স্যার আইজ্যাক নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার গল্পটি পৃথিবীজুড়েই খুব জনপ্রিয়। এই গল্প শুনে অনেকেরই মনে হতে পারে, হঠাৎ করে মাথায় একট আপেল পড়ার পরই বোধহয় নিউটন তার বিখ্যাত মহাকর্ষ সূত্র নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলেন! আসলে একটু চিন্তা করলে এবং বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করলে জানা যায়, ব্যাপারটি পুরোপুরি সত্যি নয়। যতটুকু জানা যায়, নিউটন তার কাজের মাঝেই মগ্ন ছিলেন, আর গভীরভাবে চিন্তামগ্ন অবস্থায় একটি আপেল বাগানে বসে থাকা বা পায়চারি করার সময় তিনি বন্ধুদের সাথে আলাপ করেছিলেন, একটি আপেল কেন অন্যদিকে না গিয়ে ঠিক নিচের দিকে মাটিতেই পড়ে? আপেল পড়ার বিষয়টিকে একটি চমৎকার উদাহরণ হিসাবে নিয়ে, নিউটন চেয়েছিলেন এর কারণ খুঁজে বের করতে।
আচ্ছা, আমরা যখন ছোট্টবেলায় একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী হিসাবে নিউটনের নাম জানি, তার গল্পটি শুনি কিংবা এরপর আরেকটু বড় হয়ে তার সূত্রগুলো দিয়ে অঙ্ক করি; কখনও কি কেউ তার সেই ‘গভীরভাবে চিন্তামগ্ন’ থাকার বিষয়টি নিয়ে ভাবি? সাধারণ জ্ঞান মুখস্থ করতে গিয়ে আমরা যখন আমাদের জাতীয় সংসদের স্থপতি লুই আই কানের নাম জানি, তখন কি আমরা তার স্থাপত্যকলার স্বাতন্ত্র্য কিংবা জাতীয় সংসদ ভবনের খুঁটিনাটি গড়ন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী হই? অথবা দুর্নীতির অজস্র খবর শুনতে শুনতে কিংবা নিজেরাই দুর্নীতির শিকার হওয়ার পর, আমরা কখনও কি ভাবতে বসি যে কেন আমাদের দেশে দুর্নীতি এভাবে শিকড় গেঁড়ে বসল?
এমন যদি হতো, আমাদের একটা গোটা নতুন প্রজন্মকে আমরা বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলতে পারছি, তাদের মধ্যে সৃজনশীলতার বীজ বপন করতে পারছি, তাদের মনের মাঝে নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তি তৈরি করতে পারছি- তাহলে কেমন হতো? এমন একটি প্রজন্ম যখন বড় হতো, তখন কি তাদের মাঝে একেকজন নতুন নিউটন কিংবা স্টিফেন হকিং, একেকজন নতুন যুগের লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, লুই আই কান, নতুন কোনো মাইকেল জ্যাকসন কিংবা নতুন একেকজন জয়নুল আবেদীনদের আমরা পেতাম না!
নিশ্চয়ই পেতাম! কিন্তু আজকের শিশুরা কোথায় গেলে এই শিক্ষাগুলো পাবে? বর্তমান পৃথিবীতে আধুনিক প্রযুক্তির যে দুরন্ত অগ্রযাত্রা চলছে, সেই পৃথিবীতেই আগামী সময়ের জন্য একজন যোগ্য মানুষ হয়ে উঠতে হলে ঠিক কোন ধরনের শিক্ষা শিশুদের দেওয়া দরকার? সেই অনাগত সময়ের জন্য আমরা কি প্রস্তুত করছি নতুন প্রজন্মকে? আমরা কী জানি কীভাবে সেই প্রস্তুতিটা নিতে হবে?
আপনি কি একবারও ভেবেছেন, আজকে আপনার শিশু স্কুলে গিয়ে যা যা পড়ছে বা শিখছে, সেগুলো তার ভবিষ্যৎ জীবনটাকে সুন্দর ও সুনিশ্চিত করে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে কিনা? গৎবাঁধা মুখস্থ পড়াশোনা করে আর গাদা গাদা পরীক্ষায় ভালো ফল করলেই কি শিশুরা তাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে?
শিশুদের বেড়ে ওঠার সময়টিকে আমরা সবসময় তুলনা করি নরম কাদামাটির সাথে। এই কথাটি নিশ্চয়ই সবাই শুনেছি যে, নরম কাদামাটিকে থেকে যেমন যেকোনো আকৃতি তৈরি করে নেওয়া যায়, শিশুর মননও তেমনি তৈরি হয় একটু একটু করে, সে চারপাশে যা দেখে এবং যা করে সে অনুযায়ীই সে গড়ে ওঠে।
চার বা পাঁচ বছর বয়স হবার পরপরই এখন একটি বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে বাবা-মায়ের চিন্তা শুরু হয়। কোন স্কুলে পড়াবেন, কীভাবে ভর্তি করাবেন, কেমন করে তাকে স্কুলে নেবেন ইত্যাদি খুঁটিনাটি সকল বিষয় ভেবে তারা শিশুর স্কুলজীবন শুরু করান। আচ্ছা, কখনও কি ভেবেছেন, আপনার শিশুকে আসলে ঠিক কীসের জন্য স্কুলে ভর্তি করাচ্ছেন? স্বাভাবিকভাবেই আপনি হয়তো বলবেন, পড়াশোনার জন্য, পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার জন্য, তার নিজের জীবনটা যাতে গুছিয়ে নিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে সেটারই সূচনা করার জন্য। আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আপনি কি জানেন, আমাদের বেশিরভাগ স্কুলই এখন আর আপনার স্বপ্ন পূরণের সামর্থ্য রাখে কিনা?
একটা ছোট্ট তথ্য দেওয়া যাক। বিবিসির একটি রিপোর্টে বলা হচ্ছে, গত বছরের নভেম্বরে বিশ্বখ্যাত কনসাল্টেন্সি সংস্থা ম্যাকিনসি গ্লোবাল ইন্সটিটিউট জানিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৬টি দেশের ৮০ কোটি মানুষ তাদের চাকরি হারাবে! কারণ, তখন অটোমেশন তথা রোবটের মাধ্যমে এই কাজগুলো করা হবে। পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের মতো দৈনন্দিন কাজ থেকে শুরু করে যাবতীয় দাপ্তরিক কাজ, হিসাবনিকাশ ও প্রশাসনিক কাজ- ইত্যাদি সবই রোবটের মাধ্যমেই করানো সম্ভব হবে আগামীর পৃথিবীতে। এদিকে গত বছরের জুলাইয়ে খ্যাতনামা প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ডেল একটি রিপোর্টে জানিয়েছিল, ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে যেসব চাকরি থাকবে, তার ৮৫ শতাংশই এখনও পর্যন্ত তৈরিই হয়নি! এর মানে হলো, মাত্র এক যুগ পরের দুনিয়াতে আমাদের পরের প্রজন্ম যেসব কাজ করবে, তার মধ্যে ৮৫% ধরনের কাজ এখনও মানুষ শুরুই করেনি!
আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন, স্কুলগুলোতে ঠিক কী ধরনের পড়াশোনা হলে আপনি কিছুটা নিশ্চিত হতে পারবেন যে, আপনার শিশু সত্যিই তৈরি হচ্ছে ভবিষ্যতের জন্য। এর উত্তর পেতে হলে সর্বপ্রথমে যেটা বোঝা দরকার সেটা হলো, আগামীর পৃথিবীতে মানুষ কাজের পিছনে ছুটবে না, কাজ ছুটবে মানুষের পিছনে। ইন্টার্ভিউ বোর্ডের সামনে গিয়ে নিজেকে প্রমাণের কোনো ব্যাপার তখন থাকবে না। আপনার শিশুর পরিচয় জানিয়ে দেবে তার প্রোফাইল, যেটা তৈরি হবে কী কী গুণাবলী সে সফলভাবে অর্জন করেছে তার উপর ভিত্তি করে। সবচেয়ে যোগ্য মানুষটিকে খুঁজে নিতে তখন আজকের মতো বেগ পেতে হবে না। আপনার শিশু কী কী করতে পারবে, সেটার সাক্ষ্য দেবে তার অর্জিত শিক্ষা। আর ভবিষ্যৎ পৃথিবী কোন কোন শিক্ষাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেবে, সেটা নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।
গভীরভাবে চিন্তার সক্ষমতা
মানব সভ্যতার আজ পর্যন্ত যে উন্নতি হয়েছে, এবং আরও যে অভাবনীয় উন্নতির দিকে আমরা এগোচ্ছি- তার প্রধানতম হাতিয়ার হলো মানুষের গভীরভাবে চিন্তার সক্ষমতা। আদিমকালে দুটো চকমকি পাথর ঠুকে আগুন জ্বালানো কিংবা চাকার আবিষ্কার যেমন এই চিন্তার ফসল, নিউটনের মতো বিজ্ঞানীদের কাজগুলো যেমন তাদের চিন্তারই সাফল্য; তেমনি আপনি যে ফেসবুক চালিয়ে এত এত মানুষের সাথে যোগাযোগ করছেন, সেই ফেসবুক তৈরির ভাবনাটিও মানুষের গভীর চিন্তার কারণেই এসেছে। আগামীর পৃথিবীর মানুষের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হবে তার এই গভীরভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা।
ব্যক্তিগত কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক- যেকোনো জায়গায় যখন কোনো সমস্যা আবির্ভূত হয়, তখন সেই সমস্যা সমাধানের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত উপায়টি খুঁজে বের করতে হলে, চাই দ্রুততম সময়ে নানামুখী চিন্তার সক্ষমতা। এই সক্ষমতার জন্যই আজ বিশ্বজুড়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কোটি কোটি টাকা খরচ করে সিইও নিয়োগ দেয়। জটিল কিংবা গোলমেলে পরিস্থিতিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যই তারা এই বেতন পায়। ভবিষ্যৎ দুনিয়ার এমন ধরনের মানুষের প্রয়োজনীয়তাই থাকবে সবচেয়ে বেশি। আগামীর পৃথিবীতে হাতের কাজ করবে যন্ত্র, কেবল মাথার কাজ করবে মানুষ; আপনার শিশু সেজন্য তৈরি হচ্ছে তো?
নতুন কিছু তৈরি করা এবং নতুন আইডিয়া বের করার জন্য দরকার যথাযথভাবে চিন্তা করা। গভীর চিন্তা একজন মানুষের মনকে যৌক্তিক এবং সুস্থির করে তোলে, ফলে তার জন্য চারপাশের প্রতিকূলতাকে মোকাবেলা করা সহজ হয়।
এমনকি শিশুদের ঠিক এই মুহূর্তের পড়াশোনার কথাই ধরুন। আপনি যখন তাকে অঙ্ক কিংবা ব্যাকরণ শেখাবেন, তখনও যদি তাকে চিন্তা করে বুঝতে না শেখান, তাহলে সে একসময় অঙ্ক কিংবা ব্যাকরণের উদাহরণগুলো মুখস্থ করতে শুরু করবে। বাচ্চা যদি একের পর এক প্রশ্ন করতে শেখে, চারপাশটাকে অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে দেখতে শেখে, তাহলেই তার এই চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বটা তৈরি হবে। গভীরভাবে চিন্তার সক্ষমতাই তাকে অনাগত পৃথিবীতে টিকে থাকার রসদ যোগাবে। আমাদের স্কুলগুলো কি শিশুকে একের পর এক ইচ্ছেমতো প্রশ্ন করতে শেখায়? শিশুর চিন্তাশক্তিকে উন্নত করার লক্ষ্য নিয়ে কি এখানে কোনো স্কুলের সিলেবাস রচিত হয়? এখানে কি শিশুর সামনে চিন্তার এক অবারিত জগতের দ্বার খুলে দেওয়া হয়?
সৃজনশীল মনন
পৃথিবীতে এযাবতকালে যুদ্ধের বিরুদ্ধে মানুষ যতভাবে সোচ্চার হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও শক্তিশালী একটি সৃষ্টির নাম ‘গুয়ের্নিকা’। এই মহান শিল্পকর্মের চিত্রকর পাবলো পিকাসো যখন ভেবেছিলেন, তিনি যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন, তাকে কি পাল্টা অস্ত্র নিয়ে নামতে হয়েছিল? না, তিনি শুধু তার রং-তুলি-ক্যানভাস নিয়েই সৃষ্টি করেছিলেন অমর এক পেইন্টিং। এই অভাবনীয় সৃজনশীলতার কারণেই আজ সুদীর্ঘ আট দশক পরেও যুদ্ধবাজ বর্বরদের বিরুদ্ধে মানবিকতার আহ্বানের দলিল হয়ে আছে এই ছবিটি।
বর্তমান পৃথিবীতে তো বটেই, ভবিষ্যতেও মানুষের সভ্যতার অন্যতম প্রধান বুনিয়াদ হয়ে থাকবে মানুষের সৃজনশীলতা। সৃজনশীল মানুষ তার কাজে নিজের স্বকীয়তা প্রদর্শন করতে পারে, যেটার কারণেই সে অন্যদের চেয়ে আলাদা হয়, ভিন্নমাত্রার গুরুত্ব পায়। ঢাকা শহরে সাম্প্রতিক সময়ে নিশ্চয়ই আপনি উবার কিংবা পাঠাওয়ের মতো রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ব্যবহার করেছেন? ঢাকার মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ি কিংবা মোটরসাইকেল কিন্তু আগেও ছিল; তবে এগুলোকে যে এভাবে ব্যবহার করে শহরের নাগরিকদের একটা সুবিধাজনক পরিবহন সেবা দেওয়া যায় কিংবা গাড়ির মালিকদের আয়ের উৎস তৈরি করা যায়- সেটা কিন্তু আগে কেউ ভাবেনি! এটাই হলো সৃজনশীলতার উদাহরণ।
সময়ের সাথে সাথে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ কমছে, দূষণ বাড়ছে, তাপমাত্রা বেড়ে বরফ গলছে, এমনকি পৃথিবীর কক্ষপথে বাড়ছে মহাকাশ বর্জ্যের পরিমাণ। দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততা বাড়ছে, জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর জন্য আধুনিক হচ্ছে প্রযুক্তি। এই যে পরিস্থিতি- নানাবিধ সমস্যা আর সম্ভাবনার মাঝে আমাদের বসবাস- এগুলোকে সমন্বয় করেই প্রতিটি সংকটের জন্য একটি কার্যকর সমাধান বের করা, এটাই সৃজনশীল মানুষের কাজ।
শিশুদের সৃজনশীলতার বিকাশের জন্য আজকের স্কুলগুলোতে কি বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে? সিলেবাসের অন্য সব বিষয়ের চেয়ে সহজ ধরে নিয়ে চারুকলার জন্য সবচেয়ে কম সময় দেওয়াটাই কিন্তু এখনও বহুল প্রচলিত রীতি। কোনোমতে পরীক্ষা পাশের জন্য ছবি আঁকে এখনকার বাচ্চারা, এমনকি ক্লাস টেনে উঠে ব্যবহারিকের ছবি পর্যন্ত পেশাদার শিল্পীদের দিয়ে আঁকিয়ে নেওয়া হয়, নিজেরা আঁকতে পারে না। শুধু কি ছবি আঁকা? গল্প, গান, সিনেমা সহ শিল্পের যাবতীয় রূপের সাথে শিশুকে পরিচিত করিয়ে দেওয়া নিয়ে আমাদের দেশের কয়টি স্কুল চিন্তিত?
অথচ এই ছবি আঁকা মানে কিন্তু শুধু আঁকিয়ে হওয়া নয়, গল্প তৈরি করা মানেই কেবল লেখক হওয়া নয়। একটা শিশুকে যখন কাগজ-কলম-কাঁচি-রং-আঠা দিয়ে কিছু বানাতে বলা হয়, তখন সে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন বস্তুর আকার-আকৃতি-পরিমাপ সম্পর্কে ধারণা পায়- তার জ্যামিতিক দক্ষতা বাড়ে। সে যখন অনেকগুলো কাগজে রং করে সেগুলো আঠা দিয়ে জোড়া লাগাতে যায়, তখন কতটুকু আঠা দিলে সেটা শক্ত করে লাগবে, কীভাবে রাখলে রং গড়িয়ে পড়বে না- এসব নানাবিধ বিষয় ভাবতে ভাবতেই তার সৃজনশীলতার বিকাশ হয়। কোন রঙের সাথে কোন রঙ মেলালে কী হয় কিংবা আটটি কোণাবিশিষ্ট একটি প্যাটার্ন কীভাবে বানাতে হয়- সেগুলো ভাবতে গিয়ে তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়ে, বিজ্ঞানমনস্কতা তৈরি হয়। নিজের মতো গল্প লিখতে দিলে সে নিজের মাথায় যা চলছে তা কাগজে লিখতে শেখে। একগাদা রচনা মুখস্থ করিয়ে কিন্তু সেই লেখার দক্ষতাটি অর্জন করানো সম্ভব নয়, যেটা সম্ভব শিশুকে গল্প তৈরি করতে দিলে। এধরনের কাজের সময় শিশুকে অনেক কিছু কল্পনা করতে হয়, যার ফলে উন্নতি ঘটে তার কল্পনাশক্তির। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য কিন্তু এই কল্পনাশক্তির গুরুত্ব অপরীসিম, ইকারাসের মতো ওড়ার কথা কল্পনা করতে না জানলে তো আর মানুষ উড়োজাহাজ আবিষ্কারের কথা ভাবতেও পারত না!
এমনকি এসব হাতের কাজ করতে করতে শিশু শারীরিকভাবেও সুগঠিত হয়ে উঠে। হাত-পা নাড়িয়ে, এমনকি ঘাম ঝরিয়ে যখন সে কাজ করতে শেখে, তখন তার শরীরের নাজুক অংশগুলো ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠে। হাতের সাথে চোখের সমন্বয় দক্ষতা এবং ইন্দ্রিয়গুলোর সূক্ষ্মতা বাড়ায় এসব সৃজনশীল কাজ। শিশু নিজে নিজে যখন একটা কিছু তৈরি করে, তখন তার মধ্যে আত্মসম্মানবোধ তৈরি হয়, আত্মবিশ্বাস বাড়ে। বন্ধুবান্ধব মিলে গেইম খেলার জন্য কিংবা শুধুই আড্ডা মারার জন্য আজকাল তরুণরা যেসব ‘হ্যাংআউট’ করে, তার বদলে তারা নতুন কোনো কিছু তৈরি করার জন্য একত্রিত হতে পারত, যদি ছোটবেলা থেকে তাদের মধ্যে এই নতুন সৃষ্টির প্রবণতাটা গড়ে উঠত। শিশুদের সৃষ্টিশীল মনন তৈরির জন্য যেসব সৃজনশীল কাজের প্রশিক্ষণ ছোটবেলা থেকে দেওয়া উচিত, সেগুলো কি আজকের স্কুলগুলোতে দেওয়া হয়? আদৌ কি তারা এসব নিয়ে ভাবে?
নৈতিক মূল্যবোধ
ধরুন, আপনি একটি পারিবারিক অনুষ্ঠানে আছেন। বাচ্চারা একসাথে হয়ে খেলছে কোনো একটা ঘরে। হঠাৎ দেখা গেল, কোনো একটি বাচ্চা চিৎকার করে কেঁদে উঠল, আপনারা দৌড়ে সেখানে গেলেন। দেখলেন, সে কাঁদছে কারণ আপনার বাচ্চাটি তার খেলনা ভেঙে ফেলেছে। ঠিক এই মুহূর্তে আপনি কী করবেন? আপনার বাচ্চাকে শাস্তি দেবেন? তাকে দিয়ে জোর করে ‘সরি’ বলাবেন? নাকি কিছু না করেই তাকে সেখান থেকে নিয়ে চলে আসবেন?
এমন যদি হতো, আপনার বাচ্চাকে আপনি শিখিয়েছেন সবার সাথে ভালো ব্যবহারের কথা, কারও জিনিস ভুলে নষ্ট করে ফেললে ‘সরি’ বলার কথা, যে মনে কষ্ট পেয়েছে সে যাতে কষ্টটা ভুলে যায় সেজন্য তাকে আবার নিজেই কিছু একটা বানিয়ে উপহার দেওয়া কথা- এসব শিক্ষা পেলে এধরনের ঘটনা সামাল দেওয়াটা কিন্তু খুব সহজ হয়ে যাবে। একইভাবে আপনি যদি পরবর্তীতে আপনার বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করেন যে কেন সে অন্যজনের খেলনা ভেঙে ফেলেছে এবং সে যদি তখন জানায়, অন্যজনের খেলনা তার খেলনার চেয়ে বড় তাই ভেঙেছে- তখন আপনি তাকে শেখাতে পারেন যে, কেন হিংসা জাতীয় অনুভূতিকে গুরুত্ব দিয়ে এধরনের কাজ করা ঠিক নয়।
এই আলোচনার কারণ হলো, শিশুর আবেগীয় অনুভূতিগুলোকে সঠিকভাবে বুঝে সে অনুযায়ী তাকে নৈতিক শিক্ষা দেওয়ার কাজটি কিন্তু তার একজন মানবিক মানুষ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে অসামান্য ভূমিকা রাখে। শিশু যদি দেখে যে, দুষ্টুমি করার পর সত্যি কথা বললে সে বকা খাচ্ছে আর মিথ্যা বললে সে পার পেয়ে যাচ্ছে, তখন সে মিথ্যা বলাটা শিখবে। আবার সে যদি দেখে যে, খুব মনোযোগ না দিয়ে ছবি আঁকার পরেও সে অনেক বেশি প্রশংসা পাচ্ছে, তখন তার মধ্যে অধ্যাবসায়ের তাড়নাটা তৈরি হবে না। যেখানে বলা দরকার, ‘তুমি চাইলে আরও ভালো করতে পারবে’, সেখানে যদি বলা হয় ‘তুমি সবচেয়ে ভালো করেছ’; তাহলে তার মধ্যে আরও ভালো করার আকাঙ্ক্ষাটি তৈরি না-ও হতে পারে। পরিশ্রম, সততা, সময়ানুবর্তীতা শেখা, ভালো-মন্দের তফাত বুঝতে পারা, মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া- ইত্যাদি সমস্ত নৈতিক গুণাবলী একটি শিশু বই পড়ে একদিনেই শিখবে না। এর জন্য চাই তার শিক্ষকদের আলাদা পরিকল্পনা। শিশুর মন-মেজাজ-আচরণ বুঝে তাকে মানবিক মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষিত শিক্ষকরাই কেবল পারবেন এই নৈতিক ভিত্তিটা তৈরি করতে। আমাদের আজকের স্কুলগুলোতে কি শিশুর নৈতিক শিক্ষা নিয়ে সেরকম কোনো পরিকল্পনা করা হয়?
তাহলে কী করবেন?
শিশুদের স্কুল নিয়ে ভাবার সবচেয়ে জরুরি সময়টা এখনই। আপনার বাচ্চা স্কুলে গিয়ে যদি চিন্তা করতে না শেখে, যদি সে নতুন কিছু তৈরি করতে না শেখে, যদি সে নৈতিকতার শিক্ষা না পায়; তাহলে তার ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে আপনার শঙ্কার অবকাশ রয়ে গেছে। একদিনের মধ্যেই দেশের সমস্ত স্কুলের সিলেবাস পাল্টে ফেলা সম্ভব নয়, হুট করেই শিক্ষাপদ্ধতি পাল্টে নতুন করে সাজানোও সম্ভব নয়। এই দেরিটুকু হতে হতে কিন্তু আপনার বাচ্চার সম্ভাবনাগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই যদি এমন কোনো সুযোগ পান, যেখানে আপনার বাচ্চাকে নিয়ে গেলে হয়তো আপনি নিজেই তাকে নতুন করে করে চিনতে পারবেন- তাহলে কেন সেখানে যাবেন না?
আপনার শিশুর মাঝে যেসব গুণাবলী লুকিয়ে আছে সেগুলো আবিষ্কার করে আনার দায়িত্বটা আপনি তাদেরকে দিন, যারা এই বিষয়গুলো নিয়ে দক্ষতার সাথে কাজ করছে। যারা আগামীর পৃথিবীটাকে নিয়ে ভাবছে, আজকের প্রজন্মকে সেই অনুযায়ী গড়ে তোলার জন্য একটু হলেও চেষ্টা করে যাচ্ছে। স্বপ্নের মতো একটা স্কুল বানিয়ে এমনই একদল স্বপ্নবাজ তরুণ শিশুদের নিয়ে কাজ করে চলেছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে। তারা তাদের এই স্কুলের নাম দিয়েছে কিডস টাইম। শিশুদের নতুন পৃথিবীর যোগ্য নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে যে বুনিয়াদ তৈরি করা দরকার, এই তরুণেরা সেটা নিয়েই গবেষণা করছে, সেভাবেই তাদের স্কুলটিকে চালিয়ে যাচ্ছে। আপনিও যদি আপনার শিশুকে নিয়ে সেই স্বপ্ন দেখেন, তাহলে একবার এসে ঘুরে যেতে পারেন! এই রেজিস্ট্রেশন লিংকে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করুন, তারপর চলে আসুন আপনার বাসার সবচেয়ে কাছের কোনো একটি স্কুলে। আপনার শিশুর ভবিষ্যৎ আপনার হাতেই!
রেজিস্ট্রেশন করতে ক্লিক করুন এখানে। ঢাকার মিরপুর, ধানমন্ডি আর উত্তরার স্কুলে চলছে রেজিস্ট্রেশন!
স্কুলটি নিয়ে আরও পড়ুন এখানে: স্বপ্নের মতো একটা স্কুল আছে আমাদের
ফিচার ইমেজ © Kids Time