দৃশ্যপট ১
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম। অধ্যাপক ক্লাসে এসেই বললেন, আজ তোমাদের ভালোবাসা নিয়ে পড়াব। এবং তারপর তিনি লেকচার শুরু করে দিলেন। ভালোবাসা সংক্রান্ত একের পর এক তত্ত্ব শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরতে লাগলেন। কোন তাত্ত্বিক কী বলেছেন, তার তত্ত্বের কোন অংশগুলো গ্রহণীয়, কোন অংশগুলো বর্জনীয়, সব কিছুই খুব সুন্দরভাবে আলোচনা করলেন তিনি। এভাবে টানা এক ঘণ্টা চলল তার লেকচার। শুরুর দিকে শিক্ষার্থীরা সকলেই মনোযোগ দিয়ে অধ্যাপকের লেকচার শুনছিল। কিন্তু এত দীর্ঘ সময় ধরে লেকচার চলল যে, অনেকের পক্ষেই মনোযোগ ধরে রাখা সম্ভব হলো না। একদিকে অধ্যাপক আপনমনে লেকচার দিয়ে চললেন, আর কিছু অমনোযোগী শিক্ষার্থী সেদিকে খেয়াল না করে নিজেদের মতো করে এটা-ওটা চিন্তা করতে শুরু করল, পাশেরজনের সাথে ফিসফাস করতে লাগল। মাঝেমধ্যে অধ্যাপক কী বলছেন সেটিও তারা শোনার চেষ্টা করল বটে, কিন্তু একবার খেই হারিয়ে ফেলায় পরবর্তী তত্ত্বগুলো সবই তাদের মাথার উপর দিয়ে গেল।
ওদিকে যেসব শিক্ষার্থী পুরোটা সময় জুড়ে গোগ্রাসে অধ্যাপকের লেকচার গিলেছে, তারাও যে সবকিছু বুঝে উঠতে পেরেছে, তা-ও নয়। অধ্যাপকের সব কথা শোনার পরও অর্ধেক তারা বুঝেছে, বাকি অর্ধেক অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারেনি।
লেকচার শেষে অধ্যাপক বললেন, সবই তো তোমাদের মোটামুটি বুঝিয়ে দিলাম। এর বাইরে তোমাদেরকে প্রয়োজনীয় ম্যাটেরিয়ালস দিয়ে দেব। আশা করি পরীক্ষায় এ সংক্রান্ত প্রশ্ন আসলে তোমাদের উত্তর করতে অসুবিধা হবে না। সত্যিই, আপাতদৃষ্টিতে শিক্ষার্থীদের তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। অধ্যাপকের লেকচার শুনে যা বুঝেছে, আর তার সাথে পরীক্ষার আগের রাতে বই-শিট পড়ে আরও খানিকটা বুঝে নিয়ে, পরীক্ষার হলে বসে নিজেদের মতো করে বেশ ভালোই পাতা ভরে লিখে দিয়ে আসে তারা। পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে তাই মনে হয়, পরীক্ষা তো খুব ভালো দিলাম আমরা। এই কোর্সে চারে চার আটকায় কে! কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেখা যায়, ঐ টপিকের কিছুই আর মনে নেই তাদের। জুনিয়র কেউ যখন মেসেঞ্জারে নক দিয়ে বলে, ভাইয়া/আপু, এই টপিকটা একটু বুঝিয়ে দেন না, তখন দেখা যায় অন্যকে বুঝিয়ে দেবে কী, তাদের নিজেদেরই আর ঐ টপিকে তেমন কিছু মনে নেই। ভাসা ভাসা কিছু ধারণাই শেষ সম্বল। অর্থাৎ ক্লাসে তারা যা শিখেছে, এর মাধ্যমে পরীক্ষার বৈতরণী কোনো রকমে পার করে দিয়ে আসা গেলেও, অর্জিত শিক্ষা পরবর্তী জীবনে তাদের আর কোনো কাজেই লাগছে না।
দৃশ্যপট ২
টিএসসির চায়ের দোকানে বসে চা পান করতে করতে ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র-জুনিয়রদের আড্ডা চলছে। আড্ডার একপর্যায়ে আলোচনার বিষয়বস্তু হিসেবে উত্থাপিত হলো ভালোবাসা। তবে সাধারণভাবে ভালোবাসা নিয়ে কথা বলতে যেমন আমরা বুঝি কার সাথে কার প্রেম হয়েছে, কে কার পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এ ধরনের কোনো আলাপ সেখানে হলো না। বরং এক বড় ভাই ভালোবাসা নিয়ে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরলেন বাকিদের কাছে। কয়েকজন জুনিয়র মাথা নেড়ে, সহমত ভাই বলে একমত পোষণ করলেও, অন্যরা মেনে নিল না। একজন ঘাড়ত্যাড়া জুনিয়র তো বলেই বসল, ভালোবাসা নিয়ে আমার মনে এখনও কিছু সংশয় আছে ভাই। কিছু প্রশ্নের জবাব আমি আপনার কথায় খুঁজে পাইনি। এরপর সে একের পর এক প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগল বড় ভাইকে। বড় ভাইও নিজের মতো করে সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলেন, নিজের মতবাদকে ডিফেন্ড করতে লাগলেন। এবং তিনিও বেশ কিছু পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। এভাবে তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে আলোচনা দারুণ প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। সেই আলোচনায় সামিল হলো উপস্থিত বাকিরাও।
ঘন্টাখানেক এই আলোচনা চলার পর দেখা গেল, বড় ভাই যে পুরোপুরি ঠিক, তা যেমন নয়, তেমনই জুনিয়রের মনে যেসব বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল, তার অনেকগুলোও নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক। শেষপর্যন্ত বিতর্কে জয়ী হলো না কেউই, কিন্তু হেরেও গেল না কেউ। বরং দুই পক্ষ পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে একটি মতৈক্যের জায়গায় পৌঁছাল। নতুন কিছু না কিছু শিখল। এবং যা তারা শিখল, সেগুলো আজীবন তাদের চলার পথে সঙ্গী হয়ে থাকবে। কেননা আজ তারা যেসব সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে, তা অন্য কেউ জোর করে তাদের উপর চাপিয়ে দেয়নি। নিজেরাই নিজেদের সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে নিজস্ব মতবাদ তৈরি করে নিতে পেরেছে।
পর্যালোচনা
প্রথম দৃশ্যপটে আমরা যা দেখেছি, তা হলো প্রচলিত পাঠদান পদ্ধতি। সেই স্কুলজীবনের শুরুতেই আমরা এ ধরনের পাঠদানের সাথে পরিচিত হই, যা আমাদের পিছু ছাড়ে না কলেজ জীবন, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও। এ ধরনের পাঠদানের মূল কথা হলো, একজন শিক্ষক থাকবেন যিনি সংস্লিষ্ট বিষয়ে সর্বজ্ঞ হবেন, এবং তিনি তার জ্ঞান তার শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনাবাধায় বিতরণ করবেন। তিনি যা বলবেন, শিক্ষার্থীরা সেগুলোকেই ধ্রুব সত্য বলে মেনে নেবে এবং মনেপ্রাণে ধারণ করবে। ভিন্ন কোনো দৃষ্টিকোণ থেকেও যে ঐ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা যায়, সে কথা কারও মাথায় আসবে না। আর আসলেও তা মাথাতেই রয়ে যাবে, সেটির বহিঃপ্রকাশ ঘটবে না।
এ ধরনের পাঠদান পদ্ধতি যে একদমই খারাপ, সে কথা বলা যাবে না। কারণ এ ধরনের পাঠদান পদ্ধতিতে পরিশ্রম কম করতে হয়। স্রেফ শিক্ষক যা যা বলছেন, সেগুলোকে আত্মস্থ করে নিলেই চলে। ফলে একটি সীমিত পরিসরের ভেতরে থেকেই যেকোনো বিষয়ে জ্ঞানার্জন সেরে ফেলা যায়। সেই বিষয়ে আলাদা করে কোনো বিভ্রান্তিও আমাদের মনে থাকে না।
কিন্তু এ ধরনের পাঠদান পদ্ধতির সমস্যাটাও কিন্তু উপর্যুক্ত প্রথম দৃশ্যপটেই উঠে এসেছে। এক্ষেত্রে অখন্ড মনোযোগের প্রয়োজন হয়, নতুবা ঐ বিষয়ে পুরোপুরি বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না। আর কেউ যদি পরবর্তীতে বইপত্র ঘেঁটে বোঝার চেষ্টা করেও, সেটা খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া নিশ্চিত করা গেলেও, খুব বেশিদিন সেই জ্ঞান মাথায় থাকে না। ফলে অর্জিত জ্ঞান কেবল পরীক্ষা পাশের হাতিয়ার হিসেবেই থেকে যায়। এর বেশি কোনো কার্যকারিতা উপলব্ধ হয় না।
অপরদিকে আমরা যদি দ্বিতীয় দৃশ্যপটের দিকে তাকাই, এখানে কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস দেখতে পাব। কারও জ্ঞানকেই এখানে প্রশ্নাতীত সত্য বলে মেনে নেয়া হয়নি। বরং একজনের মতামতকে ক্রমাগত প্রশ্নের পর প্রশ্নের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন একটি মতবাদ বের করে আনা হয়েছে, যার সাথে পূর্ববর্তী মতবাদের কিছু অংশের মিল আছে, আবার কিছু অংশের মিল নেই। এক্ষেত্রে চিরাচরিত উপায়ে ঝগড়া করা হয়নি। কেউ তার নিজের মতামত অন্যের উপর চাপিয়েও দিতে চায়নি। কিন্তু অন্যের মতামতকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মাধ্যমে তাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করা হয়েছে, এবং সেই নতুন করে ভাবার মাধ্যমে নতুন চিন্তার উন্মেষ ঘটেছে। শেষ পর্যন্ত এমন একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে, যেখানে দুই পক্ষেরই সমর্থন রয়েছে। অর্থাৎ প্রাথমিক মতবাদের চেয়ে এই নতুন মতবাদ বেশি সত্যঘনিষ্ঠ ও যৌক্তিক হয়ে উঠেছে, যে কারণে সেটি সর্বসম্মতি লাভ করেছে।
সিদ্ধান্ত
এখন যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়, কোন দৃশ্যপটের ঘটনাটি আপনাকে বেশি আকৃষ্ট করেছে, অবশ্যই দ্বিতীয় দৃশ্যপটের ঘটনাটির প্রতিই আপনি পক্ষপাতিত্ব দেখাবেন। কেননা, এখানে একজনই কেবল কথা বলে যায়নি। সবাই কথা বলেছে, এবং সবাই মিলে একটি বিষয়ে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তাহলে নতুন কিছু শেখার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় দৃশ্যপটের পদ্ধতিই তো অধিক সহায়ক, তাই না? এবং এভাবে পাঠদান করা হলেই কি কোনো বিষয়ে শিক্ষা অর্জন বেশি সহজ ও কার্যকর হয়ে উঠবে না? এই প্রশ্নেও অধিকাংশের উত্তরই হ্যাঁ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
তবে এখন অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, দ্বিতীয় দৃশ্যপটের মতো করে শিক্ষা অর্জন সহজ হয় ঠিকই, কিন্তু এটি তো নিছকই আড্ডা ছিল। একদম ইনফরমাল একটি ব্যাপার। শ্রেণীকক্ষে কি এভাবে পাঠদান আদৌ সম্ভব? শিক্ষক বলবেন, ছাত্রছাত্রীরা শুনবে, এমনটিই তো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসছে। শিক্ষক ও ছাত্ররা তাদের স্বাভাবিক সম্পর্ক বাদ দিয়ে শ্রেণীকক্ষে আড্ডা দিতে শুরু করলে তো দুনিয়া উচ্ছন্নে যাবে! এটি একদমই অবাস্তব একটি ধারণা!
যারা এমনটি ভাবছেন, তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, পাঠদানের এমন একটি ধারণার উদ্ভব কিন্তু প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেই ঘটেছে। এবং বিশ্বের অনেক দেশেই, এমনকি আমাদের বাংলাদেশেও অনেক শিক্ষকের শ্রেণীকক্ষেই এ পদ্ধতিতে পাঠদানের বাস্তব প্রচলনও রয়েছে। এই বিশেষ পদ্ধতির নাম হলো সক্রেটিক মেথড।
সক্রেটিক মেথড কী?
নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, এতক্ষণ যারা মনোযোগ দিয়ে উপরের লেখা পড়েছেন, তাদেরকে নতুন করে সক্রেটিক মেথড সম্পর্কে ধারণা দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনারা নিজেরাই বিষয়টি বেশ বুঝে গেছেন। সক্রেটিক পদ্ধতি হলো সেই পাঠদান পদ্ধতি, যেখানে শিক্ষক সরাসরি তার শিক্ষার্থীদের কোনো বিষয়ে পাঠদানের পরিবর্তে, তাদের সামনে কোনো বিষয় উত্থাপন করেন, এবং এরপর তাদেরকে সংস্লিষ্ট বিষয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে তাদের চিন্তাশক্তিকে প্রবলভাবে নাড়িয়ে দেন। শিক্ষার্থীরা নিজেদের মতো করে সেই বিষয়ে তাদের মতামত উপস্থাপন করতে থাকে, আর শিক্ষক পুনরায় প্রশ্নের মাধ্যমে সেই মতামতের দুর্বল দিকগুলো ধরিয়ে দেন, এবং নতুন করে চিন্তা করতে উৎসাহিত করেন। এভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর প্রশ্ন-উত্তর খেলা অব্যাহত থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না শিক্ষার্থীরা এমন একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে যা শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা লাভ করছে।
প্লেটোর ডায়লগে সক্রেটিক মেথডের প্রামাণ্য উদাহরণ দেখা যায়।
যেভাবে এই পদ্ধতির জন্ম
নাম থেকেই বুঝতে পারছেন, এই পদ্ধতির সাথে সক্রেটিসের যোগসাজশ রয়েছে। সক্রেটিস প্রচলিত উপায়ে জ্ঞান বিতরণে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, এর মাধ্যমে মানুষকে কেবল কিছু বিষয়ে জানানো সম্ভব, কিন্তু বিশ্বাস করানো সম্ভব নয়। একজন ব্যক্তির কাছে একটি বিষয় কেবল তখনই পরিষ্কার হবে, যখন সে সেই বিষয়ের সাথে একাত্ম হয়ে উঠতে পারবে। তাই সক্রেটিসের কাছে কেউ কোনো বিষয়ে পরামর্শ চাইলে বা কিছু জিজ্ঞেস করলে, তিনি সরাসরি কোনো উত্তর বা উপায় বাতলে দিতেন না।
“চলো বন্ধু, আমরা মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে এই প্রশ্নগুলোকে পর্যালোচনা করে দেখি। যদি আমার কোনো বক্তব্যের ব্যাপারে তোমার ভিন্নমত থাকে তবে তা বলতে পারো। যৌক্তিক হলে আমি তা মেনে নেব।”
ধারণা করা যায়, এমন কিছু বলেই সক্রেটিস প্রথম এই পদ্ধতির প্রচলন ঘটিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, জ্ঞানের চেয়েও বেশি জরুরি হলো মানুষের নিজস্ব চিন্তাশক্তির গভীরতা। যখন মানুষ গভীরভাবে কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে পারবে, তখন জ্ঞান নিজেই এসে ধরা দেবে। আর মানুষের চিন্তাধারা যেন সঠিক পথে পরিচালিত হয়, সেজন্য তিনি একজন পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করতেন। এমন একজন পথপ্রদর্শক, যিনি মানুষকে সঠিক পথ দেখাতেন না, কিন্তু মানুষ ভুল পথে ধাবিত হলে তাকে থামাতেন, এবং সে যাতে নিজেই সঠিক পথের হদিস পায়, সে ব্যাপারে তাকে সর্বোচ্চ সহায়তা করতেন।
যেভাবে কাজ করে সক্রেটিক মেথড
কথোপকথনের মাধ্যমে এগিয়ে চলে সক্রেটিক মেথড। এক্ষেত্রে প্রথমেই উত্থাপিত হয় আলোচনার বিষয়বস্তু বা সমস্যা। এরপর দুজন ব্যক্তি সেই বিষয়ের উপর চিন্তাশীল আলোচনা চালাতে থাকে। দুই ব্যক্তির মধ্যে একজন হলেন শিক্ষক, যাকে বলা হয় inquisitor বা জেরাকারী। অপরজন তার ছাত্র, যার পোশাকি নাম interlocutor বা অংশগ্রহণকারী।
আলোচনার বিষয়বস্তু শিক্ষক বা ছাত্র যে কারও মাধ্যমেই উত্থাপিত হতে পারে। কিংবা দুজনের মিলিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেও হতে পারে। তবে আলোচনা তখনই বেগবান হয় যখন শিক্ষক তার ছাত্রের উদ্দেশ্যে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। সেই প্রশ্নের উত্তরে ছাত্র তার সীমিত জ্ঞান বা অনুমানের ভিত্তিতে একটি উত্তর দেয়, যাকে বলা হয় হাইপোথিসিস। এবং তারপরই শুরু হয় বিতর্ক, যাকে বলা হয় ইলেংকাস (Elenchus)। ছাত্র আরও গভীরভাবে ভেবে তার হাইপোথিসিসের দুর্বল দিকগুলো বের করে, এবং সেগুলো সংশোধনের মাধ্যমে একটি শ্রেয়তর উত্তর দেয়।
কিন্তু এরপরই শিক্ষক ছাত্রের সেই উত্তরের উপর ভিত্তি করে নতুন আরও একটি প্রশ্ন করে। তখন ছাত্র সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তার আগের উত্তরে আরেক দফা পরিবর্তন আনে। এরপর শিক্ষক নতুন উত্তরকে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করেন। এভাবে যতক্ষণ পর্যন্ত না ছাত্র একটি সন্দেহাতীত উত্তর দিতে পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষক প্রশ্ন করা অব্যাহত রাখেন, এবং ছাত্রও তার উত্তর সংশোধন করতে থাকে। প্রসেস অব এলিমিনেশনের ভিত্তিতে যতক্ষণ পর্যন্ত না ছাত্র তার উত্তরের সব ভুল শুধরে সেটিকে নিখুঁত করে তুলতে পারছে, এবং শিক্ষক পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি লাভ করছেন, ততক্ষণ প্রশ্নোত্তর পর্ব চলতেই থাকে। যখন দুই পক্ষেই আর কোনো সংশয়ের অবকাশ থাকে না, অর্থাৎ দ্বিপাক্ষিক সম্মতির ভিত্তিতে একটি উত্তরে পৌঁছানো সম্ভব হয়, তখনই ইলেংকাসের অবসান ঘটে।
সক্রেটিক মেথডের বিভিন্ন ধাপ
সক্রেটিক মেথডের মাধ্যমে কোনো সিদ্ধান্ত বা সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য বেশ কয়েকটি ধাপ পার হতে হয়। এটি মূলত একটি আলাপচারিতায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষক ও ছাত্রের উপরই নির্ভর করে যে তারা কতগুলো ধাপ পার হবে। তবে মোটা দাগে আমরা পাঁচটি ধাপকে চিহ্নিত করতে পারি।
- চিন্তা: শিক্ষকের প্রাথমিক প্রশ্ন শেষে ছাত্র উত্তর খুঁজে বের করতে চিন্তা শুরু করে।
- হাইপোথিসিস তৈরি: চিন্তা করা শেষ হলে ছাত্রের নিজের জ্ঞান ও চিন্তার মাধ্যমে সৃষ্ট অনুমানের ভিত্তিতে সে একটি হাইপোথিসিস তৈরি করে।
- ইলেংকাস: এটিই এই মেথডের কেন্দ্রীয় ধাপ। এই ধাপে দ্বিপাক্ষিক বিতর্ক চলতে থাকে। ছাত্র যে হাইপোথিসিস উপস্থাপন করে, তা শিক্ষকের মনঃপুত না হওয়ায় তিনি প্রশ্ন করেন। সেই প্রশ্ন শুনে ছাত্র নতুন করে চিন্তার অবকাশ পায়, এবং তার পূর্ববর্তী হাইপোথিসিস সংশোধন করে একটি নতুন উত্তর দেয়। শিক্ষক আবার সেই উত্তর শুনে নতুন উত্তর ছুঁড়ে দেন, এবং ছাত্র সেই প্রশ্নের ভিত্তিতে উত্তর খোঁজে।
- ঐক্যমত: ইলেংকাস ধাপের সমাপ্তি ঘটে শিক্ষক ও ছাত্র দুজনেই যখন একটি উত্তরে সম্মত হয়। অর্থাৎ দুজনের কারোরই আর সেই উত্তর নিয়ে সংশয় থাকে না, তারা সেই উত্তরটিকে গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।
- প্রয়োগ: সর্বসম্মতিক্রমে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পর সেটির বাস্তব প্রয়োগের পালা। অর্থাৎ নতুন পাওয়া সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ছাত্রের মূল্যবোধ, কার্যপদ্ধতি, জীবনাচরণে পরিবর্তন আনা, অর্থাৎ নিজের জীবনে ঐ নবলাভকৃত সিদ্ধান্ত বা উত্তরের প্রতিফলন ঘটানো।
একটি আধুনিক শ্রেণীকক্ষে সক্রেটিক মেথডের প্রয়োগ
আধুনিক পাঠদান পদ্ধতিতেও চাইলেই সক্রেটিক মেথডের প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব। প্রচলিত পাঠদান পদ্ধতিতে শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে এসে সরাসরি লেকচার প্রদান শুরু করেন। তা না করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিনি আগে শিক্ষার্থীদের মতামত গ্রহণ করতে পারেন। যেমন- পাঠ্যবিষয় যদি হয় মার্শাল ম্যাকলুহানের গ্লোবাল ভিলেজ ধারণা, তবে শুরুতেই এ বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনার পরিবর্তে তিনি কয়েকজনকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারেন গ্লোবাল ভিলেজ শব্দযুগল শুনে তাদের কী মনে হচ্ছে। বলাই বাহুল্য, আগে থেকে জানা না থাকলে কারও পক্ষে সঠিকভাবে এর উত্তর দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সকলের পক্ষেই সম্ভব কিছু না কিছু অনুমান করা। এরপর যার অনুমান মূল উত্তরের কাছাকাছি হবে, তাকে তিনি পরবর্তী প্রশ্নটি করতে পারেন। সে সঠিক উত্তর দিতে না পারলে শিক্ষক অন্যদেরও প্রশ্নটি করতে পারেন। এভাবে একাধিক উত্তরদাতার মধ্য দিয়ে আরেকজনকে পাওয়া যাবে যার উত্তর সঠিক উত্তরের কাছাকাছি হয়েছে। তখন তিনি তাকে পরবর্তী প্রশ্নটি করতে পারেন। এভাবে সরাসরি মূল তত্ত্বে না গিয়ে তিনি ধাপে ধাপে এগোতে পারেন, আর সেক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারেন তার শিক্ষার্থীদের অনুমানকেই।
সক্রেটিক মেথডে পাঠদানের উপকারিতা
- শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতা বাড়ে। চুপ করে শিক্ষকের লেকচার শোনার চেয়ে, নিজেরা যদি অনুমানের ভিত্তিতে ভুল উত্তরও দেয়, তারপরও আলোচ্য বিষয়বস্তুর সাথে তাদের একটি সংযোগ অবশ্যই ঘটে।
- সঠিক উত্তর না জানা সত্ত্বেও অনুমান করতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তি ধারালো হয়। তারা গভীরভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা অর্জন করে এবং তাদের উর্বর মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ ব্যবহার ঘটে।
- মনোবিজ্ঞান বলে, মানুষ অন্যের কাছ থেকে কোনো জ্ঞান লাভের পর তা খুব দ্রুতই ভুলে যেতে পারে। কিন্তু যদি সে ঐ বিষয়ে শুরুতে কোনো ভুল করে এবং পরবর্তীতে কেউ তার ভুল সংশোধন করে দেয়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আর কখনও সে ওই বিষয়টি ভোলে না। অনুরূপভাবে সক্রেটিক মেথডে শুরুতে ভুল উত্তর দেয়ার পর যদি শিক্ষার্থীকে তার ভুল ধরিয়ে দিয়ে নিজে থেকে সঠিক উত্তর খুঁজে বের করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়, তাহলে সেই উত্তর সে আর কখনোই ভুলে যায় না।
- প্রচলিত পাঠদান পদ্ধতিকে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছেই একঘেয়ে মনে হয়। ফলে অনেক শিক্ষার্থীই লেকচারে মনোযোগ দিতে পারে না। কিন্তু সক্রেটিক মেথডে প্রশ্নোত্তরের ভিত্তিতে পাঠদান করা হলে শিক্ষার্থীদের একঘেয়েমি দূর হয়। তারা নিজে থেকেই শ্রেণীকক্ষের পড়ায় আগ্রহ খুঁজে পায়।
- একজন শিক্ষার্থী যখন শুরুতে অনুমানের মাধ্যমে ভুল উত্তর দিলেও পরবর্তীতে শিক্ষকের প্রশ্নের জবাবে নিজে থেকেই সঠিক উত্তরটি দিতে পারে, তখন তার মধ্যে প্রবল আত্মবিশ্বাস জন্মায়। পাঠ্যসূচির বিষয়বস্তুর প্রতি তার ভালোলাগা জন্মায়। ফলে তাকে আর দায়সারাভাবে পড়াশোনা করতে হয় না, নিজের ভালোলাগা থেকেই সে পড়াশোনা করতে পারে।
সবক্ষেত্রে সম্ভব নয় সক্রেটিক মেথড
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদানে সক্রেটিক মেথড খুবই উপকারী সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর শিক্ষা দেয়া হয়, যেখানে বিচার-বিশ্লেষণের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তাই সরাসরি কোনো দার্শনিক, বিজ্ঞানী বা শিক্ষাবিদের তত্ত্ব শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে না দিয়ে, তাদেরকে নিজস্ব মতবাদ সৃষ্টিতে উৎসাহিত করতে সক্রেটিক মেথড খুবই সহায়ক। আর তাহলে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বগুলোও তাদের পক্ষে বোঝা সহজ হয়। কিন্তু সক্রেটিক মেথডের সীমাবদ্ধতা হলো, প্রাথমিক জ্ঞান প্রদানে এটি খুব বেশি প্রভাব ফেলে না। যেমন- স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে পড়া কোনো শিক্ষার্থী, যাকে আপনি শেখাবেন তিনের ঘরের নামতা বা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল কী, এসব ক্ষেত্রে তো আপনি সক্রেটিক মেথডের সাহায্য নিতে পারবেন না। এসব প্রাথমিক জ্ঞান তাকে হাতে ধরেই দিতে হবে, প্রয়োজনে মুখস্তবিদ্যাও কাজে লাগাতে হবে। সক্রেটিক মেথড কেবল উচ্চতর স্তরেই কার্যকর, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে, এবং কখনও কখনও কলেজ স্তরেও।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/