তার মা মারা যান খুব অল্প বয়সেই। মাত্র এক বছর বয়সেই মা হারানো শিশু হিসেবে জীবনে অন্ধকার আরও ঘনীভূত হয় যখন তার বাবা আরেক বিয়ে করেন এবং নবাগত সৎমা তাকে বাঁকা চোখে দেখতে শুরু করে। শিশু হিসেবে তাকে কঠোর শাসনে রাখায় তিনি বিরক্ত হয়ে যান, কিন্তু মুক্তির মতো কোনো পথ খোলা ছিল না। শেষপর্যন্ত তাকে বাড়ি ছাড়তে হয়। ভাগ্যক্রমে চাচা তাকে আশ্রয় দেন এবং স্কুলেও ভর্তি করান। যে সময় একজন শিশু পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে পূর্ণ সমর্থন পায়, বন্ধুদের সাথে জীবনের সেরা সময়গুলো পার করে, জগতের সমস্ত জটিলতা থেকে দূরে থেকে পৃথিবী উপভোগের চেষ্টা করে– সেসময় তাকে পেতে হয়েছে পরিবারের ঘৃণা ও অবহেলা। বড় হয়ে একজন মানুষ যেরকম শৈশব নিয়ে গর্ব করে, সেরকম কোনো শৈশব তিনি চোখে দেখেননি।
বলছিলাম শিশুদের কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতির উদ্ভাবক, জার্মানির কিংবদন্তি শিক্ষাবিদ ফ্রিডরিখ ফ্রোবেলের কথা।
ফ্রোবেল যখন চাচার কাছে আশ্রয় পান, তখন তিনি নতুন করে জীবন নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। চাচার বাসার সাথেই একটি চমৎকার বাগান ছিল, যেখানে তিনি বেশিরভাগ সময় একা থাকতেন। তিনি চাচার বাড়িতে স্বাচ্ছন্দ্যেই থাকতেন। দিনের একটা বড় অংশ বাগানে কাটানোর জন্য কেউ তাকে বকাঝকা করত না। বাগানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে তিনি প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যান, এবং পরবর্তীতে জীবনের সবক্ষেত্রে প্রকৃতির দ্বারা প্রভাবিত হন। জন্মের পর মানুষের স্বাভাবিক বিকাশের ক্ষেত্রে যে প্রকৃতির বিশাল প্রভাব রয়েছে– এই বিষয়টি তার মাথায় খেলেছিল দারুণভাবে। প্রাথমিক শিক্ষায় যে ‘কিন্ডারগার্টেন সিস্টেম’ উদ্ভাবনের জন্য তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন, সেই সিস্টেমেও কিন্তু প্রকৃতির প্রভাব এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই কোনোভাবেই!
চাচার বাড়িতে থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণের পর ফ্রোবেল খনিবিজ্ঞান এবং স্থাপত্যবিদ্যার উপর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। জার্মানিতে তখন শিল্পবিপ্লব চলে, তাই খনিবিজ্ঞানের উপর যারা স্নাতক করেছেন, তাদের প্রচুর চাহিদা ছিল। কিন্তু ফ্রোবেলের ইচ্ছা ছিল তিনি জার্মানির শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কাজ করবেন। এজন্য ফ্রাঙ্কফুর্ট মডেল স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সেইসময় স্কুলটিতে জার্মান শিক্ষাবিদ জোহান হেইনরিখ পেস্তালোজ্জির নিয়ম অনুসরণ করা হতো। পড়াশোনার খরচ বহন করার মতো সামর্থ্য যাদের ছিল না, তাদের এই স্কুলে বিনা পয়সায় পড়ানো হতো। কাউকে মৌলিক শিক্ষাগ্রহণ থেকে বঞ্চিত করা হবে না– এই নীতি খুব কট্টরভাবে অনুসরণ করা হতো। প্রত্যেক শিশুকেই পাঠ্যবইভিত্তিক গতানুগতিক শিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার সবধরনের আয়োজন ছিল এই স্কুলে। আসলে সেইসময় জার্মানিজুড়ে সমস্ত স্কুলেই পেস্তালোজ্জির মূল নীতিগুলো অনুসরণ করা হতো।
প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষাবিদ পেস্তালোজ্জির নিয়ম ফ্রোবেলের খুব একটা পছন্দ হয়নি। এজন্য ফ্রাঙ্কফুর্টের সেই মডেল স্কুলে অল্প কিছুদিন শিক্ষকতার পর তিনি স্বাধীনভাবে নিজের নিয়মে শিক্ষকতা শুরু করলেন। তার নিয়মটা ছিল অদ্ভুত। তিনি যেসব বাচ্চাদের পড়াতেন, তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে কিছু জমি চেয়ে নিতেন, যেখানে একটি বাগান গড়ে তোলা হতো। এই বাগানে চলতো শিক্ষাদান কার্যক্রম। গতানুগতিক শ্রেণিকক্ষের পরিবর্তে বাচ্চাদের এই বাগানে বিভিন্ন খেলনাসমেত ছেড়ে দেয়া হতো। এরপর সেই শিশুরা নিজে থেকেই খেলাধুলায় মেতে উঠত, গান গাইত, প্রকৃতির মাঝে সুন্দর সময় পার করতে। পেস্তালোজ্জির সাথে ফ্রোবেলের চিন্তাপ্রসূত নতুন প্রাথমিক শিক্ষার মূল পার্থক্য ছিল এই যে– পেস্তালোজ্জির নিয়মে শিশুদের একটি নির্দিষ্ট সময়ের আগে রুটিনমাফিক ক্লাস ও পাঠ্যবইয়ে আটকে ফেলা হতো, যেখানে ফ্রোবেলের নিয়মে শিশুদের প্রকৃতির মাঝে ছেড়ে দেয়া হতো।
প্রাথমিকভাবে নিজের পদ্ধতিগুলোর প্রয়োগে সফলতা পাওয়ার পর ফ্রোবেল এবার বড় পরিসরে পদক্ষেপের চেষ্টা করলেন। ১৮৩৭ সালে জার্মানির ব্যাড ব্ল্যাকেনবার্গ নামক একটি শহরে প্রথমবারের মতো একটি প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করেন, যেটি তার নিজের চিন্তাপ্রসূত নীতিগুলোর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। প্রায় তিন বছর পর, ১৮৪০ সালে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের নাম দেন ‘কিন্ডারগার্টেন’ (Kindergarten) বা ‘শিশুদের বাগান’। ইউরোপে তখন সাত বছর বয়স হওয়ার আগে শিশুদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা ছিল। কারণ ধারণা করা হতো, সাত বছর বয়স হওয়ার আগে শিশুদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণের জন্য পর্যাপ্ত মানসিক পরিপক্বতা তৈরি হয় না। কিন্তু ফ্রিডরিখ ফ্রোবেলের হাতে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করতে আসা বাচ্চাদের বয়স ছিল চার থেকে ছয় বছর। আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণের আগে শিশুদের নিজস্ব সৃজনশীলতা বিকাশ ও মস্তিষ্কের জট খোলার জন্য নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশে পরিবেশ প্রয়োজন– এমনটাই ভাবতেন ফ্রোবেল।
ফ্রোবেলের দর্শনের আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক। খ্রিস্টধর্মের অনুসারী ফ্রোবেলের কাছে মানুষ ছিল ‘ঈশ্বরের সন্তান’। তিনি মনে করতেন, প্রকৃতির সাথে মানুষের গভীর সম্পর্ক আছে, প্রকৃতিই মানুষের প্রতিভা ও সৃজনশীলতা বিকাশে সর্বোচ্চ সহায়তা করতে পারে। তার কাছে প্রতিটি শিশু ছিল বাগানের ফুলের মতো, যাদের প্রাথমিকভাবে সুনিপুণ যত্নের সাথে বেড়ে তোলা উচিত। তার ভাষায়, “শিশুরা বাগানের ছোট্ট ফুলের মতো বৈচিত্র্যময় এবং তাদের পর্যাপ্ত যত্ন প্রয়োজন। তাদেরকে যখন একত্রে দেখা হয়, তখন তারা প্রত্যেকেই আলাদা করে সৌন্দর্যের অধিকারী।” সাধারণত তার স্কুলে এটা মনে করা হতো যে, শিশুরা জন্মের পর মানসিক বিকাশের জন্য তাদের পরিবারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা লাভ করে না, অথচ প্রতিটি শিশুর ক্ষেত্রেই এটি দরকারি। অভিভাবকেরা ছোট থেকেই শিশুদের প্রকৃতির সাথে সময় কাটানোর পথ রুদ্ধ করে দেন বলেই এমনটা হয়।
ফ্রোবেলের হাত ধরে গড়ে ওঠা পৃথিবীর প্রথম কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের বিভিন্ন খেলনাসহ বাগানে রেখে আসা হতো। ফ্রোবেল তার শিক্ষাপদ্ধতি ‘সেল্ফ-লার্নিং’ বা ‘সেল্ফ-অ্যাক্টিভিটি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যেখানে একজন ব্যক্তি শিক্ষকের চেয়ে ‘দিকনির্দেশনাকারী’ হিসেবে বেশি ভূমিকা পালন করে। ফ্রোবেলের কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকেরা কোনো শিক্ষার্থীকে কিছু করতে বাধ্য করতেন না, শুধু তাদের কী করা উচিত, সেই সম্পর্কে দিকনির্দেশনা প্রদান করতেন। শিশুরা খেলনা ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে নিজেদের মতো করে খেলতো। ফ্রোবেল প্রতিটি শিশুকে নিজেদের মতো করে খেলতে, গান গাইতে কিংবা ছবি আঁকতেন সহায়তা করতেন। তার প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা ছিল পূর্ণমাত্রায় স্বাধীন। কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার সমস্ত কার্যক্রম বাগানে হওয়ার কারণে শিশুরা মুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠত।
ফ্রোবেলের এই কিন্ডারগার্টেনের ধারণা খুব দ্রুত ইউরোপ ও আমেরিকায় জনপ্রিয়তা লাভ করে। সাধারণত প্রতিটি দেশই তাদের শিশুদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দিতে চায় না। শিশুরা জাতির ভবিষ্যত– এটা পৃথিবীর সব দেশের ক্ষেত্রেই সত্য। ফ্রোবেলের কিন্ডারগার্টেনে শিশুরা বেড়ে উঠত বাধাহীনভাবে, সাত বছর বয়স হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণের জন্য যেরকম মানসিক পরিপক্বতা দরকার, সেটা তৈরি হতো এই স্কুলের মাধ্যমে।
ফ্রোবেল শিক্ষাবিদ হিসেবে খুব বেশি খ্যাতি না পেলেও তার মস্তিষ্কপ্রসূত কিন্ডারগার্টেন সিস্টেম এখন পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই অনুসরণ করা হচ্ছে। শিশুদের সঠিকভাবে শিক্ষাপ্রদান ও বেড়ে তোলার পেছনে ফ্রোবেলের কিন্ডারগার্টেন সিস্টেমের কাছে পৃথিবীবাসী আজীবন ঋণী হয়ে থাকবে।