রোম, পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্য যারা ইউরোপের প্রায় পুরোটাই শাসন করেছিল, দখল করেছিল আফ্রিকার উত্তরাঞ্চল ও এশিয়ার পশ্চিমার কিছু অংশ। পৃথিবীর শাসনকেন্দ্র থেকে আধুনিক ইতালির রাজধানীতে পরিণত হওয়া রোম সাক্ষী অসংখ্য ইতিহাসের। আর রোমের কথা বললে রোমান সাম্রাজ্যের কথা আলাদাভাবে বলার দরকারও পড়ে না। কলোসিয়াম, গ্লাডিয়েটর, জুলিয়াস সিজার, স্পার্টাকাস, হানিবালসহ অসংখ্য ইতিহাসের সাক্ষী রোমান সাম্রাজ্য। রোমান সাম্রাজ্যের পতন বহু আগে হলেও তাদের রেখে যাওয়া বর্ষপঞ্জিকা কিন্তু আমরা এখনো ব্যবহার করি। কিছুটা পরিবর্তন হলেও মূল নিয়ম সেই রোমানদের সময়েই তৈরী। রোমান স্থাপত্যগুলো ইতিহাসের খোঁজ করা মানুষগুলোকে অবাক করে তোলে। আর পাঠকদের জন্য ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরব সেই রোমের উত্থান আর পতনের গল্পগুলো। ছোট্ট এক জনপদ থেকে রোমের বেড়ে ওঠা, পরাক্রমশালী হয়ে ওঠা, দুই ভাগে বিভক্ত হওয়া, রোমান সাম্রাজ্যের ভিত নাড়িয়ে দেয়া বিদ্রোহ আর আক্রমণগুলোর কথা- সবগুলোই উঠে আসবে ধীরে ধীরে। তাহলে চলুন ফিরে যাওয়া যাক সেই সময়টায়, যখন রোম বলে পৃথিবীর বুকে কিছুই ছিল না!
রোমের গোড়াপত্তন
রোমের গোড়াপত্তনের ব্যাপারে ঐতিহাসিক তথ্যের চেয়ে কিংবদন্তীর সংখ্যাই বেশি। তবে সবচেয়ে প্রচলিত হচ্ছে রোমিউলাসের গল্প। কিংবদন্তী অনুসারে, খ্রিস্টপূর্ব ৭৫৩ সালে রোমিউলাসের হাত ধরে প্রথম রোমের গোড়াপত্তন হয়। উপকথা অনুসারে, রোমিউলাস ও তার ভাই রেমাসের মা ছিল সিলভিয়া আর তাদের বাবা ছিল যুদ্ধ দেবতা ‘মার্স’ কিংবা হারকিউলিস। তবে বাবা যে-ই হোক না কেন, ভবিষ্যদ্বাণী ছিল দুই ভাই বড় হয়ে স্থানীয় এক রাজাকে পরাজিত করবে। এ কারণে দুই ভাইকে ছোটবেলায় টাইবার নদীর তীরে ফেলে যাওয়া হয়। এরপর এক নেকড়ের কাছে বড় হয় তারা, অনেকটা গল্পের মোগলির মতো। বড় হয়ে তারা দুই ভাই ঠিকই সেই রাজাকে পরাজিত করে আর সিদ্ধান্ত নেয় টাইবার নদীর তীরে একটি শহর গড়ে তোলার। কিন্তু দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝামেলা বাঁধে আর তখন রোমিউলাস তার ভাই রেমাসকে হত্যা করে নিজের নামে গোড়াপত্তন করে রোমের।
অন্য আরেকটি কিংবদন্তীতে রোমিউলাসকে বলা হয়েছে ট্রয়ের যুদ্ধের সময় পালিয়ে আসা এক ট্রোজান রাজপুত্রের বংশধর হিসেবে। ট্রয় থেকে পালিয়ে এসে সেই রাজপুত্র ইতালিতে আসে আর তারই বংশধর পরবর্তীতে রোমের গোড়াপত্তন করে। ঐতিহাসিকভাবে এসব কিংবদন্তীর কোনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু রোমান ঐতিহাসিকরা দীর্ঘদিন ধরে রোমিউলাসকেই রোমের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এসেছেন। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৭৫৩ সালে রোমের গোড়াপত্তনের ব্যাপারে মতপার্থক্য জানিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ববিদগণ। রোমের বিভিন্ন স্থানে তারা খ্রিস্টপূর্ব ৭৫৩ সালের আগে মানুষ বসবাসের প্রমাণ পেয়েছেন। তবে সেগুলো রোমের গোড়াপত্তনের আগে থেকে থাকা স্থানীয় ছোট গ্রামেরও হতে পারে বলে অনেকে বলেছেন। কিন্তু ঠিক কবে, কীভাবে, কে রোমের গোড়াপত্তন করল সেটির কথা হয়তো কখনোই জানা সম্ভব হবে না।
তৎকালীন পৃথিবী
রোমের গোড়াপত্তনের পর কীভাবে বড় হলো সেটা বলার আগে সে সময়ের পৃথিবীর কথা বলাটা জরুরি। সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে কিংবদন্তীর খ্রিস্টপূর্ব ৭৫৩ সালকেই রোমের গোড়াপত্তন ধরা হয়। সে হিসেবে রোমের গোড়াপত্তনের অনেক কয়েক হাজার বছর আগেই মিশরীয়রা তৈরি করে ফেলেছিল গ্রেট পিরামিড। ভারত, চীন, মেসোপটেমীয় সভ্যতা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। রোমের গোড়াপত্তনেরও কয়েক বছর আগে অনুষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে অলিম্পিক। ব্রোঞ্জ যুগের শেষে মানুষ লোহার ব্যবহার শুরু করে ফেলেছিল, গ্রিসে বিভিন্ন নগর ক্ষমতায় আসতে শুরু করেছিল। ধারণা করা হয়, ইলিয়ড আর ওডিসি রচনাও শেষ হয়ে গিয়েছিল রোমের গোড়াপত্তনের আগেই।
রোমের বেড়ে ওঠা
রোমার গোড়াপত্তনের মতো বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও রোমিউলাসের কিংবদন্তীই প্রাধান্য পায়। কিংবদন্তী অনুসারে, রোমিউলাসের হাত ধরে রোমের গোড়াপত্তন হলে তিনি বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকদের নিজের শহরে নিয়ে আসতে থাকেন। মুক্ত ও দাস সবাইকেই সমানভাবে নিজ শহরে প্রবেশের অনুমতি দেন তিনি। কিন্তু শহরে শুধুমাত্র পুরুষই ছিল তাই পরিবার গঠন করার কোনো সুযোগ ছিল না। তার রোমের চারপাশে বাস করা স্যাবাইন গোত্রের মেয়েদের বিয়ের প্রস্তাব দেয় তারা। কিন্তু রোমের পুরুষদের সাথে বিয়ের ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানায় তারা।
কোনো উপায় না পেয়ে রোমানরা এক ফন্দি আঁটে। মেলার নাম করে স্যাবাইনসহ আশপাশের গোত্রগুলোকে রোমে নিয়ে আসে আর মেলায় আসা মেয়েদেরকে বন্দী করে। স্বাভাবিকভাবেই সাথে আসা পুরুষরা বাধা দিয়েছিল, কিন্তু সব প্রস্তুতি নিয়ে থাকা রোমানদের সাথে পেরে উঠেনি তারা। বন্দী করা মেয়েদের ভাগ্যে ঠিক কী হয়েছিল সেটি নিয়েও বেশ কয়েকটি মত রয়েছে। কেউ কেউ বলে থাকেন এসব মেয়েদের ধর্ষণ ও অত্যাচার করা হয়েছিল। আবার অনেকে বলে থাকেন, বন্দিনীদের স্বামী হিসেবে রোমান কাউকে বেছে নেবার সুযোগ দেয়া হয়।
বিখ্যাত রোমান ঐতিহাসিক লিভের ভাষ্যমতে, কারো উপরেই কোনো যৌন নির্যাতন চালানো হয়নি। বরং মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে তাদের রোমানদের বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়। বন্দিনীদের ভাগ্যে যা-ই ঘটুক না কেন, রোমানরা শিকার হয় গোত্রগুলোর। সবার প্রথমে আক্রমণ করে কায়েনানিস, কিন্তু রোমিউলাসের বীরত্বে তাদের পরাজিত করে রোমানরা। এরপর রোমানরা পাল্টা আক্রমণ করে কায়েনানিসদেরকেই, যা ছিল রোমানদের ইতিহাসে প্রথম আক্রমণ। জয়ের পর রোমে ফিরে এসে রোমিউলাস রোমান দেবতা ‘জুপিটারের’ নামে একটি মন্দির বানায়। লিভের মতে এটি ছিল রোমের প্রথম মন্দির।
এরপরে আরো দুটি গোত্র রোমানদের আক্রমণ করে, কিন্তু আগের মতোই রোমানরা বিজয়ী বেশে ফিরে আসে। সবার শেষে আক্রমণ করে স্যাবাইনরা, বন্দিনীদের মধ্যে যে গোত্রের মেয়ে ছিল সবচেয়ে বেশি। এক রোমান গর্ভনরের মেয়ের বিশ্বাসঘাতকতায় স্যাবাইনরা প্রায় জিতেই যাচ্ছিল, কিন্তু মুখোমুখি অবস্থানে থাকা রোমান আর স্যাবাইনদের মাঝে এসে দাঁড়ায় স্যাবাইন মেয়েরা। একদিকে স্বামী, অন্যদিকে বাবা-ভাই, তাই তারা চায়নি কোনো পক্ষের ক্ষতি হোক। শেষপর্যন্ত দুই পক্ষই শান্তিচুক্তি করে আর স্যাবাইনরা রোমের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দ্বৈত শাসনের প্রচলন করে। তবে সেই দ্বৈত শাসন ছিল মাত্র স্যাবাইনদের রাজা বেঁচে থাকা পর্যন্ত। পাঁচ বছর পর তিনি মারা গেলে পুরো এলাকার শাসন পেয়ে যায় রোমিউলাস। তবে সেই রোমও ছিল অনেক ছোট্ট।
রোমান রাজাদের শাসনকাল
খ্রিস্টপূর্ব ৩৯০ সালে গলদের আক্রমণে রোমানদের তৎকালীন লিখিত ইতিহাস ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় কিংবদন্তীর উপরেই গড়ে উঠেছে রোমান রাজাদের ইতিহাস। লিভে, প্লুটার্ক এর মতো রোমান ঐতিহাসিকরা পরবর্তী সময়ে সেসব কিংবদন্তীর উপর ভিত্তি করে ইতিহাস রচনা করেছেন এবং বর্তমানে সেগুলোকেই গ্রহণযোগ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। তাদের রচিত ইতিহাস অনুযায়ী, রোম শাসন করেছেন সাতজন রাজা। তবে রাজা উত্তরাধিকারসূত্রে হতো না বরং রোমান সিনেট একজন রাজাকে নির্বাচন করত। পূর্বের রাজা মারা গেলে ক্ষমতা ন্যাস্ত হতো সিনেটের হাতে। সিনেট সদস্যরা বিভিন্ন যোগ্য প্রার্থী থেকে রাজা নির্বাচন করার পর সে ব্যাপারে জনগণের মতামত নিত। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ধর্মীয় আচারের মাধ্যমে রাজাকে শাসনভার দেয়া হতো।
রোমান রাজাদের মধ্যে সর্বশেষ ছিলেন লুসিয়াস টারকুইনিয়াস সুপারবাস। আশপাশের বেশ কিছু এলাকা রোমের অধীনে আসে তার শাসনামলে। জনগণের জন্য বেশ কিছু প্রকল্প চালু করেন তিনি, বিশেষ করে ধর্মীয় ও বিনোদনের ক্ষেত্রে। কিন্তু অতিরিক্ত কঠোর হবার কারণে সবাই অসন্তুষ্ট হতে থাকে টারকুইনিয়াসের উপর। পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হয় তার ছেলে সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক রোমান মেয়েকে ধর্ষণের পর। এরপরই রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয় এবং টারকুইনিয়াসকে তার পরিবারসহ রোম থেকে নির্বাসনে পাঠানো হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫০৯ সালে।
টারকুইনিয়াসের পতনের সাথে সাথে রোমে পতন ঘটে রাজতন্ত্রের। বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়া ব্রুটাস ও কোলাটিনাসের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা হয় রোমান প্রজাতন্ত্রের (রোমান রিপাবলিক)। পরবর্তী ৫০০ বছর ছিল রোমান প্রজাতন্ত্রের যুগ আর এই ৫০০ বছরেই নতুন সব ইতিহাস লিখতে থাকে রোমানরা, জয় করতে থাকে চারিদিকে। তবে সময়ে সময়ে রোমানরাও মুখোমুখি হয়েছিল বেশ কয়েকটি বিপর্যয়ের। রোমান প্রজাতন্ত্রের সেসব ইতিহাস থাকবে পরবর্তী আয়োজন।
তথ্যসূত্র
১. Titus Livius (Livy), The History of Rome (Translated)
ফিচার ইমেজ- The Times