প্রতিবছর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের দিকটায় এদেশের অনেক মানুষকে এক অজানা উৎকণ্ঠায় দিন কাটাতে হয়। কারণ এ সময়টাতেই প্রতিবছর শুরু হয় অধিকাংশ পাবলিক ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষের ক্লাস। কিন্তু সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ্যসূচি, শিক্ষক বা আনুষঙ্গিক বিষয়াদি নয়, সবচেয়ে বড় ভয়ের বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয় যেটি, সেটি হলো র্যাগিং।
প্রতিবছর এমন অন্তত একটি-দুটি সংবাদ আমরা পেয়েই থাকি, যেখানে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়রদের কাছ থেকে র্যাগিংয়ের নামে প্রচন্ড রকম হেনস্তার শিকার হয়েছে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। এর ফলে কেউ কেউ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে, কেউ আবার অপমানে আত্মহত্যার চিন্তাভাবনাও করতে থাকে। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, এতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ব্যাপারে মনের মাঝে যেসব রঙিন স্বপ্নের আঁকিবুকি কেটে এসেছে তারা, সেগুলো এক ফুঁৎকারে উড়ে যায়। ডিপ্রেশন নামক মানসিক রোগটির সাথে তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পরই পরিচিত হয় অধিকাংশ শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কথা শিক্ষার্থীদের জন্য নিজেদের প্রকাশ করার বাঁধাহীন মুক্তমঞ্চ, কিন্তু এখানে এসেই তাদেরকে হতে হয় একপ্রকার মানসিক দাসত্বের নিগড়ে বন্দি।
খুব বেশি পেছনে ফিরে তাকাব না। এই তো, মাত্র কিছুদিন আগেই, গত ২ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ধ্যা সাতটা থেকে দশটা পর্যন্ত র্যাগিংয়ের নামে মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার চালানো হয় দুই প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীর উপর। সেই ঘটনার আবার ভিডিওচিত্রও ধারণ করা হয় এবং অনলাইনে প্রকাশ করা হয়, যা পরবর্তীতে ভাইরাল হয়ে যায়। এবং ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছিল বলেই, এর সাথে সংস্লিষ্ট ছয়জন দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীকে চিহ্নিত করে বহিষ্কার করতে পেরেছে বিশ্ববিদালয় প্রশাসন।
কিংবা যদি ফিরে যাই আরো এক বছর আগে। ২০১৮ সালে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন র্যাগিংয়ের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রচারের ফলে আলোচনায় এসেছিল। শাবিপ্রবিতে ছয় নবীন শিক্ষার্থীকে র্যাগিংয়ের নামে অর্ধনগ্ন করে শৌচাগারে সেলফি তুলতে বাধ্য করার অভিযোগে সাময়িক বহিষ্কার করা হয় পাঁচ শিক্ষার্থীকে। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক নবীন শিক্ষার্থী ‘বড় ভাইদের’ হাতে এতটাই শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহের শিকার হয়েছিল যে, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল সে; চিনতে পারছিল না এমনকি নিজের নিজের বাবা ও আত্মীয়স্বজনদেরকেও।
এখানে একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, উপরে যে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলা হয়েছে, শুধু সেগুলোতেই কিন্তু র্যাগিংয়ের ঘটনা ঘটে না। এমন ঘটনা কমবেশি ঘটে থাকে দেশের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই, হোক তা পাবলিক কিংবা প্রাইভেট। উপরোক্ত তিনটি ঘটনার মধ্যে দুটি অনলাইনে ভাইরাল হয়েছিল, এবং অন্যটিতে র্যাগিংয়ের শিকার শিক্ষার্থীটির অবস্থা পর্যুদস্ত হয়ে উঠেছিল, যে কারণে ঘটনাগুলো পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছিল।
কিন্তু কোনো রকম সন্দেহের অবকাশ না রেখেই বলা যায়, প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন ছোট-বড় র্যাগিংয়ের ঘটনা হাজার হাজার ঘটে থাকে। প্রকাশ্যে আসে না বলেই সেগুলো আমাদের অজানা থেকে যায়। কিন্তু তলে তলে এর বিরূপ প্রভাব ঠিকই পড়তে থাকে সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকা শিক্ষার্থীদের উপর। কেউ কেউ আবার এগুলোকে মেনেও নিতে শিখে যায়। আর সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, কারো কারো কাছে এগুলোকেই অতি স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে হয়, যে কারণে পরের বছর সিনিয়র হওয়ার পর তারা নিজেরাও জুনিয়র শিক্ষার্থীদেরকে র্যাগ দিতে শুরু করে। এভাবে র্যাগিং নামক ভয়াবহ সংস্কৃতিটি উত্তরাধিকারসূত্রে এক বর্ষের শিক্ষার্থীদের থেকে অন্য বর্ষের শিক্ষার্থীদের হাতে হস্তান্তর হতে থাকে। এটি অনেকটা যেন এমন একটি চক্র, যার শুরু হয়েছিল কোনো একদিন ঠিকই, কিন্তু শেষ আছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না।
র্যাগিং কী?
র্যাগিং কী, সে বিষয়ে নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এটি হলো বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে প্রচলিত এমন একটি ‘পরিচিতি বা দীক্ষা পর্ব’, যার মূল লক্ষ্যই থাকে প্রবীণ শিক্ষার্থী কর্তৃক নবীন শিক্ষার্থীদেরকে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা। একাধারে যেমন তাদেরকে মৌখিক গালিগালাজ করা হয় (বাবা-মা তুলে, যে জেলা থেকে এসেছে সেই জেলাকে হেয় করে), বিভিন্ন অপমানজনক কাজ করতে বাধ্য করা হয়, বিভিন্ন দুঃসাহসী কাজ করতে বলা হয় (যেমন- সিনিয়র কাউকে ভালোবাসার প্রস্তাব দেয়া, শীতের রাতে পুকুরে নেমে গোসল করে আসা ইত্যাদি), তেমনই সরাসরি তাদের গায়ে হাতও তোলা হয়। র্যাগিং মূলত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে, অর্থাৎ ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলংকা প্রভৃতি দেশে প্রচলিত রয়েছে। তবে অনুরূপ সংস্কৃতি বিশ্বের আরো অনেক দেশেই বিদ্যামান। যেমন- উত্তর আমেরিকার দেশগুলোতে একে বলা হয় ‘হেজিং’, ফ্রান্সে ‘বিজুটাহে’, পর্তুগালে ‘প্রায়ে’, অস্ট্রেলিয়ায় ‘বাস্টার্ডাইজেশন’ ইত্যাদি।
র্যাগিংয়ের উদ্ভব
কেউ যেন মনে করবেন না র্যাগিং সংস্কৃতির উদ্ভব হাল আমলে। কারণ সেই খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম বা অষ্টম শতক থেকেই র্যাগিংয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান। এবং তখন এটি অন্তর্ভুক্ত ছিল গ্রিক সংস্কৃতির। কোনো ক্রীড়া সম্প্রদায়ে নতুন খেলোয়াড় বা শিক্ষার্থীদের আগমন ঘটলে, তার ভেতর কতটুকু একতা রয়েছে তা ঝালাই করে নিতে, এবং তার মধ্যে ‘টিম স্পিরিট’-এর বীজ বপন করে দিতে, প্রবীণরা মিলে তাকে নানাভাবে উপহাস করত, তার নানা পরীক্ষা নিত, তার শারীরিক ও মানসিক শক্তি যাচাই করত। সময়ের সাথে সাথে এই প্রক্রিয়ায় অনেক পরিবর্তন আসে। একপর্যায়ে সৈন্যদলগুলো এই পদ্ধতিটি অনুসরণ শুরু করে, যেখান থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে এটির প্রবেশ ঘটেছে।
শিক্ষাঙ্গনে র্যাগিংয়ের প্রবেশ
শিক্ষাঙ্গনে র্যাগিং প্রবেশ করার পরও দীর্ঘদিন এটি বিভিন্ন অদল-বদল ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, এবং তারপর ধীরে ধীরে এটি একটি সাংগঠনিক ‘ক্যাম্পাস সহিংসতা’র রূপ ধারণ করে।
শুরুতে র্যাগিংয়ের নামকরণ করা হতো বিভিন্ন গ্রিক বর্ণ, যেমন- আলফা, ফি, বিটা, কাপা, এপসাইলন, ডেল্টা প্রভৃতির নামানুসারে, এবং এদেরকে বলা হতো গ্রিক লেটার অর্গানাইজেশন বা ফ্র্যাটার্নিটি। এসব ফ্র্যাটার্নিটিতে আসা নবীনদেরকে বলা হতো প্লেজেস (PLEDGES)। শুরুর দিকে র্যাগিংয়ের ছিল একদমই প্রাথমিক রূপ। প্লেজেসদেরকে কেবল কিছু সাহসিকতা, শারীরিক সক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তার পরীক্ষা নিয়েই ছেড়ে দেয়া হতো। কিন্তু একপর্যায়ে এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কোনো একসময় যেটি ছিল কেবলই প্রবীণদের সাথে নবীনদের বন্ধন সুদৃঢ় করার একটি উপায় মাত্র, সেটিই এবার পেয়ে যায় প্রাণঘাতি রূপ।
র্যাগিংয়ের কারণে প্রথম মৃত্যু
র্যাগিংয়ের কারণে মারা যাওয়া প্রথম শিক্ষার্থী হলেন মর্টিমার লেগেট। আমেরিকান গৃহযুদ্ধের এক বিখ্যাত জেনারেলের সন্তান ছিলেন তিনি। ১৮৭৩ সালে নিউ ইয়র্কের কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে প্রথম সেমিস্টারে ভর্তি হওয়ার পর তিনি অন্তর্ভুক্ত হন র্যাগিংয়ের কাপা আলফা ফ্র্যাটার্নিটিতে। এক রাতে, সেই ফ্র্যাটার্নিটির দীক্ষা পর্বের অংশ হিসেবে, তাকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় জঙ্গলে। তার করণীয় ছিল পথ চিনে ইথাকায় অবস্থিত চ্যাপ্টার হাউজে ফিরে আসা। নিয়ম অনুযায়ী, ফ্র্যাটার্নিটির অন্য দুই নবীনের সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার পর তারা তার চোখ খুলে দেন। এরপর তারা তিনজন মিলে একটি ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করেন, নিকটবর্তী কোনো রাস্তায় গিয়ে ওঠা যায় কি না, সেই আশায়। কিন্তু খুব বড় ভুল করে ফেলেছিল তারা। যেটিকে তারা ঢাল বলে মনে করেছিল, যেটি আসলে ছিল ৩৭ ফুট উচ্চতার খাড়া পাহাড়ের দেয়াল। একপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একদম নিচে গিয়ে পড়েন মর্টিমার। শক্ত পাথরের উপর পড়ে তার শরীরটা পুরোপুরি থেতলে যায়। তার সঙ্গী দুজনও আহত হয়েছিলেন বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রাণে বাঁচেন তারা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভূমিকা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর র্যাগিং সংস্কৃতিতে এক বিশাল পরিবর্তন আসে, এবং এটি আগের থেকে আরো বেশি ভয়াবহ, সহিংস ও নৃশংস হয়ে ওঠে। যুদ্ধ চলাকালীন অনেকেই সৈন্যদলে নাম লিখিয়েছিল, এবং সেখানে তারা অনেক কঠিন কঠিন রীতিনীতির সাথে পরিচিত হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে যখন তারা আবার কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এলো, তারা চিন্তা করল সৈন্যদলে শেখা রীতিনীতিগুলোকেই এবার প্রাতিষ্ঠানিক র্যাগিংয়ের অন্তর্ভুক্ত করার। এবং এভাবেই বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ র্যাগিংয়ের অংশ হয়ে উঠলো। কিন্তু যুদ্ধ চলাকালীন সৈন্যদলে যেসব রীতিনীতি মানতে হতো, সেগুলোর প্রয়োজনীয়তা ছিল দলের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করা, কঠিন কোনো মিশনে যাওয়ার জন্য তারা উপযুক্ত কি না তা যাচাই করা। কিন্তু নন-মিলিটারি শিক্ষার্থীরা যখন এসব রীতিনীতির সাথে পরিচিত হলো, তারা এগুলোর কার্যকারিতা না জেনেই যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু করে দিল। সেজন্য এখন র্যাগিংয়ের নামে শিক্ষার্থীদেরকে এমন কঠিন কঠিন সব কাজ করতে দেয়া হয়, যার সাথে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো সম্পর্কই নেই।
ভারতবর্ষে যেভাবে এলো র্যাগিং সংস্কৃতি
ইংরেজ শিক্ষা ভারতবর্ষের শিক্ষার্থীদের সামনে নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেছে ঠিকই, কিন্তু একইসাথে সেটি এখানে র্যাগিং সংস্কৃতির আমদানিও করেছে। প্রথমে ভারতবর্ষের সৈন্যদল ও ইংরেজি স্কুলগুলোতে র্যাগিং আসে। তবে র্যাগিং তার ভয়াবহ রূপ ধারণ করে স্বাধীনতারও অনেক পরে।
ভারতবর্ষে এমনকি গত শতাব্দীর ৬০’র দশকের শেষ ভাগ পর্যন্তও র্যাগিং বিশেষ কোনো সমস্যা ছিল না। একে কেবল সিনিয়র-জুনিয়রের মধ্যকার পরিচিতি, সম্পর্ক গঠন এবং হাসিঠাট্টার একটি প্রক্রিয়া বলেই মনে করা হতো। এর অপব্যবহার তখনও শুরু হয়নি। কারণ তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজের সর্বস্তরের ছেলেমেয়েরা পড়তে শুরু করেনি। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরাই ছিল সমাজের অভিজাত স্তরের। আর মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত শ্রেণীর যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসত, তাদের কাছেও র্যাগিং শ্রেণীর কোনো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত মাথা ঘামানোর চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মন দিয়ে ক্যারিয়ার গঠনই বেশি জরুরি ছিল।
সমস্যার সূচনা ঘটল উচ্চশিক্ষার দ্বার সমাজের সর্বস্তরের মাঝে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে। উচ্চশিক্ষা সহজ থেকে সহজতর হতে থাকায়, এর মূল্য যেন কমতে শুরু করল। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলে শিক্ষার্থীরা সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করত। কিন্তু পরবর্তীতে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, প্রতিটি ব্যাচেই এমন কিছু শিক্ষার্থী দেখা যেতই, যাদের কাছে মনে হতো: বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারা মানেই জীবনের চূড়ান্ত সাফল্য লাভ হয়ে গেছে, এখন আর নতুন করে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছু শেখার নেই। এ ধরনের শিক্ষার্থীরাই র্যাগিং সংস্কৃতিটাকে বর্তমানের ভয়াবহ রূপে নিয়ে আসতে শুরু করল। তারা নিজেরা ক্লাস-পরীক্ষা ইত্যাদির পরোয়া করত না, আর তাই অন্যদেরকেও এমনটিই মনে করত। অন্য আর সবকিছুর চেয়ে, র্যাগিংয়ের মাধ্যমে জুনিয়রদেরকে ‘ভদ্রতা শেখানো’-ই তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, বর্তমান সময়েও যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিং নিয়ে বেশি মাতামাতি করে, তাদের মানসিকতাও ঠিক একই রকম।
ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা
র্যাগিং সংস্কৃতি যে আজকের এই কলুষিত অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেটির পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষয়িষ্ণু ছাত্র রাজনীতির বড় ভূমিকা রয়েছে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, আজকের দিনে র্যাগিংয়ে যারা নেতৃত্ব দেয়, তাদের অধিকাংশ কিন্তু শুধু সিনিয়র বড় ভাইয়া বা আপুই নয়, তাদের আরো বড় একটি পরিচয় আছে: তারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনটির সদস্য। এর ফলে র্যাগিং প্রতিহত করা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দুরূহ হয়ে পড়েছে। যারা র্যাগিং করে, তারা আবার ছাত্র রাজনীতিও করে। তাই তারা নিজেদেরকে অনেক ক্ষমতাবান মনে করে। তারা চিন্তা করে, আমাদের পেছনে একটি রাজনৈতিক দলের ‘ব্যাক আপ’ রয়েছে, তাই আমরা যা-খুশি-তাই করতে পারি। এমন মানসিকতা থেকেই অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংকে আরো এক ধাপ উপরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেটির নাম দেয়া হয়েছে ‘গেস্ট-রুম কালচার’। এটি যদিও সরাসরি ক্যাম্পাস-ভিত্তিক নয়, বরং বিভিন্ন হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদেরকে এই বিশেষ র্যাগিংয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
শিক্ষার্থীদের মানসিকতা
মজার ব্যাপার হলো, অনেক শিক্ষার্থীই র্যাগিং নামক জিনিসটির সাথে মানিয়ে নেয়। প্রথম বর্ষে তারা মুখ বুজে র্যাগিং সহ্য করে, এবং এক বছরের সিনিয়র হয়ে যাওয়ার পর তারা নিজেরাও জুনিয়রদেরকে র্যাগ দিতে শুরু করে। এর পেছনে কিছু সাধারণ মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়:
- অনেক শিক্ষার্থী মনে করে, আমরা যেহেতু র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছি, তাই আমাদের জুনিয়রদেরকেও আমরা র্যাগ দেব।
- অনেকেই আবার মনে করে, র্যাগিং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেরই অংশ। ভবিষ্যৎ কর্মজীবনে যেসব প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হবে, র্যাগিংয়ের মাধ্যমে সেগুলোর সাথে আগাম পরিচিত হয়ে যাওয়া যায়।
- আবার কেউ কেউ মনে করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের যেন ডানা গজায়। সেই ডানা ছেঁটে দিতে, এবং তাদেরকে ভদ্রতা শেখাতে র্যাগিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। বরং র্যাগিং হলো তাদের জন্য একটি ‘রিয়েলিটি চেক’।
২০১৭ সালে ভারতে একটি জরিপ চালানো হয়েছিল, যার বিষয়বস্তু ছিল র্যাগিং বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মানসিকতা। সেখানে দেখা গিয়েছিল, ৩৬% শিক্ষার্থীই বিশ্বাস করে র্যাগিং তাদেরকে ভবিষ্যৎ জীবনের কঠিন বাস্তবতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ৪৫% শিক্ষার্থী বলেছিল, শুরুতে তাদের র্যাগিংয়ের শিকার হতে খারাপ লেগেছিল বটে, তবে একপর্যায়ে তাদের মনে হয়েছিল সব ঠিকই আছে। ৩৩% শিক্ষার্থী বলেছিল, র্যাগিংয়ের অভিজ্ঞতা তাদের কাছে উপভোগ্য ছিল। আর ৮৪% শিক্ষার্থী বলেছিল, র্যাগিংয়ের শিকার হয়েও কখনো কারো কাছে তারা এ বিষয়ে অভিযোগ জানায়নি। যদিও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মানসিকতা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে এখন পর্যন্ত এ ধরনের গবেষণা হয়নি, তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো থেকে একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় যে, কোনো শিক্ষার্থী মাত্রাতিরিক্ত র্যাগিংয়ের শিকার হলে সবাই সেটির বিপক্ষে অবস্থান নেয় ঠিকই, কিন্তু সাধারণ অবস্থায় র্যাগিংয়ের প্রয়োজনীয়তা আছে কি নেই, এমন প্রশ্নের জবাবে অনেকেই র্যাগিংকে সমর্থন দেয়।
র্যাগিংয়ের শাস্তি
যেমনটি আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি, র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো সুনির্দিষ্ট শাস্তির ব্যবস্থা নেই। কেবলমাত্র কোনো শিক্ষার্থীর র্যাগিংয়ের শিকার হওয়ার খবর নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলে, তখন অভিযুক্তদের বহিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের দায়িত্ব সারে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত র্যাগিংকে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধের আওতায় আনা না হবে, এবং প্রতিটি বিভাগ থেকে র্যাগিং-বিরোধী প্রচারণা চালানো না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত র্যাগিং পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হবে না।
এদিক থেকে ভারত কিছুটা হলেও ভালো অবস্থানে আছে। সাম্প্রতিক অতীতে র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে সেখানে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হওয়ায়, ২০০৯ সালে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশ দিয়েছে র্যাগিং বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার। এছাড়া তারা একটি টোল ফ্রি হেল্পলাইনও চালু করেছে, যেখানে কল করে র্যাগিংয়ের শিকার হওয়া শিক্ষার্থীরা নিজেদের অভিযোগ জানাতে পারে, যাতে করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে।
শেষ কথা
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আবেগের জোয়ারে ভেসে না গিয়ে একটি নিয়মতান্ত্রিক জীবনের অনুসারী হওয়া প্রয়োজন। ক্যাম্পাস ও হলের সিনিয়রদের থেকে শুরু করে নিজের ও বাইরের বিভাগের সকল শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়াও একান্ত জরুরি। কিন্তু এগুলো শেখানোর নাম করে কোনো শিক্ষার্থীকে র্যাগ দেয়া, তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্ক হওয়া উচিৎ পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসা ও স্নেহের। কিন্তু কারো কাছ থেকে জোরপূর্বক সম্মান আদায় করতে তাকে ভয় দেখানো বা তার গায়ে হাত তোলা কোনো সঠিক পথ হতে পারে না। আর তাই র্যাগিং সংস্কৃতি বন্ধ হওয়া এখন সময়ের দাবি। অন্যথায় কত সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীই যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পরিবেশের বিরূপ পরিবেশ সহ্য করতে না পেরে আমাদের অগোচরে ঝরে যাবে, তা আমরা কোনোদিন জানতেও পারব না।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/