-নিচে খেলানোর চেষ্টা করা যাবে। মাশরাফির চোখে চারজন ওপেনার থাকলেও এই কম্বিনেশনে দলের সামর্থ্য সমানভাবে অটুট থাকবে দেশে ও দেশের বাইরে।
প্রথম ওয়ানডের পর মিরপুরে সংবাদ সম্মেলনে এই কম্বিনেশন নিয়ে বাংলাদেশের অধিনায়ক বলেছেন,
‘সৌম্য তো আসলে স্পিন থেকে পেস বেশি খেলতে পছন্দ করে। সাধারণত যেটা হয় ওপেনাররা স্পিনের চেয়ে পেস বলে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সৌম্য যে জায়গায় খেলছে, বিশ্বকাপে এই পজিশনে কিন্তু পেস বোলাররাই বোলিং করবে। কোনোভাবেই মিঠুনকে ছোট করার কোনো সুযোগ নেই। ও এশিয়া কাপে যে ইনিংসগুলো খেলেছে, এমনকি জিম্বাবুয়ের সাথেও ও ভালো খেলেছে। আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, এখানে একটা কম্বিনেশন দাঁড় করানো আছে। আমরা চারজন ওপেনার খেলানো হলেও ওদের দু’একজনের এই সামর্থ্য আছে যে অন্য জায়গায় ব্যাটিং করতে পারবে। লিটনও ছয় নম্বরে বেশ কিছু ম্যাচ খেলেছে টেস্টে। এই সামর্থ্য থাকাটা দলের ফ্লেক্সিবিলিটি বাড়ায়। একই সময়ে খেলোয়াড়দের জন্যও ভালো।’
আবার এটা ঠিক নয় যে, চলমান হোম সিরিজের দলটাই বিশ্বকাপে যাচ্ছে। নিশ্চিতভাবেই দুই-একটি পরিবর্তন হবে চূড়ান্ত স্কোয়াডে। বিশ্বকাপে দলটাও হবে ১৫ সদস্যের। ক্যারিবিয়ানদের বিরুদ্ধে এই সিরিজে বাংলাদেশ দলটা হলো ১৬ সদস্যের। দলে আছেন; মাশরাফি বিন মুর্তজা (অধিনায়ক), সাকিব আল হাসান (সহ-অধিনায়ক), তামিম ইকবাল, সৌম্য সরকার, লিটন কুমার দাস, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, রুবেল হোসেন, মুস্তাফিজুর রহমান, মেহেদী হাসান মিরাজ, নাজমুল ইসলাম অপু, মোহাম্মদ মিঠুন, সাইফউদ্দিন, আবু হায়দার রনি ও আরিফুল হক।
এই ১৬ জনের বাইরে বিশ্বকাপের সমীকরণে আছেন সাব্বির রহমান রুম্মান, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিষিদ্ধ হয়ে আছেন সাব্বির, আগামী ফেব্রুয়ারিতে তার নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হবে। ওয়ানডের একাদশে ছয়-সাতে তার মতো হার্ডহিটার কাউকে সবসময়ই চায় বাংলাদেশ দল। টিম ম্যানেজমেন্ট সূত্র বলছে, ফর্ম-ফিটনেস ঠিক থাকলে নিষেধাজ্ঞা শেষ হলেই দলে দেখা যেতে পারে সাব্বিরকে। নিজের ফর্ম হারিয়ে ফেলা মোসাদ্দেক অবশ্য সম্প্রতি রান পেয়েছেন। ইমার্জিং কাপে সেঞ্চুরি, হাফ সেঞ্চুরির পাশাপাশি অফস্পিনেও ভালো করেছেন।
তবে মোসাদ্দেকের চেয়ে সাব্বিরের দলে ফেরার সম্ভাবনা প্রবল। আবার সাব্বির ফিরলে বাদ পড়তে পারেন মোহাম্মদ মিঠুনও। দ্বিতীয় বাঁহাতি স্পিনার কোটায় টিকে যেতে পারেন নাজমুল ইসলাম অপু। চার ওপেনারের কেউ আগামী কয়েক মাসে ফর্ম হারিয়ে ফেললেই বিপদে পড়তে পারেন। ইনফর্ম বলেই চারজনকে দলে রাখা হয়েছে। রানখরা দেখা দিলেই তাদের একজনের উপরও কোপ আসতে পারে।
পেস বিভাগে মাশরাফি-রুবেল-মুস্তাফিজের বাইরে দলে আছেন বাঁহাতি পেসার আবু হায়দার রনি। এর বাইরে আর কেউ বিশ্বকাপের দলে চলে আসার মতো অবস্থানে নেই। সবকিছু ঠিক থাকলে চতুর্থ পেসার হিসেবে রনি হয়তো থাকছেন। পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে সাইফউদ্দিনের জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বী কম। বর্তমানে দলে থাকলেও আরিফুল হকের উপরই হয়তো শেষ পর্যন্ত কোপটা পড়বে। খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ পাচ্ছেন না তিনি। বিশ্বকাপ দলে আরিফুলের থাকাটা তাই শঙ্কার মুখেই বলতে হবে।
গত বিশ্বকাপে খেললেও তাসকিন আহমেদ এবারের আসরের সমীকরণে পিছিয়ে পড়েছেন। চোটজর্জর এই পেসার দলে নেই। সুস্থ হয়ে মাঠে নামার লড়াইয়ে থাকা তাসকিন আগামী কয়েক মাসের মধ্যে দলে ফিরতে পারবেন, এমন বাজি ধরার লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মাশরাফির নেতৃত্বে ২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছিলো বাংলাদেশ। ভারতের কাছে হেরে বিদায় নেয় টাইগাররা। ওয়ানডে অধিনায়কের চোখে গত আসরের চেয়ে এবারই দল হিসেবে বেশি ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। তিনি বলেছেন,
‘আমি বলবো, অবশ্যই এবার। কারণ আমরা যাদের তরুণ খেলোয়াড় বলছি, ওরাই দুই-তিন-চার বছর খেলে ফেলেছে। সৌম্য’র তো প্রায় চার বছরই হতে চলেছে। ইমরুল লম্বা সময় ধরে খেলছে, লিটনও দুই-তিন বছর ধরে খেলছে। এদের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। আপনি যদি পেস বোলারদের দেখেন, সাইফউদ্দিন ছাড়া আর সবাই বেশ অভিজ্ঞ। এখন পারফর্মও করছে বিশেষ করে এই সংস্করণে। ২০১৫ সালে বেশিরভাগই নতুন ছিল। তার মানে এই না, বিশ্বকাপে গিয়ে সেমিফাইনালে খেলে ফেলবে। অবশ্যই ভালো অবস্থানে আছে, যেহেতু অভিজ্ঞতায় এগিয়ে।’
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের স্বপ্ন-সারথী কারা হবেন, তা সময়ই বলে দেবে। তবে বিশ্বকাপে ভালো সাফল্য পেতে একটা ভারসাম্যপূর্ণ একাদশ, সঠিক কম্বিনেশনের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা অনেক। আগামী ম্যাচগুলোতেও সেটির সন্ধানেই থাকবে বাংলাদেশ, যদিও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ওয়ানডে সিরিজে টিম কম্বিনেশনটা বেশ সুবিধাজনক এবং স্বস্তিদায়ক জয়ই এনে দিয়েছিলো বাংলাদেশকে।