১.
ভারতের মেলাঘর ট্রেনিং সেন্টার অন্যগুলোর চেয়ে একটু আলাদা ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের সব ঘাড়ত্যাড়াগুলোর আখড়াও ছিল বলা যায়। এর মূল কারণ হলো তারুণ্যনির্ভর শক্তি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আগে সেখানে কঠোর প্রশিক্ষণ হতো। সেখান থেকে বিভিন্ন অপারেশন নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ এই বাংলাদেশে আসতে হতো।
মেলাঘরের বেশিরভাগ প্রশিক্ষণার্থী ছিলেন তৎকালীন সময়ের একেবারে তরুণ প্রজন্ম। সবকিছুর মধ্যে একটা দল নজর কেড়েছিল আলাদাভাবে। মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে কে ফোর্সের সদস্যদের কথা বলা হচ্ছে। শহীদ রুমি, বদি, আজাদ ও বিখ্যাত ক্রিকেটার জুয়েলসহ আরও অনেকে ছিল এই দলে। তাদেরকে শেখানোই হতো, কীভাবে দ্রুত অপারেশন করে ভোজবাজির মতো মিলিয়ে যাওয়া যায়। অনেকটা কমান্ডো আর গেরিলার মিশেল আরকি। কেউ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র, কেউ বা কেবলই বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা করেছে, কারো নতুন চাকরি, আবার কেউ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতো, কিন্তু দেশের ডাকে আর হয়ে ওঠেনি। কে ফোর্সের সদস্যদের বয়সের পারদ ছিল এমনই।
কে ফোর্সের প্রথম অপারেশনের জায়গা ছিল ঢাকাতেই। মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক আক্রমণের জন্যই তাদের তৈরি করা হয়েছিল। গোপনে পুরো একটা দল যখন ঢাকায় ঢুকলো, তখন কেবলই অপেক্ষার ঘুণে সময় কেটেছে তাদের। প্রতীক্ষা, কখন দলপতি খালেদ মোশাররফের কাছ থেকে অপারেশনের বার্তা আসবে। বার্তা এলোও, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের আশেপাশে খানিকটা গোলাগুলি করে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে হবে, এটুকুই কাজ। কারণ সেখানে আসছে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল। উদ্দেশ্য, ঢাকার অবস্থা বুঝে প্রতিবেদন পেশ করা। পাকিস্তান সরকার তাদের সেনাবাহিনী বিশেষভাবেই তৈরি করে রেখেছে, যেন কোনোরকম গণ্ডগোল না হতে পারে। যেন জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল বুঝতে পারে, এখানে কিছুই নেই।
কে ফোর্সের ছোট্ট এই দলের কাছে যে বার্তা এলো, বাস্তবায়ন হয়েছিল তার চেয়েও বেশি কিছু। হোটেলের আশেপাশে নয়, তারা হোটেলের ভেতরে গিয়ে গ্রেনেড বিস্ফোরণ করে এসেছিল সেনাবাহিনীর চোখ এড়িয়েই। টের পাইয়ে দিয়েছিলো, এখানে আসলেই কিছু হচ্ছে, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে হচ্ছে। পুরো ঢাকা তটস্থ করে দিয়েছিল ছেলেগুলো। আর খালেদ মোশাররফ? অবাক হয়ে কেবল বলেছিলেন,
‘হোটেলের আশেপাশে গোলাগুলি করতে বললাম, এরা হোটেলের ভিতরে গিয়ে গ্রেনেড ফাটিয়ে এলো! দিজ অল আর ক্র্যাক পিপল!
সেই থেকে কে ফোর্সের নাম হয়ে গেলো ক্র্যাকপ্লাটুন। ঢাকার স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ছিল ‘বিচ্ছুবাহিনী’ নামে। পুরো ৯ মাসে শত শত সফল অপারেশন চালিয়েছে তারা।
২.
এই ক্র্যাক কিংবা বিচ্ছুদের একজন ছিলেন জুয়েল। পুরো নাম আবদুল হালিম চৌধুরী। পরাধীন বাংলার অন্যতম সেরা ওপেনার, সঙ্গে উইকেটকিপিং। জুয়েল হতে পারতেন লাল-সবুজ বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক, অন্তত সেই স্বপ্ন তিনি দেখতেন। যুদ্ধে প্রথমবার আহত হওয়ার পর, হয়তো বা পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনে ধড়ে শেষ পর্যন্ত প্রাণ থাকা অবস্থাতেও স্বপ্নটা দেখতেন।
এ কথা মিথ্যে নয় যে, মুক্তিযুদ্ধ কী তা বুঝে উঠতে একটু সময় লেগেছিল সাধারণ মানুষের। পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের কারেন্ট জাল থেকে সবাই বের হতে চাইতো বটে, রাজনৈতিকভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীদের স্বপক্ষে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আলাদা একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্নও দেখতো তারা। কিন্তু ১৯৭১ সালে প্রথম প্রতিক্রিয়াটা এসেছিলো ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের কাছ থেকেই।
‘৬০ এর দশকে অনেক বাঙালি ক্রিকেটার পাকিস্তানের ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের দাপুটে সদস্য ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সালমান কবির, রকিবুল হাসান, দৌলাত-উজ-জামান ও শহীদ জুয়েল। পাকিস্তানের সেরা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট টুর্নামেন্ট কায়েদ-ই-আজম তখন এই পূর্ব পাকিস্তানেও অনুষ্ঠিত হতো, ঢাকা স্টেডিয়াম ছিল নিয়মিত ভেন্যু। ১৯৭১ সালের মৌসুমে ৯ মার্চ থেকে টুর্নামেন্টের ম্যাচ গড়ানোর কথা ছিল। চতুর্থ গ্রুপে পশ্চিম পাকিস্তানের পিআইএ, পূর্ব পাকিস্তান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলা ছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; এই দুই দল মাঠেই নামেনি। পিআইএ ওয়াক ওভার পেয়ে যায় এ কারণে। মূলত ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর পশ্চিম পাকিস্তান শাসকদের বিরুদ্ধে অনেকটা ‘প্রথম’ প্রতিরোধ ও চলমান আন্দোলনের পক্ষে ম্যাচ বয়কট করে এই দুই দল।
এরপর ২৫ মার্চ কালোরাতে যখন গণহত্যা চালায় পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী, তারপরই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পরের গল্পটা সবার জানা।
যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, জুয়েল তখন নিজের ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে ছিলেন। তরুণ এই ক্রিকেটার আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে খেলেছেন, জিতেছেন ঢাকা লিগ। যে ‘মোশতাক ভাই’-এর হাত ধরে আজাদ বয়েজ ক্লাবের শুরু, সেই মোশতাক ভাইয়ের সঙ্গে জুয়েলের ছিল আপ্রাণ সম্পর্ক। কিন্তু ২৭ মার্চ যখন মোশতাক ভাইয়ের বুলেটে ক্ষতবিক্ষত দেহটা জেলা ক্রীড়া পরিষদের মূল ভবনের সামনে খুঁজে পেলেন জুয়েল, তখন আর নিজেকে থামাতে পারেননি তিনি। ক্রিকেট ব্যাট আর কিপিং গ্লাভস খুলে রেখে হাতে তুলে নিয়েছেন স্টেনগান।
জুয়েল আজাদ বয়েজ ক্লাব ছাড়াও খেলেছেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। ১৯৬৯ সালে মোহামেডানে যোগ দেওয়ার পর শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত এখানেই খেলেছেন তিনি। ১৯৬৬ সালের ২১ মে প্রথম শ্রেণিতে অভিষেকের পর খেলেছেন মোট সাত ম্যাচ। এই ফরম্যাটে ঢাকা দল, পূর্ব পাকিস্তান ও পাকিস্তান হোয়াইটের হয়ে ২১.৫৮ গড়ে মোট ২৫৯ রান তুলেছিলেন। তবে ১৯৭০-৭১ মৌসুমে জুয়েলের পারফরম্যান্স ছিল সত্যিই মনে রাখার মতো। এই সময়ে নিয়মিত বড় ইনিংস খেলছিলেন তিনি। কারদার সামার ক্রিকেটে সেঞ্চুরিও পেয়েছিলেন, যা তাকে পূর্ব পাকিস্তান ক্রিকেট দলে আরও শক্ত ভিত এনে দেয়। বলে রাখা ভালো, পশ্চিম পাকিস্তানের মতো পূর্ব পাকিস্তান দলেও সেই সময়ে অবাঙালিদের প্রাধান্য ছিল। ১৯৬৯ সালে যখন পাকিস্তানে তিনটি টেস্ট খেলতে এলো নিউজিল্যান্ড, তখন পাকিস্তান দলের ক্যাম্পে ডাক পেয়েছিলেন। কিন্তু মূল দল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি তিনি।
৩.
জুয়েলের যুদ্ধে যাওয়ার লড়াইটাও সহজ ছিল না। পিতৃহীন ছেলেটাকে ছাড়তে চাননি মা। চাননি চোখের আড়াল করতে। তাই জুয়েল একদিন নিজের একটা ছবি বাঁধিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে দিলেন। তারপর মাকে বললেন,
‘আমাকে মনে পড়লে এইটা দেখবা, আমারে দেখবা।’
ঐ ঘটনার কয়েকদিন পরই বাসা থেকে পালিয়ে যুদ্ধে যান জুয়েল। কিন্তু যুদ্ধে গিয়েও তার ধ্যানেজ্ঞানে ছিল শুধুই ক্রিকেট। বলা যায়, স্বাধীন বাংলার ক্রিকেট।
একবার ক্র্যাকপ্লাটুনের উপর সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ারস্টেশন উড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পড়লো। তারই ধারাবাহিকতায় এক রাতে জায়গাটা রেকি করতে বের হলেন বদি, আজাদ, জুয়েলসহ মোট ১০ জন যোদ্ধা। বাড্ডার পিরুলিয়া গ্রাম থেকে নৌকায় যাত্রা করার পর বেশ কিছুদূর গিয়ে সবাই টের পেলেন, সামনে থেকে আরেকটা নৌকা আসছে। আর সেটা পাকিস্তানি আর্মিতে ভরা। একমাত্র বদি ছাড়া সবার স্টেনগান ছিল নৌকার পাটাতনের নিচে। সেটা বুঝতে পেরেই বদি কোনো কিছু না ভেবেই সমানে ব্রাশফায়ার চালিয়ে দিলেন সামনের নৌকার দিকে। হানাদার অনেকে মরলো, নৌকা উল্টে গেল; কয়েকজন হয়তো বেঁচেছিলো সাঁতরে। ওদের পক্ষ থেকেও গুলি ছোঁড়া হয়েছিলো। যে কারণে সবকিছু ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার পর জুয়েল হঠাৎ অন্ধকার থেকে বলে উঠলেন,
‘ঐ আমার হাতে যেন কী হইছে’।
টর্চের আলোয় দেখা গেল, পাক হানাদারদের ছোঁড়া গুলি জুয়েলের আঙুল ভেদ করে চলে গেছে। সেই অবস্থাতেই তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ডা. আজিজুর রহমানের চেম্বারে। যাওয়ার পথে আজাদ তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘জুয়েল, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে না?’
দাঁত বের করে জুয়েল বললেন,
‘নাহ, হেভি আরাম লাগতেছে। দেশের জন্য রক্ত দেওয়াও হইলো, আবার জানটাও বাঁচলো।’
অভিজ্ঞ ডাক্তার আজিজুর রহমান জুয়েলের হাতের অবস্থা দেখে সেদিন চমকে উঠেছিলেন। আঙ্গুলের রক্তপাত বন্ধ হচ্ছিলো না কোনোমতেই। ড্রেসিং করতে গিয়ে অবস্থা আরও বেগতিক। জুয়েল দাঁতে দাঁত চেপে শুধু বলছিলেন,
‘প্লিজ স্যার, আমার আঙ্গুল তিনটা রাইখেন। দেশ স্বাধীন হলে আমি ওপেনিং নামবো, ক্যাপ্টেন হবো।’
এরপর আর অপারেশনে নামা হয়নি জুয়েলের। থাকতেন সহযোদ্ধা আজাদের বাড়িতে। সেখানেই একদিন হানাদার বাহিনী হামলা চালায়। ক্যাম্পে উঠিয়ে নিয়ে যায় জুয়েলকে। অকথ্য নির্যাতনের মাধ্যমে সব তথ্য বের তার কাছ থেকে আদায় করতে চেয়েছিলো শত্রুরা। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের মতোই মাটি কামড়ে সেদিন দেশের জন্য ব্যাট করে গেছেন জুয়েল। পাক হানাদাররা শেষ পর্যন্ত হত্যা করেছিলো জুয়েলকে।
স্বাধীন বাংলায় জুয়েল মুক্তিযুদ্ধে তার অসামান্য অবদানের জন্য বীর বিক্রমে ভূষিত হয়েছিলেন। দেশের ক্রিকেটও তাকে মনে রেখেছে, ‘হোম অব ক্রিকেট’খ্যাত মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের জুয়েল স্ট্যান্ড তারই নামানুসারে করা। আর আজাদ বয়েজ ক্লাবের সেই মোশতাক ভাইয়ের নামে মোশতাক স্ট্যান্ড। প্রতি বিজয় দিবসে তাদের স্বরণে সাবেক-বর্তমান ক্রিকেটারদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় শহীদ জুয়েল-মোশতাক স্মৃতি প্রীতি ম্যাচ।