![](https://assets.roar.media/assets/W7q5v3b0TFIyZHOb_1.png?w=1200)
প্রাচীন রোমের কথা মাথায় আসলে যে অল্প কয়েকটি বিষয় আমাদের মনে উঁকি দিয়ে যায়, তার মাঝে গ্ল্যাডিয়েটর শীর্ষস্থানীয়। অন্য আরেকজন গ্ল্যাডিয়েটর, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী, এমনকি বন্য প্রাণীদের সাথেও লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হতো তাদের। আর এভাবেই উপস্থিত দর্শকদের বিনোদনের খোরাক যোগানোর কাজটি করে যেত তারা।
আজকের লেখায় সেই গ্ল্যাডিয়েটরদেরই মৃত্যু সংক্রান্ত এমন কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হবে, যা অধিকাংশ বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের কাছেই এতদিন ছিলো অজানা। আর অজানাকে সবার সামনে তুলে ধরাই তো রোর বাংলার কাজ!
১
অ্যারেনার ভেতরে যুদ্ধ হতো গ্ল্যাডিয়েটরদের মাঝে। অধিকাংশ সময়ই তারা জোড়ায় জোড়ায় একে অপরের সাথে লড়াইয়ের লিপ্ত হতো। মাঝে মাঝে সেটা একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনের যুদ্ধও ছিলো। কখনো কখনো প্রতিপক্ষকে একেবারে ধরাশয়ী করে তাকে প্রাণভিক্ষা চাওয়া পর্যন্ত গড়াতো যুদ্ধগুলো। এমন পরিস্থিতিতে কী ঘটতে যাচ্ছে তার ভাগ্যে, সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতো খেলা দেখতে আসা দর্শকবৃন্দ এবং সেই প্রদর্শনীর প্রধান, যাকে বলা হতো এডিটর।
![Image Source: Quora](https://assets.roar.media/assets/awaRf7pgba8pQXzM_1.png)
বিজয়ী হলে গ্ল্যাডিয়েটরকে পুরষ্কার স্বরুপ অর্থ প্রদান করা হতো। মৃত গ্ল্যাডিয়েটরকে স্ট্রেচারে করে একটি বিশেষ গেট দিয়ে অ্যারেনার বাইরে নিয়ে যাওয়া হতো। এই বিশেষ গেটকে রোমানরা বলতো ‘পোর্টা লিবিটিনেনসিস’। এখানে পোর্টা অর্থ গেট এবং লিবিটিনেনসিস দ্বারা দাফনের দেবী লিবিটিনাকে বোঝানো হতো।
২
খেলার ফলাফল যা-ই হোক না কেন, একজন গ্ল্যাডিয়েটরের শেষ পরিণতি কী হবে এটা নির্ভর করতো অ্যারেনাতে তার কার্যাবলীর উপর।
ধরুন, একজন গ্ল্যাডিয়েটর প্রতিপক্ষের কাছে পরাজিত হলেন। কিন্তু মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি বীরের মতো লড়াই করলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে পালানোর কোনো চেষ্টা করলেন না, দেখালেন না দুর্বলতার সামান্যতম চিহ্নও- এমন একজনের মৃতদেহও সসম্মানে অ্যারেনা থেকে নিয়ে যাওয়া হতো। হেরে গেলেও সকলের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হয়েই থাকতেন তিনি।
![](https://assets.roar.media/assets/17SP6wQGSSSHDgu7_1.png)
এখন আরেকজন গ্ল্যাডিয়েটরের কথা চিন্তা করা যাক, যিনিও প্রথমজনের মতো হেরে গেছেন। তবে তার বেলায় ঘটনাটি ছিলো প্রথমজনের ঠিক বিপরীত। তিনি লড়াই করেছিলেন কেবল করতে হয়েছিলো বলেই, একটু পরপরই পালানোর পথ খুঁজছিলেন, আবার তাকে আঘাত না করার জন্য প্রতিপক্ষের কাছে মিনতি করছিলেন বারবার- এমন একজনকে খেলা দেখতে আসা কেউই পছন্দ করতেন না। তাকে গণ্য করা হতো একজন কাপুরুষ হিসেবে। প্রথমোক্ত গ্ল্যাডিয়েটরের মৃতদেহ যেখানে সম্মানের সাথে বয়ে নেয়া হতো, শেষোক্ত ব্যক্তির মৃতদেহ সেখানে টেনেহিচড়ে অ্যারেনার বাইরে নেয়া হতো।
৩
এখন কেউ কেউ ভাবতে পারেন, কোনো গ্ল্যাডিয়েটর হয়তো অ্যারেনাতে মারা যাবার মিথ্যা অভিনয় করতে পারতেন। পরে তাকে টেনেহিচড়ে বাইরে নিয়ে গেলে সুযোগ বুঝে পালিয়ে গেলেই হয়ে যেতো!
এমনটা যে হতে পারতো, সেটা গ্ল্যাডিয়েটরদের মাঝে যুদ্ধের আয়োজকেরাও অনুমান করেছিলো। তাই এটা যেন কোনোভাবেই না হতে পারে, সেই ব্যবস্থাও তারা করে রেখেছিলেন।
![](https://assets.roar.media/assets/tTa0p5pLHV8EuARB_1.png)
একজন গ্ল্যাডিয়েটর যখন সাহসের সাথে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেন, তখন তার মৃতদেহকে সসম্মানে একটি বিশেষ কক্ষে নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানে তার দেহ থেকে সকল রকমের বর্ম অপসারণের পর গলা কেটে দেয়া হতো। ফলে তখনও যদি তার মাঝে জীবনের কোনো চিহ্ন অবশিষ্ট থাকতো, এরপর সেটাও উধাও হয়ে যেত।
আবার, যেসব গ্ল্যাডিয়েটর কাপুরুষের মতো অ্যারেনায় মারা যেত, তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে এরপর একজন ক্রীতদাসকে সেখানে পাঠানো হতো। তিনি সেখানে গিয়ে একটি বড় পাথরখণ্ড বা মুগুরের সাহায্যে ঐ মৃত গ্ল্যাডিয়েটরের মাথা পুরো থেঁতলে দিতেন!
অর্থাৎ, এখানে অভিনয়ের কোনো সুযোগই ছিলো না।
৪
একটু আগেই যে ক্রীতদাসদের কথা বলা হলো, তারাও একেক সময় একেক পোশাক পরিধান করতেন।
![](https://assets.roar.media/assets/ADg1c8dou2RAo1V9_1.png)
আনুমানিক ৭০ খ্রিস্টাব্দ সময়কালের এক গ্ল্যাডিয়েটর কবরস্থান থেকে এই সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সেখানে তাদের কবরগুলোতে মৃতদেহের সাথে বিভিন্ন জিনিসপত্র দেয়া হতো, যা থেকে ক্রীতদাসদের পোশাক সম্পর্কে ধারণা মেলে। কেউ কেউ মৃতদেহ অপসারণের সময় মিশরীয় মর্ত্যদেবতা আনুবিসের মুখোশ পরিধান করতেন। কেউ আবার জোড়ায় জোড়ায় অ্যারেনাতে প্রবেশ করতো। তাদের একজন চারুন (এট্রুস্কান মৃত্যু দেবতা) ও অপরজন হার্মিস সাইকোপম্পাসের (মর্ত্যলোকে আত্মাকে পথ দেখায় যে) বেশ ধারণ করতো। যখনই মনে হতো একজন গ্ল্যাডিয়েটর মারা গিয়েছে (কাপুরুষের মতো), তখন মৃত্যু নিশ্চিত করতে চারুন তার মাথায় হাতুড়ি দিয়ে জোরেশোরে আঘাত করতো এবং হার্মিস গরম রড তার দেহের ভেতর ঢুকিয়ে দিতো।
৫
প্রাচীন রোমে গ্ল্যাডিয়েটরদের মাঝে অধিকাংশই ছিলো বিভিন্ন যুদ্ধবন্দী, যাদেরকে ক্রীতদাস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিলো। অবশ্য স্বল্প সংখ্যক স্বাধীন মানুষও থাকতো তাদের মাঝে।
![](https://assets.roar.media/assets/JVIlTenWlnwN3nSg_1.png)
তাদেরকে প্রথমেই অ্যারেনাতে পাঠানো হতো না। বরং তাদেরকে প্রথমে পাঠানো হতো গ্ল্যাডিয়েটরদের জন্য নির্মিত বিশেষ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে, যেখানে তাদেরকে বিভিন্ন রকমের শারীরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। সেই সাথে বিভিন্ন রকমের অস্ত্রের ব্যবহারও শেখানো হতো, যাতে তারা প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করতে পারে দক্ষতার সাথে। এসব দক্ষতার পাশাপাশি কীভাবে খেলা জমিয়ে তুলে দর্শকদের মন জয় করে নিতে হয়, এই প্রশিক্ষণও দেয়া হতো তাদেরকে। এতে করে একজন ক্রীতদাস পর্যন্ত একজন স্বাধীন মানুষের মতোই অ্যারেনা থেকে সদর্পে বেরিয়ে যেতে পারতো।
তবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের অ্যারেনাতে পাঠানোর আগে কোনোরকম প্রশিক্ষণই দেয়া হতো না। যত ভালোই মোকাবেলা করুক না কেন, মৃত্যুই ছিলো তাদের শেষ নিয়তি। তাদের রক্তই ছিলো উপস্থিত দর্শকদের বিনোদনের খোরাক।
৬
গ্ল্যাডিয়েটরদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে একটি অদ্ভুত জিনিস শেখানো হতো। সেটি হলো, কীভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়। খুব অদ্ভুত শোনালেও, এই সময়ে তাদের চাহনি এবং অঙ্গভঙ্গিই পারতো পুরো পরিস্থিতি বদলে দিতে।
ধরুন, দুজন গ্ল্যাডিয়েটরের মাঝে তুমুল লড়াই চলছে। এর মাঝে হঠাৎ করেই একজন তার প্রতিপক্ষকে এমন আঘাত করলো যে সেই লোকটি সাথে সাথে মাটিতে পড়ে গেলো, আর একটি মাত্র আঘাতই তার প্রাণপাখিকে মুক্ত করে দিতে যথেষ্ট। এমন পরিস্থিতিতে নিয়ম ছিল যে, দাঁড়িয়ে থাকা গ্ল্যাডিয়েটরকে মরণ আঘাত হানার আগে আয়োজকদের দিকে একটিবারের জন্য হলেও তাকাতে হতো। তখন আয়োজকরাই সিদ্ধান্ত নিতেন, পড়ে যাওয়া সেই গ্ল্যাডিয়েটরকে প্রাণ ভিক্ষা দেয়া হবে, নাকি সেখানেই মেরে ফেলা হবে।
![](https://assets.roar.media/assets/D8oMHEDERTtSTe99_1.png)
এই পরিস্থিতিতে পড়ে যাওয়া গ্ল্যাডিয়েটর যদি ব্যথায় কাতরাতে থাকতেন কিংবা তাকে দেখে ভীতসন্ত্রস্ত বলে মনে হতো, তাহলে তার মৃত্যুর ব্যাপারেই রায় আসতো। কারণ, তিনি কাপুরুষের মতো আচরণ করেছেন। অন্যদিকে, মাটিতে পড়ে গেলেও যদি সেই লোকটি ব্যথায় না কাতরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিপক্ষের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হানতেন, তাহলে এমন আচরণ তার ভেতরের সাহসী মনোভাবকেই তুলে ধরতো, যা তাকে দর্শক ও আয়োজকদের সহানুভূতি লাভ করে বেঁচে থাকার রায় এনে দিতো।
৭
গ্ল্যাডিয়েটরদের একটা বড় অংশই যে স্বেচ্ছায় এই পথে আসতেন না তা তো কিছুক্ষণ আগেই বলা হয়েছে। এর ফলস্বরুপ তাদের অনেকে এই জীবন-মরণ খেলায় অংশও নিতে চাইতেন না।
চতুর্থ শতকের রাজনীতিবিদ সিম্মাকাস একবার একটি প্রতিযোগিতার জন্য ২০ জন গ্ল্যাডিয়েটরকে সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু যখন অ্যারেনাতে তাদের প্রবেশের সময় হলো, তখন তারা পূর্বপরিকল্পনানুযায়ী একে অপরকে হত্যা করে ফেলেছিলো। এমন ঘটনায় উপস্থিত সকলেই হতবুদ্ধি হয়ে যায়।
![](https://assets.roar.media/assets/TePseAMc0JBWDFVN_1.png)
একবার এক লোককে যখন লড়াইয়ে নামার জন্য অ্যারেনাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো, তখন সে সুযোগ বুঝে গাড়ির চাকার নিচে তার মাথা ঢুকিয়ে দেয়। এতে ঘাড় ভেঙে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
৮
একজন গ্ল্যাডিয়েটর যখন প্রতিপক্ষের আঘাতে মাটিতে পড়ে যেতো এবং যখন তার মৃত্যুও সেখানেই নিশ্চিত হয়ে যেত, তখন কখনও কখনও দেখা যেত যে, দর্শকদের মাঝে কেউ ছুটে সেই গ্ল্যাডিয়েটরের কাছে গিয়ে ক্ষতস্থান থেকে তার রক্ত পানে মত্ত হয়ে উঠেছে! কথাটি অদ্ভুত শোনালেও আসলেই এমনটা ঘটতো। আর এটা করতো মূলত মৃগীরোগীরা। কারণ তাদেরকে বলা হতো, যদি তারা একজন গ্ল্যাডিয়েটরের রক্ত পান করে, তবে তাদের এই রোগ চিরতরে সেরে যাবে।
![](https://assets.roar.media/assets/c6v9ErXaXdAHDJuG_1.png)
যদি সেই গ্ল্যাডিয়েটরের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যেত, তখনও এমনটা দেখা যেত। তখন কয়েকজন করে ছুটে যেত যেন যেকোনোভাবে সেই গ্ল্যাডিয়েটরের কলিজার একটি টুকরা হলেও পাওয়া যায়! কারণ, তাদের বিশ্বাস ছিলো যে, নয়টি ডোজে গ্ল্যাডিয়েটরের কলিজা খেলে মৃগীরোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব!
৯
গ্ল্যাডিয়েটরদের রক্ত যে শুধুমাত্র মৃগীরোগীরা ব্যবহার করতেন তা কিন্তু না। তাদের শারীরিক শক্তি অনেকের কাছেই তাদেরকে মডেলে পরিণত করেছিলো। বিভিন্ন ফুলদানী, মোজাইল ও দেয়ালচিত্রে তাদের দেখা মিলতো।
![](https://assets.roar.media/assets/wCKMcSdMpG2v5O4i_1.png)
সাধারণ পুরুষরা মনে করতেন, শক্তিশালী এই গ্ল্যাডিয়েটরদের রক্তেও বোধহয় বিশেষ কিছু আছে। সেই বিশ্বাস থেকেই নিজেদের যৌনক্ষমতা বৃদ্ধির আশায় তারা গ্ল্যাডিয়েটরদের রক্ত পান করতেন! তবে এটা সরাসরি অ্যারেনাতে গিয়ে করা হতো না, বরং চাহিদামতোই কেনা যেত। আর বিশেষ এই চাহিদার জন্য এই উদ্দেশ্যে বিক্রি হওয়া রক্তের দামও ছিলো অত্যধিক। তবে সেই রক্ত আসলেই একজন গ্ল্যাডিয়েটরের থাকতো, নাকি সেখানে অন্য কোনো মানুষ কিংবা প্রাণীর রক্তকে গ্ল্যাডিয়েটরের বলে চালিয়ে দেয়া হতো, সেই সত্য জানবার উপায় আজ আর নেই।
১০
অ্যারেনা থেকে একজন মৃত গ্ল্যাডিয়েটরকে কীভাবে নেয়া হবে সেটা তো আগেই আলোচনা করা হয়েছে। এবার চলুন জানা যাক তাদের মৃতদেহের শেষ পরিণতি সম্পর্কে।
একজন গ্ল্যাডিয়েটর যদি বীরের মতো মৃত্যুবরণ করতেন, তবে তার মৃতদেহটি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যাবার অনুমতি দেয়া হতো। শবদাহের পর বিভিন্ন উপহাস সামগ্রীর সাথে দেহের ভস্মটুকু মাটিচাপা দেয়া হতো।
![](https://assets.roar.media/assets/qFz50KNEC28C4Zfk_1.png)
তবে কাপুরুষের মতো মারা যাওয়া গ্ল্যাডিয়েটরদের মৃতদেহের ভাগ্যও ছিলো খারাপ। কোনো আত্মীয়স্বজন এসে দেহটি নিয়ে যাবার দাবি না জানালে কিছুদিন পর দেহটি নদীতে ফেলে দেয়া হতো কিংবা ভাগাড়ে ফেলে দেয়া হতো যাতে সেখানেই তা পচে যায়।