“আপু আমার গার্লফ্রেন্ডকে আপনার স্কুলে সাইক্লিং শেখাতে চাই। কিন্তু সাইক্লিং করতে গিয়ে ওর ভার্জিনিটি নষ্ট হয়ে যাবে না তো?”
ঠিক এরকম একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হবো এই যুগে এমনটা ভাবি নি। কিন্তু হতে যখন হয়েছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একজন শিক্ষিত তরুণের কাছ থেকে হতে হয়েছে, তখন বিষয়টা ভাবিয়ে তুলেছে বৈকি। এদেশের মানুষ অথবা এই উপমহাদেশের মানুষ মেয়েদের ভার্জিনিটি বা সতীত্বকে ঠিক কীভাবে দেখে? এর ব্যাখ্যা তাদের কাছে কেমন? কতখানি যুক্তিযুক্ত এবং সঠিক? সমস্যাটা শুধু হয়তো এই উপমহাদেশেরও নয়, পুরো পৃথিবী জুড়েই। মেয়েদের ভার্জিনিটি নিয়ে যে কুসংস্কার মানুষের মাঝে চালু আছে, সেটার বয়সও নেহায়েত কম নয়, শত বছরের পুরনো তো হবেই। আর সে কারণেই হয়তো এই ভার্জিনিটি কুসংস্কার মানুষের মনে বিশ্বাসের মতো গেঁথে গেছে।
সবচেয়ে পুরনো কুসংস্কারটা মেয়েদের রক্তপাত নিয়ে। ধারণা করা হয়, মেয়েদের যোনীতে থাকা সতীত্ব নির্ধারণকারী পাতলা পর্দা বা হাইমেন ছিঁড়ে রক্তক্ষরণ হয় কেবলমাত্র তার প্রথম ভ্যাজাইনাল সেক্সের সময়। অন্যভাবে বলা যায়, বিয়ের প্রথম রাতে বিছানার চাদরে মেয়েদের রক্তের দাগ না থাকলে তাকে ভার্জিন মেয়ে হিসেবে গণ্য করা হয় না।
পরের কুসংস্কারটাকে প্রথম কুসংস্কারের ব্যাখ্যা হিসেবে ধরে নেয়া যায়। যেহেতু প্রথম ভ্যাজাইনাল সেক্সের সময় হাইমেন ছিঁড়ে যায় এবং রক্তপাত ঘটায়, তাই মানুষ মনে করে একবার ভ্যাজাইনাল সেক্সের পর মেয়েদের যোনীতে হাইমেনের আর কোনো অস্তিত্ব থাকে না। এই ধারণা অনুযায়ী কোনো মেয়ে আদৌ ভার্জিন কিনা সেটা তার যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করেই বলে দেয়া সম্ভব।
প্রশ্ন হলো, কেন এই ব্যস্ততম যুগেও মেয়েদের শরীরের ছোট্ট একটা অংশ নিয়ে সাধারণ মানুষকে এতোখানি মাথা ঘামাতে হবে? কিন্তু সত্যিটা হলো, এই ধারণাগুলো যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রচলিত কুসংস্কারের বাইরেও অনেক বড় কিছু, যার ভুক্তভোগী পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মানুষ- নারী। হাইমেন নিয়ে এই ভুল ধারণা কেবল একটা ধারণা নয়; বরং এটা অনেক জায়গার জনপদের রীতি আর সংস্কৃতি, যা সেই জনপদের মেয়েদেরকে শারীরিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। শুধু নিয়ন্ত্রণ বলাও ভুল হবে, কারণ এই রীতি মেয়েদেরকে ধরে সমাজের সামনে অবিশ্বাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে, তাদেরকে বোঝাচ্ছে যে বিয়ের রাতে রক্তপাত না হওয়া মানে তাদের জন্য লজ্জার বিষয়। এরচেয়েও ভয়ঙ্কর ব্যাপার যখন শুধুমাত্র এই অজুহাতে মেয়েদেরকে শারীরিক অত্যাচারের শিকার হতে হয়। এ বছরের চলতি মাসেই তাজিকিস্তানে এক নববধুকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে ভার্জিনিটি টেস্ট করানো হলে সে আত্মহত্যা করে! শুধু বিবাহিত মেয়েদের ক্ষেত্রেই নয়, বিয়ের বাইরেও অনেক মেয়েকে ভার্জিনিটি পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাদের সম্মান, কিংবা চাকরি বাঁচানোর জন্য।
একসময় ইন্দোনেশিয়াতে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে যোগ দিতে গেলে মেয়েদেরকে এই পরীক্ষায় পাশ করতে ঢুকতে হতো। ২০১১ সালে ইজিপ্টে বিপ্লবীয় উত্থানের সময় নারী বিপ্লবীদেরকে ভার্জিনিটি পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছিলো। শুধু তা-ই না, এই তো গত বছরেই সেদেশের মন্ত্রী এলহামী আগিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার জন্য শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের তত্ত্বাবধানে ছাত্রীদের ভার্জিনিটির পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ইউরোপিয়ান নর্ডিক অঞ্চলেও চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গিয়ে মেয়েদের হাইমেন পরীক্ষা করানোর এই সংস্কৃতি বাড়ছে।
২০১৫ সালে ‘Cold Facts‘ নামের সুইডিশ এক টেলিভিশান অনুষ্ঠানে দেখা যায় অনৈতিকভাবে মেয়েদের ওপর এই পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে ব্যাপারটা এতোটাই ভয়ঙ্করভাবে মেয়েদের মানসিক চাপে ফেলছে যে অনেকেই হাইমেনোপ্লাস্টি বা প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যে হাইমেন জোড়া দেয়ার জন্য হাজার হাজার টাকা খরচ করছে। আমাদের পাশের দেশ ভারতেই সরকারি এবং বেসরকারিভাবে প্রায় লাখখানেক পর্যন্ত রুপি খরচ করে রি-ভার্জিনেশানের এই প্রক্রিয়াতে নিজের যৌনাঙ্গকে সার্জারির ছুরি-কাঁচির নিচে ফেলছে শত শত মেয়ে। যারা নিজের ওপর অস্ত্রোপচার চালাচ্ছেন না, তারা সহজেই নকল ভার্জিনিটি কিট কিনে নিচ্ছেন, যেখানে থাকছে নকল হাইমেন আর রঙিন তরলের স্বয়ংক্রিয় ভঙ্গুর অ্যাম্পুল। এইটুকু খরচও যারা করছেন না, তারা চালাকি করে লাল তরল নিয়ে চাদর রাঙিয়ে ফেলছেন। ভার্জিনিটি রীতির কতখানি প্রভাব একজন নারীর জীবনে যে, সে সত্যি হোক কী মিথ্যে, সাধারণত এই কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যেতে চায় না। নইলে কেবল ভার্জিনিটি নকল করার জন্য এতোগুলো উপায় নিশ্চয়ই বাজারে থাকতো না!
কতখানি গোঁড়া হলে আমরা ভার্জিনিটি কুসংস্কার দূর করার জায়গায় প্রাপ্ত বয়স্ক একটা মেয়েকে উল্টো বাধ্য করি খেলাধুলা, পিরিয়ড, শরীরচর্চা নিয়ে সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতে যেন তার কোনো কাজের বিনিময়ে তার সতীত্ব নষ্ট না হয়! সেই সতীত্ব যেটা কিনা হাইমেন নামের একটা সামান্য ভঙ্গুর পাতলা পর্দা নির্ধারণ করে! যে পাতলা পর্দা শরীরের অংশ, প্লাস্টিকের পলিথিন নয়!
স্বাভাবিকভাবে এই হাইমেন একেকজনের ক্ষেত্রে দেখতে একেকরকম হয়। কখনো চাকার রিমের মতো, কখনো ডোনাটের মতো, অর্ধেক চাঁদের মতো, কিছু কিছু আবার এলোমেলো পেঁচানো তারের মতো। কখনো কখনো হাইমেনের মাঝে কেবল একটাই ফাঁকা গোলক থাকে, কখনো আবার থাকে অসংখ্য।
হাইমেনের এত রকম আকারের কারণেই ভার্জিনিটি পরীক্ষা করার ব্যাপারটা এতটাও সোজা সাপ্টা নয়। সুতরাং ভার্জিনিটি নষ্ট হওয়া মানেই হাইমেন ছিঁড়ে একেবারে ধ্বংস হয়ে যাওয়া না। ইলাস্টিকের রাবার ব্যাণ্ড যেমন টানলে বড় হয়, হাইমেনও তাই। আর এই সাবলীল ইলাস্টিসিটির জন্যই একেবারে অক্ষত থেকেও এটা ভ্যাজাইনাল সেক্সকে সহ্য করে নিতে পারে। আবার অনেকের জন্য ব্যাপারটা এমন যে, হাইমেন কিছুটা হয়তো ছিঁড়ে গিয়ে ভ্যাজাইনাল সেক্সের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা করে দেয়, কিন্তু এটা কখনোই যোনী থেকে একেবারে উধাও হয়ে যায় না। বড়জোর এর আকার কিছুটা পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ যেসব মেয়েদের হাইমেনের বৈশিষ্ট্য চুলের রাবার ব্যান্ডের মতো, সেসব মেয়ের কখনোই সেক্সের সময় রক্তপাত ঘটবে না, হোক সে ভার্জিন কিংবা ভার্জিন নয়। তার মানে এই দাঁড়ায় যে, কিছু মেয়ের প্রথমবার সেক্সের পর রক্তপাত হতে পারে, কিছু মেয়ের না-ও হতে পারে। সুতরাং মেয়ে ভার্জিন হলে রক্তপাত ঘটবেই- এই কুসংস্কারটা এখানেই ভুল প্রমাণিত হয়ে যায়।
রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ জার্নালের ২০১৭ সালের প্রকাশনাতে ওলসন-মরেনোর প্রকাশিত আর্টিকেল থেকে দেখা যায়, মেয়েদের ভার্জিনিটি নির্ধারণে হাইমেন পরীক্ষা বিশ্বাসযোগ্য কোনো ফলাফল দিতে অক্ষম। উপরন্তু এই পরীক্ষা নারীদেরকে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে। যেহেতু শুধু মেয়েদের যোনীর দিকে তাকিয়ে তার সেক্সুয়াল জীবন সম্পর্কে কিছু বলে দেয়া অসম্ভব এবং হাইমেনের আকার-আকৃতিতে ভিন্নতা থাকার কারণে কোনো মেয়ের ভার্জিনিটি পরীক্ষা করে এটাও বলা সম্ভব নয় যে, সেই মেয়ের পরীক্ষিত হাইমেনের আকৃতি তার স্বাভাবিক আকৃতি নাকি পরিবর্তিত আকৃতি, সুতরাং প্রথমবার সেক্সের পরে হাইমেন পুরোপুরি হারিয়ে যায়- এই ধারণাও অবান্তর।
একদম প্রথমবারের সেই প্রশ্নে এবারে চলে আসি যেখান থেকে এই লেখার শুরু। সাইক্লিং করলে মেয়েদের ভার্জিনিটি নষ্ট হয় কিনা এরকম জিজ্ঞাসু যাদের মন, আশা করি ভার্জিনিটি সম্পর্কে তাদের ধারণা এবার বদলাবে। শুধু হাইমেন অক্ষত থাকাই যে ভার্জিনিটির সঠিক কোনো সংজ্ঞায়ন নয় এবং হাইমেন পরীক্ষা করাও যে কেবল অপ্রাসঙ্গিকই নয় বরং অনুচিত- এই মানসিকতা থেকে সমাজ বেরিয়ে আসুক, এটাই কাম্য।