মনে করুন, আপনি চুরি করতে গিয়ে হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। মন খারাপ করবেন না, কারণ আপনার চুরির সঙ্গী হিসেবে আমিও ছিলাম এবং আমিও আপনার সাথে গ্রেপ্তার হয়ে গেছি। আমাদের দুজনের বিরুদ্ধেই অভিযোগ মোটামুটি এক। বিচারেও দুজনেরই একইরকম শাস্তি হবে। কিন্তু পুলিশের ধারণা, আমরা আরো বড় কোনো অপরাধের সাথে জড়িত। গত সপ্তাহে চৌধুরী বাড়ি থেকে যে ২০ লাখ টাকার গয়না চুরি হয়েছিল, পুলিশের ধারণা সেটাও আমাদেরই কাজ। কিন্তু পুলিশের কাছে যেহেতু কোনো প্রমাণ নেই, তাই স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য তারা আমাকে এবং আপনাকে ভিন্ন ভিন্ন দুটি কক্ষে বন্দী করে পৃথক পৃথকভাবে একইরকম প্রস্তাব দিল।
পুলিশ প্রথমে আপনার কাছে গিয়ে বলল, আপনি যদি আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন, তাহলে আপনাকে বিনা বিচারে ছেড়ে দেওয়া হবে, কিন্তু আপনার সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে আমার ৩ বছরের জেল হয়ে যাবে। অন্যদিকে আপনি যদি চুপ থাকেন, এবং উল্টো আমিই আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে দিই, তাহলে আপনার ৩ বছরের জেল হয়ে যাবে, আর আমি বিনা বিচারে ছাড়া পেয়ে যাব। যদি আপনি এবং আমি দুজনই দুইজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিই, তাহলে উভয়ের ২ বছরের কারাদণ্ড হবে। আর যদি দুজনের কেউই কারো সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করি, তাহলে উভয়ের ১ বছরের কারাদণ্ড হবে।
শুনতে খুব বেশি জটিল মনে হতে পারে, কিন্তু উপরের চিত্রটি যদি লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখতে পারবেন শর্তগুলো আসলে খুবই সহজ। সমস্যা হচ্ছে, পুলিশ যেহেতু আমাকে এবং আপনাকে ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে বন্দী করেছে , তাই আমাদের একজনের পক্ষে জানা সম্ভব না অন্যজন কী সিদ্ধান্ত নেবে। অথচ আমাদের ভাগ্য শুধু নিজেদের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে না, নির্ভর করবে একইসাথে অপরজন কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তার উপরও। এখন আপনি যদি আসলেই কখনো এরকম পরিস্থিতিতে পড়েন, তাহলে কী করবেন? আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেন? নাকি চুপ করে থাকবেন? কোনটা আপনার জন্য বেশি লাভজনক হবে?
সাধারণভাবে মনে হতে পারে, চুপ করে থাকাটাই হয়তো উভয়ের জন্য ভালো। সেক্ষেত্রে তেমন কোনো ঝুঁকি না নিয়ে উভয়েই মাত্র ১ বছর জেল খেটে বেরিয়ে যেতে পারব। অন্যের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে গেলে একটা সম্ভাবনা আছে বিনা বিচারে মাফ পেয়ে যাওয়ার, কিন্তু তাতে ঝুঁকিও আছে। সেক্ষেত্রে আপনি হয়ত চুপ করে থাকতেই আগ্রহী হবেন। কিন্তু যেহেতু আমিও চোর, তাই আমার উপর কি আপনি ভরসা রাখতে পারবেন? কী নিশ্চয়তা আছে যে, আমিও আপনার মতোই চুপ করে থাকব? হয়ত আমি বেশি লোভ করে আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে বসব! সেক্ষেত্রে আপনাকে ৩ বছর পর্যন্ত জেলে পচতে হবে।
আপনি যদি ঠান্ডা মাথায় প্রতিটি সম্ভাবনা বিবেচনা করেন, তাহলে দেখতে পাবেন, চুপ করে থাকাটা উভয়ের জন্য ভালো মনে হলেও বাস্তবে প্রত্যেকে যদি নিজের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে, তাহলে অপরের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়াটাই প্রতিটি ক্ষেত্রে লাভজনক। ধরুন, আমি চুপ করে রইলাম। সেক্ষেত্রে আপনিও যদি চুপ থাকেন, তাহলে আপনার শাস্তি হবে ১ বছর। আর যদি আপনি আমার সাথে প্রতারণা করেন, তাহলে আপনার শাস্তি হবে ০ বছর। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আমার সাথে প্রতারণা করাই আপনার জন্য শ্রেয়। এবার ধরুন, আমি আপনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলাম। এখন আপনি যদি চুপ করে থাকেন, তাহলে আপনার শাস্তি হবে ৩ বছর। অন্যদিকে আপনিও যদি আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন, তাহলে আপনার শাস্তি হবে ২ বছর। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়াই আপনার জন্য লাভজনক।
একই শর্ত বিপরীতভাবে আমার জন্যও সত্য। অর্থাৎ এরকম পরিস্থিতিতে বিপরীত পক্ষ যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন, সবক্ষেত্রেই প্রতারণা করে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়াই নিজের জন্য লাভজনক। সামগ্রিকভাবে উভয়ের জন্য এটা সবেচয়ে ভালো ফলাফল না, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকের জন্য এটাই সর্বোত্তম ফলাফল। তাই বাস্তব জীবনে যদি প্রতিপক্ষের সাথে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকে, অথবা প্রতিপক্ষের উপর যথেষ্ট আস্থা এবং বিশ্বাস না থাকে, তাহলে অধিকাংশ মানুষই এই পথই বেছে নেবে।
এই সমস্যাটিকে বলা প্রিজনারর্স ডাইলেমা বা কারাবন্দীর দ্বন্দ্ব, যা গেম থিওরির একটি বহুল ব্যবহৃত উদাহরণ। গেম থিওরী মূলত যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংঘর্ষ এবং সহযোগিতার একটি গাণিতিক মডেল। এটি বাস্তব জীবনে অর্থনীতি, রাজনীতিসহ অসংখ্য ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি বিভিন্ন জটিল পরিস্থিতিতে মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে বুঝতে সাহায্য করে। গেম থিওরিতে অসহযোগিতামূলক প্রতিযোগিতায় উভয় পক্ষ যখন এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যেটা সামগ্রিকভাবে সর্বোত্তম সমাধান না হলেও উভয়ের জন্য ভারসাম্যমূলক সমাধান, তখন তাকে ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়াম বলা হয়। উপরের উদাহরণে পরস্পরের সাথে প্রতারণা করে ২ বছর জেল খাটলে সেটাই হবে ন্যাশ ইকুইলিব্রিয়াম বা ন্যাশ সাম্যাবস্থা।
বাস্তব জীবনে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে প্রিজনার্স ডাইলেমা কীভাবে ব্যবহৃত হতে পারে, তার একটি উদাহরণ আমরা বিবেচনা করতে পারি। ধরুন এমন একটি শহর আছে, যেখানে মোট ১০০ জন মানুষ বাস করে। এদের সবাই ধূমপায়ী এবং দিনে প্রত্যেকে এক প্যাকেট করে সিগারেট কেনে। এখন দুইটি সিগারেট কোম্পানী ঐ শহরে ব্যবসা করতে গেল। একটির ব্র্যান্ড নাম রেড স্ট্রাইক এবং অপরটির ব্র্যান্ড নাম স্মুথ ব্লু। যেহেতু তাদের সিগারেটের গুণগত মান একইরকম, তাই ঐ শহরের ৫০ জন মানুষ রেড স্ট্রাইক কেনে, আর বাকি ৫০ জন মানুষ কেনে স্মুথ ব্লু।
এখন কোনো একটি কোম্পানি যদি বেশি ব্যবসা করতে চায়, তাহলে তাকে বিজ্ঞাপন দিতে হবে। বিজ্ঞাপন দিলে বিক্রি বৃদ্ধি পাবে, কিন্তু বিজ্ঞাপন দিতে গেলে আবার খরচও বৃদ্ধি পাবে। সমস্যা শুধু এটাই না। যদি শুধু একটি কোম্পানি বিজ্ঞাপনের পেছনে খরচ করে, তাহলে তার বিক্রয় বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু যদি উভয়েই বিজ্ঞপনের পেছনে সমান অর্থ খরচ করে, তাহলে তাদের উভয়েরই বিক্রয় আবার আগের অনুপাতে ফিরে আসবে, মাঝখান থেকে বিজ্ঞাপনের পেছনে টাকা খরচ করতে গিয়ে তাদের মোট আয়ের পরিমাণ কমে যাবে।
গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ করতে চাইলে ধরা যাক, প্রতিটি সিগারেটের প্যাকেটের দাম ২ ডলার করে। ফলে স্বাভাবিকভাবে উভয় কোম্পানির দৈনিক আয় ৫০×২=১০০ ডলার। আরো ধরা যাক, বিজ্ঞাপনের পেছনে খরচ হয় ৩০ ডলার। কিন্তু যদি যেকোনো একটি কোম্পানি বিজ্ঞাপন দেয়, তাহলে বিজ্ঞাপন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ৮০ জন মানুষ ঐ কোম্পানির সিগারেট কেনে, অন্যদিকে মাত্র ২০ জন মানুষ অন্য কোম্পানির সিগারেট কেনে। এক্ষেত্রে দিন শেষে বিজ্ঞাপনের পেছনে অর্থ খরচ করা কোম্পানীর আয় হবে (৮০×২-৩০)=১৩০ ডলার। আর অপর কোম্পানীর আয় হবে ২০×২=৪০ ডলার। কিন্তু যদি দুই পক্ষই বিজ্ঞাপন দেয়, তাহলে তাদের উভয়ের আয় হবে (৫০×২-৩০)=৭০ ডলার।
প্রিজনার্স ডাইলেমার মতোই এখানেও যদি উভয়েই বেশি লোভ না করে বিজ্ঞাপনের পেছনে খরচ না করে, তাহলে উভয়ের সর্বোচ্চ ১০০ ডলার করে সম্মিলিতভাবে ২০০ ডলার আয় হবে, যা পুরো সিস্টেমের জন্য সবচেয়ে লাভজনক। কিন্তু উভয়েই সম্মিলিত লাভের চেয়ে নিজের লাভের কথা বেশি চিন্তা করবে। ফলে ১০০ ডলারের পরিবর্তে ১৩০ ডলার আয়ের লক্ষ্যে বিজ্ঞাপন দেবে। কিন্তু যদি অপর কোম্পানিও একই পদক্ষেপ নেয়, তাহলে উভয়ের আয় শেষপর্যন্ত মাত্র ৭০ ডলার করে মোট ১৪০ ডলারে গিয়ে ঠেকবে। এটি কারো জন্যই সর্বোচ্চ সম্ভাব্য আয় না, কিন্তু তারপরেও এটিই সাম্যাবস্থা।
তবে বাস্তব জীবনে কোম্পানীগুলো ইচ্ছে করলেই একে অন্যের সাথে সমঝোতায় যেতে পারে এবং বিজ্ঞাপনের পেছনে কোনো খরচ না করেই সর্বোচ্চ আয়ের সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু সবাই যে সবসময় কথা রাখবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। কেউ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে বিজ্ঞাপন দিলেই প্রতিপক্ষও পাল্টা বিজ্ঞাপন দিয়ে আবারও ন্যাশ সাম্যাবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
ফিচার ইমেজ- Market Realist