শিক্ষাজীবনে একাডেমিক কার্যক্রমের পাশাপাশি আমরা অনেকেই যুক্ত থাকি বিভিন্ন সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমে। বিদ্যালয়ে পড়ায় মূল উদ্দেশ্য শিক্ষার্জন হলেও মনন বিকাশ, যোগাযোগ বৃদ্ধি বা নেতৃত্ব বিকাশের মতো দক্ষতাগুলো অর্জন করা শিক্ষার্থীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের চর্চা শিক্ষার্থীদের উপর চাপ কমায় ও মনোযোগ বিকেন্দ্রীকরণের একটি সুযোগ তৈরি করে দেয়। পড়াশোনার পাশাপাশি সুস্থ বিনোদন ও মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য তাই সহশিক্ষা কার্যক্রমের চর্চাটা দরকার।
সহশিক্ষা কার্যক্রম বলতে আমরা সাধারণ অর্থে বিতর্ক, আঁকাআঁকি, নাচ-গান, আবৃত্তি, অভিনয়, বক্তব্য ইত্যাদি বুঝে থাকি। একজন শিক্ষার্থী সাধারণ সে সকল কার্যক্রমেই অংশগ্রহণ করে, যা তার কাছে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ মনে হয়ে। তবে, সহশিক্ষা কার্যক্রম বিনোদনের একটি অন্যতম প্রধান উপায় হলেও সকল ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমই যে শুধুমাত্র বিনোদনের উদ্দেশ্যে চর্চা করা হয়, তা কিন্তু নয়। শিক্ষাজীবনে নিজেকে ভালোভাবে প্রস্তুত করে গড়ে তুলতে সহযোগী পাঁচটি সহশিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে আজকের লেখায় আলোচনা করা হবে।
স্কাউটিং
স্কুল বা কলেজ পর্যায়েই স্কাউটিং শুরু করা বেশ ভালো সিদ্ধান্ত। স্কাউটিং মূলত মাঠপর্যায়ে দলগত কাজ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ ও মৌলিক জীবন দক্ষতা সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। স্কুল-কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাধারণত স্কাউটদেরই নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। প্রতি স্কাউট দলের একজন করে দলনেতা থাকে, যাকে সিনিয়র পেট্রোল লিডার বলে। দলকে আবার সার্বিকভাবে পরিচালনা করে থাকেন সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের ক্রীড়াশিক্ষক। এভাবেই শৃঙ্খলা প্রশিক্ষণের মূল শিক্ষা স্কাউটাররা পেয়ে থাকে। বিদ্যালয় পর্যায়ে কার্যক্রমের পাশাপাশি বছরান্তে উপজেলা, জেলা, আঞ্চলিক পর্যায়ের স্কাউট সমাবেশ ও সর্বোচ্চ পর্যায়ে ন্যাশনাল জাম্বুরি বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্কাউটিং করার সুযোগও মেলে। নিজের দক্ষতার প্রমাণের মাধ্যমে মেলে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাজ অর্জনের সুযোগ। সর্বোচ্চ পর্যায়ে একজন স্কাউট প্রেসিডেন্ট স্কাউট ব্যাজও অর্জন করতে পারে।
এ তো গেল স্কাউটারদের দায়িত্ব পালন ও আনুষঙ্গিক আলোচনা। হাইকিং, তাঁবু জলসা, ক্যাম্প ফায়ার, ক্যাম্প ভিজিটের মতো মজার সব অভিজ্ঞতাও স্কাউটিং থেকেই পাওয়া যায়। অন্য বন্ধুরা যখন ছুটির দিনগুলোতে বাসায় বসে অলস সময় পার করছে, আপনি তখন সারাদিনের হাইকিং শেষে শীতের রাতে তাঁবুর পাশে বসে ক্যাম্পফায়ারে অন্য সব স্কাউটারের সাথে আড্ডায় সময় কাটাচ্ছেন, এর থেকে ভালো ছুটি আর কী হতে পারে!
বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৭০টি দেশের পাঁচ কোটি স্কাউট সদস্য রয়েছে। তাই বিশাল কমিউনিটির একজন হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা একজন শিক্ষার্থীকে শুরু থেকেই কর্মক্ষেত্রে দক্ষ করে তোলার শিক্ষা প্রদান করবে। যে কারণে সহশিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে স্কাউটিং করাটা বেশ ফলপ্রসূ।
বিতর্ক
যুক্তি দিয়ে মুক্তি মেলে কি মেলে না, তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তবে বিতর্ক শিখে উপকার বৈ অপকার হয়েছে, এমনটি খুঁজে পাওয়া যাবে না। স্কুল, কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও অনেকে বিতর্কের সাথে সম্পৃক্ত হয়। সহশিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে যে ক’টি নাম সবার আগে চলে আসে, তার মাঝে বিতর্ক একটি। কোনো বিষয় নিয়ে কতভাবে, কত আঙ্গিকে চিন্তা করা যায়, তা শেখায় বিতর্ক। আর সে চিন্তাগুলো পরিপূর্ণতা পায় তখনই, যখন তাতে থাকে যথাযথ যুক্তির মিশেল। তাই আর দশজন মানুষের চিন্তাধারা থেকে নিজের চিন্তাধারাকে একটি গ্রহণযোগ্য মাত্রা দিতে বিতর্কের চেয়ে ভালো বিকল্প আর হয় না।
বিতর্কের মাধ্যমে নিজেকে উপস্থাপন করতে শেখা যায়। জনা দশেক মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে আমাদের অনেকের মাঝেই হয়তো আড়ষ্টতা কাজ করে। এ আড়ষ্টতা কাটানোর জন্যে বিতর্ক চর্চা বেশ সহায়ক। নিয়মিত কথা বলার চর্চা করলে ধীরে ধীরে জড়তা কেটে যায়। পাশাপাশি বিতর্ক একজন শিক্ষার্থীকে পরমতসহিষ্ণু করে তোলে। বর্তমান সময়ে মানুষ একে অন্যের মতামতকে সম্মান করতে ভুলে যাচ্ছে, ভুল হলেও যেকোনো উপায়ে নিজের মতামতকে চাপিয়ে দেওয়ার যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সেরকম একটি সময়ে এখনো বিতার্কিকরা প্রতিপক্ষের যুক্তি শুনছে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি জানছে।
তবে শুধু দক্ষতাই অর্জন নয়, জ্ঞানের দিকটা সমৃদ্ধ করতেও বিতর্কের বড় ভূমিকা রয়েছে। বিতর্ক সাধারণত সাহিত্য, রাজনীতি, আইন, নৈতিকতা, অর্থনীতি, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে। একজন বিতার্কিককে এ সকল ব্যাপারে তাই সবসময় জানাশোনা রাখতে হয়। বিতর্ক করতে হলে প্রয়োজন প্রচুর পড়াশোনা আর সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে নিয়মিত আপডেটেড থাকা। জ্ঞানের বিকাশগত জায়গা থেকে বিতর্কের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
কুইজ প্রতিযোগিতা
হালের জনপ্রিয় ‘কে হতে চায় কোটিপতি’ বা ‘স্পেলিং বি’ প্রতিযোগিতা টেলিভিশনের পর্দায় আমরা অনেকেই দেখেছি। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে স্বাধীনতা বা বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত বিশেষ কুইজ প্রতিযোগিতা, কিংবা ইংরেজি স্কুলগুলিতে ডিসি, মার্ভেল বা পটারহেডদের জন্যে কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন তো হরহামেশাই চোখে পড়ে। প্রচলিত কুইজ প্রতিযোগিতার আরেকটু আপগ্রেডেড প্রতিযোগিতা হচ্ছে আঞ্চলিক, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অলিম্পিয়াডগুলো।
এই প্রতিযোগিতাগুলো সাধারণত পাঠ্যবই বা তার বাইরের বিষয় থেকে হয়ে থাকে। যে কারণে একজন কুইজারকে একইসাথে জানা থাকতে হয় অনেক কিছু। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার মতো নিতান্ত বাধ্য হয়ে কুইজের পড়াশোনা করতে হয় না বিধায় খানিকটা পড়ুয়াদের কাছে কুইজ অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটি সহশিক্ষা কার্যক্রম।
আবৃত্তি
আবৃত্তি মূলত কবিতা বা কোনো গদ্য লেখনীর হয়ে থাকে। প্রচলিতভাবে আবৃত্তি খুব সাধারণ একটি সহশিক্ষা কার্যক্রম মনে হলেও এর শিখনফল সুদূরপ্রসারী। আবৃত্তি যারা নিয়মিত করে বা শেখে, তাদের কথা বলার ধরনে থাকে শৈল্পিক ছোঁয়া। আবৃত্তিকার হতে হলে গম্ভীর বা রাশভারি কণ্ঠস্বর হতে হবে, এমনটা জরুরি নয়। বরং কণ্ঠস্বর যেমনই হোক না কেন, তাতে শব্দের গাঁথুনি হতে হয় শুদ্ধ ও স্পষ্ট। সাধারণত সাহিত্যে অধিকতর দখল থাকে বিধায় একজন আবৃত্তিকারের শব্দচয়ন অন্য যে কারোর থেকে সুসংবদ্ধ ও শ্রুতিমধুর হয়।
একজন বক্তা মূলত তার বক্তব্যের দ্বারাই শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। আর তাই বক্তাদের চাই বক্তব্যের যৌক্তিকতা, বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্য ও শ্রুতিমাধুর্য। এ তিনের সমষ্টি হলে শ্রোতা কখনো আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে না। পাশাপাশি, শিক্ষাজীবন শেষে কর্মক্ষেত্রের নিয়োগ পরীক্ষা বা অন্য যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রেও আমাদেরকে ভাইভা বোর্ডের সম্মুখীন হতে হয়। ভাইভা বোর্ডে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান, একাডেমিক রেকর্ড ইত্যাদির পাশাপাশি যোগাযোগ দক্ষতা ও ভাষার ব্যবহারও বড় একটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তাই শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই আবৃত্তির মতো সহশিক্ষা কার্যক্রমগুলির সাথে সংযুক্ত থাকলে ভবিষ্যত জীবনেও এর ভালো ফল মিলবে।
লেখালেখি
আমাদের অনেকেরই কন্টেন্ট রাইটিংয়ের উপর প্রথমজীবন থেকে বেশ ভালো দখল থাকে। বিশেষ করে যারা খানিকটা লাজুক প্রকৃতির, তারা উপরের চার ধরনের সহশিক্ষা কার্যক্রমে যোগ দিতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ না করলেও লেখালেখির কাজটা করতে তাদের খুব একটা অসুবিধে হয় না। তাই একজন শিক্ষার্থী যদি একান্তই জনপরিসরের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত কোনো সহশিক্ষা কার্যক্রমে যোগ দিতে না চায়, তবে রচনা লেখা প্রতিযোগিতা বা ওয়াল ম্যাগাজিন, স্ক্রিপ্টবুক রাইটিংয়ের মতো কাজগুলোতে সময় দেয়া যায়। এতে করে লেখার ধরনে যথেষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তন আসে, নতুন নতুন আঙ্গিকে লেখা যায়। শিক্ষাজীবন থেকেই যারা এ ধরনের কাজের সাথে সম্পর্কিত থাকেন, পরবর্তী সময়ে রিপোর্ট রাইটিং বা ব্লগ রাইটিংয়ের মতো আনুষ্ঠানিক ক্ষেত্রগুলোতে তাদের কাজ যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন ও দক্ষ হয়।
একুশ শতকের জীবনে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি বর্তমান প্রজন্মের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে একাডেমিক জ্ঞানের পাশাপাশি চাই অতিরিক্ত কিছু যোগ্যতা অর্জন, যা ব্যক্তিকে আর দশজনের তুলনায় আলাদা হিসেবে উপস্থাপন করবে। পড়াশোনার পাশাপাশি নেতৃত্ব, বাগ্মিতা, দলীয় কাজের অভিজ্ঞতা, চমৎকার উপস্থাপনার মতো দক্ষতাগুলো তাই কর্মক্ষেত্রেও তাকে এগিয়ে রাখবে সবার আগে, আর সেজন্য চাই সহশিক্ষা কার্যক্রমের নিয়মিত চর্চা।