পৃথিবীর বয়স বাড়ার সাথে সাথে তথ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, মানুষের গল্প বৃদ্ধি পাচ্ছে, কল্পনাশক্তির বদৌলতে তৈরি হচ্ছে হাজার হাজার গল্প, উপন্যাস। লেখক বাড়ছে, সাথে বাড়ছে বইয়ের সংখ্যা। পত্রিকা-ম্যাগাজিনের সাথে সাথে অনলাইন কমিউনিটিগুলো বেশ বড় হচ্ছে। ব্লগ, ই-ম্যাগাজিন, ই-নিউজ সহ আরো হাজার হাজার মাধ্যম কাজ করছে মানুষের কাছে সঠিক তথ্য সংবলিত লেখা পৌঁছে দিতে। সারা পৃথিবী জুড়ে অবস্থান করা কল্পনাপ্রবণ লেখকদের সংখ্যাও কম না। তারা বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত আর নিজেদের কল্পনাশক্তিকে পুঁজি করে লিখে যাচ্ছেন নানা কল্প-কাহিনী। অবসরে বিনোদন দিয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি পাঠকদের।
এক জায়গায় এসে এই পাঠকরা দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে। একভাগ কোনো একটি বই পড়ার পর বিস্তারিত মনে রাখতে পারে। আরেক ভাগ পড়ার পর আস্তে আস্তে বইয়ের প্রত্যেকটি জিনিস ভুলে যায়। এমনকি বইয়ের শিরোনামও! প্রয়োজনের খাতিরে পড়া বইগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো ব্যাপারেও তাদের ধারণা থাকে না।
‘এমন কেন হয়?’ প্রশ্নটা সহজ হলেও, উত্তর বেশ কঠিন। তবে এতোটুকু বলা যায়, এই দু’ভাগকে ‘কী পড়েছে?’ কিংবা ‘একদল আরেক দলের চেয়ে জ্ঞানী বা উন্নত মস্তিষ্ক সম্পন্ন’ বলে ভাগ করা যাবে না। বরং ‘তারা কীভাবে পড়ছে?’ প্রশ্নটির উত্তরে আলোকপাত করলেই পুরো ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
‘পড়ার’ ব্যাপারে কিছু ভ্রান্ত ধারণা দূর করা উচিত
১) “Quality matters more than quantity” কথাটি কোনো বই পড়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। অমনোযোগী হয়ে কোনো একটি লাইব্রেরির অর্ধেক বই পড়ে ফেলার চাইতে মর্ম উপলব্ধি করে শুধুমাত্র একটি বই আত্মস্থ করাও উত্তম।
২) ‘স্পীড-রিডিং‘ ধারণাটিকে এড়িয়ে চলুন। দ্রুত পড়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে নিয়মিত বই পড়া।
৩) কোনো বইয়ের সংক্ষেপিত সংস্করণ না পড়ে পুরো বইটি পড়ুন। এতে আপনার প্রয়োজনীয় কোনো তথ্য ছুটে যাওয়ার সম্ভাবনা শূন্য শতাংশে এসে পৌঁছাবে।
৪) নিজের কাছে বিরক্তিকর মনে হওয়া বইগুলোকে এড়িয়ে চলুন।
বই পড়ার পূর্বে কয়েকটি বিষয়ে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন
১) বই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম-নীতি অনুসরণ করার প্রয়োজন নেই। ব্যাপারটা এমন নয় যে, পড়ার জন্য আপনাকে সবচাইতে বেশি বিক্রীত বা অধিকাংশ পাঠকদের দ্বারা সমাদৃত বইটি বাছাই করতে হবে। যেহেতু আপনি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কোর্স সম্পন্ন করার জন্য বইটি পড়তে যাচ্ছেন না, সেহেতু ইচ্ছেমতো বাছাই করুন। আপনার আগ্রহের বিষয়গুলোর ব্যাপারে মনযোগী হোন। তবে হ্যাঁ, অনুবাদ পড়ার ক্ষেত্রে আগে দেখুন ক’জন অনুবাদক দ্বারা অনুবাদ সম্পন্ন করা করা হয়েছে। এরপর পাঠক সমাজের মতামতের উপর ভিত্তি করে আপনি সবচাইতে ভালোটা বাছাই করতে পারেন।
২) একটি বই পড়ার পূর্বে বইটির ব্যাপারে ধারণা নিতে চেষ্টা করুন। নিজেকে প্রশ্ন করুন, বইটির বিষয়বস্তু কী? কী উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে? ঐ সময়টাতে পারিপার্শ্বিক অবস্থা কেমন ছিল? কী কী বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে? সে সময় কোনো যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা বা উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেছিল কিনা? এবং সাথে সাথে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করুন। এতে করে পড়ার সময় অনেক অপ্রত্যাশিত প্রসঙ্গ খুব সহজেই বুঝে উঠতে পারবেন।
৩) নিজেকে প্রশ্ন করুন, কেন বইটি পড়ার জন্য বাছাই করেছেন? বিনোদনের জন্য, নাকি কোনোকিছু বা কারো ব্যাপারে জানার জন্য? কর্মক্ষেত্রে উন্নতির জন্য, নাকি নতুন কোনো দক্ষতা অর্জনের জন্য? আপনার অবশ্যই ধারণা থাকতে হবে, আপনি কী ধরনের জিনিস বাছাইকৃত বইটি থেকে পেতে যাচ্ছেন। আপনি অবশ্যই হরেক রকম অপ্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহের ব্যাপারে আগ্রহী নন!
৪) নন-ফিকশনাল, দক্ষতা বৃদ্ধির বইগুলো পড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা, সম্পাদকের কথা, গ্রন্থবিবরণী, তথ্যসূত্রগুলোতে চোখ বুলাতে পারেন। একটি বই লেখার জন্য লেখককে অসংখ্য বই পড়তে হয়। নানান পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। আর এই বিষয়বস্তুগুলোই উপরোক্ত জায়গাগুলোতে উল্লেখ করা থাকে। আগ্রহের বিষয়টির উপর আরো বেশি দক্ষ হওয়ার জন্য এসব বেশ সাহায্য করে থাকে।
৫) আপনার পরিস্থিতি বিবেচনা করে বই বাছাই করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, আপনি সামনের ছুটিতে লাদাখ যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। সেই সুবাদে শঙ্কু মহারাজের ‘লাদাখের পথে’ পড়তে পারেন। কোনোকিছুতে অভ্যাস তৈরির চেষ্টা করছেন, তাহলে চার্লস ঢুহিগের ‘পাওয়ার অফ হ্যাবিট’ পড়তে পারেন। যদিও পারিপার্শ্বিক অবস্থা, নিজস্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় এনে সব সময় বই বাছাই করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তবে বর্তমানের চ্যালেঞ্জগুলোকে আরো ভালভাবে মোকাবেলা করার জন্য, পরিস্থিতিগুলো আরো ভালভাবে সামাল দেওয়ার জন্য এটি বেশ কার্যকর উপায়।
পড়ার সময় যা করণীয়
১) কোনোকিছু মনে রাখার সবচাইতে সহজ উপায় হচ্ছে সেই বিষয়াদির উপর নোট রাখা। কোনোকিছু পড়ে মনে রাখার ব্যাপারেও এই পদ্ধতিটি ফলদায়ক। যা পড়ছেন তার উপর সংক্ষিপ্ত আকারে নোট করে রাখুন। নোট রাখার জন্য নিজের পছন্দের পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন। হয়তো ছোট প্যাড খাতা ব্যবহার করে ক্রমানুসারে প্রত্যেকটি অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো লিখে রাখতে পারেন। অথবা একই কাজ ছোট ছোট কার্ড বা স্টিকি পেপারে লিখে বইয়ের নির্দিষ্ট অধ্যায়ে বুকমার্ক আঁকারে রাখতে পারেন।
২) কোনো বই পড়ার সময় ঐ বইটি ছাড়া অন্য যেকোনো জিনিসের প্রতি ফোকাস করা থেকে বিরত থাকুন। প্রয়োজনে ফোন বন্ধ রাখুন। বিরক্তি কিংবা মনোযোগ আকর্ষণের কারণ হতে পারে এমন সব জিনিস থেকে দূরে থাকুন। মনে রাখবেন, বইয়ের প্রত্যেকটি জিনিসকে আত্মস্থ করার জন্য পুরো মনোযোগ প্রয়োজন। সক্রিয় পাঠকদের কাছ থেকে বই গভীর মনোযোগ দাবি করে।
৩) ছোটকাল থেকেই আমাদের ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, বইয়ে দাগ কাটা বা লেখালিখি করা যাবে না। কিন্তু আপনি যদি কোনো বই মনে রাখতে বা আত্মস্থ করতে চান, তাহলে অবশ্যই আপনাকে বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো চিহ্নিত করে রাখতে হবে। নোট রাখার মাধ্যমে কাজটি করা গেলেও, নোট হারিয়ে যেতে পারে। কিংবা সময়ে-অসময়ে নোটটি ধারে-কাছে না-ও থাকতে পারে। তাই বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোতে পেন্সিল অথবা সাইনপেন দিয়ে চিহ্নিত করে রাখতে পারেন। এক্ষেত্রে হাইলাইটার-কলমগুলোও বেশ কাজের। তাছাড়া বইয়ের বিভিন্ন অংশে আপনি আপনার মন্তব্য লিখে রাখতে পারেন। অথবা অন্য ভাষায় লেখা বই হলে, অপরিচিত শব্দগুলোর অর্থও সংগ্রহ করে লিখে রাখতে পারেন। এতে করে ‘মনে রাখতেই হবে’ অংশগুলো খুব ভালভাবে মনে গেঁথে যাবে। এছাড়াও দ্বিতীয়বার বইটি পড়তে গেলে আপনি খুব সহজেই পূর্বের না বোঝা বিষয়াদি খুব সহজেই বুঝে যেতে পারবেন।
৪) বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অথবা অংশ পড়ার পর থামুন এবং সেই অংশের পরিষ্কার একটি চিত্র কল্পনা করার চেষ্টা করুন। চিত্রটি যত বেশি দৃষ্টিগোচর হবে, তত বেশি মনে থাকার সম্ভাবনা তৈরি হবে।
৫) বইয়ের ধারণা, বিষয়াদিগুলোকে বাস্তব জীবনের ঘটনা, অন্য কোনো বইয়ে উল্লিখিত অংশ, অথবা পূর্ব অভিজ্ঞতার সাথে সংযুক্ত করতে চেষ্টা করুন। এতে মনে থাকার পরিমাণ আরো বেড়ে যায়।
৬) বইটির ব্যাপারে মস্তিষ্কে নিজস্ব একটি ধারণা তৈরি করুন! নিজেকে নিচের প্রশ্নগুলো করে নিজে নিজে উত্তর খোঁজার চেষ্টার মাধ্যমে ধারণাটি তৈরি করতে পারেন। যেমন: বইটি কি আপনার আদর্শের সাথে মিলে যাচ্ছে? বইয়ের কোন চরিত্রটি আপনার সবচাইতে ভালো লেগেছে? বইয়ের লেখক উল্লিখিত বিষয়টির উপর যেসব তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো কি পর্যাপ্ত? আপনি কি এর চাইতে ভালো কিছু লিখতে পারতেন? কোন অধ্যায়টা নিজের ব্যক্তিজীবনে প্রয়োগ করতে পারবেন? বইটি পড়ার সাথে সাথে কি আপনার মধ্যে কোনো পরিবর্তন এসেছে? এর মাধ্যমে বিভিন্ন আঙ্গিকে বইটিকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পাবেন। একটি বই আত্মস্থ করার জন্য আর কী প্রয়োজন!
৭) বিরক্তিকর বই পড়া থেকে বিরত থাকুন। পড়তে পছন্দ করে এমন পাঠকরা নিদারুণ বিরক্তিকর বইগুলো এড়িয়ে চলে। জার্মান দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ার এব্যাপারে বলেছিলেন, “One can never read too little of bad, or too much of good books: bad books are intellectual poison; they destroy the mind.” জেমস জয়েসের মতে, “Life is too short to read a bad book.”
একটি বই শেষ করার পর আমরা বইটি নিয়ে ভাবার চেষ্টা করি না। হয়তো নতুন আরেকটি বইয়ের মধ্যে নিজেদের নিমজ্জিত করে রাখি। কিন্তু আপনি যদি বইটি থেকে কিছু পেতে চান, অথবা বইয়ের কথাগুলো আত্মস্থ করতে চান, তাহলে অবশ্যই বইটি পড়ে শেষ করার পর বইটি নিয়ে ভাবতে হবে।
আরো কিছু পদ্ধতি!
১) ফাইনম্যান টেকনিক প্রয়োগ করতে পারেন। ফিজিক্সে নোবেল প্রাইজ পাওয়া বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান কোনোকিছু মনে রাখার জন্য চারটি কৌশল বাৎলে দিয়েছেন। প্রথমত, তিনি যেকোনো একটি ধারণা, অধ্যায় বা বিষয় বাছাই করতে বলেছেন। দ্বিতীয়ত, ঐ বিষয়টি সম্পর্কে অনেক অল্প জানে, এমন কাউকে শেখাতে বলেছেন। তৃতীয়ত, যদি আপনার মনে হয় যে, বিষটি সম্পর্কে আপনার জানার পরিমাণ কম, তাহলে আবার শেখার উৎসের দিকে মনোযোগ নিবন্ধনের কথা বলেছেন। সর্বশেষ, বিষয়টিকে সহজভাবে পর্যালোচনার মাধ্যমে উপস্থাপন করার কথা বলেছেন।
২) বইয়ের মূল ধারণাগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করুন। নিজের জীবনে সেগুলো প্রয়োগের চেষ্টা করুন। পড়ার পর যদি মনে হয়, বইয়ের নির্দিষ্ট ধারণাটি আপনি আপনার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারবেন, তাহলে সাথে সাথে প্রয়োগ করুন। ফলাফল যা-ই আসুক না কেন, কোনোকিছু শেখা এবং প্রয়োগ করার মাধ্যমেই আমরা সেগুলো আত্মস্থ করতে পারি।
৩) অন্য কাউকে শিক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে আপনি আরো গভীরভাবে কোনো তথ্য বা ধারণা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে পারবেন। এমনকি সে ব্যাপারে নিজের জ্ঞান কতটুকু, সেটি সম্পর্কেও ধারণা করতে পারবেন। তবে খেয়াল রাখুন, শেখানোর সময় যেন সহজ ভাষাটি ব্যবহার করা হয়। প্রয়োজনে বইয়ে ব্যবহৃত কঠিন কথাগুলোকে নিজের মতো করে সহজ করে প্রচার করুন।
৪) পড়ার সময় তৈরি নোটগুলোকে একত্র করুন। একটি নির্দিষ্ট ক্রমে সাজানো চেষ্টা করুন, যাতে পরবর্তীতে হঠাৎ প্রয়োজনে সেগুলোতে চোখ বুলাতে পারেন।
৫) প্রয়োজনে বইটি আবার পড়ুন। সময়ের অপচয় মনে হলেও, ভালো বই একাধিকবার পড়া উচিত। আপনার হয়তো আরো অনেক বই পড়ার আছে। কিন্তু শেখার ক্ষেত্রে একই বই, একই বিষয় সম্পর্কে বারবার পড়ার ব্যাপারটি আপনাকে সে বিষয়ে আরো শক্তিশালী করে তোলে।