গণিতের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে অধিকাংশজনই ফিবোনাচ্চি ধারাকে বাছাই করেন। প্রথম কারণ এ ধারাটি খুবই সহজ- আগের দুটি সংখ্যাকে যোগ করেই পরের সংখ্যাটি পাওয়া যায়। আপনি প্রথমে ০ ও ১ সংখ্যা দুটি নিলেন। এ দুটিকে যোগ করে পেলেন ১, এটি পরবর্তী সংখ্যা। এরপর ১ আর ১ যোগ করে ফেলেন ২। এরপর ২ আর ১ যোগ করে পেলেন ৩। ৩ আর ২ কে যোগ করে পাওয়া যায় ৫। এভাবে চলতেই থাকবে, ধারায় একের পর এক যুক্ত হতে থাকবে ০, ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫… ইত্যাদি ফিবোনাচ্চি সংখ্যা।
ধারাটির জনপ্রিয়তার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে প্রকৃতিতে নিহিত অনেক গাণিতিক নকশা প্রকাশ করে এটি। ডেইজি ফুলে পাপড়ির সংখ্যা প্রায় সব সময়েই একটি ফিবোনাচ্চি সংখ্যা হয়। সূর্যমূখীর বীজ যে সংখ্যক সর্পিলাকার গঠনে সাজানো থাকে, তা-ও পাওয়া যায় এ ধারায়। সৌন্দর্যের গোপন সূত্র ‘গোল্ডেন রেশিও’র সাথে রয়েছে এর নিকটতম সম্পর্ক। এছাড়াও চমৎকার সব প্যাটার্ন দেখা যায় ধারাটিতে। যেমন, পরপর দুটি ফিবোনাচ্চি সংখ্যার বর্গ (স্কয়ার) যোগ করে যে সংখ্যা পাওয়া যায় সেটিও একটি ফিবোনাচ্চি সংখ্যা হয়। এসব কারণেই ফিবোনাচ্চি ক্রম গণিতবিদ, বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে অভিভূত করে কবি, শিল্পীদেরও।
এ চমৎকার সংখ্যাক্রমটির উদ্ভাবক হিসেবে কৃতিত্ব দেওয়া হয় ইতালিয়ান গনিতবিদ ফিবোনাচ্চিকে। ১২০২ খ্রিস্টাব্দে তার বই ‘লাইবার অ্যাবাচিতে তিনি তুলে ধরেন এ ধারাটিকে। অবশ্য ‘ফিবোনাচ্চি’ তার আসল নাম ছিল না। জীবিত থাকতে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘লিওনার্দো অব পিসা’ নামে। কিন্তু কালক্রমে তিনি ফিবোনাচ্চি নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। সে অনুসারে ‘ফিবোনাচ্চি সিকোয়েন্স’ নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে ধারাটি।
সাম্প্রতিককালে এসে কয়েকজন গবেষক ফিবোনাচ্চিরও আগে ভারতবর্ষে এ ধারাটি নিয়ে চর্চার প্রমান পান। মজার বিষয় হচ্ছে, প্রাচীন ভারতে গণিতশাস্ত্রে নয়, বরং কবিতায় ব্যবহৃত হতো এটি। হয়তো ভাবছেন কবিতায় ফিবোনাচ্চি ক্রম কীভাবে আসলো? তা-ও আবার ফিবোনাচ্চিরও আগে? দেখে আসি চলুন।
জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রাচীন ভারতবর্ষের অবদান অস্বীকার করার জো নেই। আধ্যাত্মিকতা থেকে শুরু করে গণিত কিংবা চিকিৎসাবিজ্ঞান- সব ক্ষেত্রেই ভারতবর্ষ সমৃদ্ধ করেছে পৃথিবীর জ্ঞান-ভাণ্ডারকে। নিজেদের আহরিত জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে সেসময় ভারতীয় বিদ্ধানরা বেছে নিয়েছিলেন সংস্কৃত ভাষাকে।
এ ভাষার বিশেষত্ব ছিল যে, এতে সহজেই কবিতা রচনা করা যেত। সেসব কবিতার মাধ্যমে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ত তাদের আহরিত জ্ঞান। স্রেফ শিল্পকলার খাতিরে নয়, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান থেকে দর্শনশাস্ত্র পর্যন্ত সকল বিষয়ে জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে রচনা করা হতো কবিতা। রামায়ণ, মহাভারত ও ভগবদগীতার মতো গ্রন্থগুলো সংস্কৃত কাব্যভাষায়ই রচিত হয়েছিল।
মাধ্যম হিসেবে সংস্কৃত ভাষাকে বাছাই করেই থেমে থাকেননি গবেষকরা। এরপর মানুষের মনে সংস্কৃত কবিতাকে সহজে গেঁথে দেওয়ার উপায় খুঁজতে লাগলেন তারা। এটি করতে গিয়ে আসে সংস্কৃত প্রসদি বা ছন্দশাস্ত্র। এ শাস্ত্রে কবিতার ছন্দ-তাল ইত্যাদি নিয়ে চর্চা করা হয়। খোঁজা হয় সহজাত ছন্দের ছাঁচ। যে ছাঁচে ফেলে রচনা করা কবিতাগুলো শ্রুতিমধুর হয়ে উঠবে, খুব একটা কষ্ট না করেই মানুষ মনে রাখতে পারবে পংক্তিগুলো।
কবিতার এ ছাঁচ তৈরি করতে গিয়েই আসে গাণিতিক হিসাব-নিকাশ। কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন, কবিতার মতো বিষয়ের সাথে গণিত আসে কীভাবে? কবিতা তো আপনা আপনি চলে আসে কবিমনে। অলৌকিকভাবেই জন্ম নেয় অসাধারণ সব কাব্যিক চরন। এভাবে ভাবলে বিষয়টি আকর্ষণীয় ঠেকে। মনে হয় নিগূঢ় রহস্যময় কোনো বিষয় লুকিয়ে আছে এতে।
কিন্তু ছন্দশাস্ত্র মেনে রচনা করা কবিতাগুলো অলৌকিকভাবে অবর্তীর্ণ হওয়া বাক্য নয়। বরং প্রতিটি পঙক্তিকে গণিতের বেঁধে দেওয়া নিয়ম উতরোতে হয়। সূক্ষ্ম নিয়ম মেনে কবিরা সাজান সেসব শব্দ। অদ্ভুত ঠেকলেও সত্যি যে, গণিতের বাঁধাধরা নিয়মগুলো কবিতাকে করে তোলে আরো প্রাঞ্জল। কবিতায় একটি সহজাত গতি চলে আসে, মোটেই আরোপিত বা কৃত্রিম কিছু মনে হয় না আর।
সংস্কৃত ছন্দশাস্ত্রের একদম মূলে আছে দু’ধরনের অক্ষর (syllable)- লঘু অক্ষর, যার দৈর্ঘ্য এক মাত্রার (Beat) ও গুরু অক্ষর, যেটি দুই মাত্রার। কবিতা ছাড়া সঙ্গীতেও এ ধারণার প্রয়োগ করা হয়। যেমন- তবলাবাদকরা ‘ধিন’ (লঘু) ও ‘ধা’ (গুরু) এর সমন্বয়ে সুর তৈরি করেন।
এবার চলুন দেখি ছন্দশাস্ত্রে ফিবোনাচ্চি ক্রম আসলো কীভাবে। কবিতা রচনা করার আগে প্রায় প্রত্যেক কবিই প্রতি চরণে (লাইনে) মাত্রার সংখ্যা নির্দিষ্ট করে নেন। এরপর এ সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রের মধ্যেই তাকে তার কাব্যিক প্রতিভার প্রমাণ দিতে হয়। এজন্য তার জানা দরকার, এ নির্দিষ্ট সংখ্যক মাত্রার মধ্যে তিনি তার অক্ষরগুলোকে কতভাবে সাজাতে পারবেন।
ধরুন, আপনি ঠিক করলেন প্রতি চরণে আপনি একটি মাত্রা রাখবেন। এক্ষেত্রে আপনি কেবল একটি লঘু অক্ষরই ব্যবহার করতে পারবেন। আর দুই মাত্রার চরণের ক্ষেত্রে আপনার হাতে দুটি বিকল্প আছে। আপনি হয় দুটি লঘু অথবা একটি গুরু অক্ষর ব্যবহার করতে পারেন। আর যদি প্রতি চরণে তিন মাত্রা হয়, তবে কতভাবে লঘু-গুরুর বিন্যাস করা যায়?
১) তিনটি লঘু
২) প্রথমটি লঘু দ্বিতীয়টি গুরু
৩) প্রথমটি গুরু দ্বিতীয়টি লঘু
সর্বমোট তিনভাবে বিন্যস্ত করা সম্ভব। এভাবে চারটি মাত্রার জন্যে পাওয়া যায় পাঁচটি বিন্যাস। পাঁচটি মাত্রার জন্যে আটটি ও ছয়টি মাত্রার জন্যে অক্ষরগুলোকে তেরভাবে সাজানো সম্ভব। ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩… সংখ্যাগুলোকে কি পরিচিত মনে হচ্ছে? এগুলো ফিবোনাচ্চি সংখ্যা বৈ ভিন্ন কিছু নয়। এভাবে আমরা n সংখ্যক মাত্রার জন্য বিন্যাস সংখ্যা এ ধারার n তম পদ থেকে পেতে পারি। অর্থাৎ যদি বলি দশটি মাত্রার জন্যে লঘু-গুরুর কতটি বিন্যাস সম্ভব? আপনাকে আর কষ্ট করে সবকটি বিন্যাসে সাজিয়ে গুনতে হবে না। স্রেফ এ ধারার দশম পদটি খুঁজে বের করে বলে দিতে পারেন যে এ সংখ্যাটি ৮৯।
সংস্কৃত ছন্দশাস্ত্রে এ প্যাটার্নটির ধারণা সর্বপ্রথম উল্লেখ করেন পিঙ্গালা নামের একজন ঋষি। পিঙ্গালা এটি করেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় অথবা চতুর্থ শতকে, যা ফিবোনাচ্চির জন্মের প্রায় হাজার বছর আগের কথা। তবে এটি নিয়ে বিস্তারিত কাজের উল্লেখ পাওয়া যায় হেমচন্দ্র নামে অন্য একজন ব্যাকরণবিদের কাজে। তিনি ধারাটির এ বৈশিষ্ট্য প্রমাণসহ উল্লেখ করেন। হেমচন্দ্র এ প্রমাণটি করেছিলেন ১০৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। ফিবোনাচ্চির প্রায় অর্ধশতক আগে।
ফিবোনাচ্চিকে তাই এ ধারাটির উদ্ভাবক বলা যায় না। ভারতবর্ষে এটি আরো আগে থেকেই জানা ছিল মানুষের। তবে লাইবার অ্যাবাচির মাধ্যমে পশ্চিমা বিশ্বের সামনে তিনি এটি প্রথম তুলে ধরেছিলেন। এ বইটিতে ফিবোনাচ্চি আরব ও ভারতীয় অঙ্কশাস্ত্র ব্যবহার করেছিলেন বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যা সমাধানের জন্য। তেমনি খরগোশের প্রজনন বিষয়ক একটি সমস্যা সমাধানের জন্যে তিনি ব্যবহার করেন এ ধারাটি। এর বাইরে এটি নিয়ে তেমন কিছু লেখেননি তিনি।
এ নিয়ে আগে তেমন একটা মাতামাতিও ছিল না। উনিশ শতকে এসে গণিতবিদরা যখন এ ধারাটির অন্যান্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করলেন, তখন এটি নজর কাড়ে সবার। যেহেতু লাইবার অ্যাবাচি থেকে তারা এর সাথে পরিচিত হয়েছিলেন, তাই তারা ফিবোনাচ্চির নামেই নামকরণ করেন এর। তবে এখন সংস্কৃতে এ নিয়ে চর্চার বিষয়ে জানার পর অনেকে তাদেরও স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। অনেকে ফিবোনাচ্চি ক্রমকে উল্লেখ করেন ‘হেমচন্দ্র-ফিবোনাচ্চি’ ক্রম নামে।