করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বেশ লম্বা একটা সময় ধরে স্থবির হয়ে ছিল গোটা বিশ্ব, সেই সাথে আমাদের বাংলাদেশও। এখনো করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না এলেও অনেক দেশই লকডাউন তুলে নিতে শুরু করেছে। আমাদের বাংলাদেশেও শর্তসাপেক্ষে অফিস ও গণপরিবহন খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কেননা, বেশিদিন তো এই অচলাবস্থা জারি থাকতে পারে না। এমনিতেই যতটা ক্ষতি হয়ে গেছে, তাতে করোনা-পরবর্তী দেশের অবস্থা নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েছেন অনেকেই। দেশের অর্থনীতি, কৃষি, উৎপাদন, যোগাযোগ, কর্মসংস্থান প্রভৃতির ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রবল আশঙ্কা।
তবে সবার আগে, গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ হয়েছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এবং এখন অবধি সেগুলো খোলার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি। ইউনেস্কো থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের ১৯১টি দেশ জাতীয়ভাবে এবং ৫টি দেশ স্থানীয়ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে, যার ফলে বিশ্বের মোট শিক্ষার্থীর ৯৮.৪ ভাগের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।
বেশিরভাগ আলোচনাতেই যে প্রশ্নটি এখন বারবার উঠে আসছে, তা হলো: অফিস-গণপরিবহন খোলার সিদ্ধান্ত তো হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে কবে? ইতঃমধ্যেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আদেশ এসেছে যে, আগামী ১৫ জুনের আগে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে না। তাই অনেকেরই জিজ্ঞাসা, তাহলে কি ১৫ জুনের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে? চলছে এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা বিতর্ক।
কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের অধিকাংশের আলোচনার দৌড় শুধু এই ‘কবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে’ প্রশ্নেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। অন্য নানা খাতের পাশাপাশি শিক্ষাখাতেও যে করোনার ফলে এক মহাবিপর্যয়ের আগমন ঘটতে চলেছে, সে ব্যাপারে আগ্রহের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে সিংহভাগ মানুষের মাঝেই। সম্ভবত তারা বুঝতেও পারছেন না, করোনার ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ঠিক কতটা ক্ষতির সম্মুখীন হতে চলেছে।
কী সেই ক্ষতি? সেটি হলো শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি। নিঃসন্দেহে করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার নিকট অতীতের যেকোনো সময়কে ছাপিয়ে যাবে। কেননা, শিক্ষার সাথে যে সরাসরি রয়েছে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার যোগাযোগ। এবং অর্থনীতিতে যদি একবার মড়ক লাগে, সেই আঁচ থেকে শিক্ষার পক্ষেও গা বাঁচানো অসম্ভব।
সাধারণত বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো পরিবারের আর্থিক দৈন্য। যদি বাবা-মা কিংবা অভিভাবকের আর্থিক অবস্থা ভালো হয়, দু’বেলা দু’মুঠো অন্নসংস্থান হয়, তাহলেই কেবল তারা সন্তানকে বিদ্যালয়ের পাঠানোর ‘বিলাসিতা’ দেখাতে পারেন। কিন্তু তাদের মুখে সেই ভাতই যদি না জোটে? কিংবা মেটানো না যায় অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণের খরচ?
করোনা কিন্তু আমাদেরকে সেরকমই একটা ভয়াবহ বাস্তবতার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। ইতোমধ্যেই দিনমজুরসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার দিনাতিপাত করছে। তাদের আয়ের ব্যবস্থা নেই, ফলে বসে থাকতে হচ্ছে অন্যের সাহায্যের আশায়। করোনা-পরবর্তী দেশের অর্থনৈতিক মন্দার ফলে তৎক্ষণাৎ তাদের নতুন কোনো কাজ পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। এদিকে এখনো যাদের কাজ রয়েছে, কিংবা হাতে রয়েছে, করোনা-পরবর্তী সময়ে সেগুলো ফুরিয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা প্রবল।
এমন যদি অবস্থা হয়, তাহলে অবশ্যই তাদেরকে জীবনযাত্রার মান কমাতে হবে। এবং জীবনযাত্রার মান কমানোর প্রথম দিককার পদক্ষেপ হলো, সন্তানের পড়ালেখা বন্ধ করে দেয়া। তারা বরং সন্তানকে জীবন-জীবিকার তাগিদে কাজে পাঠাবেন, এতে করে দেশে বেড়ে যাবে শিশুশ্রমের হার। আর একবার যদি কোনো শিশু পড়ালেখা বাদ দিয়ে অর্থোপার্জনে লেগে পড়ে, তার বিদ্যালয়ে ফেরার সম্ভাবনা যে কত কম, তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) প্রকাশিত শিক্ষা পরিসংখ্যান প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছেলেদের ক্ষেত্রে ১৭ দশমিক ১৫ আর মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৭ দশমিক ৫৬ শতাংশই মা-বাবাকে ঘরের বা আয়-উপার্জনের কাজে সহায়তার কারণে বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। করোনা-পরবর্তী সময়ে এসব হার অবশ্যই বাড়বে।
এছাড়া শিশুশ্রমের পাশাপাশি মেয়েদের বাল্যবিয়েরও হিড়িক লেগে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ওইসব মেয়ের শিক্ষাজীবনই কেবল বিনষ্ট হবে না, হুমকির মুখে পড়বে তাদের স্বাস্থ্যসহ গোটা ভবিষ্যৎ জীবন।
এছাড়া শিক্ষা ও বিদ্যালয়বিমুখতাও শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। অতীত ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, দেশে যখনই শিক্ষাপঞ্জির কোনো বড় ছুটি আসে, এরপর পুনরায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার কমে যায়। এবারও সে হার বাড়বে বৈ কমবে না।
কেননা, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা থামে না। বাসায় বসে তারা পড়াশোনা করে, বাসায় শিক্ষক এসে পড়ান, অনেকে আবার কোচিং ক্লাসেও যায়। কিন্তু করোনার ফলে শিক্ষকের বাসায় এসে পড়ানো, কিংবা কোচিংয়ে গিয়ে পড়ে আসার চল একেবারে উঠেই গেছে। এবং শিক্ষার্থীরা বাসায় বসে শুরুর দিকে একটু-আধটু পড়াশোনা করলেও যত দিন গেছে, তাদের সে প্রবণতাও কমেছে। দিনের পর দিন গৃহবন্দি থেকে তাদের মানসিক অবস্থার ব্যাপক অবনতি ঘটছে। এ অবস্থায় পড়ায় কি আর মন বসে! এতে একদিকে সীমিত উপার্জনকারী শিক্ষকদের জীবনযাত্রা যেমন দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে, তেমনই শিক্ষার্থীদের মানসিক স্থিতি বজায় রাখা হয়ে উঠেছে দুষ্কর।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমাদের সরকার শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা যাতে অব্যাহত থাকে, সে ব্যাপারে বেশ আন্তরিকতাই দেখিয়েছে। কিন্তু সেই আন্তরিকতা কি আদৌ ফলপ্রসূ হয়েছে? বোধহয় না। সংসদ টিভির মাধ্যমে পাঠদানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তাতে তেমন একটা সাড়া পাওয়া যায়নি। অন্তত ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থীর কাছে তো এটি পৌঁছায়নি বটেই, বাকি যে ৪০ শতাংশের কাছে পৌঁছেছে, তারাও টিভি দেখে পাঠগ্রহণের প্রক্রিয়াকে সাদরে গ্রহণ করেনি, থেকেছে অমনোযোগী। এছাড়াও বেতার, অনলাইনের মাধ্যমেও শিক্ষাদানের নিত্য-নতুন প্রচেষ্টা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। সেগুলো কতটুকু সফলতা পাবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি দৃশ্যমান, তাতে দীর্ঘদিন পড়াশোনার বাইরে থাকা শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রভাবক হতে বাধ্য। কেননা, ইতোপূর্বেও লেখাপড়ায় আগ্রহ না থাকার কারণে গড়ে ১০ দশমিক ৯৭ শতাংশ ছেলে ও ১১ দশমিক ২২ শতাংশ মেয়ে এ স্কুলে যেত না।
দুর্যোগ-পরবর্তী যানবাহনের সংকটকেও বিবেচনা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার একটি বড় কারণ হিসেবে। ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ ছেলে ও ১৭ দশমিক ২৭ শতাংশ মেয়ে এ কারণে বিদ্যালয়ে যায় না। করোনা-পরবর্তী সময়ে যেহেতু রাস্তাঘাটে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যানবাহনে চলাচলের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হবে, তাই গণপরিবহনগুলোতে স্থান সঙ্কুলান হবে না অনেকেরই। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দূরে যাদের বাস, তাদের মধ্যে একটা বড় অংশকে বাসায় বসে থাকতে হবে।
জানিয়ে রাখা ভালো, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ‘বাংলাদেশ প্রাইমারি এডুকেশন: অ্যানুয়াল সেক্টর পারফরম্যান্স রিপোর্ট ২০১৯’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুদের ১৮ দশমিক ৬ শতাংশই পঞ্চম শ্রেণি শেষ করার আগে ঝরে পড়ে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার প্রথম শ্রেণীতে ১ দশমিক ৯ শতাংশ, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ২ দশমিক ৭, তৃতীয় শ্রেণীতে ৩ দশমিক ৪, চতুর্থ শ্রেণীতে ৮ দশমিক ৪ ও পঞ্চম শ্রেণীতে ২ দশমিক ৫ শতাংশ।
এদিকে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার দৃশ্য তো আরো করুণ। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সেখানে ২০১৮ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ৩৭ দশমিক ৬২ শতাংশ। আর উচ্চ মাধ্যমিকে ২০১৮ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ঝরে পড়ার হার নেহায়েত কম নয়। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ অনেক বেশি হওয়ায় প্রতি বছরই ১০ থেকে ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে।
অনেক শিক্ষাবিদই আশঙ্কা করছেন, করোনা-পরবর্তী সময়ে ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ফিরবে না। অর্থাৎ গড়ে দেশের প্রতি পাঁচজন শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন বিদ্যালয়ে তাদের শেষ ক্লাসটি করে ফেলেছে।
দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দিয়ে বসে আছে দীর্ঘদিন। এই যে লম্বা ছেদ পড়ল তাদের শিক্ষাজীবনে, এতে করে তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো আর উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হবে না, বা হওয়ার সুযোগ পাবে না। বিশেষত যেসব শিক্ষার্থী ফেল করবে, তাদের শিক্ষাজীবন এখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
অভিন্ন চিত্র দেখা যাবে উচ্চমাধ্যমিকে পড়া শিক্ষার্থীদের বেলায়ও, যাদের এইচএসসি পরীক্ষার দিনক্ষণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কবে তাদের এইচএসসি পরীক্ষা হবে, আর কবেই বা সেই পরীক্ষার ফল প্রকাশ হবে, কিছুই আপাতত বলা যাচ্ছে না। আর সেই ফল প্রকাশের পরও যে ঠিক কবে তারা উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেবে, সেখানে উত্তীর্ণ হবে, এবং কবে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু করবে, সেগুলোও সব সময়ই বলে দেবে। কিন্তু সব অভিভাবক কি আর সেই সময়ের অপেক্ষায় বসে থাকবে?
সবচেয়ে কঠিন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু বলা। জীবনে বহু প্রতিবন্ধকতা জয় করে যারা এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে, তারা নিশ্চয়ই চাইবে শিক্ষাজীবন শেষ করতে, অন্তত স্নাতকের সনদপত্রটা অর্জন করতে। ফলে যখনই বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার ক্লাস শুরু হোক না কেন, তারা চাইবে ক্লাসে ফিরে যেতে। নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চাইবে না।
কিন্তু চাওয়া আর পাওয়ার মেলবন্ধন সবক্ষেত্রে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই না হওয়ার পেছনে তিনটি কারণ প্রধান হয়ে দাঁড়াতে পারে।
প্রথমত, নিজের বা পরিবারের আর্থিক অসঙ্গতি। অনেক শিক্ষার্থীই নিজে টিউশন বা অন্যান্য পার্ট-টাইম চাকরি করে পড়াশোনার খরচ জোগাড় করে। করোনার কারণে তারা টিউশন বা চাকরি হারিয়েছে। কবে আবার সেগুলো ফিরে পাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। পকেটে টাকা না থাকলে কীভাবে তারা শিক্ষাজীবন অব্যাহত রাখবে?
এদিকে পরিবার কর্তৃক প্রদত্ত খরচের উপর যারা নির্ভরশীল, তারাও অভিন্ন কারণে পড়াশোনা ছাড়তে বাধ্য হতে পারে। বিশেষত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি টিউশন ফি না কমায় বা কোনো বিশেষ বিবেচনা না করে, তাহলে অনেক শিক্ষার্থীরই আর কোনো উপায় থাকবে না। বরং নেমে পড়তে হবে পরিবারকে সহযোগিতায়।
দ্বিতীয়ত, বিয়ে কিংবা বিদেশ গমনের ফলেও অনেকের শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটতে পারে। মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ের সম্ভাবনাই বেশি। অনেক অভিভাবকই হয়তো বিদ্যমান অর্থনৈতিক দুরবস্থায় মেয়েকে আর না পড়াশোনা না করিয়ে ‘সৎপাত্রে তুলে দেয়া’কে শ্রেয় মনে করবে।
এদিকে ছেলেদের বেলায় দেশে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বলে বিদেশে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এবং বিদেশে যে পড়াশোনার চেয়ে কাজ করতে যাওয়ার প্রবণতাই থাকবে বেশি, সে কথা বলাই বাহুল্য।
তৃতীয়ত, দীর্ঘদিন পড়াশোনা থেকে দূরে থাকা। হ্যাঁ, অন্যান্য স্তরের শিক্ষার্থীদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্যও এটি হতে পারে একটি বড় কারণ ঝরে যাওয়ার পেছনে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে এমনিতেও অনেক শিক্ষার্থী আর পড়াশোনাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না। কেউ জড়িয়ে পড়ে রাজনীতিতে, আবার কেউ ব্যস্ত হয় পার্ট-টাইম বা ফুল-টাইম চাকরিতে। ক্যাম্পাসে ফিরে গিয়েও তারা হয়তো ক্লাসে মনোনিবেশের বদলে ওগুলোকেই গুরুত্ব দেবে বেশি। ফলে ধীরে ধীরে একসময় পড়াশোনাকে চূড়ান্ত বিদায়ও বলে দিতে পারে।
তো এই হলো করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ চিত্র। অবশ্যই এসব বাস্তবতা এড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে সে ধরনের নানা ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই নেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে অনলাইনে পাঠদানের ধারণাটি তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আমাদের বাংলাদেশেও এ নিয়ে কমবেশি কথাবার্তা হচ্ছে, এবং অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এ প্রক্রিয়ায় পাঠদান চালুও করেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ পদ্ধতিতে পড়াশোনা কি দেশের সকল শিক্ষার্থীর পক্ষে সম্ভব? মোটেই না। কেননা অনলাইনে পড়াশোনার প্রয়োজনীয় উপকরণই যে শিক্ষার্থীদের কাছে নেই। ভুলে গেলে চলবে না, দেশের ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী টিভি দেখেই পড়াশোনা করেনি। সেখানে অনলাইনে ক্লাস করা কি এতই সোজা? দেশে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর ব্যাপক প্রসার হয়েছে বটে, কিন্তু অনলাইনে পড়াশোনা করতে দরকার ভালো কম্পিউটার কিংবা অন্ততপক্ষে ট্যাবলেট। এবং সেই সাথে উচ্চগতির ইন্টারনেটও। সে ব্যবস্থা কি দেশের সর্বত্র আছে? তা তো নেই।
কম্পিউটার বা ট্যাব কেনার সামর্থ্য বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরই নেই। আর থাকলেও ইন্টারনেটের দৈন্যদশা যে আরো বড় বাধা। শহরাঞ্চলে হয়তো ইন্টারনেট ভালোই পাওয়া যায়, যেহেতু ব্রডব্যান্ড সুবিধা রয়েছে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেটের অবস্থা এত বাজে যে, তা কাজে লাগিয়ে পড়াশোনার কথা চিন্তাও করা যায় না।
অনেক শিক্ষাবিদ আবার বিকল্প পাঠদান ব্যবস্থার কথা বলছেন, যেখানে বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং এনজিওগুলোকে কাজে লাগানোর পরামর্শ তারা দিয়েছেন। তবে ঠিক কোন ছকে তারা এ কাজটি করতে বলছেন, তা এখনো পরিষ্কার নয়। এদিকে অনলাইন মাধ্যম ছাড়াও সরকার অন্যভাবে শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তাভাবনা করছে। আমাদের এখন আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করতে হবে, শিক্ষার্থীবান্ধব কোনো পথ যেন বের হয়ে আসে।
এই দীর্ঘ আলোচনা শেষ করা যাক সিংহভাগ লোকের মূল আগ্রহের বিষয়টি দিয়েই। তা হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খুলবে? ১৫ জুনের পর কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা উচিত? এই মুহূর্তে দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার উভয়ই ঊর্ধ্বমুখী। ফলে জুন মাসটাকে মনে করা হচ্ছে টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে। এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়াটা হবে নিতান্তই আত্মবিধ্বংসী একটি সিদ্ধান্ত। এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, শিক্ষাব্যবস্থার দায়িত্বে থাকা দুই মন্ত্রণালয়ের নীতি-নির্ধারকরাও এখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার বিপক্ষে। যতদিন পর্যন্ত দেশে করোনা পরিস্থিতি নাগালে না আসে, ততদিন পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ব্যাপারেই তাদের অভিমত।
তাছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফ থেকে আসা দিকনির্দেশনাও অদূর ভবিষ্যতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার বিপক্ষে ইঙ্গিত দিচ্ছে। কেননা সেই দিকনির্দেশনায় বলা হয়েছে, প্রতিটি শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে বাধ্যতামূলক মাস্ক দিয়েই কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যাবে। সেক্ষেত্রে আমাদের দেশে কোটি কোটি মাস্ক প্রয়োজন হবে। দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, সেই প্রস্তুতি এখনো আমাদের নেই।
তাই ‘কবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে’ এই আলোচনাতেই শুধু পড়ে না থেকে, আমাদের আরো চিন্তার বিষয় হওয়া উচিত, করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যে মহাদুর্যোগ আসন্ন, সেটিকে কীভাবে মোকাবেলা করা যাবে। হুট করে অথৈ জলে পড়লে, টিকে থাকাটা বড্ড মুশকিল হয়ে যাবে।