আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞায়, পৃথিবীর প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে ইতালির বোলোগনা বিশ্ববিদ্যালয়। তবে, আজকের আলোচ্য বিষয় পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। অনুমান করতে পারবেন নামটি? চলুন আপনাকে কিছু সহায়ক তথ্য জানানো যাক। সেগুলো দেখে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় বের করার চেষ্টা করুন।
- এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ইংরেজি ভাষার প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়।
- এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনীটি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রকাশনী।
- উইলিয়াম গ্লাডস্টোন, মার্গারেট থ্যাচার আর বর্তমানের থেরেসা মে সহ ২৭ জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।
- হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জুলফিকার আলি ভুট্টো, বিল ক্লিন্টন, অং সান সু চি সহ ৩০ জন আন্তর্জাতিক নেতা এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করেছেন।
- পদার্থবিজ্ঞানে ৫ জন, রসায়নে ১১ জন, চিকিৎসাবিজ্ঞানে ১৬ জন সহ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
- স্টিফেন হকিং, রবার্ট হুক, রবার্ট বয়েল, এডুইন হাবলের মতো নামকরা বিজ্ঞানীরা এখানে পড়ালেখা করেছেন।
- অ্যাডাম স্মিথ আর অমর্ত্য সেনের মতো ভুবনখ্যাত অর্থনীতিবিদগণ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।
- অস্কার ওয়াইল্ড, টি. এস. ইলিয়ট, জে. আর. আর. টোকিনের মতো কালজয়ী সাহিত্যিকরা এই বিশ্ববিদ্যালয়েই সাহিত্যচর্চা করে গেছেন।
- জন লক, জেরেমি বেন্থাম আর থমাস হবসের মতো অনেক খ্যাতিমান দার্শনিক তাদের দর্শনচর্চা করেছেন এই বিশ্বাবিদ্যালয়ে।
সূত্র ধরিয়ে দিতে থাকলে আরো হাজারো তথ্য হাজির করা সম্ভব এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। কিন্তু তার বোধকরি আর প্রয়োজন নেই। আপনি এতক্ষণে জেনে গেছেন যে, লেখাটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে।
“Dominus Illuminatio Mea” বা “প্রভু আমার আলো” কে নীতিবাক্য হিসেবে বুকে ধারণ করে সেই যে ১০ম শতকে অক্সফোর্ডে উচ্চ শিক্ষার কার্যক্রম শুরু হয়, তা হাজার বছর যাবত অতীত ঐতিহ্য আর সুনাম যথার্থভাবে ধরে রেখে আজও চলছে। এই সময়ে শত শত রথী-মহারথীর পদচারণায় সর্বদাই মুখরিত ছিল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি জ্ঞান সৃষ্টি করার মাঝেও অনন্য হয়ে ওঠে এই বিশ্ববিদ্যালয়। একে আদর্শ মেনে নিয়ে পৃথিবীর আনাচে কানাচে গড়ে উঠেছে কত শত বিশ্ববিদ্যালয় তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু, সেসবের মাঝে ‘অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়’ নামটি মধ্যগগনের সূর্যের মতোই সর্বোচ্চ তেজে জ্বলজ্বল করছে। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষ একনামে যে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে চেনে তা হলো এই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।
যশ আর খ্যাতির চূড়ায় যে বিশ্ববিদ্যালয়টি বসে আছে, তার শুরুর ইতিহাসটি সঠিকভাবে কোথাও লেখা নেই! এ যেন এক চিরন্তন রহস্যেরই নামান্তর। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শুরু হবার লিখিত দলিল পাওয়া যায় ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে। কিন্তু, নানান ঐতিহাসিক তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে এটা নিশ্চিত যে, ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দের আরো কিছুকাল পূর্বেই স্থাপিত হয়েছিল এই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমদিকের একজন বিদেশী অধ্যাপক হিসেবে ‘ইমো অব ফ্রিজল্যান্ড’ এর নাম আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই। রাজা তৃতীয় হেনরির আমলে, ১২৪৮ সালে প্রথম রাজকীয় সনদপত্র লাভ করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।
১২০৯ খ্রিস্টাব্দে, অক্সফোর্ডের স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ বাঁধে এবং প্রচণ্ড মারামারি হয়। তখনো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র শতবর্ষী একটি প্রতিষ্ঠান, সবে নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেছে। এই সংঘর্ষের ফলে অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থী অক্সফোর্ড ত্যাগ করে ক্যামব্রিজ চলে যান, যার সূত্র ধরেই কিছুকাল পর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে, জ্ঞানচর্চায় অক্সফোর্ডের একাধিপত্যের ইতি টেনে ডুয়োপলির সূচনা করে ক্যামব্রিজ। উচ্চশিক্ষার প্রসারে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অপরিসীম তা না বললেও চলে। কিন্তু, ইংল্যান্ডে নিজেদের কর্তৃত্ব ধরে রাখতে জ্ঞান বিকাশের পথকে দীর্ঘকাল প্রসারিত করতে দেয়নি এই দুই প্রতিষ্ঠান। ১৮৩৪ সালে, কয়েকজন পণ্ডিত মিলে স্ট্যামফোর্ডে একটি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে তারা অক্সফোর্ড এবং ক্যামব্রিজের রোষের মুখে পড়ে। তখন রাজা তৃতীয় হেনরি একটি পিটিশন জারি করে দেন, যার দরুন ১৮২০ সালের আগে ইংল্যান্ডে আর কোনো উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি!
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চা প্রথম কয়েকশ বছর কিছুটা চার্চ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তবে সবকিছু পরিবর্তিত হতে শুরু করে রেনেসাঁর সময়। ১৫৩৪ সালে ‘চার্চ অব ইংল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং শীঘ্রই তারা দেশজুড়ে সংস্কারকাজ শুরু করে যা ‘ইংলিশ রিফর্মেশন’ নামে পরিচিত। এ সময় রোমান ক্যাথলিক চার্চ এবং প্রোটেস্ট্যান্টদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে চার্চ অব ইংল্যান্ডের আওতায় চলে আসে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। এতে অসন্তুষ্ট হয়ে অসংখ্য ‘রিকুজেন্ট’ পণ্ডিত এবং শিক্ষার্থী অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে। রিকুজেন্ট বলতে মূলত ক্যাথলিক চার্চের অনুসারী এবং ‘অ্যাংলিকান’ বা ইংরেজ সংস্কারের বিরোধীদের বোঝায়।
সব কিছু মিলিয়ে, ‘এজ অব এনলাইটম্যান্ট’ বা আলোকিত যুগেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে যায়। ক্যাথলিক চার্চে বিশ্বাসী অসংখ্য শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক হারানোর পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম নষ্ট হয়। নতুন শিক্ষার্থী ভর্তির হার অনেক কমে যায়, নেমে যায় পড়ালেখার মানও। তবে, এটি ছিল অক্সফোর্ডের জন্য রূপান্তরের সময়। দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে রেনেসাঁর শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করতে কিছুটা সময় লাগা ছিল খুবই স্বাভাবিক।
যা হোক, ১৭ শতকের শুরুর দিকে আবার প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। ১৬৩৬ সালে ক্যান্টারবুরির আর্চবিশপ উইলিয়াম লড বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন আইনগুলোর সাথে নতুন নতুন ধারা যোগ করে বিধিবদ্ধ করেন। ১৯ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত তার সে সংবিধানেই চলেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। লড বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ছাপাখানাটি আরো শক্তিশালী করেন এবং লাইব্রেরিগুলোকে উন্নত করেন। তাছাড়া, চার্চ অব ইংল্যান্ডের সাথে সংযুক্ততার কারণে নিয়ম ছিল যে, কোনো ‘ডিসেন্টার’ অক্সফোর্ডে স্নাতকোত্তর পড়ালেখা করতে পারবেন না। এই নিয়ম ১৮৭১ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। ডিসেন্টার বলতে চার্চ অব ইংল্যান্ডের অননুগামীদের বোঝানো হতো। অন্যদিকে, চার্চ অব ইংল্যান্ডের সদস্য হতে হলে অক্সফোর্ড থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের নিয়ম ছিল।
এ তো গেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যযুগীয় ইতিহাস। আধুনিক যুগে পদার্পণ করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কেমন যেন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছিল। অক্সফোর্ডে পড়ার সুযোগ পেত কেবল সমাজের উচুস্তরের মানুষ। গরীব কৃষক শ্রেণীর জন্য অক্সফোর্ড ছিল অনেকটা আকাশ কুসুম স্বপ্ন। তাছাড়া অক্সফোর্ডের যে পাঠ্যক্রম চালু ছিল, তা ছিল অতিমাত্রায় সীমিত এবং অবাস্তবধর্মী। অধ্যাপকদের জন্য সুযোগ সুবিধাও ছিল অপ্রতুল। সব দিক থেকে অক্সফোর্ড যখন ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ছিল, তখনই আরো একদফা এই বিশ্ববিদ্যালয়কে পুনরুজ্জীবিত করার কাজ হাতে নেয়া হয়। ১৮৫২ সালে দুটি অত্যন্ত শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি দুটির রিপোর্ট অনুযায়ী যে ব্যাপক সংস্কারকাজ শুরু হয় তা এক নজরে দেখে নেয়া যাক।
- জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মডেল অনুসরণ করে শিক্ষকদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া।
- শিক্ষকদের চাকরির নিশ্চয়তা দেয়া এবং বেতন কাঠামো ঠিক করে দেয়া।
- পাঠদানভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খোলস ছেড়ে গবেষণার উপর জোর দেয়া।
- শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ তুলে দিয়ে ধনী-দরিদ্রের সমান ব্যবস্থা করা।
- চারটি নারী কলেজ স্থাপন।
- ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান।
- প্রথাগত ক্লাসিক্যাল ঘরনার শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে পাঠ্যক্রমকে ঢেলে সাজানো এবং প্রসারিত করা।
বিস্তীর্ণ স্থান জুড়ে বিস্তৃত বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে অবগত নয় এমন মানুষ অনেক সময়ই বিশ্ববিদ্যালয়টাকেই ঠিক চিনে উঠতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য একাডেমিক ভবনের যেকোনোটির সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও অনেক সময় “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়টা কোথায়?” এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়! এই প্রশ্ন অক্সফোর্ডে গেলে উঁকি দিতে পারে আপনার মনেও! পুরো অক্সফোর্ড শহরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন কলেজ, একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, লাইব্রেরি, গবেষণাগার। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রে দাঁড়িয়েও আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, অক্সফোর্ডটা আসলে কোথায়!
দর্শনার্থীদের জন্য অক্সফোর্ডের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভবনগুলো হচ্ছে রেডক্লিফ ক্যামেরা, শেলডোনিয়ান স্কুল, ক্রাইস্টচার্চ ক্যাথেড্রাল এবং এক্সামিনেশন স্কুলগুলো। আর শহরজুড়ে ছড়িয়ে আছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৩৮টি কলেজ ও ৬টি হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীরই কোনো না কোনো হল বা কলেজের সদস্য হতে হয়। শিক্ষার্থীদের অবকাশ যাপনের জন্য আছে মোট ৭০ একর পার্ক। রয়েছে অসংখ্য ছোট বড় খেলার মাঠ, বোটানিক্যাল পার্ক, জেনেটিক পার্ক। পার্কগুলো দিনের বেলা দর্শনার্থীদের জন্যও উন্মুক্ত থাকে। খেলার মাঠগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের প্রয়োজনেও ব্যবহার করা হয়।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু জাদুঘর রয়েছে যার মধ্যে অ্যাশমোলিয়ান জাদুঘর সবচেয়ে পুরাতন। ১৬৮৩ সালে এটি স্থাপিত হয়। তাছাড়া ‘ইউনিভার্সিটি মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রি’, ‘পিট রিভারস মিউজিয়াম’, ‘মিউজিয়াম অব দ্য হিস্ট্রি অব সায়েন্স’, ‘ক্রাইস্টচার্চ পিকচার গ্যালারি’, প্রতিটি জাদুঘরই ১৯ শতকে স্থাপিত হয়েছে। এসব জাদুঘর দর্শনার্থীদের জন্য দিনের বেলা বিনামূল্যে উন্মুক্ত থাকে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব প্রেস, ‘অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস’ বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় ছাপাখানা। প্রতিবছর এখান থেকে ৬ হাজার বই, গবেষণা, রেফারেন্স গ্রন্থ এবং অভিধান ছাপা হয়।
প্রধান গবেষণা গ্রন্থাগার বোডলেয়ান, নতুন বোডলেয়ান, রেডক্লিফ ক্যামেরা, ক্লারেন্ডন বিল্ডিং, এই চারটি লাইব্রেরি হচ্ছে অক্সফোর্ডের প্রধান চারটি গ্রন্থাগার ভবন যেগুলো মাটির নীচ দিয়ে একটি টানেলের মাধ্যমে প্রত্যেকে প্রত্যেকের সাথে সংযুক্ত। তাছাড়া ‘স্যাকলার লাইব্রেরি’, ‘সোশ্যাল সায়েন্স লাইব্রেরি’, ‘রেডক্লিফ সায়েন্স লাইব্রেরি’ সহ মোট ২৮টি লাইব্রেরির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ‘বোডলেয়ান লাইব্রেরিস গ্রুপ’ ইংল্যান্ডের বৃহত্তম একাডেমিক গ্রন্থাগার। প্রতিটি বিভাগের অন্তর্গত বিভাগীয় গ্রন্থাগার এই হিসাবের বাইরে। এই লাইব্রেরিতে মোট ১১ মিলিয়নের অধিক সংখ্যক কপি বই রয়েছে, যেগুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে সর্বমোট ১৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ সেলফে! আরো আশ্চর্যজনক তথ্য হচ্ছে, গত কয়েক বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বই এবং গবেষণাপত্রের সংখ্যা এত দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে যে সেগুলো সাজিয়ে রাখতে প্রতিবছর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেলফ! গ্রন্থাগারের এই পরিসংখ্যান থেকেই উপলব্ধি হয়ে যায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। বর্তমান বিশ্বের সকল স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিং পদ্ধতিতেই অক্সফোর্ড সেরা দশটির একটি। এবছর ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ এর বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিংয়ে এর অবস্থান ১ নম্বরে।
বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিভুক্ত কলেজের সাথে অক্সফোর্ডের কলেজগুলোর সামঞ্জস্য খুঁজে থাকবেন অনেকেই। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও তেমন নয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়কে আপনি একটি কলিজিয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ও বলতে পারেন, যেটি মূলত এর আওতাধীন কলেজ এবং হলগুলোর একটি ফেডারেশনের মতো। সবগুলো কলেজ নিয়েই এই বিশ্ববিদ্যালয় যা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের প্রধান হচ্ছেন ভাইস চ্যান্সেলর বা উপাচার্য। তাকে সহযোগিতা করেন আরো পাঁচজন উপ-উপাচার্য। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক প্রধান এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হচ্ছেন চ্যান্সেলর বা আচার্য, যিনি কনভোকেশনের সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন। কনভোকেশন এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে যাওয়া সকল স্নাতক ডিগ্রিধারীর সমন্বয়ে গঠিত হয়।
২০১৭ সালের হিসাবে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট একাডেমিক স্টাফের সংখ্যা ১৮০০, শিক্ষার্থী সংখ্যা ২৩ হাজারের কিছু বেশি। এর মধ্যে ৯,৩০০ জনই বিশ্বের ১৪০টি দেশ থেকে আগত বিদেশী শিক্ষার্থী। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট আয় ছিল ১,৪০০ মিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড, বাংলাদেশি টাকায় সংখ্যাটা ১৬ হাজার কোটি টাকারও অধিক! সেখানে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট মাত্র ৬৬০ কোটি টাকা! যা হোক, এই আয়ের ৫৬৪ মিলিয়ন পাউন্ডই এসেছে গবেষণা খাত থেকে, আর শিক্ষার্থীদের বেতন এবং অন্যান্য একাডেমিক খরচ থেকে আসে ৩০৭ মিলিয়ন পাউন্ড। অন্যদিকে, এই আয়ের বিপরীতে শিক্ষক এবং স্টাফদের বেতন, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার খরচ ও অন্যান্য ব্যয় মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খরচ করে ১,৩৯৭ মিলিয়ন পাউন্ড। এখানে উদ্ধৃত ৩ মিলিয়ন পাউন্ড এবং অন্যান্য বিনিয়োগ ও অনুদানসহ, এই অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত আয় হয় ২১৯ মিলিয়ন পাউন্ড।
উচ্চশিক্ষার পীঠস্থান এবং রথি মহারথীদের আঁতুড়ঘর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় নিঃসন্দেহে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি। ঐতিহ্য আর শিক্ষা বিস্তারে এর ভূমিকা বিবেচনায় একে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় বললেও খুব একটা ভুল বলা হবে না। চালু হবার পর থেকেই যুগে যুগে যত মনীষী পৃথিবীতে এসেছেন, তাদের একটা বড় অংশ এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই নিজেদের গড়েছেন। অর্থাভাব এবং অন্যান্য জটিলতার কারণে আমাদের দেশীয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ হওয়া হয়তো স্বপ্নেরও অধিক, কিন্তু চেষ্টা করতে দোষ কী? অক্সফোর্ডের কাঠামো এবং পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে বিশ্বের কত বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় বহু এগিয়ে গেছে। সময় এসেছে আমাদের ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামক শব্দযুগলের অন্ধ মায়া থেকে বেরিয়ে বাস্তবিকভাবে নিজেদের পাঠদান কাঠামো এবং শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার করার।
ফিচার ছবি: vivowallpaper.com