ইংরেজিতে Stoicism বলে একটি শব্দ আছে; যার অর্থ হলো, জীবনের সমস্ত দুর্ঘটনা আর কঠিন সময়কে অনুভূতিশূন্যভাবে মোকাবেলা করা। ভেতরে যত কষ্টই হোক আর যা কিছুই ঘটুক, মনকে একেবারে পাথর করে রেখে নির্ভীকভাবে সেই সময়টিকে পার করা।
বছর দুয়েক আগে একদিন আমার মোবাইলে একটি কল এলো। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক মেয়ে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ কথা বললাম মেয়েটির সাথে। হাসিখুশি স্বপ্নে ভরা মন নিয়ে সে পড়তে এসেছিলো। প্রেমের মোহে পড়ে ঘটনাচক্রে নিজেকে খুব অসহায় ভাবছে এবং আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে।
জীবনের একটি চরম সত্যি কথা হলো- হয় আপনি আপনার ভয়কে ধ্বংস করবেন অথবা আপনার ভয় আপনাকে ধ্বংস করবে। আশার ব্যাপার হলো, মানুষের সবচেয়ে খারাপ সময়েও জীবন তাকে অনেকগুলো উপায় দেখিয়ে দেয়। যেকোনো একটি উপায় বেছে নেয়ার সময় কেউ ভাবতে পারে, এটা ভুল হয়ে যায় কিনা কিংবা অন্য কোনোটি ঠিক কিনা। কিন্তু সত্যি কথাটি হলো, খারাপ সময়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেয়ে শান্ত থাকা অনেক বেশি জরুরি। এ কাজটি আমরা খুব কম মানুষই করতে পারি।
এক ভদ্রলোকের গল্প বলি। তার নাম টিম ফেরিস। অসম্ভব প্রতিভাবান একজন মানুষ; লেখক, উদ্যোক্তা, পাবলিক স্পিকার এবং তারচেয়েও বড় কথা, পৃথিবীতে হাতেগোনা অল্প ক’জন মানুষের মাঝে একজন, যিনি তার জীবনে এই Stoicism এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে সমর্থ হয়েছেন। আজ সবার কাছে উদাহরণ হয়ে ওঠার আগে কিন্তু তাকেও নিজের ভয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কলেজ জীবনে এই মানুষটি আত্মহত্যা করতে গিয়েও ফিরে আসেন এবং যেখান থেকে তিনি ফিরে আসেন, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ভাবতে শুরু করেন, কেন তিনি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। তার মানে, যে ঘটনা তাকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছিলো, সেই ঘটনার মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস আসলে তার ছিল না!
Stoicism এর উৎস বহু পুরনো। এই যুগে অনেকের কাছেই এই আদি-আদ্যিকালের ব্যাখ্যা অনেক বিরক্তিকর। তারপরও টিম ফেরিস থেকে শুরু করলে Stoicism নিয়ে বলতেই হয়। শুরুর সেই পুঁথিগত অনুবাদ বা অর্থের দিকে না যাই। বরং এভাবে বলা যায়, Stoicism হলো প্রতিটি মানুষের ভেতরে সেট করে দেওয়া একটি সিস্টেম, যে সিস্টেম জীবনের কঠিন সময়ের মুহূর্তেই শুধু কাজ করে, যেন মানুষ একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এর শুরুটা হয়েছিলো এথেন্সে, ৩০০ খ্রিস্টপূর্বে Zeno of Citium নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে। এই ভদ্রলোক একটি রঙিন আরামচেয়ারের চারপাশে ঘুরে ঘুরে লেকচার দিচ্ছিলেন, যে আরাম চেয়ারটির নাম ছিলো Stoa। এখান থেকেই আসে Stoicism। সেই সময়ে এই Stoicism এর চর্চাটি একটু আলাদা ছিলো। আর এখনকার সময়ে, বিশেষ করে এই প্রসঙ্গে Stoicism টেনে আনার উদ্দেশ্য হলো, আপনাকে একটি দেয়াল তৈরি করতে সাহায্য করা, যে দেয়াল আপনি জীবনের যা কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন আর যা কিছু করতে পারেন না, তার মাঝে স্পষ্ট একটি রেখা টানতে পারে।
এই নিয়ন্ত্রণ করার খেলাটা সত্যিকার অর্থে মানুষকে সিনেমার অ্যাকশান হিরোদের মতো সুপার পাওয়ার দিতে সক্ষম। কিন্তু শর্ত হলো, খেলাটা নিজেকেই খেলতে হবে। অন্য কেউ এসে কারো হয়ে খেলে দেবে না। এই খেলার আবার একটি মজার নাম আছে- Premeditatio Malorum বা Pre-meditation of Evils, বাংলায় যাকে বলা যায় শয়তানের প্রি-মেডিটেশন। খুব সহজ ব্যাখ্যায় বলা যায়, মানুষ তার জীবনে যা কিছুকে ভয় পায়, সেসব জিনিসকে নিঁখুতভাবে যতটা খুঁটিনাটি আকারে পারা যায়, সেভাবে কল্পনা করা। জীবনের কোনো খারাপ সময়ে যে কাজটা করতে মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায়, এই কল্পনা তাকে সেই সময়ে সেই কাজটা এড়িয়ে যাওয়ার অথবা সেটাকে মোকাবেলা করার উপায় বের করে দেবে। এমনকি কোনো খারাপ কারণে যেটুকু মানসিক প্যারালাইসিস ঘটার সম্ভাবনা থাকতো, সেটি কাটিয়ে ওঠার জন্যে সে অনেকগুলো উপায় নিজেই খুঁজে পাবে।
কীভাবে খেলা যায় এটি? একটি খাতা আর কলম নিয়ে বসে যেতে হবে শুরুতে। আপনার কী করতে ভালো লাগে বা জীবনে কী করতে চান, নিজেকে কোথায় দেখতে চান, এসব প্রশ্ন করলে যেমন আপনি একবাক্যে উত্তর দিতে পারেন, আমি ডাক্তার হতে চাই, বিদেশে পিএইচডি করতে যেতে চাই কিংবা উদ্যোক্তা হতে চাই; তেমন করে আপনি জীবনে কী কী ভয় পান- এই প্রশ্নের উত্তরও নির্দ্বিধায় আপনাকে জানতে হবে। পুরো খেলাটি খেলতে তিনটি আলাদা পৃষ্ঠা লাগবে। প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনাম হবে-
যদি আমি…?
এই শিরোনামের মানে হলো, যা কিছু করতে আপনি ভয় পান, যা কিছু আপনাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয়, যা কিছু আপনাকে নার্ভাস করে, আপনাকে দ্বিধায় ফেলে দেয়- সেগুলো নিয়ে ভাবা। হতে পারে, আপনি যাকে ভালোবাসেন তাকে সেটা বলতে পারছেন না। হতে পারে, অনেক পরিশ্রমের পরেও আপনি বসের কাছে সরাসরিভাবে পদোন্নতির কথা, বেতন বাড়িয়ে দেয়ার কথা বলতে দ্বিধাবোধ করছেন। হতে পারে, আপনি চাকরি ছেড়ে দিতে ভয় পাচ্ছেন অথচ চাকরিটা করে আপনার পোষাচ্ছে না। এমনও হতে পারে, আপনি নিজেই নতুন কোনো ব্যবসা শুরু করতে চাইছেন কিন্তু সাহসের অভাবে সেটা শুরু করতে পারছেন না। হতে পারে, সম্পর্ক ভেঙে গেলে একা কেমন করে বাঁচবেন সেই ভয়ের কারণে, অসম্মানিত হয়েও সম্পর্ক ছেড়ে চলে আসতে পারছেন না। এমন অনেক অনেক কিছুই হতে পারে। এই পৃষ্ঠার প্রথম কলামে সেসব খারাপ জিনিসগুলো লিখবেন, যা আপনার সাথে ঘটলে আপনি ভয় পাবেন। যত বেশিই থাকুক না কেন এমন জিনিস, তাতে কিছু আসে-যায় না। কিন্তু সবগুলো ভয়ের কারণ যেন এখানে অবশ্যই লেখা থাকে।
দ্বিতীয় কলাম হবে, কী করলে এই খারাপ ঘটনাগুলো আপনার জীবনে ঘটার সম্ভাবনা কমে যাবে অথবা ঘটবে না তার তালিকা। ধরা যাক, আপনি অফিসের পরিবেশের কারণে চাকরি ছেড়ে দিতে চাইছেন কিন্তু পারছেন না। তাহলে চিন্তা করুন, কী কী কাজ করলে আপনি এই পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে অথবা এই পরিবেশকে মেনে নিতে পারবেন, যাতে করে আপনাকে চাকরিটা ছাড়তে না হয়।
তৃতীয় কলামে থাকবে, কী করলে আপনি প্রথম কলামের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন। যেমন- চাকরিটা যদি আপনাকে ছেড়ে দিতেই হয়, তাহলে এই ক্ষতি পোষানোর জন্য আপনাকে চিন্তা করতে হবে, কী করলে আপনার এই ছেড়ে দেয়াটা একেবারে বিফলে যাবে না। উদাহরণস্বরূপ, চাকরি ছেড়ে সাময়িকভাবে আপনি দুই-তিনটি টিউশান নিতে পারেন। এগুলোর পাশাপাশি আরো ভালোভাবে অন্য চাকরির জন্য চেষ্টা করতে থাকতে পারেন।
প্রথম পৃষ্ঠায় তিনটি কলাম পূরণের পর এবার আসবে খেলার দ্বিতীয় ধাপ। দ্বিতীয় পৃষ্ঠার শিরোনাম হবে-
ইতিবাচক ফলাফল
একটি খারাপ সময়ে যে কাজ আপনি করতে যাচ্ছেন, সেই কাজটি করলে মানসিক, শারীরিক, আর্থিক কিংবা সামাজিক দিক থেকে আপনার কী কী ভালো ফলাফল আসতে পারে সেগুলো খুঁজে বের করা হবে এই ধাপের কাজ। এই যে আপনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে টিউশন শুরু করলেন, তাতে আপনার কোন কোন ক্ষেত্রে কতটুকু ইতিবাচক ফল আসবে, সেটা চিন্তা করতে হবে এবার। সেই ফলাফলগুলো লিখে রাখুন এই পৃষ্ঠায়।
এরপর খেলার তৃতীয় ও সর্বশেষ ধাপ। এই তৃতীয় পৃষ্ঠার শিরোনাম হবে-
নেতিবাচক ফলাফল
তৃতীয় পৃষ্ঠার কাজটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে ঘটনা ঘটবে বলে আপনি ভয় পান, সেটা যদি ঘটেই যায় এবং সেই ঘটনা না ঘটানোর জন্য অথবা ঘটে যাবার পর সেটা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য আপনি যদি কিছুই না করে থাকেন, তাহলে ৬ মাস, ১ বছর কিংবা ৩ বছর পরে এই ঘটনার নেতিবাচক কী কী ফলাফল আপনি ভোগ করতে বাধ্য হবেন অথবা ভোগ করবেন বলে মনে হয়? আগের পৃষ্ঠার মতোই শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, সামাজিক ইত্যাদি প্রেক্ষাপটে আলাদা আলাদাভাবে এমন ঘটনার নেতিবাচক ফলাফল সম্পর্কে লিখে ফেলুন।
মজার ব্যাপার হলো, তৃতীয় পৃষ্ঠা শেষ করার পর আপনি বুঝতে পারবেন, জীবনের কোনো খারাপ ঘটনায় ভয় পেয়ে সেটি মোকাবেলা করার জন্য ‘কিছুই না করা’ আসলে কোনো অপশন নয়। ভালো কথা, এখনো কিন্তু খেলাটি শেষ হয়নি। এবারে প্রথম দুই পৃষ্ঠায় ফিরে গিয়ে প্রতিটি ঘটনার বিপরীতে আপনার সম্ভাব্য গৃহীত সিদ্ধান্তের পয়েন্টগুলোকে আলাদা করে ১০ এর মাঝে স্কোর দিন। যে পয়েন্টগুলো ১০ এর ভেতর ১, ২, ৩ পাবে, সেগুলো খারাপ সময়ে আপনাকে হয়তো মানসিকভাবে শান্তি দেবে, তবে এটা হবে সাময়িক। আর ৮, ৯, ১০ স্কোর পাওয়া পয়েন্টগুলো আপনার জীবনে মোটামুটি স্থায়ীভাবে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। এবারে আপনি নিজেই নিজের প্রতিটি ভয়ের বিপরীতে কী করা উচিত বা কী করতে পারেন, সেটা খুব সহজে বুঝতে পারবেন।
আসলে খারাপ সময় জীবনে আসবেই। জীবন থেকে এটাকে একেবারে উধাও করে দেওয়া যায় না। তবে সেই সময়কে ভয় পেয়ে উল্টোপাল্টা কাজ না করে, বরং খাতা-কলম নিয়ে ভয়ের সেট-আপের সাথে আগেই মাইন্ড গেইম খেলতে বসাই বুদ্ধিমানের কাজ। আদ্যিকালের পুরনো Stoicism বা Defense Mechanism কিন্তু আসলে Pre-meditation of Evil এর জন্য একেবারেই খারাপ না। কারণ সবকিছুর পরেও Letters from a Stoic বইতে উদ্ধৃত Seneca-র এই কথাটা অনেক বেশি সত্যি-
We suffer more often in imagination than in reality.
আর এই সত্যি কথাটি বছর দুয়েক পরে এসেও প্রমাণ করে যাচ্ছে সেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েটি, যে একদিন ফোনকল করে আমাকে আত্মহত্যা করতে চাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলো!
ফিচার ইমেজ- thelandscapeoflearning.com