চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১২টি ফ্রি কিক গোল করার রেকর্ডটি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর দখলে। কিন্তু ইদানিং বয়সের সাথে সাথে ফ্রি কিকে রোনালদোর দক্ষতাও গিয়েছে কিছুটা কমে। অন্যদিকে ক্যারিয়ারের শুরুতে এই দিকটাতে এতটা উজ্জ্বল না থাকলেও ধীরে ধীরে দারুণ উন্নতি করেছেন মেসি। বর্তমানে সেরা ফ্রি কিক টেকারদের মধ্যে মেসির নাম আসাটা অত্যাবশ্যকীয়। সব মিলিয়ে অবশ্য ফ্রি কিক গোলে রোনালদো এখনও এগিয়ে আছেন মেসির থেকে। মেসির ক্লাব ও আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৪২ ফ্রি কিক গোলের বিপরীতে রোনালদোর ঝুড়িতে রয়েছে ৫১টি ফ্রি কিক গোল। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ফ্রি কিকে গোল করার সেরা দশ তালিকায় কি জায়গা পাবেন সময়ের সেরা এই দুই ফুটবলার? চলুন দেখে আসা যাক।
১০. মার্সেলিনহো ক্যারিওকা – ৫৯ গোল
ফুটবলের ইতিহাসে ততটা পরিচিত না হলেও ফ্রি কিকে অসাধারণ দক্ষতার মালিক ছিলেন এই ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার। ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে মাত্র ৩টি ম্যাচ খেললেও ব্রাজিলিয়ান ক্লাব করিন্থিয়ান্সের প্রাণ ছিলেন মার্সেলিনহো।
নিজের ২১ বছরের ক্যারিয়ারে ১৩টি ক্লাবে ঘুরলেও সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন করিন্থিয়ান্সের হয়ে। ব্রাজিলিয়ান এই ক্লাবের হয়ে ৪২০ ম্যাচে ২০৬টি গোল করেন মার্সেলিনহো। ক্যারিয়ার জুড়ে ৫০৫টি গোল করলেও তিনি বিখ্যাত ছিলেন ফ্রি কিক গোলের জন্য। পুরো ক্যারিয়ারে মোট ৫৯টি গোল করেছেন ফ্রি কিক থেকে। ফ্রি কিকে দারুণ দক্ষতার জন্য তিনি ‘পে-দে-আনজো’ ডাকনাম অর্জন করেন, যার অর্থ ‘এঞ্জেল ফুট’।
৯. রজারিও চেনি – ৫৯ গোল
ফ্রি কিকে ৫৯ গোল করার চেয়েও বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে রজারিও চেনি একজন গোলকিপার। যদিও নিজের ২৩ বছরের উপর ক্যারিয়ারের পুরোটাই কাটিয়েছেন ব্রাজিলিয়ান ক্লাবগুলোতে। আরও ভালো করে বলতে গেলে সাও পাওলোতে। তারপরেও চেনির ফ্রি কিক দক্ষতা ছিলো এক ধাপ উপরে।
ব্রাজিলের হয়ে ১৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা চেনির ক্যারিয়ারে মোট গোল সংখ্যা ১০০টির উপর। তার মধ্যে ৫৯টি গোলই এসেছে ফ্রি কিক থেকে। গোলকিপার হওয়া সত্ত্বেও এক মৌসুমে একবার সর্বোচ্চ ২১টি গোল করেছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে ৪০ বছর বয়সে এসেও তার সাথে নতুন চুক্তি করেছিলো সাও পাওলো।
৮. রোনাল্ড ক্যোমান – ৬০ গোল
বর্তমান এই ডাচ কোচের ঝুলিতে রয়েছে ৬০টি ফ্রি কিক গোল। এই স্বনামধন্য ডাচ ডিফেন্ডার ক্যারিয়ারের বড় একটি সময় কাটিয়েছেন বার্সেলোনাতে। বার্সেলোনা ছাড়াও তিনি খেলেছেন আয়াক্স, পিএসভি আইন্দহোভেন ও ফেইনুর্ডের হয়ে।
মেসির আগে ন্যু ক্যাম্পে ফ্রি কিকের রাজা ছিলেন ক্যোমানই। একজন ডিফেন্ডার হওয়া সত্ত্বেও তার ক্যারিয়ার গোলসংখ্যা ২০৭টি, যার প্রায় ৩ ভাগের ১ ভাগই এসেছে ফ্রি কিক থেকে। তার করা ৬০টি ফ্রি কিক গোলের মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ওয়েম্বলিতে বার্সেলোনার হয়ে সাম্পোদোরিয়ার সাথে করা গোলটি। ঐ গোলের কল্যাণেই বার্সেলোনা প্রথমবারের মতো ঘরে তোলে ইউরোপিয়ান কাপ। ক্লাব ক্যারিয়ারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেও সমানভাবে উজ্জ্বল ছিলেন ক্যোমান।
৭. জিকো – ৬২ গোল
সাদা পেলে খ্যাত জিকো এই তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন ৭ নাম্বারে। জিকোর ক্যারিয়ারে ফ্রি কিক গোল সংখ্যা ৬২টি। ক্যারিয়ারে খেলেছেন ব্রাজিলিয়ান ক্লাব ফ্ল্যামেঙ্গো ও ইতালিয়ান ক্লাব উদিনেসে।
বল পায়ে দারুণ ক্ষিপ্র জিকো অসাধারণ ছিলেন ফ্রি কিকেও। ক্যারিয়ারে তার গোল সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। বিশ্বকাপেও তার রয়েছে একটি ফ্রি কিক গোল। ১৯৮২ বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ফ্রি কিক থেকে গোল করেন এই ফুটবল জিনিয়াস। ব্রাজিলের হয়ে ৭টি ফ্রি কিকের পাশাপাশি উদিনেসের হয়ে ১৭ ও ফ্ল্যামেঙ্গোর হয়ে ২৩টি ফ্রি কিক গোল রয়েছে তার।
৬. দিয়েগো ম্যারাডোনা – ৬২ গোল
বল পায়ে পুরো বিশ্বকে মোহিত করা ম্যারাডোনা ডেড বলেও ছিলেন এক ভয়ঙ্কর জাদুকর। বাঁ পায়ের ভেলকিতে ক্যারিয়ারে ম্যারাডোনা ফ্রি কিকে গোল করেছেন মোট ৬২ বার। স্বদেশী ম্যারাডোনার অনেক রেকর্ড ভেঙে দিলেও এই রেকর্ড হয়তো ভাংতে পারবেন না লিওনেল মেসি।
ক্লাব ক্যারিয়ারে বোকা জুনিয়র্স, নাপোলি, বার্সেলোনা, সেভিয়ার পাশাপাশি আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের জার্সি গায়েও নিজের ফ্রি কিক ক্যারিশমা দেখিয়েছেন ম্যারাডোনা। বাঁ পা দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো বল বাঁকানোর ক্ষমতা ছিলো তার। ২৫ গজের ভেতরে পাওয়া ফ্রি কিকে দুর্দমনীয় ছিলেন এই ফুটবল গ্রেট।
৫. ডেভিড বেকহাম – ৬৫ গোল
‘৯০ দশকের শেষের দিকে ফ্রি কিকের পোস্টার বয় ছিলেন এই স্টাইলিশ ইংলিশ মিডফিল্ডার। ফ্রি কিক ও ক্রসে দুর্দান্ত বেকহাম ছিলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবের মধ্যমণি। এর বাইরে খেলছেন পিএসজি, এলএ গ্যালাক্সি ও মিলানের হয়েও।
বেকহামের বল বাঁকানোর অসাধারণ দক্ষতার ফলে ‘বেন্ড ইট লাইক বেকহাম’ নামে একটি সিনেমাও তৈরি হয়েছিলো সেই সময়। নিজের ক্যারিয়ারে সর্বমোট ৬৫টি ফ্রি কিক গোল করেছেন বেকহাম। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে আছে ওল্ড ট্রাফোর্ডে ২০০১ সালে গ্রিসের বিপক্ষে অন্তিম মূহুর্তে ফ্রি কিক থেকে করা গোলটি।
৪. ভিক্টর লেগ্রোটেগলি – ৬৬ গোল
তালিকার অন্যান্যদের সাথে ভিক্টর লেগ্রোটেগলির পার্থক্য হচ্ছে অন্যদের মতো এত বিখ্যাত নন তিনি। তবে ফ্রি কিক কিংবা সেট পিসের ক্ষেত্রে সেরাদের সেরা একজন এই আর্জেন্টাইন। ক্যারিয়ারে সর্বমোট ৬৬টি গোল করেছেন ফ্রি কিক থেকে। অলিম্পিক গেমসেও ভিক্টর লেগ্রোটেগলির রয়েছে ১২টি গোল।
ক্যারিয়ারের পুরো সময় কাটিয়েছেন আর্জেন্টিনার ঘরোয়া লিগের ক্লাবগুলোতে খেলে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে খেলেছেন ইন্দিপেন্দিয়েন্তের হয়ে। ভিক্টরের প্রতি ইন্টার মিলান ও রিয়াল মাদ্রিদ আগ্রহ প্রকাশ করলেও তিনি নিজ দেশ ছাড়তে চাননি। ইউরোপিয়ান ফুটবলে না যাওয়ায় হয়তো অন্যদের মতো এত আলোচিতও হননি ষাটের দশকের এই প্রতিভাবান ফুটবলার ও ফ্রি কিক জাদুকর।
৩. রোনালদিনহো – ৬৬ গোল
রোনালদিনহো ও ফ্রি কিক শব্দ দুটি শুনলেই ফুটবলপ্রেমীদের মনে পড়বে ২০০২ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড গোলরক্ষক ডেভিড সিম্যানের মাথার উপর দিয়ে করা সেই ফ্রি কিক গোল। বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ৪০ গজ দূর থেকে করা সেই গোলসহ ক্যারিয়ারে মোট ৬৬ বার ফ্রি কিক থেকে বল জালে জড়িয়েছেন রোনালদিনহো।
বার্সেলোনা, মিলান, পিএসজি, গ্রেমিও, ফ্ল্যামেঙ্গো, ফ্লুমিনেন্স, এটলেটিকো মিনেইরো- যেখানেই ছিলেন সেখানেই নিজের সহজাত ফ্রি কিকে মুগ্ধ করেছেন দর্শকদের। স্বাভাবিক ফ্রি কিক ছাড়া রোনালদিনহো বিখ্যাত হয়ে আছেন ফ্রি কিক থেকে মানব দেয়ালের নিচ দিয়েও গোল করে। তার দেখাদেখি মেসি, সুয়ারেজরাও একই ভঙ্গিতে ফ্রি কিক থেকে গোল করে মুগ্ধ করেছেন ফুটবলপ্রেমীদের।
২. পেলে – ৭০ গোল
ফুটবলের সম্রাট কালো মানিক খ্যাত পেলে বিখ্যাত ছিলেন ফ্রি কিকের জন্যও। নিজের ক্যারিয়ারে সর্বমোট ৭০টি ফ্রি কিক গোল করেছেন তিনি। ব্রাজিল জাতীয় দলের পাশাপাশি পেলের ফ্রি কিক গোল রয়েছে সান্তোস ও কসমস ক্লাবের হয়েও।
অন্যান্যদের তুলনায় পেলের মাহাত্ম্য একটু বেশিই। কারণ তৎকালীন সময়ের চামড়ার ভারি বলে ফ্রি কিক থেকে গোল করা বেশ কষ্টসাধ্য ছিলো। তবে নামটি পেলে বলেই সম্ভব হয়েছে।
১. জুনিনহো – ৭৭ গোল
ফ্রি কিকের ঈশ্বর খ্যাত জুনিনহোর ক্যারিয়ারে ফ্রি কিক গোল সংখ্যা ৭৭টি। তর্কাতীতভাবে তিনিই এই তালিকার প্রথম স্থানটি দখল করে আছেন। গতি, ক্ষমতা, বল ভাসানো, বাঁকানোর কার্যকারীতা- সব মিলিয়ে ফ্রি কিকে অদম্য ছিলেন এই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার।
ক্লাব ক্যারিয়ারে বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন ফরাসি ক্লাব লিঁওতে। এছাড়াও খেলেছেন নিউ ইয়র্ক রেড বুলস, সান্তা রেসিফে, ভাস্কো দা গামা ক্লাবে। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জুনিনহোর ফ্রি কিক গোল ১৮টি। তবে ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ ফ্রি কিক গোলই এসেছে লিঁওর হয়ে। এই ক্লাবে ৮ মৌসুম খেলে ১০০টি গোল করেছেন জুনিনহো, যার মধ্যে ৪৪টি এসেছে ফ্রি কিক থেকে। আর তাই নিঃসন্দেহে তিনিই ফুটবলে ফ্রি কিকের বরপুত্র।