আচ্ছা, আপনি কখনো ভোরের সূর্যোদয় দেখেছেন? কিংবা বিকালের আকাশে নীড়ে ফেরা পাখির ঝাঁক? সমুদ্রের ঢেউ অথবা পাহাড়ের বিশালতা? নয়নাভিরাম এসব দৃশ্যের বাইরেও আমাদের চারপাশে রয়েছে অনেক সৌন্দর্য, যা প্রতি মুহুর্তে মুগ্ধ করে আমাদের। অথচ সৌন্দর্যের প্রাচুর্যে ভরা আমাদের পৃথিবীতে বঞ্চিত অনেক মানুষ আছেন, ভাগ্য যাদের চোখে দেখার ক্ষমতা দেয়নি অথবা দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেছেন কোনো দুর্ঘটনায়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সেসব মানুষেরা বেঁচে থাকত অন্যের অনুগ্রহে, পরনির্ভরশীল হয়ে। দৈনন্দিন কাজেই যেখানে তারা পরনির্ভরশীল থাকতেন, সেখানে পড়াশোনা তাদের জন্য নিতান্ত অলীক বস্তু। অবশেষে ১৯২৪ সালে দৃষ্টিহীন মানুষদের জন্য শিক্ষার আলো নিয়ে আসেন এক ব্যক্তি, যা স্রষ্টার সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। দৃষ্টিশক্তি ছাড়াই এক থেকে ছয় বিন্দুতে অঙ্গুলি নির্দেশনা ও স্পর্শের মাধ্যমে প্রতিটি অক্ষর উপলব্ধি করে লেখা ও পড়ার এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘ব্রেইল‘ পদ্ধতি। অন্ধ ব্যক্তি ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের কল্যাণ ও সহায়তায় এই পদ্ধতির সূত্রপাত করেন ফরাসি আবিষ্কারক ও শিক্ষক লুইস ব্রেইল।
১৮০৯ সালের ৪ জানুয়ারি, ফ্রান্সের প্যারিস শহর থেকে আরো ৪০ কিলোমিটার দূরে ছোট শহরতলী কুপভ্রে সাইমন রেনে ব্রেইল-এর সংসারে ৪র্থ সন্তান হয়ে জন্ম নেন লুইস ব্রেইল। পিতা সাইমন রেনে ছিলেন একজন চামড়া ব্যবসায়ী। ছোট থেকেই লুইস ব্রেইল পিতার কারখানায় যেতেন, সেখানে বিভিন্ন যন্ত্রপাতিই ছিল তাঁর খেলনা। আকস্মিকভাবে একদিন তুরপুন (মুচিদের জুতো সেলাইয়ে ব্যবহৃত সূঁচ) নিয়ে খেলার সময় দুর্ভাগ্যবশত সেটা তাঁর চোখে ঢুকে যায়। স্থানীয় চিকিৎসকেরা তাঁকে সারিয়ে তুলতে ব্যর্থ হন। তখন এন্টিবায়োটিকের প্রচলন না থাকায়, ব্রেইলের অন্য চোখেও সংক্রমণ ছড়িয়ে পরে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মাত্র ৩ বছর বয়সে দুই চোখই পুরোপুরিভাবে অন্ধ হয়ে যায় তাঁর।
ছোট থেকেই ব্রেইল প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। তাই দৃষ্টিহীনতা তাঁর জীবনে যাতে বাঁধা না হয়ে দাঁড়ায় এই উদ্দেশ্যে তাঁর বাবা-মা ও জ্যাকুস পলি নামক সেখানকার গীর্জার একজন যাজক তাঁকে কুপভ্রের একটি বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। সেখানে তিনি তাঁর অসামান্য মেধার পরিচয় দেন। কানে শুনে শুনেই তিনি অনেক কিছু শিখে ফেলতেন।
কিন্তু অন্ধত্ব তাঁর জন্য সেখানেও বাঁধা হয়ে দাড়ায়। কারণ, সেখানকার শিক্ষাপদ্ধতি ছিল সাধারণ শিশুদের জন্য। দশ বছর তিনি সেখানেই পড়াশোনা করেন। তাঁর মেধা ও সৃজনশীলতা বিদ্যালয়ের পাদ্রীদের মুগ্ধ করে। তাই ১৮১৯ সালে তাঁকে ‘রয়্যাল ইনস্টিটিউট ফর ব্লাইন্ড ইয়ুথ‘ বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। এটি ছিল তৎকালীন দৃষ্টি-প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত স্বনামধন্য বিদ্যালয়গুলোর একটি।
বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা, ভ্যালেনটিন হোয়, অন্ধ ব্যক্তিদের সহায়তা ও পড়াশোনায় তাঁর জীবন অতিবাহিত করেন। দৃষ্টিহীন ব্যক্তি শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত- সমাজের এই ধারণা বদলাতে তিনি সেখানে তাদের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেন। তিনি মোটা কাগজের উপর বর্ণমালার অক্ষরগুলো বড় আকারে উঁচু করে সাজিয়ে বই তৈরি করতেন। পদ্ধতিটি খুব সহায়ক না হলেও তাঁর প্রচেষ্টার ফলে পরবর্তীতে এর উপর ভিত্তি করেই উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হয়েছিল।
ভ্যালেনটিনের তৈরি বইগুলো ছিল রোমান অক্ষরে লেখা। ব্রেইল লাইব্রেরী থেকে সংগ্রহ করে সেসব বইয়ের সাহায্যে শিখতে শুরু করেন। অচিরেই তিনি অনুধাবন করেন, অক্ষরগুলো পড়তে অসুবিধা না হলেও লেখার জন্য ততটা সহায়ক নয়। তাছাড়া এভাবে শিখতে সময়ও লাগবে অনেক। শীঘ্রই ব্রেইলের একাগ্রতা ও অধ্যবসায় তাঁকে ‘রয়্যাল ইনস্টিটিউট ফর ব্লাইন্ড ইয়ুথ‘ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুযোগ এনে দেয়। এছাড়া সঙ্গীতে পারদর্শিতার কারণে পরবর্তীতে তিনি চার্চের অর্গ্যান যন্ত্রবাদক হিসেবেও যোগদান করেন।
শিক্ষকতা জীবনে দৃষ্টিহীন মানুষের পড়তে ও লিখতে তিনি আরো সহজ উপায় খুঁজে বের করায় বদ্ধপরিকর ছিলেন। অবশেষে তাঁর কাজ আরো সহজ হয়ে যায় ১৮২১ সালে, যখন চার্লস বার্বিয়া নামে একজন অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ওই প্রতিষ্ঠানে আসেন। চার্লস বার্বিয়া একটি পড়ার পদ্ধতি সম্পর্কে জানান যেটা যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য তৈরি হয়েছিল। এই পদ্ধতিতে নিচ থেকে উঁচু করা, দুইটি কলামে ও ৬টি সারিতে মোট ১২টি বিন্দুর সাহায্যে অক্ষর প্রকাশ করা হত, যা হাতের স্পর্শে সহজেই আয়ত্ত করা সম্ভব ছিল। সাংকেতিক চিহ্নের সাহায্যে পড়ার এই অভিনব পদ্ধতি ব্রেইল সহ প্রতিষ্ঠানের সকলেরই খুব পছন্দ হয়েছিল। ব্রেইল অতি উৎসাহে পদ্ধতিটি আয়ত্ত করেন এবং আরো দুই বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে একটি সহজ ও সুন্দর সাংকেতিক পদ্ধতির উদ্ভাবন করেন।
ব্রেইলের প্রস্তাবিত এই পদ্ধতিতে তিনি ১২টি বিন্দু কমিয়ে তিন সারিতে দুইটি করে, মোট ৬টি বিন্দু ব্যবহার করে অক্ষর তৈরি করেন। ১৮২৪ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি ‘ব্রেইল‘ পদ্ধতি অবিষ্কার করেন এবং শীঘ্রই রয়্যাল ইনস্টিটিউটে তাঁর প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে শিক্ষাদান শুরু করেন। ধীরে ধীরে সকলের কাছে এই পদ্ধতি অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। ১৮২৯ সালে তিনি এই চিহ্নের সাহায্যে তৈরি তাঁর প্রথম বই ছাপান। তাঁর নামানুসারে দৃষ্টিহীনদের শিক্ষার এই অভিনব পদ্ধতি ‘ব্রেইল‘ পদ্ধতি নামেই প্রচলিত ও সমাদৃত হয়।
১৮৩৭ সালে বইটির ২য় সংস্করণ ড্যাশ চিহ্ন বাদ দিয়ে প্রকাশিত হয়, কারণ ব্রেইলের মতে সেটি অক্ষর অনুধাবনে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিল। সেসময় সহজবোধ্যতার জন্য আরো কিছু সংগঠন ‘ব্রেইল’ পদ্ধতিতে বই প্রকাশ করেছিল। ১৯১২ সালে ‘ওয়াচটাওয়ার সোসাইটি’ প্রস্তাবিত ‘ব্রেইল‘ পদ্ধতিতে ইংরেজি ভাষার বই প্রকাশ করত। ‘ব্রেইল‘ পদ্ধতিতে তৈরি বইয়ের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে সোসাইটি-টি আরো আটটি ভাষায়, ৭০টি দেশে বই প্রকাশ করে।
এছাড়াও সঙ্গীতের উপর তিনি ‘ব্রেইল’ পদ্ধতিতে কিছু ‘মিউজিক্যাল নোটেশন‘ তৈরি করেন এবং পরবর্তীতে এই বিষয়ে একটি বই লেখেন, যার নাম ”Method of Writing Words, Music, and Plain Songs by Means of Dots, for Use by the Blind and Arranged for Them”.
শৈশব থেকেই ব্রেইল সর্বদা অসুস্থতায় দিন অতিবাহিত করতেন। ৪০ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগ ধরা পরলে তিনি কর্মজীবন থেকে অবসর নেন। শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটায় তাঁকে কুপভ্রে নিয়ে আসা হয়। অবশেষে ১৮৫৩ সালে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে প্যারিসে নিজ বাসভবনেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
২০০৯ সালে তাঁর দ্বি-শতবর্ষ জন্মদিন উপলক্ষে বিশ্বের সর্বত্র যথাযথ মর্যাদায় বিভিন্ন প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। অন্ধদের শিক্ষাদানে তাঁর অবদানের শ্রদ্ধার্ঘ্যে বেলজিয়াম ও ইতালিতে দুই ইউরো, ভারতে দুই রূপী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক ডলার মূল্যমানের মুদ্রা প্রকাশ করা হয়।
এছাড়া কুপভ্রে তাঁর বাসভবনটিকে ঐতিহাসিক ভবন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং সেখানে ‘লুইস ব্রেইল’ জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। প্যারিস শহরের চত্বরে ব্রেইলের স্মরণে তৈরি একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে, যা ‘ব্রেইল স্কয়ার’ নামে পরিচিত।
১৯৫২ সালে মৃত্যুর শত বছর পর ব্রেইলকে পুনরায় রাষ্টীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। তবে প্রতীক স্বরূপ তাঁর একটি হাত নিজ বাসভবনে সমাহিত করা রয়েছে।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মাত্র ৩ বছর বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েও নিজের অদম্য প্রচেষ্টায় হাজার হাজার অন্ধ মানুষের শিক্ষা লাভের পথ তৈরি করে গেছেন এই মহামানব, যার কল্যাণে বর্তমানে দৃষ্টিহীন মানুষ পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে শিক্ষার আলো লাভ করে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে সক্ষম হতে পারছে।