Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইহুদী জাতির ইতিহাস (পর্ব চৌদ্দ): জীবন সায়াহ্নে দুই নবী

ইসরাইল এখন তাওরাত তথা একটি শরিয়ত পেলো; যেখানে খুবই বিস্তারিতভাবে নিয়ম কানুন লেখা ছিল। সেগুলো মেনে কাজ করা শুরু করেছিলেন মূসা (আ)।

তিনি আল্লাহর আদেশে নির্মাণ করলেন ধর্মীয় ইতিহাসের সবচেয়ে ক্ষমতাধর বস্তু- Ark of the Covenant, বা শরিয়ত-সিন্দুক, বা তাবুতে সাকিনা (سكينة); আরবি সাকিনা শব্দের সাথে হিব্রু শেখিনা (שכינה‎) শব্দের মিল আছে, যার অর্থ ‘আল্লাহর উপস্থিতি’। সোনা দিয়ে বানানো এ সিন্দুকের মাপ ছিল প্রায় ১৩১×৭৯×৭৯ সেন্টিমিটার; কুরআনের সুরা বাকারার ২৪৮ নং আয়াতে এ আর্ক বা সিন্দুকের কথা উল্লেখ আছে,

“তাদের নবী আরো বললেন, তালূতের নেতৃত্বের চিহ্ন হলো এই যে, তোমাদের কাছে একটা সিন্দুক আসবে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে তোমাদের মনের সন্তুষ্টির নিমিত্তে। আর তাতে থাকবে মূসা, হারুন এবং তাদের সন্তানবর্গের পরিত্যক্ত কিছু সামগ্রী। সিন্দুকটিকে বয়ে আনবে ফেরেশতারা। তোমরা যদি ঈমানদার হয়ে থাক, তাহলে এতে তোমাদের জন্য নিশ্চিতই পরিপূর্ণ নিদর্শন রয়েছে।” (কুরআন ২:২৪৮)

সিন্দুকের মডেল; Image Source: CGTrader

এই সিন্দুকের ক্ষমতা সম্পর্কে বলা হয়, যে জাতির কাছে সিন্দুক থাকবে সে জাতি হবে অজেয়। যতদিন সিন্দুক ইসরাইলের কাছে ছিল ততদিন ইসরাইল ছিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি। কিন্তু ইসরাইলের কাছ থেকে হারিয়ে যাবার পর থেকে ইসরাইলের পতন শুরু হয়।

বলা হয়, এ সিন্দুকের ভেতরে আছে তাওরাতের বেহেশতি ফলকগুলো, মান্না আর সালওয়ার নমুনা, মূসা (আ) এর লাঠি, সুলাইমান (আ) এর অলৌকিক আংটি ইত্যাদি। কথিত ভবিষ্যৎবাণী অনুযায়ী, শেষ সময়ে পুনরায় আবিস্কার হবার কথা এ সিন্দুকের। 

মূসার (আ) সময়ের অনেক পরে, যখন জেরুজালেমে Temple of Solomon নির্মিত হয়, তখন সেই টেম্পল বা মন্দিরের সবচেয়ে পবিত্র কক্ষ ‘Holy of The Holies’ এর ভেতরে সুরক্ষিত করে রাখা হয় আর্ক অফ দ্য কভেন্যান্টকে। আর্ক অফ দ্য কভেন্যান্টের সাথে ইসরাইলের ইতিহাসের অনেক অংশই জড়িত। যখন তারা কোথাও শিবির করতো, তখন সেই সিন্দুক বরাবর উপরে মেঘ করত, যখনই সেই মেঘ সরে যেত, তখনই বুঝে নিতে হতো, আল্লাহ বলছেন, এবার যাবার পালা যাযাবর ইসরাইলের।

মরুভূমিতে আল্লাহ্‌র প্রতিশ্রুত ভূমির সন্ধানে ঘুরছে ইহুদী জাতি। তাদের নেতা তখন মূসা (আ)। মিসর থেকে বেরিয়ে আসার ১৪ মাস পর মূসা (আ) একটি আদমশুমারির ব্যবস্থা করলেন ইসরাইলের জন্য। হিসেব করে দেখা গেল, সেখানে ২০ বছরের বেশি বয়সের মানুষ ছিল ৬,০৩,৫৫০ জন। ইসরাইল জাতি অবস্থান করছিল বিশাল সীন মরুভুমির এলিম নামক স্থানে। আদমশুমারি শেষ হলে দেখা গেল, যে মেঘখণ্ড আর্ক অফ কভেন্যান্ট সিন্দুক সম্বলিত তাঁবুর উপর ছায়া দেয় সেটি সরে গেছে। এখন ইসরাইল জাতিকে আবার যাত্রা করতে হবে। 

আর্ক বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইহুদীরা; ©Benjamin West

এলিমে মুসা (আ) তার ভাই হারুন (আ) আর তার বংশধরদের জন্য একটি বিশেষ পদের ব্যবস্থা করে দিলেন, সেটি হলো ‘ইমাম’ পদ।তখনকার নিয়মআনুযায়ী ইহুদীদের মধ্যে ইমাম হতে হলে তাকে অবশ্যই হতে হবে হারুন (আ) এর বংশের। যারা ইহুদী জাতির ইতিহাস একদম ঈসা (আ) এর আগমন পর্যন্ত পড়বেন তারা অনেক জায়গাতেই একটি শব্দ পাবেন- “লেবীয়” (Lebites)। এর মানে হলো লেবীয় বংশ তথা হারুনের বংশ।

এর মাধ্যমে মূসা (আ) স্থির করে গেলেন, ভবিষ্যতে ইসরাইল যখন জেরুজালেমে পৌঁছাবে আর সেখানে আল্লাহ্‌র ঘর বানাবে তখন তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব থাকবে লেবীয়দের। আর্ক অফ দ্য কভেন্যান্ট সিন্দুকের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও লেবীয়দের। এরকম সময়েই ইহুদীদের জন্য হারাম আর হালাল খাবারের তালিকা নাজিল হলো। ইহুদীদের জন্য হালাল খাবারগুলোকে কোশার (כָּשֵׁר) বলা হয়, যা একই সাথে মুসলিমদের জন্যও হালাল।

এলিম; Image Source: biblestrue.com

এরপর মূসা (আ)-এর নেতৃত্বে কাফেলা আবার বেরিয়ে পড়লো সিনাই মরুভূমি থেকে। সেটা ছিল মিসর থেকে বেরিয়ে যাবার পর ১৪তম মাসের ২০তম দিন। কাফেলা চলতে চলতে যতক্ষণ পর্যন্ত না পারান মরুভূমিতে এসে পোঁছালো ততক্ষণ সবাই চলতেই থাকল। 

পারান মরুভূমি এখন আমাদের কাছে ভিন্ন নামে পরিচিত। এটা মক্কা আর তাঁর আশপাশ জুড়ে বিস্তৃত সুবিশাল মরুকে বোঝায়। ঠিক এ জায়গায় এসে ইহুদীদের ইতিহাস গ্রন্থগুলো আমাদের কিছুই জানায় না- সেখানে তারা কী দেখলো না দেখল। এ বিশাল মরুভূমির কোনো এক স্থানে অনেক শতাব্দী পূর্বে হযরত ইব্রাহিম (আ) তার শিশুপুত্র ইসমাইল (আ) আর তার মা হাজেরাকে রেখে গিয়েছিলেন। সেখানে জমজম কূপ গড়ে ওঠে, গড়ে ওঠে এক উপত্যকা। খুব উন্নত নয় বটে, তবুও একটি জনবসতি ছিল বটে।

তবে এদেরকে বলা হত ‘ইসমাইলি’; এবং তাদের বলা হত ‘ইসরাইলিদের ভাই’; কারণ, ইসমাইল (আ) এর ভাই ইসহাক (আ) এর ছেলের নামই ছিল ইসরাইল (ইয়াকুব)।

কিন্তু, ইসরাইলিরা খুবই ঘৃণার চোখে দেখত ইসমাইলিদের। কেন?

কারণ, ইসমাইল (আ) এর মা হাজেরা একসময় ইব্রাহিম (আ) দাসী ছিলেন। আর ইসহাক (আ) এর মা সারাহ ছিলেন রাজকন্যা। এজন্য ইসরাইলিরা নিজেদের রাজরক্তধারী ভাবে। আর ইসমাইলিরা হলো ‘নিচু বংশ’। 

পারানে থাকার সময়ে কেউ কি একবারও কাবার কাছে গিয়েছিলেন? গেলেও সে বিষয়ে ইহুদীদের ইতিহাস চুপ, হয়তো আসলেই কেউ যাননি। কারণ মরুভূমিটা খুব ছোট নয় কিন্তু, বেশ বড়। এত রাস্তা অতিক্রম করে কেউ ইসমাইলিদের সাথে দেখা করতে হয়তো যাবে না। আমরাও তাই কিছু জানি না ইতিহাস থেকে। তবে কুরআনে না হলেও ইসলামি সূত্রে তার হজ্ব পালনের কথা বলা রয়েছে।

ইসরাইলের যাত্রাপথে; Image Source: biblestrue.com

বেহেশতি মান্না আর সালওয়া খেতে খেতে ইহুদীদের আর ভালো লাগছিল না। এ নিয়ে তারা মূসার (আ) কাছে অভিযোগ করতেই লাগলো। শেষে মূসা (আ) বিরক্ত হয়ে শরিয়ত সিন্দুকের কাছে গিয়ে আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ্‌ উত্তর দিলেন, তিনি টানা এক মাস এই এত জন লোকের জন্য ভিন্ন মাংস পাঠাবেন।

মূসা (আ) অবাক হয়ে বললেন, “সমুদ্রের সমস্ত মাছ ধরে আনলেও তো বোধ হয় এদের কুলাবে না, এত মানুষ!” 

আল্লাহ্‌ তাকে তাঁর কুদরত দেখার জন্য অপেক্ষা করতে বললেন। তখন আল্লাহ্‌র নির্দেশ মোতাবেক বনি ইসরাইলের ৭০ জন নেতাকে তাঁবুর সামনে এনে দাঁড় করালেন। এবং এ অবস্থায় আল্লাহ্‌র সাথে কথা বললেন মূসা (আ)।

মূসা (আ) তার ব্যক্তিগত পরিচর্যাকারী আর সঙ্গী হিসেবে নিযুক্ত করলেন নূন এর ছেলে ইউশাকে। এই ইউশাকে সাথে নিয়েই মূসা (আ) দেখা করতে যান খিজির (আ) এর সাথে। তবে সে কাহিনী অন্য কোনো সিরিজে বর্ণিত হবে, যেহেতু ইহুদী জাতির ইতিহাসের সাথে এটি অপ্রাসঙ্গিক।

পরদিন সকাল বেলা দেখা গেল সমুদ্রের দিক থেকে অসংখ্য পাখি উড়ে আসছে আর কাফেলার কাছে এসে মরুতে পড়ে যাচ্ছে মরে। অবাক চোখে তাকিয়ে রইল সবাই। হিসেব করে দেখা যায়, সেদিন ওরা ১,৮০০ কেজি পাখির মাংস সংগ্রহ করেছিল। পেট পুরে খেল তারা।

কিছুদিন পর, পারান থেকে যাত্রা শুরু করলেন মূসা (আ)। এবার তাদের লক্ষ্যস্থল হলো পবিত্র ভূমি অর্থাৎ ফিলিস্তিন-ইসরাইল উপত্যকা। সেটা তখন পরিচিত ছিল ‘কেনান’ (כְּנָעַן) ভূমি নামে।

কেনান দেশের ফলক; Image Source: Wikimedia Commons

কিন্তু কেনান ছিল খুবই শক্তিশালী একটি রাজ্য (রাজ্য না বলে উপত্যকা বলাই শ্রেয়); তাই কেনান জয় করার জন্য আগে বের করতে হবে এ উপত্যকার প্রধান প্রধান শহর আর সেসব শহরের দুর্বলতাগুলো। একেকটা শহর যেন একেকটা দুর্গের মতো। একটি একটি করে শহর দখল করে নিতে হবে।

এতক্ষণ পর্যন্ত বলা যায় আরাম করেই মরুভূমি পার করেছে ইসরাইলের কাফেলা। কিন্তু এখন শুরু হলো জীবনের ঝুঁকি। কারণ, যে পথ ধরে তারা পার হবে, প্রায়ই সেখানে জনবসতি পড়বে। আর জনবসতি মানেই হলো শত্রু। ভিনদেশীদেরকে শত্রু হিসেবেই দেখে তারা।

তাই মূসা (আ) সিদ্ধান্ত নিলেন গুপ্তচর প্রেরণ করবেন সেই কেনান এলাকা দেখে আসার জন্য। কিন্তু, তিনি যেটা জানতেন না সেটা হলো, ইসরাইল জাতি এতই অলস ছিল যে তারা যুদ্ধ করতেও চাচ্ছিল না। তারা চাচ্ছিলো যে, তারা কেবল যাবে আর শহরগুলো নিজে থেকেই তাদের মুঠোয় চলে আসবে।

মূসা (আ) বারোজন গুপ্তচর নির্বাচন করলেন ইসরাইলের বারো গোত্র থেকে। তারা ছিল শামুইয়ে, শাফত, কালুত (কালেব), জিগাল, ইউশা, পলতি, গাদিয়েল, গাদি, অমিয়েল, সাথুর, নাহবি আর গুয়েল। (বোল্ড করা নাম দুটো মনে রাখলেই চলবে)

মূসা (আ) তাদের বলে দিলেন, “তোমরা দেখবে, সেখানে যারা বাস করে তারা শক্তিশালী নাকি দুর্বল। দেশগুলো ভাল না মন্দ। দেয়াল ঘেরা নাকি দেয়াল নেই। ফসল কেমন, গাছপালা কেমন, পারলে ফল নিয়ে আসার চেষ্টা করবে।”

১২ জন গুপ্তচর রওনা হয়ে গেল। আর মূসা (আ) ইসরাইল কাফেলা নিয়ে অপেক্ষা করলেন সেই পারানেই, রওনা দিলেন না আর।

৪০ দিন পর খবর পাওয়া গেল, গুপ্তচরেরা নাকি ফিরে এসেছে। 

তারা এসে মূসা (আ) আর হারুনকে (আ) বলল, “আপনি যে দেশের জন্য রওনা দিচ্ছেন সেটা খুবই সুজলা সুফলা দেশ সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই দেশের মানুষ অনেক শক্তিশালী।” তারা বোঝানোর চেষ্টা করল যে, এই দেশ দখল করা ইসরাইলের পক্ষে সম্ভব না।

কিন্তু যে ১২ জন গিয়েছিল তাদের মধ্যে ইউশা আর কালুত ছিলেন খুব সৎ। তারা সত্যটা বললো, “আমরা পারবো দখল করে নিতে।”

আল্লাহ্‌ও নির্দেশ দিলেন, কুরআন আমাদের বলছে, “হে আমার সম্প্রদায়, পবিত্র ভূমিতে প্রবেশ কর, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন এবং পেছন দিকে প্রত্যাবর্তন করো না। অন্যথায় তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।” [কুরআন ৫:২১]

কিন্তু তারা মানতে চাইল না। ১০ জন গুপ্তচর তখন বের হয়ে এসে লোকদের মাঝে গুজব ছড়িয়ে দিল যেন সবাই ভয় পেয়ে যায়। তাদের ছড়ানো গুজব ছিল, “আমরা যে দেশের খোঁজ খবর নিয়ে এসেছি সেই দেশের বাসিন্দারা নরখাদক। যেসব লোক আমরা সেখানে দেখেছি ওরা দেখতে খুব বড়। আমরা যাদের দেখেছি সেখানে তারা হলো নেফিলিম! অনাকের বংশধর! নেফিলিম! ওদের দেখে আমরা নিজেদের মনে করলাম ঘাসফড়িং!”

নেফিলিম কী জিনিস অনেকেই জানে না। ইহুদী ধর্ম মতে, বেহেশত থেকে বহিষ্কৃত ফেরেশতারা (ফলেন অ্যাঞ্জেলরা) মানবীদের সাথে যৌন মিলিত হবার ফলে যে সন্তান জন্ম হত তারা ছিল প্রবল পরাক্রমশালী। এ ভিন্ন সংকর প্রজাতিকে নেফিলিম (נְפִילִים) বলা হতো হিব্রুতে। নেফিলিম অর্থ ‘Fallen’ বা ‘পতিত’। মূলত Fallen Angel থেকে এটা এসেছে। আপাতত এটা জেনে রাখাই যথেষ্ট যে, নেফিলিমের গল্প শুনিয়ে বাচ্চাদের ভয় দেখানো হতো। তবে এটা তাদের কাছে পৌরাণিক ছিল না, এটা তারা বিশ্বাস করতো, বড়রাও বিশ্বাস করতো। ছোট থেকেই নেফিলিম ভয় করতে শিখতো তারা। তাই যখন তারা রটিয়ে দিল যে, কেনান ভূমিতে নেফিলিম আছে, তখন পুরো কাফেলা ভয় পেয়ে গেল। তারা আর এগোতেই চাইল না।

নেফিলিম; Image Source: Wikimedia Commons

আরবিতে ‘নেফিলিম’ শব্দ নেই। এটা হিব্রু। কুরআন বলছে, গুপ্তচরেরা বলেছিল, “সেখানে একটি প্রবল পরাক্রান্ত জাতি রয়েছে। আমরা কখনও সেখানে যাব না, যে পর্যন্ত না তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়। তারা যদি সেখান থেকে বের হয়ে যায় তবে নিশ্চিতই আমরা প্রবেশ করব।” [কুরআন ৫:২২]

তবে, কালুত আর ইউশা জানতেন, এটা ভুয়া। তারা বোঝানোর চেষ্টা করলেন সবাইকে। কিন্তু গুজব বন্ধ করা কি আর এত সহজ?

কুরআন বলছে, “খোদাভীরুদের মধ্য থেকে দু’ব্যক্তি যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছিলেন, (কালুত আর ইউশা) বললেন, তোমরা তাদের উপর আক্রমণ করে দরজায় প্রবেশ কর। এরপর তোমরা যখন তাতে পবেশ করবে, তখন তোমরাই জয়ী হবে। আর আল্লাহর উপর ভরসা কর যদি তোমরা বিশ্বাসী হও।” [কুরআন ৫:২৩]

কিন্তু কে শোনে কার কথা!

“তারা বললো, হে মূসা, আমরা জীবনেও সেখানে যাব না, যতক্ষণ তারা সেখানে থাকবে। অতএব, আপনি ও আপনার আল্লাহ্‌ই যান এবং দুজনে যুদ্ধ করে নেন। আমরা এখানেই বসলাম।” [কুরআন ৫:২৪]

তারা সবাই মিলে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসলো। মূসা (আ)-কে সরিয়ে নতুন নেতা নির্বাচন শুরু করলো! ইউশা আর কালুতকে ধরে নিয়ে গেল পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করার জন্য।

আল্লাহ্‌ বললেন, কুরআন না, বরং বাইবেলই বলছে যে, আল্লাহ্‌ বলেছিলেন তখন, “আর কতকাল এই লোকগুলো আমায় অবজ্ঞা করবে? আর কত অলৌকিকতা দেখানোর পর ওরা আমায় অবিশ্বাস করবে? পবিত্র ভূমির যে অধিকার আমি ইসরাইল জাতিকে দিয়েছি সেটা আমি কেড়ে নেব আর আমি তাদের থেকেও বড় আর শক্তিশালী জাতি সৃষ্টি করব।” [গণনাপুস্তক 14:12]

মূসা (আ) বললেন, “হে আমার পালনকর্তা, আমি শুধু নিজের উপর ও নিজের ভাইয়ের উপর ক্ষমতা রাখি। অতএব, আপনি আমাদের মধ্যে ও এ অবাধ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ করুন।” [কুরআন ৫:২৫]

তখন আল্লাহ সকল ইসরাইলবাসীকে উদ্দেশ্যে বললেন, “এ দেশ চল্লিশ বছর পর্যন্ত তাদের জন্যে হারাম করা হলো। তারা ভুপৃষ্ঠে উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরবে ফিরবে।” [কুরআন ৫:২৬]

যে দেশ মাত্র কয়েকশ কিলোমিটার দূরে ছিল, সেখানে তারা ৪০ বছরেও পৌঁছাতে পারবে না। দেখা গেল, পরের বছরগুলোতে সেই ১২ জনের অবাধ্য ১০ জন কোনো না কোনো রোগে মারা যায়। বেঁচে থাকেন কেবল কালুত আর ইউশা।

বনি ইসরাইল তখন ভয় পেয়ে গেল। সবাই এবার যাবার জন্য প্রস্তুত কেনান দেশে! যে দেশে যাবার জন্য এতক্ষণ সবাই অনিচ্ছুক ছিল, এখন তারাই দৌড়ে যাচ্ছে। কিন্তু মূসা (আ) গেলেন না। বসে রইলেন আর্ক অফ দ্য কভেন্যান্টের কাছে। তিনি জানেন, তারা যেতে পারবে না।

এগিয়ে যাওয়া সেই কাফেলার উপর আক্রমণ করে বসলো আমালেক জাতি আর কেনান জাতি। অতর্কিত আক্রমণে তারা পালিয়ে ফিরে আসা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলো না। এরপর থেকে কাফেলা কেবল সীন মরুভূমিতে ঘুরপাক খেতেই থাকলো।

এর মধ্যেও, এত কিছুর পরেও তারা কিন্তু মূসার (আ) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অব্যাহতই রাখলো। এমনকি, লেবিগোত্রের কারুণ নিজেকে নেতা বলে দাবি করে বসলো। সে তার দল নিয়ে এসে বললো, “মূসা আর হারুন, আপনারা কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছেন। আপনাদের এমন কী বিশেষত্ব যে আপনারা নেতা থাকবেন?”

মূসা (আ) বললেন, “না, তোমরাই বাড়াবাড়ি করছ। কাল সকালেই দেখা যাবে।”

পরদিন আল্লাহ্‌ মূসাকে (আ) দিয়ে সবাইকে বললেন, “কারুণ আর তার অনুসারীদের তাঁবু থেকে যেন সবাই সরে দাঁড়ায়…”

সবাই ভয় পেয়ে সরে গেল।

এরপর মূসা (আ) বললেন সবাইকে উদ্দেশ্য করে, “কারুণ আর এরকম লোকদের যদি স্বাভাবিক মৃত্যু হয়, বা অন্যান্য লোকের স্বাভাবিকভাবে যা হয় তা-ই হয়, তবে তোমরা ধরে নিবে, আমি আল্লাহ্‌র প্রেরিত না। আর মাবুদ যদি সম্পূর্ণ নতুন কিছু করেন, যদি মাটি তাদের গিলে ফেলে, তবে বুঝবে এরা অপরাধী।”

মূসার (আ) এই কথা শেষ হবার সাথে সাথেই লোকগুলোর পায়ের নিচের মাটি দু’ফাঁক হয়ে গেল। এবং সেই লোকগুলো মাটির ভেতর পড়ে গেল। এরপর মাটি আবার এক হয়ে গেল। সবাই ভয়ে বেশ কিছুদিন চুপ থাকলো।

এর পরের বছরের প্রথম মাসে, কাফেলা সীন মরুভূমির কাদেশের কাছে গিয়ে পোঁছাল। মূসার (আ) বোন মরিয়ম সেখানে মারা গেলেন। তাঁকে সেখানেই দাফন করা হলো। তার স্বামীই ছিলেন কালুত।

এক টুকরো মরু; Image Source: iStock

এর পরপরই জনগণ আবার বিদ্রোহ করে বসলো মূসা (আ) আর হারুনের (আ) বিরুদ্ধে, কারণ তাদের পানির সংকট দেখা দিয়েছিল, আর এজন্য তারা মূসাকে (আ) দায়ী করছিল। কারণ, মূসা (আ) তাদের এই মরুতে এনে ফেলেছেন।

আল্লাহ্‌ তখন মূসাকে (আ) যা করতে বললেন, সেই মোতাবেক মূসা (আ) এক বিরাট পাথরের কাছে গিয়ে তাঁর লাঠি দিয়ে জোরে দুবার আঘাত করলেন। সেখান থেকে প্রবল বেগে তখন পানি বেরিয়ে আসতে লাগলো। প্রাণ ভরে পান করলো ইহুদীরা, পশুগুলোকেও খাওয়াল।

কিছুদিন পর আল্লাহ্‌ মূসাকে (আ) বললেন, তিনি যেন তাঁর ভাই হারুন আর হারুনের ছেলে ইলিয়াসারকে নিয়ে হোর পর্বতে আরোহণ করেন। সাথে এটাও বললেন, তাঁর ভাই হারুন (আ) এর মারা যাবার সময় হয়েছে।

তাই মূসা (আ), হারুন (আ) আর ইলিয়াসার গেলেন হোর পাহাড়ের চূড়োয়। সেখানে মূসা (আ) হারুনের (আ) গা থেকে খুলে নিলেন প্রধান ইমামের পোশাক, আর সেটা পরিয়ে দিলেন ইলিয়াসারের গায়ে। এখন থেকে সে-ই হবে প্রধান ইমাম।

সেই পাহাড়ের চূড়াতেই মারা গেলেন হারুন (আ)। তাঁর বয়স হয়েছিল ১২৩ বছর।

তার মারা যাবার পর ইসরাইল জাতি এক মাস ধরে শোক পালন করলো। কিন্তু তারা কি জানতো মূসা (আ) এরও যাবার সময় হয়ে গেছে?

হারুন (আ) এর কবর, জর্ডানের পেত্রাতে; Image Source: Wikimedia Commons

 

পঞ্চদশ পর্ব: রাহাব ও দুই গুপ্তচরের কাহিনী

এ সিরিজের পর্বগুলো হলো:

প্রথম পর্ব: ইহুদী জাতির ইতিহাস: সূচনা পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব: মিশরে যাবার আগে কেমন ছিল বনি ইসরাইল?

তৃতীয় পর্ব: হযরত ইউসুফ (আ): দাসবালক থেকে মিসরের উজির- ইহুদী জাতির ইতিহাস

চতুর্থ পর্ব: ইউসুফ-জুলেখার কাহিনীর জানা অজানা অধ্যায়

পঞ্চম পর্ব: মসজিদুল আকসা আর বাইতুল মুকাদ্দাসের ইতিবৃত্ত

ষষ্ঠ পর্ব: দাসবন্দী বনী ইসরাইল এবং হযরত মুসা (আ:) এর জন্ম

সপ্তম পর্ব: মিসরের রাজপ্রাসাদ থেকে সিনাই পর্বত

অষ্টম পর্ব: সিনাই পর্বত থেকে ফারাওয়ের রাজদরবার

নবম পর্ব: মিসরের অভিশাপ

দশম পর্ব: দ্বিখণ্ডিত লোহিত সাগর, এক্সোডাসের সূচনা

একাদশ পর্ব: মরিস বুকাইলি আর ফিরাউনের সেই মমি

দ্বাদশ পর্ব: তূর পর্বতে ঐশ্বরিক সঙ্গ এবং তাওরাত লাভ

ত্রয়োদশ পর্ব: ইসরাইলের বাছুর পূজা এবং একজন সামেরির ইতিবৃত্ত

চতুর্দশ পর্ব: জীবন সায়াহ্নে দুই নবী

পঞ্চদশ পর্ব: রাহাব ও দুই গুপ্তচরের কাহিনী

ষোড়শ পর্ব: জেরিকোর পতন এবং স্যামসনের অলৌকিকতা

সপ্তদশ পর্ব: এক নতুন যুগের সূচনা

 

বোনাস প্রাসঙ্গিক আর্টিকেল:

দ্য ফার্স্ট মুসলিম: একজন ইহুদীর চোখে মহানুভব হযরত মুহাম্মাদ (সা)

ইজরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত: কী, কেন এবং কীভাবে এর শুরু?

This article is in Bangla language, and about the incidents following the Exodus of the Israelites from the Biblical times. For references, please visit the hyperlinked sites.

Featured Image: jewellpage.wordpress.com

This article is copyrighted under Roar Bangladesh Ltd. No textual part of this article may be reproduced or utilized in any form or by any means, electronic or mechanical, including photocopying, recording, or by any information storage and retrieval system, without express permission in writing from the publisher. Any person or entity found reproducing any portion of this article will be held in violation of copyright, and necessary steps will be taken.

Related Articles