মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা নিকট অতীতেও ছিল অবিশ্বাস্য। বিশেষ করে চীনের বিরুদ্ধে ট্যারিফ নিয়ে তার কড়া অবস্থান সারা বিশ্বের মুক্ত বাজার অর্থনীতির সমর্থকদের ক্রমাগত অবাক করে চলেছে।
প্রথমদিকে ট্রাম্পের ট্যারিফ সংক্রান্ত বাগড়াম্বরকে রাজনৈতিক বক্তব্য ধরা হলেও বেইজিং এখন উপলব্ধি করছে ট্রাম্পের নেতৃত্বে চীন বিষয়ে আমেরিকার কৌশলগত অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। ফলে চীনও আমেরিকার সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করতে শুরু হয়েছে। এই সম্পর্ক কোনদিকে মোড় নেবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না তবে তা কোনোদিনই যে আগের মতো হবে না সে বিষয়ে দু’পক্ষই নিশ্চিত।
এ প্রসঙ্গে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াং-ই কিছুদিন আগে নিউ ইয়র্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, “একটা গ্লাস ভাঙা সহজ, কিন্তু জোড়া লাগানো কঠিন। আমাদের বর্তমান দূরত্ব হয়তো একসময় কমে আসবে, কিন্তু তা কখনোই আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না। আমাদের গ্লাসটা এখনও পুরোপুরি ভেঙে যায়নি ঠিকই, কিন্তু যে ফাটল ধরেছে তার দাগ থেকেই যাবে।”
চায়না ডেইলির সৌজন্যে ইওয়ানের সংবাদপত্র ডেস মইনেস রেজিস্টারে প্রকাশিত একটি ক্রোড়পত্রে কিছুদিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে বেশ বিদ্রুপ করা হয়েছে, যা ট্রাম্পের নজর এড়ায়নি। তিনি এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী কংগ্রেস নির্বাচনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা বলে অভিযোগ তুলেছেন। যদিও ঐ ক্রোড়পত্রে বলা হয়েছিল কীভাবে ইওয়ার কৃষকেরা পূর্বের চীন-মার্কিন স্থিতিশীল অর্থনৈতিক সম্পর্কের ফলে লাভবান হয়ে আসছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, যদি এ সম্পর্ক আগের মতো স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরে না যায়, তবে তা ইওয়ার কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে তাদের রাজ্য থেকে যেসব পণ্য রপ্তানি করা হবে, সেগুলোর উপর যে শুল্ক এবং রিটালিয়াটরি শুল্ক বা প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপিত হয়েছে, তা ইওয়ানের কৃষি অর্থনীতির উপর প্রায় ২.২ বিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত বোঝা আরোপ করেছে।
এ সমীক্ষার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পূর্ববর্তী বাণিজ্য যুদ্ধ, যেমন- ১৯৮০ সালের রাশিয়ার শস্য নিষেধাজ্ঞা এবং ২০০৯ সালে চীনের সাথে ‘টায়ার বনাম মুরগী’র বিরোধ থেকে দেখা গেছে একবার বাণিজ্যিক বাজার হারালে তা ফিরে পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য, যা হয়তো আর কখনোই পুরোপুরি ফেরত পাওয়া যায় না।
চীন তো ইতিমধ্যেই জোরেশোরে বলতে শুরু করেছে, চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে মার্কিন কৃষকরা যে ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে তা তারা আর কখনোই কাটিয়ে উঠতে পারবে না। চীনের কৃষি উপমন্ত্রী ইতিমধ্যেই আমেরিকান কৃষকদের সতর্ক করে দিয়েছেন এই বলে যে, এই বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে চীনা বাজারে মার্কিন কৃষকরা তাদের মার্কেট শেয়ার চিরস্থায়ীভাবে হারাতে পারে, কারণ আমেরিকার পরিবর্তে অন্য কোনো দেশ থেকে সহজেই কৃষি সামগ্রী কেনার সক্ষমতা চীনের রয়েছে।
এছাড়া, মার্কিন বাজারে চীনা পণ্য প্রবেশ করতে না পারলে যে শূন্যতা তৈরি হবে তা পূরণের জন্য বিকল্প হিসেবে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা ‘ট্রাম্প ট্যারিফ’ এর আওতা বহির্ভূত দেশ থেকে পণ্য আমদানী করা না গেলে মার্কিন ভোক্তাদের হয় এসব পণ্য ক্রয় থেকে বিরত থাকতে হবে অথবা অধিক মূল্যে পণ্য কিনতে হবে। ট্রাম্প ট্যারিফের কারণে বিভিন্ন পণ্যে অধিক মূল্য পরিশোধের বিষয়টি মার্কিন ভোক্তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় যে বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে তা নিশ্চিত হয়েই বলা যায়।
এদিকে চীনের দৃষ্টিকোন থেকে বিবেচনা করলে দেখা যাবে, তারা দুটি ক্ষেত্রে আমেরিকার উপর বেশ নির্ভরশীল। প্রথমত, কৃষিক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট সামগ্রীর জন্য তারা পুরোপুরি আমেরিকার উপর নির্ভর করে। দ্বিতীয়ত, চীনের রপ্তানির মূল বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যা তাদেরকে ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত ট্যারিফ মোকাবেলায় বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে।
শুল্ক আরোপের পাশাপাশি বেইজিংয়ের রাশিয়ান যুদ্ধ বিমান সু-৩৫ এবং ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণ যোগ্য এস-৪০০ প্রতিরক্ষা মিসাইল ক্রয়ের প্রতিক্রিয়ায় চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ইকুইপমেন্ট ডেভেলপমেন্ট ডিপাটমের্ন্টের উপর মার্কিন সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। স্বাভাবিকভাবেই চীন এই নিষেধাজ্ঞাকে ভালোভাবে নেয়নি।
এদিকে ভারতও রাশিয়া থেকে এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ওয়াশিংটন যদি ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ না করে, তবে তা বেইজিংয়ের অস্বস্তির পাশাপাশি মাকির্ন-চীন সম্পর্কে আরও দূরত্ব তৈরি করবে।
কিছুদিন আগে গালফ নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্প প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা চীনা কূটনৈতিকদের জানিয়েছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে তাদের সম্পর্ককে একধরনের প্রতিযোগিতা হিসেবেই দেখছে। এতে চীন এই বার্তাই পেল যে, ওয়াশিংটন প্রতিযোগিতা চায়, সহযোগিতা নয়।
বাস্তবে বেইজিং বা ওয়াশিংটনের কেউই পূর্ববর্তী বাণিজ্যিক সম্পর্কে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে এখন আর মাথা ঘামাচ্ছে না। বিনিয়োগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান টিএস লম্বার্ডের অর্থনীতিবিদ ল্যারি ব্র্যেইনার্ড এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, “চীনা নেতৃত্ব বাধ্য হয়েছে চীনের উন্নয়ন সম্পর্কিত কৌশলের মৌলিক দিকগুলো পুনর্মূল্যায়ন করতে।”
তিনি আরও বলেন, “মার্কিন দেশে নিজেদের রপ্তানিপণ্যের বৃহৎ অংশ ট্রাম্প ট্যারিফের সম্মুখীন হওয়ায় চীন ভবিষ্যতে নতুন কিছু সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হবে, যেমন- অত্যাধুনিক মার্কিন প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হবে। আবার রপ্তানি হ্রাস পাওয়ায় চীনা শ্রমিকরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা সহজে কাটিয়ে ওঠা সম্ভবপর নয়।”
চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান টিএস লম্বার্ড মনে করে, “বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক শক্তিগুলো এখনও বেশ ভালো অবস্থানে আছে। নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার জন্য এ শক্তিগুলো এখন নিজেদের বাণিজ্য ব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করতে শুরু করবে যাতে স্বল্প উৎপাদনে পণ্য উৎপাদন সম্ভব হয় এবং উৎপাদিত এসব পণ্য তারা মার্কিন বাজারে বিক্রির বদলে ভিন্ন বাজারে বিক্রির পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। ফলে চীনকে কেন্দ্র করে একটি নতুন এশিয়ান বাণিজ্যিক ব্লক গড়ে উঠবে।”
চীন চলমান এই বাণিজ্য যুদ্ধের পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারলে তা এমন একটি অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করবে, যা বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্র ও সর্ববৃহৎ সমাজতন্ত্রের দেশের প্রায় সব ক্ষেত্রকে নড়বড়ে অবস্থানে নিয়ে যাবে। ফলে বিশ্ব অর্থনীতি, প্রযুক্তি কিংবা ভূ-রাজনীতির বর্তমান ধারা এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। তবে এশিয়ার অন্য রাষ্ট্রগুলো এ বাণিজ্য যুদ্ধের সময় চীনকে কতটা আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আপন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অর্থনৈতিক শক্তি ব্যবহার করে বলপ্রয়োগের দৃষ্টান্ত চীনের রয়েছে।
যেমন- ২০১২ সালে ম্যানিলা অভিযোগ করে বেইজিং দক্ষিণ চীন সাগরের ‘স্কারবোরো শোল’ নিয়ে সামুদ্রিক বিরোধের জের ধরে ফিলিপাইন থেকে কলা কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। এদিকে গত বছর দক্ষিণ কোরিয়া মার্কিন অ্যান্টি-মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘টার্মিনাল হাই অ্যাল্টিচিউড অ্যারিয়া ডিফেন্স (থাড)’ স্থাপন করায় দক্ষিণ কোরিয়া চীনা অর্থনৈতিক হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল।
তবে গবেষণা প্রতিষ্ঠান টিএস লম্বার্ড মনে করে, চলমান মার্কিন-চীন বাণিজ্য বিরোধের কারণে চীনের বাণিজ্য নতুনভাবে বিশ্বায়িত হবে। অন্যদিকে এইচএসবিসি অনুমান করেছে, চীন ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সর্ববৃহৎ অর্থনীতির দেশ হওয়ার জন্য ইতিমধ্যেই পুরোপুরি প্রস্তুত। যদিও এমন ধারণার সাথে অনেকেই একমত হতে পারছে না।
বর্তমান ট্যারিফ নিয়ে নিজেদের অবস্থান ব্যাখা করতে গিয়ে ওয়াশিংটন যুক্তি দেখাচ্ছে যে, এটি চীন-মার্কিন অর্থনৈতিক সম্পর্কে উভয়ের ‘ন্যায্য’ অবস্থান গড়ে তুলবে, যা কিছুদিন আগে পশ্চিম ভার্জিনিয়াতে ট্রাম্পের বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি, যেখানে তিনি বলেছেন, “আমেরিকা এখন চীনকে নিজেদের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই বিবেচনা করে এবং সে অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে।”
পরিশেষে বলা যায়, মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধ যে বিশ্ব বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যোগ করবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতিমধ্যেই বিশ্বে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি হতে শুরু করেছে। এই মেরুকরণ বিশ্বের জন্য কতটুকু কল্যাণকর হবে তা সময়ই বলে দিবে। তবে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, সংঘাতের পথ কখনোই কল্যাণ বয়ে আনে না। তাই এই যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই উচিত এমন একটা পন্থা বের করা, যার মাধ্যমে পুরো ব্যবস্থায় একটা ভারসাম্য তৈরি হবে। তবে এমনটা করা গেলে তা মানব সভ্যতার উন্নয়নে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।
[নিল কিম্বারলি ‘ম্যাক্রোইকোনমিক্স এবং অর্থনৈতিক বাজার’ বিষয়ের উপর একজন লেখক এবং বক্তা।]