
১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী ১১ দিন ধরে চলা স্রেব্রেনিকা গণহত্যায় প্রাণ হারায় প্রায় ৮,০০০ বসনিয়ান মুসলিম, যাদের সিংহভাগই ছিল অল্প বয়সী ছেলে, কিশোর ও পুরুষ। নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞের বিভীষিকায় স্তম্ভিত হয়ে ওঠে পুরো বিশ্ববাসী। যে নৃশংসতায় মানুষগুলোকে খুন করা হয়েছে, যে বর্বরতার শিকার হয়েছে সেখানকার মানুষজন, সেটা যে একজন মানুষ তারই স্বগোত্রীয় আরেকজনের সাথে করতে পারে, তা চিন্তা করতেও বেশ কষ্ট হয়।

ন্যাক্কারজনক এ ধরনের ঘটনা মানবজাতির ইতিহাসে আরও অনেক ঘটেছে। গণহত্যার শিকার হয়ে মরেছে অজস্র মানুষ। তবে এই ভয়াবহতার সত্যিকার চিত্র অনুধাবনের জন্য জানা দরকার প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা, যাদের মুখের ভাষায় ফেরত যাওয়া যায় তৎকালীন পরিস্থিতিতে। তাদের বর্ণনা শুনবার সময় মনে হয় যেন সত্যি সত্যিই সেসব আবারও ঘটছে চোখের সামনে।
আজকের এই লেখায় স্রেব্রেনিকা গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী এমনই দুজনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হবে রোর বাংলার পাঠকদের জন্য।
১) নেদ্ঝাদ আদ্ভিচ
তারা গুলি করতে শুরু করলো। ঠিক বলতে পারব না আমার গায়ে কখন গুলি লাগে। শুধু মনে আছে, আমি শুয়ে মৃত্যুভয়ে কাঁপছিলাম। চারপাশের অনেকের গায়েই গুলি লাগছিল। আমি কেবলই অপেক্ষা করছিলাম আমার গায়ে গুলি লাগার জন্য!
নেদ্ঝাদ আদ্ভিচ, মাত্র ১৭ বছর বয়সী এক কিশোর। বয়স কম হলে কী হবে! এরই মাঝে জীবনের অন্ধকার নানা অধ্যায় দেখা হয়ে গেছে তার।
তিন বছর আগের কথা; ১৯৯২ সালে সার্ব সেনারা এসে পুড়িয়ে দিয়ে যায় তাদের বাড়ি-ঘর। চোখের সামনেই এক কিশোর সেদিন ছাই হতে দেখেছিল মাথা গোঁজার একমাত্র অবলম্বনকেই।
পরবর্তীতে বাবা, মা আর তিন বোনের সাথে কিশোর আদ্ভিচ চলে আসে স্রেব্রেনিকায়। জীবনটাকে নতুন করে সাজিয়ে তোলার স্বপ্ন দেখছিল তারা, একটু একটু করে এগোচ্ছিল সেই স্বপ্ন পূরণের পথেই। এরই মাঝে চলে আসে ১৯৯৫ সাল, অভিশপ্ত পঁচানব্বই বললেও হয়তো অত্যুক্তি হবে না। জেনারেল রাৎকো ম্লাদিচের নির্দেশে সেনারা নৃশংস গণহত্যায় মেতে ওঠে স্রেব্রেনিকায়।
না, অলৌকিকভাবে সেনাদের নজর এড়াতে পারেনি আদ্ভিচ। তাকে-সহ আরও অনেককেই কাপড় দিয়ে ঢাকা এক ট্রাকে তুলে স্রেব্রেনিকা থেকে প্রায় বেশ দূরের এক বাধের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।

ইতোমধ্যে আরও অনেককেই সেখানে জড়ো করা হয়েছিল। আদ্ভিচের গ্রুপের সাথে তাদের পার্থক্য ছিল শুধু এক জায়গাতেই, তাদের কারও দেহেই তখন প্রাণের স্পন্দন ছিল না।
হাত দুটো পেছনে খুব শক্ত করে বাঁধা ছিল। এই অবস্থাতেই তাকে মাথা নিচু করে মৃতদের মাঝে বসে পড়তে বলা হয়। চারদিকে অগণিত মৃতদেহ। এর মাঝে বসেই এক কিশোর অপেক্ষা করছিল তার নিজের মৃত্যুর জন্য, গণহত্যার পরিসংখ্যানের একটি সংখ্যা হবার জন্য। তার ভাষায়,
তারা গুলি করতে শুরু করলো। ঠিক বলতে পারব না আমার গায়ে কখন গুলি লাগে। শুধু মনে আছে, আমি শুয়ে মৃত্যুভয়ে কাঁপছিলাম। চারপাশের অনেকের গায়েই গুলি লাগছিল। আমি কেবল অপেক্ষা করছিলাম আমার গায়ে গুলি লাগার জন্য!
চোখের সামনেই একে একে পরিচিত-অপরিচিত মানুষজনকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখছিল কিশোর আদ্ভিচ, আর ভাবছিল, মায়ের মুখটা বুঝি আর কখনোই দেখা হবে না। ঠিক এমন সময় তার গায়ে গুলি লাগে, পর পর তিনটি, ডান হাতে আর পেটে। প্রচণ্ড ব্যথায় কুঁকড়ে যায় সে। ভেবেছিল, এই বুঝি শেষ, মৃত্যুর স্বাদ বুঝি এমনই।
কিন্তু না, আদ্ভিচের প্রাণপাখি খাঁচা ছেড়ে বেরোতে চায়নি। তাই তো মাঝ রাতে যখন তাদের নিয়ে আসা ট্রাকটি চলে গেল, তখন প্রচণ্ড আহত হলেও বেঁচে ছিল সে। আশেপাশে আরও অনেকেই পড়ে ছিল; কেউ মৃত, কেউ জীবনের শেষ সময়টুকু পার করছে, কেউ আবার প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরাচ্ছে।

এমন দুঃসহ পরিস্থিতিতেই নিজের ডান পাশে আরেকজন জীবিত ব্যক্তিকে খুঁজে পেল আদ্ভিচ। দুজন মিলে কোনোমতে একে অন্যের বাঁধন খুলে দিল। এরপর কোনোমতে শরীরটাকে টেনে নিয়ে পাশেই গাছের আড়ালে চলে গেল, যাতে করে টহলরত সৈন্যদের নজরে পড়তে না হয়। পরদিন পাহাড়ের চূড়ায় উঠে তারা বুঝতে পারল কী এক নরক থেকেই না তারা জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছে। সেখান থেকে আশেপাশে যেখানেই চোখ যায়, কেবল লাশ আর লাশ। এত লাশ মানুষের পক্ষে সরানো সম্ভব ছিল না, তাই বুলডোজার দিয়েই সরানো হচ্ছিল লাশগুলো।
পরবর্তী কয়েকদিন ধরে এই আহত শরীর নিয়েই তারা ছুটে চলে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে। বন-জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে, সৈন্যদের উপস্থিতি টের পেলে নদীর বুকে নিজেদের গোপন করে, কবরস্থানে রাত কাটিয়ে অবশেষে তারা বসনীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা নিরাপদ এলাকায় পৌঁছতে সক্ষম হয়।
২) নির্হা এফেন্দিচ
একমাস পর বাবার ব্যাপারে আমরা জানতে পারলাম। তাকে ক্রাভিকার এক হ্যাঙারে (বিমান রাখার জায়গা) আরও অনেকের সাথে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে তাদের সবাইকেই হত্যা করা হয়।
এবার আসা যাক নির্হা এফেন্দিচের কাছে, স্রেব্রেনিকার ভয়াবহ গণহত্যার সময় যার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। জীবনের যে সময়টাতে মানুষের কাছে দুনিয়াকে সবচেয়ে বেশি রঙিন লাগে, নির্হার জীবনের সেই সময়টাই হয়ে আছে সবচেয়ে বেশি ধূসর-রঙা। সার্ব সেনারা তাদের এলাকায় আক্রমণ চালালে জীবন বাঁচাতে তারা ছুট লাগায় পোতোচারির দিকে। কিন্তু ভাগ্য খারাপ, কারণ সেখানকার জাতিসংঘ ক্যাম্প তখন লোকে লোকারণ্য, তিল ধারণের জায়গাও নেই। বাধ্য হয়ে নিকটবর্তী এক ফ্যাক্টরিকে আপাতত মাথা গোঁজার ঠাই হিসেবে বেছে নেয় নির্হা, সাথে ছিল তার মা।
মা-মেয়ের কথা নাহয় গেল, তাদের পরিবারে কি আর কেউ ছিল না? ছিল; বাবা এবং ভাই। তবে তারা যে ঠিক কোথায় গিয়েছিল গণ্ডগোলের কারণে তা আর বুঝে উঠতে পারেনি নির্হা। লোকমুখে শুনেছিল, সার্বিয়ান সেনাদের হাতেই ধরা পড়েছে তারা, আটকে রাখা হয়েছে স্রেব্রেনিকার চারপাশের পাহাড়গুলোরই কোনো একটায়।
এরপরের ঘটনাগুলো নির্হার মুখ থেকেই শোনা যাক,
হাজার হাজার নারী আর শিশুর সাথে ঐ ফ্যাক্টরিতেই আমরা তিনটা দিন কাটালাম। আমাদের না ছিল পানি, না ছিল কোনো খাবার। চতুর্থ দিনে মুক্তাঞ্চলের দিকে যাওয়া বাস-ট্রাকে আমাদের একে একে তুলে দিল সার্বিয়ান সেনারা। যেটুকু পথ পাড়ি দিলাম, স্বাভাবিক সময়ে ওটুকু যেতে বড়জোর এক ঘণ্টা লাগবার কথা। কিন্তু সেদিন এত বেশি নারী ও শিশুকে একটু পর পর তোলা লাগছিল যে ঐ পথটুকু যেতেই লেগে যায় চার ঘণ্টার মতো সময়।

টানা তিন দিন ধরে পেটে দানাপানি কিছু পড়েনি, তৃষ্ণায় হাহাকার করছে বুকের ভেতরটা, এর উপর এই ভয়াবহ যাত্রার ধকল- সব মিলিয়ে বেশ জ্বরে পড়ে গেল নির্হা। মুক্তাঞ্চলে পৌঁছার পর তাই আর আশেপাশে কে কেমন আছে সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে চায়নি সে, কেবল চাইছিল এই মৃত্যু আর আতঙ্কঘেরা পরিবেশ থেকে একটু মুক্তি, একটু খোলা হাওয়া, নিজেকে আরেকটিবার মানুষ বলে ভাবতে পারার অবকাশ।
বাবা-ভাইয়ের পরবর্তী পরিণতির কথাও জানা যাক নির্হার মুখ থেকেই,
একমাস পর বাবার ব্যাপারে আমরা জানতে পারলাম। তাকে ক্রাভিকার এক হ্যাঙারে (বিমান রাখার জায়গা) আরও অনেকের সাথে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীতে তাদের সবাইকেই হত্যা করা হয়। ২০০২ সালে স্রেব্রেনিকার এক গণকবরে তার দেহাবশেষ শনাক্ত করি আমরা। অবশেষে ২০০৪ সালে তাকে আলাদা একটি কবরে স্থানান্তরিত করি। চার বছর আগে (২০১১ সালে) আমার ভাইয়ের ব্যাপারেও জানতে পারি। তার দেহাবশেষের মাত্র এক-চতুর্থাংশই খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। বিশতম জন্মদিনের মাত্র উনিশ দিন আগে জ্ভরনিকে তাকে হত্যা করা হয়।