১৯৬৮ সাল, অলিম্পিকে ৮০ হাজার দর্শকের সামনে উচ্চ লাফের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন ডিক ফসবারি নামের তুলনামূলক অচেনা এক বালক। তখন পর্যন্ত ফসবারির খেলোয়াড়ি রেকর্ড খুব একটা ভালো নয়। ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতা থাকা সত্ত্বেও তার স্কুলের বাস্কেটবল দলে জায়গা পাননি। বাস্কেটবল ছাড়া অন্য খেলাধুলাতেও তার অবস্থা একই। খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি কোনো বিভাগেই। পরিশেষে, উচ্চ লাফ নিয়েই স্থির হলেন। কারণ উচ্চ লাফেই তিনি ছিলেন সবচেয়ে কম খারাপ। প্রথমবারের চেষ্টায় অনুমিতভাবেই নিজের স্থানীয় ক্লাবেই অলিম্পিকে যাওয়ার জন্য যে ন্যূনতম উচ্চতায় লাফ দেওয়া দরকার, সে উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেননি।
যা বলছিলাম, অলিম্পিকে সবাই প্রস্তুত। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করা দুর্বল শরীরের অধিকারী এই ২১ বছর বয়সী ছেলে নিশ্চয়ই গো-হারা হেরে কোনো মেডেল ছাড়াই ঘরে ফিরতে যাচ্ছে। কিন্তু না, এরপরে যা হলো সেটি হয়ে গেল ইতিহাস।
ফসবারি ফ্লপের আবিষ্কার
ফসবারি যে সময় অলিম্পিকে অংশ নিচ্ছিলেন, তার আগে উচ্চ লাফে বারের উপর দিয়ে পার হওয়ার সাধারণত তিনটি কৌশল ছিল; সিজর, ওয়েস্টার্ন রোল এবং স্ট্রাডল জাম্প। এই তিনটি পদ্ধতিরই একটি মিল হচ্ছে তিন কৌশলেই বার পার হওয়ার পরে খেলোয়াড়রা খুব ভালোভাবে মাটিতে দাঁড়াতে পারতো পায়ের উপর ভর করে। কিন্তু ফসবারি জানতেন, গতানুগতিক ধারায় প্রতিযোগিতা করলে অন্য তুখোড় খেলোয়াড়দের সাথে তিনি পেরে উঠবেনা। তার নতুন কিছু আবিষ্কার করা লাগবে এদের সাথে প্রতিযোগিতা করার জন্য।
এরপর তিনি যে কাজটি করলেন, সেটি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল। মুখ সামনের দিকে রেখে গতানুগতিক স্ট্রাডল জাম্পের পরিবর্তে ফসবারি পেছনের দিক সামনে রেখে উল্টো পায়ে ভর করে বার পার হন। সাথে সাথেই ফসবারি সংবাদ মাধ্যম এবং তার কোচের তীব্র সমালোচনার শিকার হন উল্টো পদ্ধতিতে লাফ দেওয়ার জন্য। স্থানীয় একটি পত্রিকা তো ফসবারিকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে অলস হাই জাম্পার’ হিসেবে অভিহিত করলো।
কিন্তু ফসবারি তার নিজের সিদ্ধান্তে ছিলেন অটল। খুব তাড়াতাড়ি তার আত্মবিশ্বাসের ফল পেলেন সবাইকে চমক লাগিয়ে দিয়ে। NCC চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে টিকেট পেয়ে গেলেন অলিম্পিকের মূল পর্বে অংশগ্রহণ করার। ১৯৬৮ সালের অলিম্পিক ছিল ফসবারির জন্য নিজের কৌশল সবাইকে দেখানোর মোক্ষম সুযোগ।
ফসবারি লাফ দেওয়ার আগে আরও তিনজন গতানুগতিক স্ট্রাডল জাম্প করে বার পার হলেন। তারপর আসলো সবুজ টপ, সাদা শর্টস আর এডিডাস ট্রেইনার পরা অজানা, অচেনা এক বালকের পালা। নিজের আবিষ্কৃত পন্থাতেই সফলভাবে বারের উপর দিয়ে পার হলেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এক অজানা অচেনা বালক থেকে হয়ে উঠলেন অলিম্পিকের ইতিহাসের প্রভাবশালী ক্রিড়াবিদদের একজন।
দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে ফসবারি তার উল্টো পদ্ধতিতেই ২.২৪ মিটার লাফিয়ে উঠে বিশ্ব রেকর্ড করে স্বর্ণ পদক জিতে নেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় অর্জন হচ্ছে, ফসবারি দীর্ঘ লাফের সংজ্ঞাই পুরোপুরি পাল্টে দেন চির দিনের জন্য। স্বর্ণপদক জেতার কয়েক বছর পরেই ফসবারি ফ্লপ হয়ে উঠে দীর্ঘ লাফের গতানুগতিক ধারা। ১৯৭২ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত প্রতিটি চ্যাম্পিয়নই সফলভাবে ফসবারি ফ্লপ ব্যবহার করেছেন। কে জানতো, এক গড়পড়তা ক্রিড়াবিদ জিতবেন অলিম্পিকে স্বর্ণপদক আর পুরো খেলাটিকেই পরির্তন করে দেবেন? নতুন কিছু করার চিন্তাভাবনাই ফসবারির সাফল্যের বড় কারণ ছিল। তবে আরও একটি জিনিস বড় অবদান রেখেছিলো, সেটি হচ্ছে তার আশেপাশের পরিবেশ।
পরিবেশই উদ্ভাবনের চালিকাশক্তি
১৯৬০ সালের আগে দীর্ঘ লাফের ক্ষেত্রে খেলোয়াড়রা লাফ দেওয়ার পরে শক্ত, কঠিন মাটিতে অথবা হালকা ফোমে অবতরণ করতে হতো। ফলে বার পার হওয়ার সব কৌশলে একটি জিনিস নিশ্চিত করতে হতো, সেটি হচ্ছে লাফ দেওয়ার পরে পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানো। কিন্তু সৌভাগ্যবশত ফসবারির স্কুল হালকা ফোমের বদলে মোটা নরম ফোম ব্যবহার করা শুরু করেছিলো। ফোম নরম থাকায় ফসবারি পায়ের উপর ভর না করেও বার পার হয়ে কীভাবে মাটিতে অবতরণ করা যায় সেই কৌশল বের করার চিন্তা করতে থাকেন। সেখান থেকেই তিনি পায়ের উপর ভর করার চিন্তা বাদ দিয়ে তার পিঠের উপর ভর করার কৌশল বের করেন।
এজন্যই উদ্ভাবন এবং সাফল্যের জন্য দরকার অনুকূল পরিবেশ। যদি নরম ফোমের ব্যবহার শুরু না হতো, তাহলে এদের কেউই এই নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে পারতেন না। নতুন পরিবেশ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে একটি সমস্যার নতুন সমাধান খুঁজতে।
কীভাবে নিজের জন্য নিজের ফসবারি ফ্লপ তৈরি করবেন
“যখন একটি ভালো আইডিয়া মাথায় আসে, আমার কাজ হলো সেটিকে আশেপাশে ছড়িয়ে দেওয়া; শুধু দেখার জন্য যে আশেপাশের মানুষ কী ভাবে, কী কথা বলে এটি নিয়ে। মানুষের কাছ থেকে আইডিয়াটিকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা, মানুষের অভিমত নেওয়াই আমার মূল উদ্দেশ্য”
– স্টিভ জবস
নিচে সহজ কিছু ধাপ বর্ণনা করা হলো, যেগুলো আপনাকে নতুন নতুন আইডিয়া তৈরিতে সাহায্য করবে।
নতুন সম্ভাবনার ব্যপারে নিজেকে উন্মুক্ত রাখুন
নিজের সৃজনশীলতার উন্নতি ঘটানোর প্রথম ধাপ হলো, বিশ্বাস করা যে, দুনিয়াতে কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই, আছে শুধু বিশ্বাস। সৃষ্টির শুরু থেকে চিন্তা করুন তো, কত নিয়ম জলের বানের মতো ভেসে গেছে নতুনত্বের আবির্ভাবে। শুধু ভাবুন-
- ফেসবুক, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সোশ্যাল মিডিয়া, তারা নিজস্ব কোনো কন্টেন্ট তৈরি করে না।
- উবার, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ট্যাক্সি সার্ভিস কোম্পানি, তাদের নিজস্ব কোনো ট্যাক্সি নেই।
- আলিবাবা, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কেনাবেচার দোকান, তাদের নিজস্ব কোনো মালামাল নেই।
অনিশ্চয়তা এবং অজ্ঞতাকে ধারণ করতে শিখুন। যদি পুরনো নিশ্চিত জিনিসের মাঝেই আপনার চিন্তাভাবনা আটকে রাখেন, তাহলে নতুন কিছু কীভাবে তৈরি করবেন? আপনার চারপাশের পরিবেশে কী কী পরিবর্তন হচ্ছে সেগুলোর দিকে নজর রাখুন।
নৈরাশ্যবাদিদের উপেক্ষা করুন
এটি অসম্ভব যে, আপনি নতুন কোনো আইডিয়া রাতারাতি তৈরি করে ফেলবেন। কোনো কিছু নিয়ে লেগে থাকা অর্থাৎ দৃঢ়তা এবং ধারাবাহিকতা অনেক বড় একটি ব্যাপার। নতুন কিছু করার আগে আপনার অনেক ভুল-ত্রুটির মধ্য দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় যখন এগিয়ে যাবেন তখন নিশ্চিত থাকুন, কেউ না কেউ আপনাকে হতাশার বাণী শোনাবে। আপনার আইডিয়াকে প্রত্যাখ্যান করবে, এমনকি আপনার সমালোচনা করতেও পিছপা হবে না। যদি নতুন কোনো আইডিয়া নিয়ে হতাশ হয়ে যান, তাহলে নিচের প্রেক্ষাপটগুলোর কথা চিন্তা করুন।
- টমাস আলভা এডিসন সফলভাবে বাল্ব বানানোর আগে ১০,০০০টি লাইট বাল্বের প্রোটো টাইপ বানিয়েছিলেন।
- আট বছর ধরে ‘আইডিয়া অফ স্পেশাল রিলেটিভিটির’ পরীক্ষার পর আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেভিটি প্রকাশ পেয়েছিলো, যেটিকে বিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্রেক-থ্রু ধরা হয়।
যে হয়তো আজকে আপনার সমালোচক, সে কাল আপনার সবচেয়ে বড় ভক্ত হয়ে যেতে পারে। সুতরাং নিজের উপর মনোবল রাখুন আর আপনার আইডিয়া নিয়ে কাজ করে যান।
নিজেকে ভুল প্রমাণ করুন
সৃজনশীলতার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে আমাদের বিশ্বাস, মানে বিশ্বাস করা যে “আমি সবসময়ই সঠিক।” যখন অভিজ্ঞ লোকজন আর কোচরা ফসবারির বিরুদ্ধে বলছিল, তাদের বিশ্বাস ছিল, তারাই সঠিক। এজন্য তারা নতুন আইডিয়া গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক ছিল। এই বাধা পেরুনোর একটি উপায় হচ্ছে, নিজের ধারণাকে নিজে চ্যালেঞ্জ করা। চারপাশে প্রমাণ খুঁজুন, যেগুলো আপনার সবজান্তা ধারণাকে ভেঙে দিতে পারে। এটি একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, যা আপনার আবেগ এবং মতামতের উপর ভিত্তি করে সংকীর্ণ মনস্তাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে আপনাকে বাধা দেবে। এটি আপনাকে আপনার ধারণা পরীক্ষা করতে এবং বিভ্রান্তিকর, উদ্ভাবনী ধারণাগুলো প্রকাশ করতে বাধ্য করবে।
নিজের প্রজ্ঞার উপর বিশ্বাস রাখুন
ফসবারি অলিম্পিকে স্বর্ণপদক পাওয়ার পর সবাই বলাবলি শুরু করে যে, সে প্রথম থেকেই মেধাবী ছিল; কারণ সে গণিত এবং স্কুলে পড়ালেখায় খুব ভালো ছিল। কিন্তু সে ‘ফসবারি ফ্লপ’ আবিষ্কার করতে পেরেছে শুধু মেধার জোরেই নয়, বরং তার নিজের উপর বিশ্বাস থেকেই। সবাই যখন তাকে নিয়ে হাসাহাসি করেছিল এবং সমালোচনা করেছিল, সে নিজের উপর বিশ্বাস রেখেছিল।
“আপনারা পড়ে থাকবেন যে, আমি একজন শরীরচর্চাকারী, আমি একজন পদার্থবিজ্ঞানী। একদিন আমি টেবিলে বসেছি আর নতুনভাবে লাফ দেওয়ার কৌশল আবিষ্কার করেছি। কিন্তু এগুলোর কোনটিই সত্য নয়। আমি আমার শৈলী পরিবর্তন করিনি। বরং এটি আমার ভেতরে পরিবর্তন এনেছিল।”
– স্পোর্টস ইলাস্ট্রেশানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ডিক ফসবারি।
উল্টোভাবে লাফ দেওয়ার কথা হয়তো অন্য ক্রীড়াবিদদের মাথায়ও এসেছিল, কিন্তু তারা নিজেদের গতানুগতিক ধারার উপর অগাধ বিশ্বাসের কারণে সেটিকে পাত্তা দেননি।
পরিশেষে বলতেই হয়, উপরের বিষয়গুলো পড়ে আমাদের মনে হতেই পারে, আমাদের মাঝে হয়তো লুকিয়ে আছে পরবর্তী ডিক ফসবারি। অথবা এমন অনেক সময়ই হয়েছে, যখন আমাদের কোনো আইডিয়াকে তুচ্ছ মনে হয়েছে অথবা অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। মনে রাখবেন, কোনো আইডিয়াই মূল্যহীন নয়, যতক্ষণ না আপনি প্রমাণ পাচ্ছেন। সবসময় নিজের বর্তমান বিশ্বাস এবং ধারণাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিন, নিজের চারপাশের পরিবর্তনগুলোর উপর নজর রাখুন। কে জানে, হয়তো আপনিই হয়ে যাবেন পরবর্তী ফসবারি কিংবা এডিসন।
ফিচার ফটো: IdeaScale