সমাজের প্রতিটি সমস্যারই কোনো না কোনো সমাধান আছে। আপাতদৃষ্টিতে সমস্যা মনে না হলেও চারপাশে সূক্ষ্ম এক ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে, সেটি হচ্ছে হতাশা। মানুষের জীবনে কখনোই হতাশা আসবে না এটা ভাবাটা অযৌক্তিক, কারণ সবার জীবনেই সমস্যা আছে, অপ্রাপ্তি আছে, আছে স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার আক্ষেপ। এই হতাশা থেকে বের হয়ে আসার জন্য দরকার মোটিভেশন।এই জায়গাতেই সম্ভবত আমরা বড় বেশি পিছিয়ে।
মোটিভেশনাল স্পীকার হয়ে ওঠাটা খুব সাধারণ তা না, তবে এটাও ঠিক যে মোটিভেশন দেওয়াটা কখনোই সর্বজনীন কিছু হতে পারে না। একেকজন মানুষের একেক ধরনের সমস্যা অর্থাৎ হতাশার কারণ সম্পূর্ণ আলাদা। আর সেজন্যই ছকে বাঁধা কিছু কথা সবার জন্য সমাধান বা হতাশা থেকে বের হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। কাউকে আয়োজন করে মোটিভেশন দিতে গেলে সেটা বোধহয় হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। আর তাই শুধু উৎসাহ না দিয়ে সেটা যদি নিজের জীবনের কষ্ট, সংগ্রাম এবং এসবকে পেছনে ফেলে এসে স্বপ্ন পূরণের গল্পটা বলা যায়, তবে সেটা আরও ফলপ্রসূ হবে। সুপ্রিয় পাঠক, বিশ্বব্যপী এমনই এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিষ্ঠান হল “টেড”, যা নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।
টেডের ইতিহাস
অনুপ্রেরণার এক অন্তহীন উৎস টেড (TED) এর তিনটি অক্ষর দিয়ে যথাক্রমে বোঝানো হয় Technology, Entertainment এবং Design। এই তিনটি ক্ষেত্রে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ১৯৮৪ সালে টেডের যাত্রা শুরু হয় রিচার্ড সল উরম্যানের হাত ধরে। হ্যারি মার্কসের সহায়তায় প্রথম টেড ইভেন্টটিতে কথা বলা হয়েছিল কমপ্যাক্ট ডিস্ক, ই-বুক এবং ত্রিমাত্রিক গ্রাফিক্স ডিজাইন নিয়ে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, টেডের সেই প্রথম ইভেন্টটি একেবারেই আশাব্যঞ্জক ছিল না। তবে ছয় বছর পর ১৯৯০ সালে রিচার্ড এবং হ্যারি মিলে আবার আয়োজন করেন টেডের। এবারের স্থান ছিল ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেরিতে। সমগ্র পৃথিবী এবারের আয়োজনকে সাদরে গ্রহণ করে নেয় এবং এই ইভেন্টটি সফল হয়। শুরুর দিকে যদিও টেড শুধু আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল, তবে কালের পরিক্রমায় এখন যে কেউ এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য আবেদন করতে পারেন।
টেড, টেড এক্স, টেড এড
টেডের নিজস্ব ইভেন্টগুলোর নাম হয় শুধু TED। এই ধরনের টেড ইভেন্ট টেড কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে আয়োজন করে থাকে।
TEDx ইভেন্টগুলো TED এর নিজস্ব তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয় না। TEDx এ x বলতে স্বাধীনভাবে আয়োজিত টেড ইভেন্টকে বোঝানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ কেউ যদি নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে বা নিজের এলাকায় TED এর মত অনুষ্ঠান করতে চায় তাহলে TED কর্তৃপক্ষ থেকে তাকে লাইসেন্স নিতে হবে এবং TED এর নিয়মকানুন অনুসরণ করে তিনি নিজের মত করে এমন একটি সম্মেলনের আয়োজন করতে পারেন যেখানে দর্শকরা TED এর মত অভিজ্ঞতাই পাবেন। TED বা TEDx এ কখনোই কোনো বিশেষ মতাদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তিকে বক্তা হিসেবে সুযোগ দেওয়া যায় না এবং TED কর্তৃপক্ষ খুব কঠোরভাবেই এটা মেনে চলে যে কোনো তথাকথিত মোটিভেশন দেওয়ার জন্য তাদের এই আয়োজন নয়। ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কখনোই বক্তারা কথা বলতে পারবেন না। নিজের প্রতিষ্ঠানে বা একটি নির্দিষ্ট এলাকায় TEDx ইভেন্ট আয়োজন করার জন্য যে লাইসেন্স আয়োজকদেরকে নিতে হয় তার জন্য আয়োজক অথবা TED কর্তৃপক্ষ কাউকেই অন্যকে কোনো ধরণের অর্থ প্রদান করতে হয় না।
ঠিক একইভাবে TEDx ইভেন্টে আমন্ত্রিত বক্তারা যেমন আয়োজকদের কোনো টাকা দেন না, তেমনি আয়োজকরাও বক্তাদের মূল্যবান বক্তব্যের জন্য কোনো অর্থ প্রদান করেন না।
২০১২ সালের মার্চে TED-Ed এর কার্যক্রম শুরু হয় যার উদ্দেশ্য ছিল খুব অল্প সময়ের মাঝে বিভিন্ন বিষয়ের উপর শিক্ষামূলক ভিডিও তৈরি করে সবাইকে জ্ঞানের কাছাকাছি নিয়ে আসা।
টেড মুক্ত ভাষান্তরকরণ
বিভিন্ন টেড টকগুলোকে নিজের ভাষার মানুষদের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এই টেড ওপেন ট্রান্সলেশন প্রজেক্ট যেখানে কাজ করছেন অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী। তারা প্রত্যেকেই তাদের নিজেদের ভাষায় টেড টকে সাবটেইটেল যুক্ত করেন এবং এর ফলে বক্তাদের আইডিয়াগুলো আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।
টেড টক কেন এত জনপ্রিয়?
বর্তমানের শিক্ষাব্যবস্থার এতটাই বেহাল দশা যে ছাত্ররা খুব বেশি করে তাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে ক্লাসে। প্রকৃতপক্ষে এটাই সত্য যে, শিক্ষকরা এমনভাবে তাদের বক্তব্য দিতে পারছেন না যাতে করে শিক্ষার্থীরা তার কথার প্রতি গভীর মনযোগ দেয়। আর ক্লাসের পিছনে বসে হাতে স্মার্টফোন নিয়ে নিজের পছন্দের জায়গায় ডুব দেওয়া তো আজকাল অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।
তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে এত বছর ধরে টেড টক এতটা জনপ্রিয়তা কীভাবে পেল? সারা বিশ্ব জুড়ে এত এত মানুষ টেড টকে অংশগ্রহণকারী হিসেবে যেতে পেরে কেন নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করেন? টেডের বিখ্যাত হওয়ার কিছু কারণ এখন তুলে ধরা যাক।
- দশ বছর আগে টেড টকের কোনো ভিডিওই পাওয়া যেত না। তবে সময়ের সাথে সাথে প্রযুক্তির পরিবর্তনের বদৌলতে এখন সকল টেড টকগুলো ইউটিউবে পাওয়া যায় এবং প্রতিটি ভিডিওই সম্পূর্ণ ফ্রি।
- টেড স্পীকাররা সবসময়ই কথা বলেন একটি নির্দিষ্ট সীমার বাইরে থেকে অর্থাৎ তাদের বক্তব্যের বিষয়বস্তু কখনোই গুরুত্বহীন হয় না।
- বক্তব্যের বিষয় কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে চললেও বৈচিত্র্য টেড টকের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
- টেড টকের সময় সাধারণত আঠার মিনিটের বেশি হয় না, কারণ এটি এমন একটি সময় যেটি একই সাথে দর্শককে আগ্রহী করে তুলতে পারে এবং দর্শককে ক্লান্তও করে না।
- বক্তারা যে বিষয়ের উপর কথা বলছেন তার উপর খুব জোর দিয়ে কথা বলতে পারেন অর্থাৎ তারা এই ব্যপারে খুব সচেতন যে তারা কী বলতে যাচ্ছেন।
- শুধু নির্দিষ্ট এলাকা নয়, যেকোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়েও টেড টক আয়োজন করা যায়।
টেডে অংশগ্রহণ করার অত্যাধিক খরচ
সবার একটি সাধারণ প্রশ্ন থাকে, টেক টকে দর্শক হিসেবে অংশ নেওয়ার যে টিকিট মূল্য, তা এত বেশি কেন? এটিও টেডের সুনামের পিছনে আরেকটি কারণ। কম মূল্যের টিকেট হলে টেডকে হয়তো এত মানুষের মাথাব্যথা হত না।
শুরু হোক নতুন কিছুর
নতুন আইডিয়ার চেয়ে সুন্দর আর কী-ই বা হতে পারে! নিজেকে সাহস দেওয়া, মহৎ মানুষদের সংস্পর্শে থাকা, মোটিভেশনাল স্পীচ শোনা বা প্রেরণামূলক বই পড়ার পাশাপাশি আমাদের দেশে যদি নিয়মিত টেড ইভেন্ট আয়োজন করা যায় সেটা কোনোভাবেই বৃথা যাবে না। হয়তো প্রথম প্রচেষ্টাই একদম সফল হবে না, তবে এটাও মাথায় রাখা উচিৎ যে টেডের শুরুটা কিন্তু আহামরি কিছু ছিল না। দেশে টেড এক্স ইভেন্ট আয়োজিত হয় বুয়েট, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকায়। কিছু স্বাপ্নিক ব্যক্তির সদিচ্ছাতে যদি দেশের অন্যান্য জায়গা অথবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টেড এক্স আয়োজন করা যায়, তবে সেটা শুধু সৃজনশীলতার চর্চাই হবে না, বরং দেশের সেরা মেধাবী মানুষগুলো সবার নজরে আসবে।
ফিচার ইমেজ- blog.ted.com