Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কেমন করে নাদাল হলেন লাল-দুর্গের রাজা?

সব ক্রীড়াবিদেরই পছন্দের দু-একটা জায়গা থাকে। আজহারউদ্দীন যেমন ভালোবাসতেন কলকাতার নন্দন-কাননকে, বিরাট কোহলি ভালোবাসেন অ্যাডিলেইডকে, এসসিজির প্রেমে মজে ব্রায়ান লারা তো নিজের মেয়ের নামই রেখে দিয়েছেন সিডনি। কেন যে ‘অ্যাডিলেইড’ নামটা শুনলেই বিরাট কোহলির ব্যাট চওড়া হয়ে যায় দ্বিগুণ, কেন অফ-ফর্মে থাকা আজহারও ইডেন গার্ডেন্সে আসতেই খেলে ফেলতেন ক্রিকেটের রথী-মহারথীদের ঈর্ষা জাগানো সব ইনিংস, সেসব কেন’র ব্যাখ্যা যতটা না ক্রিকেটীয় কারণ দিয়ে করা যায়, তার চাইতে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান দিয়ে করাটা ঢের সহজ হয়।

কিন্তু নাদালের সঙ্গে কাদামাটির কোর্টের সখ্যতার এমনতর একটা ব্যাখ্যা করতে গিয়েই বাঁধছে বিপত্তি। টেস্টে যতই আজহারউদ্দীন ৯ ইনিংসে ৫ বার শতকের দেখা পান ইডেনের উইকেটে, একদিবসী ক্রিকেটে সেখানে তো শতরানের মাইলফলক ছুঁতে পারেননি একবারও। সিডনি তার যতই প্রিয় হোক, এসসিজিতে তো ২ কিংবা ১ রানের ইনিংসও খেলেছিলেন লারা।

এদের পাশে একবার লালমাটির কোর্টে নাদালের রেকর্ডগুলো দাঁড় করিয়ে দেখুন! ১৫ বার রোলাঁ গারোঁতে খেলতে নেমে ১২ বারই শেষ করেছেন শিরোপার হাসিতে, এবার জিতলে তা হয়ে যাচ্ছে ১৬ বারে ১৩! ফ্রেঞ্চ ওপেনে প্রথম ১০ সুযোগে ৯ বার জিতে গড়েছিলেন ৯৮.৫ শতাংশ জয়ের অতিমানবীয় কীর্তি; ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড়, যিনি দু’দুটো এটিপি মাস্টার্স ১০০০ টাইটেল জিতেছেন ৯ কিংবা তার বেশিবার; একই বছরে লাল মাটির তিনটি মাস্টার্স ১০০০ টুর্নামেন্টের সঙ্গে ফ্রেঞ্চ ওপেনে জেতার ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ কীর্তিটিও তো নাদালেরই গড়া!

লাল-দুর্গের রাজা; Image credit: Getty Images

নাহ, এত সবের পরে নাদালের সঙ্গে ক্লে-কোর্টের সম্পর্কের রসায়নটাকে স্রেফ জ্যোতিষশাস্ত্রের গণ্ডিতেই আটকে রাখা যাচ্ছে না। সম্পর্কটার নাড়ি নিশ্চিতভাবেই পোতা রয়েছে এর চাইতেও ঢের গভীরে।

এই লেখক প্রবেশ করতে চাইছেন সেই গভীর খাদেই, সঙ্গী হিসেবে পেতে চাইছেন আপনাকেও। ক্লে-কোর্ট পেলেই নাদালের অমন দুর্দমনীয় হয়ে উঠবার রহস্যটা দু’জনে মিলে তুলে আনতে পারি কি না, দেখবো চলুন!

ক্লে-কোর্টের স্পিন-প্লে এবং নাদাল

সর্বপ্রথম আমাদের জানা দরকার, আর সকল কোর্টের সঙ্গে কাদামাটির কোর্টগুলোর তফাৎটা কোথায়?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাদামাটির তৈরি বলে এই কোর্টগুলো হার্ডকোর্টের তুলনায় নরম, ফলতঃ বলের গতিটা হয় ধীর। সঙ্গে সঙ্গে এই কোর্টে বলের বাউন্সটাও হয় বেশি। এই দুই কারণ মিলিয়ে আলগা মাটির ক্লে-কোর্টে বলটা আটকে গিয়ে স্পিন ধরে বেশ, খেলায় তাই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হয়ে দাঁড়ায় স্পিন-প্লে। যারা বলের বাঁকটা ঠিকঠাক কাজে লাগাতে পারেন, তারাই এসব সার্কিটে সফল হন সবচেয়ে বেশি।

পায়ে পায়ে ক্ষয়ে আসে মাটি; Image source: EFE/Juan Ignacio Roncoroni

ব্যাক স্পিন, সাইড স্পিন মিলিয়ে স্পিনের নানা ধরনের প্রকারভেদ থাকলেও কাদামাটির কোর্টের স্পিনটা মূলতঃ টপ স্পিন। নাদাল র‍্যাকেটটা সেমি-ওয়েস্টার্ন গ্রিপে ধরেন দেখে এই টপ স্পিনের মাত্রা হয় অন্য যে কারো চাইতে বেশি।

এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ফোরহ্যান্ড শট খেলবার সময় নিজের হাতেই ৩২০০ আরপিএম মাত্রার টপ স্পিন করিয়ে ফেলেন নাদাল — যা কি না রজার ফেদেরার কিংবা অ্যান্ডি রডিকের চাইতে ২০ শতাংশ বেশি। নাদালের হাতের এই টপ স্পিনটা চালিত হয় বলের ওপরেও, পরিমাপ করে দেখা গেছে, নাদালের ফোরহ্যান্ড শটে বলের মিনিটপ্রতি ঘূর্ণনমাত্রা হয় ৫০০০ ছুঁইছুঁই

সাধারণত গ্রাউন্ডস্ট্রোক খেলবার সময় র‍্যাকেট আর বলের মূল সংযোগটা ঘটানোর চেষ্টা থাকে কোমরসমান উচ্চতায়; কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নাদালের এই অতিরিক্ত টপ স্পিনওয়ালা বলগুলোতে চাহিদামতো যোগাযোগটা ঘটে না। কেননা, টপ স্পিন বেশি বলে বলগুলো একটা পর্যায়ে গিয়ে নিচু হয়ে যায় আচমকাই; ফলে ড্রপের পরে সামনে এগোয় অতিরিক্ত বাউন্স আর একটু বেশি গতি নিয়ে। স্বভাবতই, ঠিকঠাক রিটার্ন করাটাও কঠিন হয়ে যায় প্রতিপক্ষের জন্যে। হঠাৎ এই গতি আর বাউন্সের হেরফেরে হতচকিত হয়ে যাওয়া প্রতিপক্ষকে আক্রমণের বদলে খেলা চালাতে হয় রক্ষণাত্মক শটেই।   

অতিরিক্ত টপ-স্পিনের কারণে ঘটা মারাত্মক ডিপটা নিশ্চয়তা দেয় কমসংখ্যক আনফোর্সড এররেরও। নাদাল যে তাই বেসলাইনে দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে ফোরহ্যান্ড শট খেলতে পারেন, তার কারণও এই অতিমাত্রার টপ স্পিনই।

ল্যাসো ফোরহ্যান্ডের নাদাল এবং ক্লে-কোর্ট

প্রতিপক্ষ হিসেবে নাদাল থাকতে পারেন, এমন কিছু অনুমান করতে পারলেই যেকোনো টেনিস খেলোয়াড় সবচেয়ে বেশি ভয়ে থাকেন নাদালের ল্যাসো ফোরহ্যান্ড নিয়ে। উইম্বলডনের ঘাসের কোর্ট বলুন, অস্ট্রেলিয়া-ইউএস ওপেনের হার্ডকোর্ট অথবা ফ্রেঞ্চ ওপেনের মাটির কোর্ট; নাদালের আক্রমণটা আবর্তিত হয় এই ফোরহ্যান্ড শটকে ঘিরেই। এক পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, ১ম সার্ভিসের পরে শতকরা ৭৯ ভাগ ক্ষেত্রেই নাদাল খেলে থাকেন ফোরহ্যান্ডে। এবং, এ শট খেলবার পরে ৭১ শতাংশ পয়েন্টেই তিনি শেষ করেন জয়ের হাসিতে।

নাদালের ল্যাসো ফোরহ্যান্ড; Image credit: USopen

অন্য কোর্টগুলোর তুলনায় মাটির কোর্টে এই ল্যাসো ফোরহ্যান্ড শট খেলাটা তুলনামূলক সহজ। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, মাটির কোর্টটা নরম হবার কারণে বলের গতিটা হয়ে যায় কিছুটা মন্থর। বলের এই খানিকটা ধীরগতির কারণে যে সামান্য ভগ্নাংশ সময় বেশি পান নাদাল, তাতেই নিজেকে ব্যাকহ্যান্ড শটের বদলে দাঁড় করাতে পারেন ফোরহ্যান্ড শট খেলবার অবস্থানে।

উদাহরণ হিসেবে সামনে টানা যায় ২০১৯ ইতালিয়ান ওপেনের ফাইনালে নাদাল-জোকোভিচ ম্যাচটিকে। সে ম্যাচের দ্বিতীয় সেটের চার নম্বর গেমে জোকোভিচ পেয়েছিলেন প্রথম ব্রেক পয়েন্টের সুযোগ। ইতিহাসের অন্যতম সেরা রিটার্নার হিসেবে জোকোভিচ স্বীকৃতি পাচ্ছেন বেশ অনেকদিন ধরেই; ব্রেক পয়েন্টের সামনে দাঁড়িয়ে সে ম্যাচে জোকোভিচ রিটার্নটাও পাঠিয়েছিলেন দারুণ। বিনিময়ে নাদালের কাছ থেকে আশা করছিলেন ব্যাকহ্যান্ড জাতীয় কোনো শট; বেশিরভাগ ক্রীড়াবিদ তো ওই মুহূর্তে তা-ই করতেন। কিন্তু বাদবাকি সবার মতো হলে তিনি আর নাদাল কেন! খেলা হচ্ছিল ক্লে-কোর্টে, নাদাল বলের মন্থরতাকে কাজে লাগিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন ফোরহ্যান্ড শট খেলবার পজিশনে। শেষে পায়ের আঙুলে ভর করে যে স্ট্রোক নাদাল খেলেছিলেন, জোকোভিচ তার কোনো জবাব দিতে পারেননি, ব্রেক পয়েন্টও আর জেতা হয়নি তার।

মাটির কোর্টে এই ল্যাসো ফোরহ্যান্ড খেলতে গিয়ে নাদাল সুবিধে পান আরও একভাবে। উইম্বলডনের মতো ঘাসের কোর্টে টেনিস বলটা পিছলে যায় বলে বাউন্স করে কম। কিন্তু মাটির কোর্টে ঘটে ঠিক উল্টো ঘটনা, মাটিতে বলটা গ্রিপ করে বলে বাউন্সও করে বেশি। আর খানিকটা বেশি বাউন্সের কারণে নাদালের জন্যে ফোরহ্যান্ড খেলতেও হয় সহজ।

বাড়তি বাউন্সের কারণে নাদালের ক্রসকোর্ট ল্যাসো ফোরহ্যান্ডের জবাব দেয়াটাও তো কঠিন হয় অনেক ক্ষেত্রে। কেননা, ওই দ্রুতগতির ক্রসকোর্ট ল্যাসো ফোরহ্যান্ডের জবাব দিতে বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই বেছে নেন কোনো না কোনো ব্যাকহ্যান্ড শট। কিন্তু কাদামাটির কোর্টে স্বাভাবিকের চাইতে বাউন্সটা বেশি করে বলে ব্যাকহ্যান্ড শট খেলবার আগে পছন্দমতো পজিশনে কিংবা কোণে দাঁড়াতে পারেন না প্রতিপক্ষ, ফলে রিটার্নটাও হয় না মনমতো।

ল্যাসো ফোরহ্যান্ড কাজ করে রক্ষণেও

বিশ্লেষকদের দাবি, কাদামাটির কোর্টে সাধারণত ওই খেলোয়াড়গুলোই ভালো খেলে থাকেন, যাদের রক্ষণটা বেশ আঁটসাট। সার্বজনীন ধারণামতেই, যেকোনো খেলোয়াড়ই ব্যাকহ্যান্ড শটগুলো খেলে থাকেন রক্ষণ সামলাতে, আর আক্রমণ করতে চাইলে বেছে নেন ফোরহ্যান্ডকে। তবে রজার ফেদেরারের মতো যাদের ঝুলিতে রয়েছে দুর্দান্ত স্লাইস ব্যাকহ্যান্ড, তারা আক্রমণ করতে পারেন ব্যাকহ্যান্ডেও।

কিন্তু কাদামাটির কোর্টে তাদের এই শটগুলো কাটাকাটি হয়ে যায় নাদালের ক্রসকোর্ট ল্যাসো ফোরহ্যান্ডের সামনে। এমনিতেই ব্যাকহ্যান্ড শটগুলো কাজ করে রক্ষণে, সঙ্গে রক্ষণে সাহায্য করছে ফোরহ্যান্ডও, নাদালের এই দ্বৈত রক্ষণ ভাঙবেন কোন খেলোয়াড়!

 

লম্বা র‍্যালি এবং নাদালের হার-না-মানা মানসিকতা

“He hit every shot as if his life depended on it. I’ve never seen anything like it, not even close.”

কথাগুলো যার, সেই কার্লোস ময়া নাদালকে দেখছেন ১২ বছর বয়স থেকে, বর্তমানে তিনি কাজ করছেন নাদালের কোচ হিসেবেও। এই সুদীর্ঘকাল ধরে নাদালকে দেখার অভিজ্ঞতায় তিনি বলছেন, আর সবার চাইতে নাদালকে আলাদা করেছে তার হার-না-মানা মানসিকতা। কোচ বলেই একটু বাড়তি তোষামোদ করেছেন শিষ্যের, এমন কিছু ভাবতে গেলেও বাধ সাধছেন পল অ্যানাকোন, ফেদেরারকে যিনি কোচিং করিয়েছিলেন ২০১০-১৩ সময়কালে। তিনিও মেনে নিচ্ছেন, আর সবার সঙ্গে নাদালের পার্থক্যটা প্রতি পয়েন্টে জয়ের একইরকম আকাঙ্ক্ষা ধরে রাখাতেই:

“It is the relentless ability to play every point like nothing else matters except that point.”

শৈশব থেকেই চাচা টনি নাদাল তাকে চালনা করতেন দারুণ সব প্রতিকূল অনুশীলনের মধ্য দিয়ে, যেগুলো সুচারুরূপে সম্পাদনের জন্যে শারীরিক সামর্থ্যর সঙ্গে সঙ্গে দরকার পড়তো প্রচণ্ড মানসিক শক্তিরও। নাদাল নিজেই যেমন তার আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন:

“তিনি (টনি নাদাল) সবসময়ই বাড়তি গুরুত্ব দিতেন সহিষ্ণুতা অর্জনে; সামনে যা-ই আসুক, মেনে নিয়ে এগিয়ে যাও; দুর্বলতা কিংবা কষ্ট জয় করতে শেখো; নিজের সাধ্যির সর্বোচ্চসীমা অব্দি তাড়া করো, কিন্তু কখনো আত্মসমর্পণ করো না। এই শিক্ষাগুলো যদি তুমি অর্জনে ব্যর্থ হও, কখনো সেরা অ্যাথলেটদের কাতারে নাম তুলবার স্বপ্ন দেখো না।”

গুরুর কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষাটা নাদাল বয়ে চলেছেন এখনো। প্রতি পয়েন্টেই নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছেন, বলকে তাড়া করছেন সামর্থ্যর একদম শেষবিন্দু অব্দি। ক্লে-কোর্টে তাকে অজেয় করেছে এই মানসিকতাই। প্রশ্নটা হচ্ছে, কীভাবে? 

এমনই উজাড় করে দেন প্রতি সেটে, প্রতি গেমে, প্রতি রিটার্নে; Image credit: Tim Clayton/Corbis via Getty Images)

গবেষকেরা বলছেন, কাদামাটির কোর্টে ফেদেরারের মতোন সার্ভিস-নির্ভর খেলোয়াড়দের কর্তৃত্ব বজায় রাখাটা কঠিন। তার চেয়ে বরং যেসব খেলোয়াড় লম্বা র‍্যালিতে অভ্যস্ত, ক্লে-কোর্টে সফল হন তারাই। গবেষকদের বিশ্লেষণ যে তুড়িতে উড়িয়ে দেবেন, সে উপায়ও নেই। কেননা, ২০১৯ সালের শুরু থেকে কাদামাটির কোর্টে ফেদেরার সর্বোচ্চ সাফল্য মানছেন ২০১৯ ফ্রেঞ্চ ওপেনের সেমিফাইনালে ওঠাকেই। রাফায়েল নাদাল যেখানে এরই মধ্যে জিতে নিয়েছেন ২০১৯ ইতালিয়ান ওপেন আর ফ্রেঞ্চ ওপেনের শিরোপা, সব ঠিকঠাক থাকলে হয়তো জিততে চলেছেন ২০২০ ফ্রেঞ্চ ওপেনও।

পরিসংখ্যান বলছে, সর্বশেষ ৫২ সপ্তাহে কাদামাটির কোর্টে সবচেয়ে ভালো সার্ভিস করেছেন রজার ফেদেরার। বিপরীতে শেষ এক বছরে নাদালের রিটার্ন রেটিং ১৭৩.১, যা কি না টেনিসের যেকোনো পর্যায়েই খেলা খেলোয়াড়দের ভেতরে সর্বোচ্চ; ক্লে-কোর্টগুলোতে এই রেটিং বেড়ে যাচ্ছে আরও ১৭.৭ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ যিনি, তার সঙ্গে নাদালের ব্যবধানটা প্রায় সাড়ে ১৫ শতাংশের। দিনশেষে যে এই রিটার্নগুলোই কাজে দিচ্ছে সার্ভিসের চেয়ে বেশি, তা তো ওই ফলাফলেই বোঝা যাচ্ছে।

এখানেই সামনে চলে আসছে নাদালের অদম্য মানসিকতার গুরুত্ব। রিটার্নগুলো ভালো হবার জন্যে, লম্বা র‍্যালি চালিয়ে যাবার জন্যে যে ম্যাচের কখনোই বিন্দুবিসর্গ ছাড় না দেবার মন থাকা চাই!

পক্ষে কাজ করে জল-হাওয়াও

কাদামাটির কোর্টের গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্টগুলো সাধারণত চলে এপ্রিল-জুন সময়কালে, ইউরোপে তখন গ্রীষ্মকাল চলে বলে সূর্যটা আলোও দেয় পুরোদমে। আর সূর্যের আলোর ছোঁয়া পেয়ে কোর্টটা হয়ে ওঠে খটখটে শক্ত, বাউন্সও করে বেশি। বাউন্স যে নাদালের ক্লে-কোর্ট সাফল্যের গুরুত্বপূর্ণ রসদ, তা নিশ্চয়ই আপনি বুঝে গিয়েছেন এতক্ষণে।

যতই দরদর করে ঘাম ঝরুক, এমনই রৌদ্রকরোজ্জল দিন চাই; Image credit: Tim Clayton/Corbis via Getty Images)

অতীতে দেখা গিয়েছে, একটু গুমোট আবহাওয়াতে পড়লে কাদামাটির কোর্টে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে নাদালকেও। উদাহরণ চাইলে উল্লেখ করা যেতে পারে ২০১২ ফ্রেঞ্চ ওপেনের ফাইনালের কথা।

জোকোভিচের বিপক্ষে সে ম্যাচ জিতলে নাদাল হাতে তুলতেন রোলাঁ গারোঁতে সপ্তম শিরোপা। প্রথম দুই সেট জিতে সেদিকে এগিয়েও গিয়েছিলেন নাদাল, কিন্তু আকাশটা মেঘে ঢেকে গিয়েছিল তারপরেই, সঙ্গে সঙ্গে নাদালের ভাগ্যাকাশেও জড়ো হয়েছিল দুর্যোগের ঘনঘটা। টানা ছয় গেম জিতে তৃতীয় সেট জিতে নিয়েছিলেন জোকার, চতুর্থ সেটের শুরুতেও পেয়ে গিয়েছিলেন ব্রেক পয়েন্ট। কিন্তু ঝুম বৃষ্টি নেমেছিল তারপরেই, সেদিনে আর খেলাই হয়নি রোলাঁ গারোঁতে। পরদিন ঝকঝকে নীল আকাশ ফেরত এসেছিল প্যারিসে, ফেরত এসেছিলেন লাল কোর্টের নাদালও। চতুর্থ সেটেই ৭-৫ গেমে জিতে পেরিয়ে গিয়েছিলেন বিওন বোর্গের ছয় ফ্রেঞ্চ ওপেন শিরোপার কীর্তি।

কোর্টে নাদালের দ্রুতগতি এবং পয়েন্ট বিনির্মাণ কৌশল

অন্যরা যেখানে কাকে কোচ করবেন, কোচের সঙ্গে কতটা মানিয়ে নিতে পারবেন, এসব নানা বিষয় নিয়ে থাকেন ভাবিত, সেখানে নাদালকে এই হ্যাপা পোহাতে হয়নি কোনোদিনই। শৈশব থেকে নাদাল যে কোচ হিসেবে পেয়েছিলেন আপন চাচা টনি নাদালকেই!

টনি নাদাল ছোটবেলা থেকেই রাফায়েল নাদালকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন দারুণ অ্যাথলেট হিসেবে, এজন্যে দ্রুতগতির পায়ের কাজ নিয়ে আলাদা সেশন করতেন নিয়মিতই। সেসব পরিশ্রম ফল দিচ্ছে এখন; কোর্টে নাদালের চাইতে দ্রুতগতিতে দৌড়াতে পারেন, এমন খেলোয়াড় খুব কমসংখ্যকই আছেন। বাকিরা যেখানে ব্যাকহ্যান্ড শটেই আশ্রয় খোঁজেন, নাদাল সেখানে তার চটুল পায়ের সাহায্যে সহজেই পৌঁছে যান ফোরহ্যান্ড শট খেলবার অবস্থানে। আর ফোরহ্যান্ডের নাদাল যে বিষম এক আতঙ্ক, তা তো এতক্ষণে আপনি জেনেই গিয়েছেন।

Image credit: Tim Clayton/Corbis via Getty Images)

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গতি কিছুটা কমে গিয়েছে বিধায় এখন নাদাল খেলার ধরন বদলে ফেলেছেন কিছুটা। সার্ভিসের বেলায় ইদানীং নাদাল বেছে নিচ্ছেন ‘ওয়াইড অব দ্য ব্যাকহ্যান্ড সার্ভ’; যা প্রতিপক্ষকে ঠেলে দেয় ব্যাকহ্যান্ডের একদম প্রান্তসীমায়, ফলে প্রতিপক্ষের রিটার্নটা হয় খুবই দুর্বল। নাদাল যার জবাব দেন ডাউন দ্য লাইনে ফোরহ্যান্ড খেলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিপক্ষরা খেই হারিয়ে ফেলেন এর রিটার্ন করতে গিয়ে, অনেকে আগেই পূর্বানুমান করে এগিয়ে যান এই ডাউন দ্য লাইন ফোরহ্যান্ডের মোকাবিলা করতে। নাদাল সব দেখেশুনে ক্রস-কোর্ট ফোরহ্যান্ডও খেলেন কখনো কখনো, সামনে এগোনো গেলেও হুট করেই পেছনে যাওয়াটা তো দুঃসাধ্য।

ইদানীংকালে নেটের কাছে দৌড়ে এসে আরেকধরনের টেকনিকও প্রয়োগ করছেন নাদাল। এখন প্রতিপক্ষকে বেসলাইনের চাইতেও দূরে আটকে রেখে নাদাল নেটের কাছাকাছি দৌড়ে এসে চেষ্টা করছেন তাড়াতাড়ি পয়েন্ট তুলবার।

হাঁটুটাও বেগড়বাই করে না ক্লে-কোর্টে

ঘাসের কোর্ট কিংবা হার্ডকোর্টের তুলনায় মাটির কোর্টে র‍্যালিগুলো লম্বা হয় বলে এখানটায় খেলোয়াড়দের দৌড়াতেও হয় বেশি। ২০১৬ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, সে বছরের ফ্রেঞ্চ ওপেনের প্রতি ম্যাচে খেলোয়াড়েরা দৌড়েছিলেন গড়ে ৪.৬ কি.মি., বিপরীতে একই বছরের উইম্বলডনে খেলোয়াড়দের দৌড়াতে হয়েছিল ০.৭ কি.মি. কম দূরত্ব।

নাদালের খেলার ধরনটাও তো খেটে খেলতেই বলে। বেসলাইন থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে খেলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বলে বলটা খেলবার জন্যে নাদাল সময় পান কিছুটা বেশি। কিন্তু কিছুটা দূরে দাঁড়ানো মানে তো কিছুটা বেশি দৌড়ানোও! ২০১৫ অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে যেমন দেখা যাচ্ছে, নাদাল সেবারের টুর্নামেন্টে প্রতি পয়েন্টের জন্যে দৌড়েছিলেন গড়ে প্রায় ১২ মিটার, সবসুদ্ধ যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৮০০০ মিটারে!

নাদাল ঠিক কতটা দৌড়োন? Image credit: si.com

এত পরিমাণ দৌঁড়ে খেলবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় চোট বাসা বেঁধেছে তার দুই হাঁটুতেই। ২১ বছর বয়স থেকেই নাদাল ভুগছেন ‘প্যাটেলার টেন্ডিনাইটিস’ নামের চোটে। অতীতে অনেকবারই দেখা গিয়েছে, ম্যাচের মাঝপথে কিংবা আগেভাগেই নিজের নাম তুলে নিয়েছেন নাদাল। শেষ কয়েক বছরে হাঁটুর সমস্যাটা বারবারই বাগড়া দিয়েছে বলে চিকিৎসকেরা নাদালকে পরামর্শ দিয়েছেন, ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত করতে চাইলে ইউএস ওপেনের মতোন হার্ডকোর্টের টুর্নামেন্টগুলো যেন বেছে বেছে খেলেন তিনি।

প্রশ্ন হচ্ছে, আর সব টুর্নামেন্ট থাকতে হার্ডকোর্ট নিয়েই চিকিৎসকদের আপত্তি কেন? উত্তরটা হচ্ছে, বেশিরভাগ হার্ডকোর্টের খেলাগুলো হয় সিনথেটিক টার্ফে, যেখানে ফ্রেঞ্চ ওপেনের কিংবা কাদামাটির কোর্টগুলো তৈরি হয় জৈব বস্তু থেকে। এই জৈব কোর্টগুলো হাঁটুকে দেয় বাড়তি সুরক্ষা, চোটাক্রান্ত হবার ঝুঁকিও দেয় কমিয়ে৷ বিপরীতে সিনথেটিক টার্ফে খানিকক্ষণ খেললেই হাঁটুতে পেয়ে বসে জড়তা, নাদাল তার স্বাভাবিক খেলা খেলতে চাইলে তাকে শ্রম দিতে হয় বাড়তি। ফলাফল, হাঁটুর চোট, নাম প্রত্যাহার, টুর্নামেন্ট মিস।

নাদাল যেন হাঁটুর চোটের ঘরবসতি; Image source: Tennisworldusa.org

পুনশ্চ, জন্ম আর বেড়ে ওঠাটা বার্সেলোনা কিংবা মায়োর্কার মতো জায়গায় বলে কাদামাটির কোর্টে নাদালের ভালো খেলাটা নিয়তিই ছিল। কিন্তু ভালো খেলা অজেয় হবার ভেতরে যে এক পৃথিবী পার্থক্য, নাদাল তা ঘুচিয়েছেন বলেই তো এ লেখা লিখতে হলো।

This article is in Bangla language. Thsi article is an analysis on Rafael Nadal's clay-court domination. Necessary hyperlinks and images are attached inside.

Featured image © Getty Images              

Related Articles