করোনাভাইরাসের সাথে মানুষের যুদ্ধ চলছে গবেষণাগারগুলোতে, সেখান থেকে তথ্য-উপাত্ত বেরিয়ে আসছে, প্রকাশিত হচ্ছে গবেষণাপত্র বা সায়েন্টিফিক জার্নালে। গবেষণাগার-গবেষক-বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণাখাতের পুরো ব্যবস্থাকে বলা হয়ে থাকে একাডেমিয়া। একাডেমিয়ার একজন গবেষকের সাথে আরেকজনের সংযোগের কাজটি করে গবেষণাপত্র; সমসাময়িক গবেষকেরা কী কাজ করছেন, একটি কাজ কোথায় কাজ এসে থেমেছে, নতুন কী করা যেতে পারে- এসব তথ্যের সরবরাহ করে গবেষণাপত্র। একজন গবেষকের গবেষণাপত্রের মান, তিনি যে জার্নালে প্রকাশ করেছেন তার ‘ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর’, গবেষকের গবেষণাপত্রের সাইটেশন বা তার কাজটি অন্য কোন গবেষণায় কতবার উল্লেখিত হয়েছে, এই সমস্ত ব্যাপার একাডেমিয়াতে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নেওয়া হয়।
তবে মানসম্পন্ন জার্নালগুলোতে গবেষণাপত্র পাঠানোর সাথে সাথেই তা প্রকাশিত হয়ে যায় না। শুরুতেই একে পাঠানো হয় ‘পিয়ার রিভিউ’তে। যেখানে গবেষণার কাজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজ করছেন এমন গবেষক কিংবা বিজ্ঞানীরা গবেষণার বিষয়বস্তুকে খুঁটিয়ে দেখেন, প্রয়োজনে মতামত বা প্রশ্ন করেন। এই মতামত বা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় ঐ গবেষককে।
প্রকাশনার গুণগত মান রক্ষার এসব বাঁধা ডিঙিয়ে একটি গবেষণাপত্র দীর্ঘ সময় পর আলোর মুখ দেখে। তার গবেষণার তথ্য পৌঁছে যায় বাকি গবেষক-বিজ্ঞানীদের কাছে। আর এজন্য গবেষণাপত্র পাঠিয়ে দিন, সপ্তাহ এমনকি কয়েক মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় একজন গবেষককে।
কোভিড-১৯ মহামারীর আঘাতে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জগতে একটি বড়সড় পরিবর্তন হয়েছে। কোভিড নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এবং নানাবিধ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা যেমন বেড়েছে ঠিক তেমনই এর সাথে যুক্ত গবেষকরাও চাইছেন তার গবেষণাটি দ্রুত সময়ের মাঝে মূল্যায়ন করা হোক, তার কাজটির কথা সারা দুনিয়ায় পৌঁছে যাক।
প্রিপ্রিন্ট সার্ভার হয়ে উঠেছে নতুন আশার আলো
গবেষকরা জার্নালের রিভিউয়ের দীর্ঘসূত্রিতা পার হয়ে সেটি প্রকাশের আগেই সেটি উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন ‘প্রিপ্রিন্ট সার্ভার’ (Preprint server) এর মাধ্যমে। কোভিড-১৯ এর ফলে সারাবিশ্ব থেকে শত শত গবেষক এই পথ অনুসরণ করছেন, নিজেদের গবেষণার সর্বশেষ তথ্যটি পৌঁছে দিতে তারা ব্যবহার করছেন এই ধরনের সার্ভার।
ভিয়েনার রিসার্চ ইন্সটিটিউট অফ মলিকুলার প্যাথোলজির গবেষক এনা ওবেনাউফ এর উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, এই গবেষক কাজ করছেন স্কিন ক্যান্সার নিয়ে। বিশ্বজুড়ে অনেক গবেষণাগারে তার মতোই প্রায় একই ধরনের কাজ হচ্ছে। তাই তার কাজটি আগে প্রকাশ করতে না পারলে দৌড়ে পিছিয়ে যাবেন। কোনো জার্নালে দেওয়ার পর তা চলে যাবে রিভিউতে, কবে প্রকাশিত হবে তার ঠিকঠিকানা নেই। তাই আগে ‘bioRxiv’ নামের সার্ভারে তিনি তার গবেষণাপত্রের পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করেছেন।
গবেষণার প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত একই ক্ষেত্রের গবেষকদের সাথে পৌঁছে দেওয়ার এই মাধ্যম পদার্থবিজ্ঞান আর গণিতে প্রায় কয়েক দশক ধরে প্রচলিত আছে। করোনার সময়ে ভাইরাস, পাবলিক হেলথ, মেডিক্যাল গবেষণা বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপকভাবে। এই পরিমাণ গবেষণাপত্র ‘পিয়ার রিভিউ’ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাচাই বাছাই করতে বিপুল পরিমাণ লোকবল এবং সময়ের প্রয়োজন। তাই গবেষকরা নিজেদের গবেষণা কাজের ফলাফল, তথ্য এবং গবেষণাপত্রের পাণ্ডুলিপি প্রিপিন্ট সার্ভারগুলোতে উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন।
জীববিজ্ঞান আর মেডিক্যাল সায়েন্সের গবেষণাগুলোর প্রিপ্রিন্ট সার্ভার হিসেবে ‘bioRxiv’ এবং ‘medRxiv’ দুটি নাম গবেষকদের কাছে বর্তমানে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই সার্ভারের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং কোল্ড স্প্রিং হারবার ল্যাবরেটরির সহযোগী পরিচালক জন ইঞ্জলিসের মতে, গবেষণা প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রিপ্রিন্টের গুরুত্ব এখন তুঙ্গে। কোভিড-১৯ এর শুরু থেকেই চীন তো বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেই প্রিপ্রিন্টে জরুরি গবেষণাপত্র আসতে থাকে। এবং করোনার পরেও বিজ্ঞানীদের মাঝে দ্রুত যোগাযোগের এই মাধ্যমটি অব্যাহত থাকবে।
করোনা দুর্যোগ আঘাত হানার আগে থেকেই ‘bioRxiv’ এ প্রচুর গবেষণা পত্র জমা পড়ছিলো। জার্নালগুলোতে প্রকাশের দীর্ঘসূত্রিতায় যাবার আগেই নিজের গবেষণা সবার সামনে উন্মুক্ত করে দেওয়ার সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হয়ে উঠছে এই সার্ভারগুলো। আর কোভিড মহামারিতে এই ব্যাপারটি হালে আরো পানি পেয়েছে।
অন্যদিকে ‘medRxiv’, যেটি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিএমজে পাবলিশিং গ্রুপের সম্মিলিত সহায়তায় পরিচালিত হয়, সেখানেো কোভিড-১৯ এর গবেষণাপত্রের বন্যা বয়ে গেছে। তিন হাজার সাতশোর বেশি কোভিড সংক্রান্ত গবেষণা জমা পড়েছে তাদের সাইটে।
গবেষকদের অনেকেই বলছেন, কোভিড-১৯ মহামারির পরেও এই প্রিপ্রিন্ট সার্ভারের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। এর ফলে কি ‘পিয়ার রিভিউ’ হয়ে আসা গবেষণার গুরুত্ব কমে যাবে, এমন প্রশ্ন জেগেছে অনেকের মনেই।
কোভিড-১৯ এর পর কি কমতে যাচ্ছে রিভিউয়ের দীর্ঘসূত্রিতা?
কোভিড-১৯ ‘পিয়ার রিভিউ’ প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। তাই ‘PLOS’, ‘eLife’, ‘The UK Royal Society’, ‘Hindawi’ এর মতো বড় বড় জার্নাল প্রকাশক আর গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিলে রিভিউয়ের কাজটিকে দ্রুত করার উদ্যোগ নিয়েছে। যেখানে রিভিউয়ের কাজে আগ্রহী বিজ্ঞানীদের একটি পুল করে তাদেরকে পাণ্ডুলিপি দেওয়া হচ্ছে। এতে দ্রুত সময়ের মধ্যেই রিভিউ শেষ করে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে।
তবে এই মহামারিতেও কোভিড-১৯ সংক্রান্ত গবেষণাপত্রগুলো অগ্রাধিকার পেলেও বাকিদের তুলনামূলক বেশি সময় লাগছে। এখানেও তাদের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রিপ্রিন্ট সার্ভারগুলো, যে গবেষণাগুলোর রিভিউ হয়ে আসতে সময় লাগছে সেগুলো চলে যাচ্ছে ঐ সার্ভারগুলোতে, সেখানে তাৎক্ষণিক মূল্যায়নের পাশাপাশি পরবর্তীতে সংশোধন, পরিমার্জনের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে, এমনকি প্রিপ্রিন্ট সার্ভারে না আসা গবেষণার তুলনায় ত্রিশ শতাংশ বেশি সাইটেশন পাওয়া যাচ্ছে।
বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র কি সবার জন্য উন্মুক্ত হবে?
কোভিড-১৯ দুর্যোগে খ্যাতনামা সব জার্নালই তাদের করোনাভাইরাস সংক্রান্ত যত বৈজ্ঞানিক গবেষণা আছে তা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এতে উপকৃত হয়েছে বিশ্বের সব প্রান্তের গবেষক, শিক্ষার্থী এবং একাডেমিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই।
কিন্তু সাধারণ সময়ে খ্যাতনামা বিভিন্ন প্রকাশনার গবেষণাপত্র পড়তে সাবস্ক্রিপশন ছাড়া গতি নেই, পেওয়াল (Paywall) এর কড়াকড়ি থাকার কারণে তরুণ গবেষক এবং শিক্ষার্থীদের অনেকেই এসব গবেষণাপত্র বৈধভাবে পড়তে পারছেন না। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের এক হিসেব অনুসারে, আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষার্থীদেরকে গবেষণাপত্র পড়ার সুযোগ করে দিতে ২.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে, যা অনেক মধ্যম এবং স্বল্পোন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্ভব নয়।
তাই বিশ্বজুড়ে গবেষক, বিজ্ঞানী, শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ যারা দীর্ঘদিন এই পেওয়ালের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন তাদের জন্য কোভিড-১৯ বড় সুযোগ করে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার কারটিন বিশ্ববিদ্যালয়য়ের গবেষক ক্যামেরুন নেইলন বলছেন,
“আমরা যদি মনে করি দুর্যোগ বা মহামারির সময়ে তথ্যের উন্মুক্ততা গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে এটি সাধারণ সময়েও আমাদের জন্য একই রকম মূল্যবান।”
বৈজ্ঞানিক গবেষণা খাতের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা, গবেষণাপত্র মূল্যায়ন, ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশের জন্য অর্থের প্রয়োজন। তাই গবেষকরা নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে নিজেদের ‘পিয়ার রিভিউ’ হয়ে আসা গবেষণা প্রিপ্রিন্ট সার্ভার, রিপোসিটরিগুলোতে উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন। পাশাপাশি গবেষক এবং একাডেমিয়ার মাঝে গড়ে উঠা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে (ResearchGate, Academia.edu) একই ক্ষেত্রের অন্য গবেষকদের জন্য ডাউনলোডের সুযোগ করে দিচ্ছেন।
কোভিড-১৯ এর সময়ে গবেষণাপত্রের এই ঐতিহাসিক উন্মুক্ততা ‘Coalition S‘ এর মতো প্রজেক্টগুলোকে সামনে এগিয়ে দেবে। এই ধরনের সমন্বয়ে ‘বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস’, ‘ওয়েলকাম ট্রাস্ট’, বারোটি ইউরোপিয়ান দেশের দাতা সংস্থাগুলো গবেষণাপত্র উন্মুক্ত করতে দাবী জানাচ্ছে। হোয়াইট হাউজের ‘Office of Science and Technology‘ প্রায় একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে, যেখানে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার পদক্ষেপ নিচ্ছে।
বৈজ্ঞানিক প্রকাশনা শিল্প সাধারণ পত্র-পত্রিকা কিংবা বই প্রকাশনা শিল্পের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা এবং জটিল। কোভিড-১৯ বিপর্যয় এই শিল্পের সাথে জড়িতদের বুঝিয়ে দিয়েছে এই খাতেও দুর্বলতা আর বৈষম্য বিদ্যমান। তাই গবেষকরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী করোনাকালে সময়ে জনপ্রিয় হওয়া প্রিপ্রিন্ট সার্ভার, পিয়ার রিভিউয়ের দীর্ঘসূত্রিতা কমিয়ে আনা কিংবা গবেষণা উন্মুক্ত করে দেওয়ার মতো পরিবর্তনগুলো এই শিল্পে স্থায়ী প্রভাব ফেলবে।