
সিলেটে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টে হারলেও জিতেছেন তাইজুল ইসলাম। তুলে নিয়েছেন ১১ উইকেট। অন্তত সিলেটের অভিষেক টেস্টে বাংলাদেশের জন্য তাতে করে কিছু মনে রাখার মতো হয়েছে। তবে এক টেস্টে ১০ বা তার বেশি উইকেট নেওয়া বাংলাদেশি হিসেবে তাইজুলই প্রথম নন। আছেন আরও তিনজন। সেই তিনজনই স্পিনার। মোদ্দাকথা, টেস্টে বাংলাদেশের সেরা বোলিং পারফরম্যান্সের প্রায় পুরোটাই এসেছে স্পিনারদের হাত ধরে। যদি সেরা পাঁচের কথা বলতে হয়, সেখানে দুবার নিজের নাম লিখিয়েছেন সাকিব আল হাসান। কীর্তির শুরুটা করেছিলেন এনামুল হক জুনিয়র। সেরা পাঁচের সেই গল্পগুলোর বিস্তর আলাপ নিয়েই এই আয়োজন।
মেহেদী হাসান মিরাজ (ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৫৯ রানে ১২ উইকেট)

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট জেতে ২০১৬ সালে। মেহেদী হাসান মিরাজ মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সেই ম্যাচে ঐতিহাসিক ১২ উইকেট নিয়ে এগিয়ে দেন দলকে। যদিও পুরো সিরিজেই মিরাজের অফ-স্পিনের সামনে পুরোপুরি নিশ্চুপ ছিল ইংলিশ ব্যাটসম্যানরা।
মজার ব্যাপার হলো, মিরাজের এটি ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচ ছিল। এই ইংলিশদের বিপক্ষেই প্রথম টেস্টে তার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়।
তামিম ইকবালের ১০৪ রানের ইনিংসে চড়ে নিজেদের প্রথম ইনিংসে ২২০ রান তোলে বাংলাদেশ। জবাবে ২৪৪ রানে থেমে যায় ইংল্যান্ড। মিরাজ ৮২ রান খরচ করে তুলে নেন ৬ উইকেট।
২৪ রানে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসে সংগ্রহ করে ২৯৬ রান। তাতে সফরকারী ইংল্যান্ডের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৭৩ রান। কিন্তু ইংলিশরা জয় তো দূরে থাক, প্রায় এক সেশনেই সব উইকেট হারিয়ে বসে।
এই ইনিংসে ৭৭ রান খরচ করে ৬ উইকেট নেন মিরাজ। সাকিব নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। এক ম্যাচে ১২ উইকেট নেওয়ার মধ্য দিয়ে মেহেদী হাসান মিরাজ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ের কাণ্ডারি হয়ে যান।
এনামুল হক জুনিয়র (জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০০ রানে ১২ উইকেট)

২০১৩ সালে বাঁহাতি স্পিনার এনামুল হক জুনিয়র তার শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটি খেলেছিলেন। ২০০৫ সালে চট্টগ্রামে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়ে তার অবদানের কথা দেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
সেই সিরিজেই ২০০ রানে ১২ উইকেট তুলে নিয়েছিলেন এনামুল। ২০১৬ পর্যন্ত সেটিই ছিল বাংলাদেশের পক্ষে এক টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড। সেই রেকর্ড ভেঙে দেন মেহেদী হাসান মিরাজ।
যে ম্যাচ নিয়ে কথা হচ্ছে, সেটি ছিল ঢাকায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট ম্যাচ। প্রথম ইনিংসে এনামুল ৯৫ রান খরচ করে তুলে নেন ৭ উইকেট। জিম্বাবুয়ে গুটিয়ে যায় ২৯৮ রানে। জবাবে বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ২১১ রানের বেশি তুলতে পারেনি। দ্বিতীয় ইনিংসে ২৮৬ রান তোলে জিম্বাবুয়ে। এবার ৫ উইকেট নেন এনামুল হক জুনিয়র। খরচ করেন ১০৫ রান।
বাংলাদেশ ঐ ম্যাচ ড্র করেছিল। নাফীস ইকবালের ৪৭০ বলে করা ২২১ রানের ইনিংস ড্রয়ের স্বাদ দিয়েছিল বাংলাদেশকে, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজ জয় করে। এই পুরো ব্যাপারটা অসম্ভব ছিল, যদি না এনামুল হক জুনিয়র এমন কীর্তি গড়তেন।
তাইজুল ইসলাম (জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১৭০ রানে ১১ উইকেট)

তাইজুল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই ২০১৪ সালে মাত্র ৩৯ রান খরচায় ৮ উইকেট নিয়েছিলেন। একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে এই মুহূর্তে চলমান সিরিজের প্রথম টেস্টে ১৭০ রান খরচায় তুলে নেন ১১ উইকেট। যদিও সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সেই ম্যাচে জয় পেয়েছে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দল।
সিলেটের টেস্ট অভিষেকের মধ্যে দিয়ে গড়ায় বাংলাদেশ-জিম্বাবুয়ে ২০১৮ সিরিজের দুই টেস্টের প্রথম ম্যাচটি। নতুন এই ভেন্যু বাংলাদেশের অষ্টম টেস্ট ভেন্যু। সেই মাঠেই নিজের স্মরণীয় পারফরম্যান্স লিখে রাখলেন তাইজুল।
বাঁহাতি এই স্পিনার সেই ম্যাচের প্রথম ইনিংসে ১০৮ রান করে তুলে নেন ৬ উইকেট। তার সামনে জিম্বাবুইয়ান ব্যাটসম্যানরা নিয়মিত বিরতিতে পরাস্ত হয়েছেন। পরের ইনিংসেও নিজের বোলিংকে রহস্যের চাদরে ঘিরে রেখেছিলেন তাইজুল। তুলে নিয়েছিলেন ৫ উইকেট।
কিন্তু এমন ঝলমলে বোলিং পারফরম্যান্স ম্লান হয়েছে বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতার সামনে। নিজেদের কাজটি ঠিকমতো করতে পারেননি মুশফিক-ইমরুলরা। ফলাফল, ম্যাচ হারের খড়গ নিয়ে সিলেট ত্যাগ করতে হয়েছে বাংলাদেশকে।
সাকিব আল হাসান (অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১৫৩ রানে ১০ উইকেট)

বাংলাদেশের এক নম্বর অলরাউন্ডার ও বর্তমানে দলের টেস্ট অধিনায়ক অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এক টেস্টে ১০ উইকেট নিয়েছিলেন। গেল বছর ২০১৭ সালে ঢাকার মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এই কীর্তি গড়েন এই মুহূর্তে ইনজুরির কারণে জাতীয় দলের বাইরে থাকা এই ক্রিকেটার।
বহুল আলোচিত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুই টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচের শুরুটা বাংলাদেশের ভালো হয়নি। টস জিতে আগে ব্যাট করতে নেমে নিজেদের প্রথম ইনিংসে ২৬০ রান তোলেন সাকিবরা।
কিন্তু স্টিভেন স্মিথ-ডেভিড ওয়ার্নারদের অবস্থা ছিল আরও নাজুক। স্বাগতিকদের করা ২৬০ রানের জবাবে মাত্র ২১৭ রানে গুটিয়ে যায় তারা। সাকিব ৬৮ রান খরচ করে ম্যাট র্যানশ, স্টিভ স্মিথ আর গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের মতো ব্যাটসম্যানদের সাজঘরের পথ দেখিয়ে দেন। সাকিবের রহস্যঘেরা বাঁহাতি স্পিনের সামনে বারবার কুপোকাত হয়েছিল অজি ব্যাটসম্যানরা।
দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশ ২২১ রানে গুটিয়ে গেলে অস্ট্রেলিয়ার সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৬৪ রান। এবারও নিজের ঘূর্ণি বলে তোপ দাগেন সাকিব। তার বলে আউট হন দুই ওপেনার উসমান খাজা ও ডেভিড ওয়ার্নার। এছাড়া দ্বিতীয়বারের মতো সাকিবের সামনে নিজেকে হারিয়ে বসেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ও অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ। এবারও সাকিব তুলে নেন ৫ উইকেট।
পরপর দুই ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেওয়ার মধ্যে দিয়ে সাকিব গড়ে বসেন নতুন রেকর্ড। আফগানিস্তান ও আয়ারল্যান্ড বাদে বাকি সব টেস্ট খেলুড়ে দলের বিপক্ষে পাঁচ উইকেট নেওয়ার এলিট ক্লাবে নিজের নাম লেখান সাকিব। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সাকিবের সেই কীর্তি বাংলাদেশকে এনে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদ। ম্যাচ সেরা সাকিবে ভর করে স্মিথ-ওয়ার্নারদের বিপক্ষে বাংলাদেশ সেই ম্যাচ জিতেছিল ২০ রানের ব্যবধানে।
সাকিব আল হাসান (জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১২৪ রানে ১০ উইকেট)

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২০১৪ সালে খুলনায় ১০ উইকেট নিয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। ক্যারিয়ারে প্রথম কোনো টেস্টে তার ১০ উইকেট নেওয়ার ঘটনা ছিল এটি। প্রথম ইনিংসে সাকিবের ১৩৭ ও তামিম ইকবালের ১০৯ রানে ভর করে ৪৩৩ রান তোলে বাংলাদেশ।
জিম্বাবুয়ে যখন ব্যাট হাতে জবাব দিতে শুরু করলো, তখন রুখে দাঁড়ালেন সাকিব। নিজের ঘূর্ণি বলের ফাঁদে ফেলে সাজঘরে ফেরালেন হ্যামিল্টন মাসাকাদজা, ব্রেন্ডন টেলর, এল্টন চিগুম্বুরা, ক্রেইগ অরভিন আর ম্যালকম ওয়ালারকে। তবে সবচেয়ে বড় উইকেট ছিলেন ওপেনার মাসাকাদজা। কারণ সেই ইনিংসে ১৫৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। নিজেদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠা এই ব্যাটসম্যানকে ফেরান সাকিব। সেই ইনিংসে ৮০ রান খরচ করে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি।
দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৫ রান এগিয়ে থেকে ব্যাটিং শুরু করে বাংলাদেশ। ইনিংস জুড়ে যোগ হয় আরও ২৪৮ রান। সব মিলিয়ে জিম্বাবুয়ের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় ৩১৪ রানের।
প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ইনিংসেও আফ্রিকার দলটির সামনে ত্রাস হয়ে দাঁড়ান সাকিব। তুলে নেন আরও ৫ উইকেট।
আবারও সাকিবের হাতে জয় পায় বাংলাদেশ। পাশাপাশি সাকিব গড়েন আরও একটি রেকর্ড। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম একমাত্র ক্রিকেটার যিনি এক টেস্টে ১০ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি সেঞ্চুরিও করেছেন।