Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গেটস ফাউন্ডেশন: ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত এক অনন্য দাতব্য সংস্থা

“মানুষ যেখানেই বাস করুক, যেভাবেই বাস করুক, অর্থনৈতিক অবস্থা যা-ই হোক না কেন; আমরা সবাই একই স্বপ্ন ধারণ করি।”

মেলিন্ডা গেটস

গেটস ফাউন্ডেশন কী?

বিল-মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন (The Bill and Melinda Gates Foundation) ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত পৃথিবীর সবথেকে বড়  সমাজসেবামূলক দাতব্য প্রতিষ্ঠান। মাইক্রোসফটের কর্ণধার বিল গেটস এবং তার স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম শুরু করেন। শুরুর সময় থেকেই প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা এবং সুস্বাস্থ্যের বিষয়টি নিশ্চিত করা। গেটস পরিবারের এই ব্যক্তিগত মানব কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান তহবিলের পরিমাণ প্রায় ৪৪.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

গেটস ফাউন্ডেশনের লোগো; Source: Wikimedia

প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, বিশেষ করে আফ্রিকার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে, মানুষের মাঝে শিক্ষার উন্নয়ন, চরম দারিদ্র্য দূরীকরণ, ম্যালেরিয়া এবং পোলিওর মতো ভয়াবহ রোগগুলো চিরতরে নির্মূল করা, যক্ষ্মা এবং এইডস থেকে মুক্তির মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত উন্নত জীবনযাপনের জন্য একটি সামাজিক নিরাপত্তা বলয় (Social Security) তৈরিতে কাজ করছে। এছাড়া এই ফাউন্ডেশন আমেরিকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে বাচ্চাদের শিক্ষার উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। প্রতিষ্ঠানটি সংক্ষেপে গেটস ফাউন্ডেশন (Gates Foundation/ BMGF) নামে পরিচিত।

শুরুর ইতিহাস এবং পথচলা

১৯৯৭ সাল। উইলিয়াম এইচ গেটস ফাউন্ডেশন (William H. Gates Foundation) নামের একটি অলাভজনক দাতব্য প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করে। কয়েক বছরের মধ্যেই এই ফাউন্ডেশনের তহবিল বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। ২০০৮ সালের ৩১ জুলাই বিল গেটস মাইক্রোসফট থেকে তার দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেন এবং গেটস ফাউন্ডেশনে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় দিতে শুরু করেন।

বিল গেটস এবং তার স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস; Source: People

২০০৫ সালে বিল এবং মেলিন্ডা তাদের সেবাধর্মী কাজের জন্য টাইম ম্যাগাজিনে বছরের সেরা ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচিত হন। ২০১০ সালের এপ্রিলে এমআইটি বিলকে আমন্ত্রণ জানায়। বিল তার অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্যে বলেন,

“তোমরা সমাজসেবায় এগিয়ে আসো। দারিদ্র্য সমাজের একটি আসল সমস্যা। এই অবস্থার উন্নতি দরকার।”

ঐ বছরেই গেটস ফাউন্ডেশন পেশাদার স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগের মাধ্যমে একটি কমিশন গঠন করে এবং স্বাস্থ্য খাতে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ২০১১ সালে কয়েকজন তহবিলদাতা প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম আরও সহজ এবং অবাধভাবে পরিচালনার আহবান জানান। পরবর্তীতে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে তাদের এই বিষয়ে আশ্বস্ত করা হয় এবং প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে অতীতর তুলনায় তাদেরকে আরও বেশি করে সম্পৃক্ত করা হয়।

হিলারি ক্লিনটনের উদ্যোগে ২০১৩ সালে ক্লিনটন ফাউন্ডেশন এবং গেটস ফাউন্ডেশনের মধ্যে এক অংশীদারিত্বমূলক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ফলে ক্লিনটন ফাউন্ডেশন নারী উন্নয়নে তাদের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করার উদ্দেশ্যে গেটস ফাউন্ডেশনের সমীক্ষাকৃত তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার শুরু করে। তাদের সমন্বিত প্রকল্পের নাম দেয়া হয় “No Ceilings: The Full Participation Project”

হিলারি ক্লিনটন; Source: Youtube

ওয়ারন বাফেটের অনুদান

মার্কিন ধনকুবের ওয়ারন বাফেট ২০০৬ সালে তার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে গেটস ফাউন্ডেশনকে পর্যায়ক্রমে ১০ মিলিয়ন ‘হ্যাথাওয়ে’ শেয়ার (Berkshire Hathaway) প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। প্রথম বছরেই এই অনুদানের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তিনটি শর্তে বাফেট গেটস ফাউন্ডেশনে এই অর্থ দান করেন।

  • বিল এবং মেলিন্ডা গেটসকে এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে থাকতে হবে।
  • দাতব্য সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম অব্যাহত থাকতে হবে।
  • প্রতিবছর প্রাপ্ত অনুদান সুষমভাবে হিসাব সাপেক্ষে খরচ করতে হবে।

পরবর্তীতে বাফেট এই শর্তানুসারে ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে দাতব্য প্রতিষ্ঠানটিতে অনুদান প্রদান করেন। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে তিনি তার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে গেটস ফাউন্ডেশনকে আরও শেয়ার প্রদান করেন, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। ওয়ারেন বাফেটের অনুদান প্রতিষ্ঠানটিকে আরও ব্যাপক পরিসরে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে সাহায্য করেছে।

ওয়ারন বাফেট, বিল এবং মেলিন্ডা গেটস; Source: CNBC

প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম

গেটস ফাউন্ডেশনের নীতিমালা অনুসারে, দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই ফাউন্ডেশন পরিচালিত হতে হলে প্রতি বছর তাদের মোট তহবিলের অন্ততপক্ষে ৫ শতাংশ খরচ করতে হবে। ২০১৪ সালের এপ্রিলে প্রতিষ্ঠানটি তাদের কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার জন্য তাদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডকে চারটি ভাগে বিভক্ত করে

  • বৈশ্বিক উন্নয়ন বিভাগ
  • বৈশ্বিক স্বাস্থ্য বিভাগ
  • মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভাগ
  • বৈশ্বিক নীতি- নির্ধারণ এবং তত্ত্বাবধান বিভাগ

প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে তাদের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বিবরণ, তহবিল সংগ্রহ প্রক্রিয়া, তহবিলদাতাদের নাম এবং তাদের উদ্দেশ্যাবলী সব কিছুই অনলাইনে প্রকাশ করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির সিইওর তত্ত্বাবধানে কার্যক্রমগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা হয়।

গেটস ফাউন্ডেশনের প্রধান অফিস; Source: Humanosphere

বৈশ্বিক উন্নয়ন বিভাগ

গেটস ফাউন্ডেশন এই বিভাগের অধীনে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রকল্প হচ্ছে-

  • গেটস ক্যামব্রিজ বৃত্তি
  • সরাসরি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে আর্থিক সাহায্য
  • বিভিন্ন দেশের কৃষি বিষয়ক কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে সামগ্রিক কৃষি উন্নয়ন
  • পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং সুস্বাস্থ্য
  • প্রযুক্তি ক্ষেত্রে গবেষণা এবং উন্নয়ন

এছাড়া পৃথিবীব্যাপী নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মহামারী রোধে এই বিভাগের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন অস্থায়ী প্রকল্পের অধীনে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

কৃষি উন্নয়নে ২০০৩-১৪ সালের বরাদ্দ; Source: Grain

বৈশ্বিক স্বাস্থ্য বিভাগ

এই বিভাগে পরিচালিত কার্যক্রম হচ্ছে-

  • বিশ্বব্যাপী এইডস, যক্ষ্মা এবং ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ
  • আফ্রিকার প্রত্যন্ত গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্য উন্নয়ন
  • পোলিও দূরীকরণ
  • শিশুদের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ টিকা
  • যক্ষ্মা প্রতিরোধ টিকা
  • জন্ম নিয়ন্ত্রণ
  • আঞ্চলিক বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ
  • স্বাস্থ্য উন্নয়নে সামাজিক সচেতনতা তৈরি
  • সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠানে সরাসরি আর্থিক সাহায্য এবং সমন্বয় সাধন।

শিক্ষা কার্যক্রম

এই প্রতিষ্ঠান শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য অনেক দেশে ব্যাপক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হল-

  • মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে সরাসরি সাহায্য এবং পৃষ্ঠপোষকতা
  • শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কোন্নয়ন
  • শিক্ষা ও গবেষণা উন্নয়ন
  • উচ্চশিক্ষায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সরাসরি বৃত্তি প্রদান
  • বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি আর্থিক সাহায্য প্রদান

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক শিক্ষা উন্নয়নে বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন কমিউনিটি প্রকল্পের মাধ্যমে গেটস ফাউন্ডেশন প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া গর্ভপাতসহ নানা নারীস্বাস্থ্য সমস্যা দূরীকরণসহ একটি বইমুখী জাতি বিনির্মাণে তাদের ‘গণপাঠাগার’ প্রকল্প চালু রয়েছে।

কার্যক্রম পরিচালনাকালে বিল এবং মেলিন্ডা; Source: Protext

আর্থিক অনুদান

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত গেটস ফাউন্ডেশন পরিচালিত আর্থিক অনুদানের একটি নমুনা (মার্কিন ডলারে) নিচে তুলে  ধরা হল।

  • সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ – ৫,৫৮৬ মিলিয়ন
  • ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ – ১,৪৫৬ মিলিয়ন
  • এইচআইভি/এইডস নিয়ন্ত্রণ – ১,৩০৮ মিলিয়ন
  • যক্ষ্মা প্রতিরোধ- ১,০৯৪ মিলিয়ন
  • জন্ম নিয়ন্ত্রণ- ৯০৫ মিলিয়ন
  • কৃষি গবেষণা- ৮০৭ মিলিয়ন
  • পরিবার পরিকল্পনা- ৬৮৮ মিলিয়ন
  • স্বাস্থ্যনীতি এবং ব্যবস্থাপনা – ৬৫৯ মিলিয়ন
  • কৃষি উন্নয়ন- ৪৮১ মিলিয়ন
  • কৃষিনীতি এবং ব্যবস্থাপনা- ৪৬০ মিলিয়ন
  • উন্নয়ন সচেতনতা- ৪৩৬ মিলিয়ন
  • মৌলিক স্বাস্থ্য সেবা- ৪১৬ মিলিয়ন
  • মৌলিক পুষ্টি – ৩৯৫ মিলিয়ন
  • মৌলিক স্বাস্থ্য – ৩৭৫ মিলিয়ন
  • আর্থিক নীতিনির্ধারণ এবং প্রশাসন ব্যবস্থাপনা – ২২২ মিলিয়ন
  • অন্যান্য খাত – ৬,১৯১ মিলিয়ন

স্বীকৃতি

সমাজসেবামূলক এই দাতব্য প্রতিষ্ঠান তাদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এ পর্যন্ত অনেক সম্মাননা এবং পুরস্কার অর্জন করেছে। উল্লেখযোগ্যগুলো হলো-

  • প্রিন্স অস্টারিয়াস পুরষ্কার (২০০৬)
  • ইন্দিরা গান্ধী পদক (২০০৭)
  • পদ্মভূষণ উপাধি (২০১৫ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বিল এবং মেলিন্ডা গেটস এই উপাধি লাভ করেন)
  • প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল (২০১৬ সালে মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে বিল এবং মেলিন্ডা গেটস এই উপাধি লাভ করেন)।

ফিচার ইমেজ- humanosphere.org

Related Articles