১৮৬৫ সালের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ একরকম শেষ হবার পথে। কনফেডারেটরা পরাজিত, ইউনিয়ন আর্মি কার্যত বিজয়ী।
ইউনিয়ন আর্মি কমান্ডার ছিলেন ইউলিসেস গ্র্যান্ট। সে বছর ৯ এপ্রিল পরাজিত কনফেডারেট আর্মির অফিসার রবার্ট এডওয়ার্ড লির সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। যুদ্ধের শেষে যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতার পর গ্র্যান্ট তাকে ইউনিয়ন আর্মির কয়েকজন বীর সেনানায়কের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইলেন। পরাজিত বাহিনীর সামরিক নেতা প্রত্যেকের সাথে হাত মেলালেন।
ইউনিয়ন অফিসারদের মধ্যে একজনকে তার চোখে অন্য সবার চেয়ে অনেক দিক থেকে অন্যরকম দেখাচ্ছিলো। প্রথমত, তার চেহারা গড়পরতা শ্বেতাঙ্গ বা কৃষ্ণাঙ্গদের মতো নয়। গায়ের রং কিছুটা লালচে কালোর দিকে, গড়ন ইউরোপীয় বংশের মতো না হলেও বেশ বলিষ্ঠ। রবার্ট লি প্রথম একটু দ্বিধা করছিলেন। শেষে ইউলিসেস গ্র্যান্ট পরিচয় করিয়ে দিলেন। তার নাম এলি স্যামুয়েল পার্কার। জাতিতে তিনি ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত নন, সেনেকা জনগোষ্ঠীর একজন আদিবাসী আমেরিকান ছিলেন।
রবার্ট হাত বাড়িয়ে দিয়ে আগ্রহের সাথে বললেন, “একজন প্রকৃত আমেরিকানের সাথে হ্যান্ডশেক করতে পেরে আমি উৎফুল্ল।” উত্তরে এলি পার্কার বললেন, “আমরা সবাই আমেরিকান”।
এলি স্যামুয়েল পার্কার উত্তর আমেরিকার আদিবাসী ঐক্য সংস্থা ইরাকুয়া দলের একজন যোদ্ধা ছিলেন। সেনেকা জনগোষ্ঠী এই দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তার জন্ম ১৮২৮ সালে নিউইয়র্ক অঞ্চলের ইন্ডিয়ান ফলস এলাকায়। তার পরিবার ছোটবেলায়ই তার জন্য মিশনারি স্কুলের মাধ্যমে উন্নত ও সময়োচিত শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। তার পরিবারে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো সংস্কৃতি চর্চার রেওয়াজ ছিলো, যা আদিবাসী পরিবারের জন্য সেসময়ের পরিস্থিতিতে কিছুটা বিরল। নৃবিজ্ঞানী লুইস হেনরি মর্গান ও ভূতাত্ত্বিক জন উইজলি পাওয়েল তাদের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করতেন।
এলি স্যামুয়েল পার্কার আইনজীবী হতে চেয়েছিলেন। প্রথাগত শিক্ষা শেষে তিনি বার কাউন্সিলের পরীক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আদিবাসী হবার কারণে তার পরীক্ষা দেবার আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়। পরে লুইস হেনরি মর্গানের সহায়তায় তিনি রেনসেলার পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ভর্তি হবার সুযোগ পান। এখান থেকে তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
১৮৬১ সালে আমেরিকায় রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এলি পার্কের তীব্র ইচ্ছা ছিলো গৃহযুদ্ধে ইউনিয়ন আর্মির পক্ষ নিয়ে অবতীর্ণ হবার। তিনি ইরাকুয়া দলের পক্ষ থেকে যুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে চাইলেন। কিন্তু নিউইয়র্কের তৎকালীন গভর্নর এডউইন মর্গান তার আবেদন নাকচ করে দেন। পরে তিনি একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ইউনিয়ন আর্মির ইঞ্জিনিয়ারিং কোরে কাজ করার আবেদন করেন। কিন্তু সেসময়ের সেক্রেটারি অব ওয়ার সিমন ক্যামেরনও তার এই আবেদন আগ্রাহ্য করেন।
আসলে মার্কিন প্রশাসন তখনও একজন আদিবাসীকে তাদের সেনাদলে নেওয়ার মতো উদার তখনও হয়ে ওঠেনি। সেজন্য প্রাথমিকভাবে এলি পার্কারের আবেদন নাকচ করা হয়েছিলো।
উপায়ান্তর না দেখে এলি পার্কার তার বন্ধু ও ইউনিয়ন আর্মির প্রধান ইউলিসেস গ্র্যান্টের কাছে আবেদন করেন। সেসময় তার বাহিনীতে ইঞ্জিনিয়ারের অভাব ছিলো। ইউলিসেস তার আবেদন মঞ্জুর করলেন। তাকে ক্যাপ্টেন পদে নিযুক্ত করা হলো। তাকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জন ইউজিন স্মিথের অধীনে ন্যস্ত করা হলো। ইউজিন তাকে সপ্তম ডিভিশনের চিফ ইঞ্জিনিয়ারের দায়িত্ব দিলেন।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধের এক ঐতিহাসিক অধ্যায় ছিলো ১৮৬৩ সালের ভিক্সবার্গ অবরোধ। এই যুদ্ধে এলি পার্কার সাফল্যের সাথে তার উপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন করেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউজিন স্মিথ তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। দক্ষ এবং কর্তব্যপরায়ণ ইঞ্জিনিয়ার এবং আদর্শ সৈনিক হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়লো।
সে বছরের শেষের দিকে ইউনিয়ন আর্মি আলাবামা, মিসিসিপি ও ফ্লোরিডার কিছু অঞ্চলে সাময়িক পরাজয়ের শিকার হয়। এসময় ইউলিসেস গ্র্যান্টের নেতৃত্বে ইউনিয়ন আর্মির একটি অংশকে সেখানে পাঠানো হয়। সেই যুদ্ধ ইতিহাসে ‘শ্যাটানুগা ক্যাম্পেইন’ নামে খ্যাত হয়ে আছে। এলি স্যামুয়েল পার্কার এসময় ইউলিসেস গ্র্যান্টের এডজুটেন্ট নিযুক্ত হন। এসময় তিনি বহু স্থানে নিষ্ঠার সাথে তার দায়িত্ব পালন করেছেন। এসময়ের যুদ্ধের মধ্যে পিটার্সবার্গ অবরোধ অন্যতম। উলেখ্য, পিটার্সবার্গে থাকতেই তাকে গ্র্যান্টের মিলিটারি সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তাকে পদোন্নতি দিয়ে লেফটেনেন্ট কর্নেল করা হলো।
গৃহযুদ্ধ চলার সময় এলি পার্কার ইউনিয়ন আর্মির যোদ্ধাদের কাছে ‘গ্র্যান্ট’স ইন্ডিয়ান’ নামে খ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। যুদ্ধের এমন প্রতিকূল অবস্থায় আদিবাসী এক যোদ্ধা এমন অকুতোভয় হয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন, এটা দেখে ইউনিয়ন আর্মির অনেকে যেমন আনন্দিত হয়েছে- তেমনি ঈর্ষা করার মতো লোকেরও অভাব হয়নি। আদিবাসী হয়েও ইংরেজী বলা ও লেখায় আর দশ জন আমেরিকান নাগরিকের মতোই সিদ্ধহস্ত ছিলেন।
দৈহিক গঠনে গড়পরতা আমেরিকানদের মতো না হলেও দৈহিক শক্তি ও সাহসে কোন অংশে কম ছিলেন না। অন্যদিকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ ও পারদর্শী। তাছাড়া পারিবারিক শিক্ষার ঐতিহ্যের কারণে সমকালীন পৃথিবী ও তার বিজ্ঞান-শিল্পকলার বৈচিত্র্য সম্পর্কে যথেষ্ঠ ধারণা রাখতেন। তার জ্ঞানপিপাসার কারণে অনেক সহযোদ্ধা তাকে two hundred pounds of encyclopedia নামে ডাকতেন। গৃহযুদ্ধে তার বীরত্ব ও অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করতেন আব্রাহাম লিংকন ও ম্যাথু ব্র্যাডি’র মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের দায়িত্ব পালন করার সময় তিনি বেশ কয়েকবার জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষেত্রে কখনও পিছপা হননি।
এর মধ্যে যুদ্ধে হতাহত ও চড়াই উৎরাই এর মধ্য দিয়ে ১৮৬৫ সাল এসে গেলো। কনফেডারেট আর্মি ক্রমাগত কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলো। সুতরাং আত্মসমর্পণ ছাড়া তাদের আর অন্য কোন পথ ছিলো না।
আত্মসমর্পণের দলিলের খসড়া করার দায়িত্ব দেওয়া হলো এলি পার্কারকে। এর আগে ইউলেসিস গ্র্যান্টের মিলিটারি সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করার সময় থেকেই তিনি সামরিক বিভিন্ন অধ্যাদেশের খসড়া লেখার ক্ষেত্রে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিলেন। গ্র্যান্টের জারি করা অধ্যাদেশে তিনি ‘By Command of Lieut. General Grant, E.S. Parker, Asst. Adjutant General’ নামে স্বাক্ষর করতেন। সিনিয়র অফিসারদের সবাই তাকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতেন। তার সামরিক জীবনের শেষ কীর্তি ছিলো কনফেডারেট আর্মির আত্মসমর্পণের দলিলের খসড়া তৈরি করা। সেজন্যই কনফেডারেট আর্মির প্রধান এডওয়ার্ড লি এলি পার্কারের প্রকৃত পরিচয় পেয়ে বলেছিলেন, “একজন প্রকৃত আমেরিকানের সাথে হ্যান্ডশেক করতে পেরে আমি উৎফুল্ল”।
গৃহযুদ্ধ শেষ হবার পর তাকে সেকেন্ড ইউনাইটেড স্টেটস ক্যাভালরির অফিসার হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এবার ফুল কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে তাকে আবারও গ্র্যান্টের মিলিটারি সেক্রেটারি করা হয়েছিলো। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের আদিবাসী ইন্ডিয়ানদের সাথে সমঝোতা করার জন্য গড়ে ওঠা ‘সাউদার্ন ট্রিটি কমিশন’ এর সদস্য হিসেবে তাকে মনোনীত করা হয়েছিলো। ১৮৬৯ সালে তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন।
এই বছরই ইউলিসেস গ্র্যান্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি এলি পার্কারকে ‘কমিশনার অব ইন্ডিয়ান অ্যাফেয়ার্স’ হিসেবে নিযুক্ত করেন। তিনিই প্রথম এই পদে নিয়োগ পাওয়া আদিবাসী আমেরিকান ছিলেন। আদিবাসীদের সাথে মার্কিন সরকারের সম্পর্ক ভালো করার উদ্যোগ হিসেবে গৃহীত ‘পিস পলিসি’র অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন এলি পার্কার। এর ফলে মার্কিন সরকার ও আদিবাসীদের মধ্যে রাজনৈতিক দূরত্ব উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিলো।
তবে এই অকুতোভয় যোদ্ধার শেষ জীবন সুখের হয়নি। ১৮৭৩ সালের অর্থনৈতিক মন্দায় শেয়ারবাজারে করা তার বিনিয়োগ নষ্ট হয়। এসময় প্রবল অর্থকষ্টে তিনি জর্জরিত ছিলেন। অনেক কাজের সন্ধান করেও তিনি ব্যর্থ হন। এছাড়া গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের বন্ধুত্বের উষ্ণতা তখন অনেকটাই ফুরিয়ে এসেছিলো। আগের কমে আসা আদিবাসী বিদ্বেষ মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিলো। সেজন্য পরিচিত সামাজিক সূত্রে অনেকের কাছে সাহায্যের জন্য গিয়েও কোনরকম প্রতিশ্রুতি পাননি। ফলে দারিদ্রের কষাঘাতে অত্যন্ত কষ্টের জীবনযাপন তাকে মেনে নিতে হয়েছিলো।
১৮৯৫ সালের ৩১ অক্টোবর এলি পার্কার কানেক্টিকাট অঞ্চলে মৃত্যুবরণ করেন। নিউইয়র্কের ফরেস্ট লন সিমেট্রিতে তার পূর্বপুরুষের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়েছিলো। মার্কিন প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে এলি পার্কারের নাম অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও গুরুত্বের সাথে স্থান দেওয়া হয়েছে।
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
আমেরিকার ইতিহাস নিয়ে জানতে পড়তে পারেন এই বইটিঃ