বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেটে ২০১৮ সালের সবচাইতে আলোচিত বিষয় চীন। ডিএসই’র ২৫% মালিকানা এখন চীনের দুটি এক্সচেঞ্জ সাংহাই এবং সেনজেনের কাছে। চীনা বিনিয়োগ নিয়ে আমাদের তুমুল আগ্রহ আছে। আমাদের আজকের আলোচনা অবশ্য সরাসরি চীনা বিনিয়োগ নিয়ে নয়। বরং চীনের শেয়ার বাজার নিয়ে কিছু আলোচনা করা হবে।
এ বছর চীনা শেয়ার বাজার বেশ খারাপ অবস্থায় আছে এবং সহসাই এ অবস্থার উন্নতি হবার সম্ভাবনা খুবই কম, যদি না বেইজিং আর ওয়াশিংটনের বাণিজ্য যুদ্ধের সমাপ্তি হয় |
সাংহাই ইনডেক্স এ বছর জানুয়ারির ২৪ তারিখ তার সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ পড়ে গেছে। একই সময়ে সেনজেন কম্পোনেন্ট মার্কেট পড়েছে প্রায় ৩৬ শতাংশ। ওয়েলস ফার্গো (আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস কোম্পানি) তার ফিনান্সিয়াল অ্যানালাইসিসে দেখিয়েছে, একটি বাণিজ্য যুদ্ধে সাধারণত গড়ে ১০% প্রভাব পড়ে কোনো একটি দেশের শেয়ার বাজারে। সেই হিসেবে চীনা মার্কেট এই বছর বেশ খারাপ অবস্থায় পড়েছে।
একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ডিএসই মার্কেটের দিকে তাকালে দেখা যাবে, U.S. S&P 500 জানুয়ারি ২৬ তারিখের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ফেব্রুয়ারি এবং এপ্রিলে দুবার সর্বোচ্চ ৪% করে কারেকশন হয়ে পুনরায় স্থিতিশীল হয়েছিল। পুরোপুরি না হলেও ডিএসইর সাথে চীনা মার্কেটের অনেকটাই মিল পাওয়া যায়। একই সময়ে ডিএসইর সূচক পড়েছে প্রায় ১৬% এর মতো।
চীনা অর্থনীতি বেশ শক্তিশালী হলেও তারা নিজেদের মার্কেট নিয়ে ধুঁকছে এই মুহুর্তে। বিভিন্ন মার্কেট গবেষকের মতে, চীনা শেয়ার বাজার শক্ত হতে আরো বেশ কিছু সময় লাগবে। হয়তো ২০১৯ এর পর তারা বর্তমান অবস্থা থেকে বের হতে পারবে। সমস্যা হলো, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এই ধারাবাহিক পতন স্বাভাবিকভাবেই আশেপাশের অনেকগুলো দেশে প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে, যে দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে চীনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত, তারা এর দ্বারা প্রভাবিত হবেই।
আমাদের ইকোনমিতে চীনের বিশাল ভূমিকা আছে। ডিএসইর সাথে চুক্তি আমাদের শেয়ার বাজারকে চীনের সাথে আরো ওতপ্রোতভাবে যুক্ত করেছে। চীনা অর্থনীতি, নির্দিষ্ট করে বললে চীনা শেয়ার বাজারের একটি প্রভাব আমাদের শেয়ার বাজারে পড়বে বলে ধরে নেওয়া যায়। প্রশ্ন হলো, সেটা কতটুকু ভালো কিংবা খারাপ হবে?
গত ৭ সেপ্টেম্বর চায়না সিকিউরিটিজ রেগুলেটরি কমিশন নতুন একটি আইন পাস করেছে। “Lack professional prudence and substantial understanding of the market” শর্তের ভিত্তিতে তারা ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউট, মিউচুয়াল ফান্ড এবং ব্রোকারেজ হাউজের সংশ্লিষ্ট অ্যানালিস্ট এবং মালিকপক্ষকে জনসম্মুখে পাবলিক বক্তব্য প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। আইনটি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। বরং মার্কেট সংশ্লিষ্ট প্রফেশনালদের জন্য করা হয়েছে। আমাদের দেশেও হয়তো অদূর ভবিষ্যতে ধরনের আইনের প্রয়োজন হতে পারে।
২০১৮ তে ডিএসইতে বেশ অনেকগুলো কোম্পানি IPO দিয়েছে, মার্কেটে এসেছে এবং তুলনামূলক ভালো করছে। আইপিও কেন্দ্রিক মানুষের আগ্রহও আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে আইপিও বাজারে এশিয়ান অঞ্চলে চীনের বেশ সুনাম আছে। এ বছর চীনের প্রতিটি আইপিও সেকেন্ডারি মার্কেটে ওপেনিং প্রাইস থেকে গড়পড়তা ৪৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এটা হতেই পারে, ডিএসইতে আইপিওর বর্তমান বাজার তৈরিতে চীনের একটি ভূমিকা আছে। এমনটা হলে তা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকার কথা আশা করা যায়।
আমাদের দেশে ইনস্টিটিউট ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে বেশ আলোচনা হয়। মার্কেটে তাদের ভূমিকা রাখার জন্য বিএসইসি, ডিএসই অনেক রকমের মিটিং করে। অথচ চীনা সেনজেন মার্কেটে ইনস্টিটিউশনাল ইনভেস্টমেন্ট নেই বললেই চলে। ৮০-৮৫ ভাগ ট্রানজেকশন করে থাকেন সাধারণ ইনভেস্টর। এর মানে অবশ্য এই নয় যে, ইনস্টিটিউট ইনভেস্টমেন্ট দরকার নেই, বরং আমাদের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদেরকে কীভাবে আর বেশি করে মার্কেটবান্ধব করা যেতে পারে, সে ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়ার দরকার।
কিছুদিন আগে ডিএসইর কিছু কিছু কোম্পানির শেয়ার সাসপেনশন নিয়ে অনেক আলোচনা আমরা দেখেছি পত্র-পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কোম্পানিকে ওটিসি মার্কেটও পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে নিয়মকানুন ভঙ্গ করার কারণে। এদিকে ট্রেড সাসপেনশন চীনা মার্কেটে নিয়মিত ঘটনা। যখন তখন যেকোনো কারণে যেকোনো কোম্পানির ট্রেড সাসপেন্ড করায় তারা সিদ্ধহস্ত। এই সাসপেনশনের ধারা যদি তারা ডিএসইর মার্কেটেও নিয়ে আসেন, তাহলে ভালোই বিপদে পড়বেন আমাদের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। এমনকি বড় বড় ইনস্টিটিউটও হয়তো এ বিপদ এড়াতে পারবে না।
আমাদের আইসিবি’র মতো চীনা একটি সংস্থা আছে, যার নাম সিআইসি। তাদের বর্তমান ফান্ডের পরিমাণ ৯০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। সিআইসি যেমন তাদের মার্কেটকে সাপোর্ট দিয়ে যায় এই ফান্ড দিয়ে, একইসাথে তারা অন্যান্য দেশেও এই ফান্ড থেকে বিনিয়োগ করে থাকে। এই ফান্ডকে কীভাবে আমাদের শেয়ার মার্কেটের কাজে লাগানো যায় সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে। প্রয়োজনীয় সময় আইসিবির পাশাপাশি সিআইসির সাহায্যও এতে হয়তো আমরা পেতে পারি। এই ফান্ডের কার্যক্রম ইন্ডিয়া, হংকং সহ অনেক দেশেই আছে ।
প্রসঙ্গক্রমে ভারতীয় শেয়ার বাজারের কথাও বলা যায়। ২০১৫ তে ভারতীয় শেয়ার বাজারের ব্যাপক পতন ঘটে। মার্কেট অ্যানালিস্টগণ বিভিন্ন কোম্পানির হতাশাজনক ইপিএস এর পাশাপাশি ভারত এবং চীনের মধ্যে বাণিজ্য কমে যাওয়াকে এর অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বাণিজ্য কমে যাওয়ার একটি প্রধান কারণ ছিল ভারতীয় রুপির বিপরীতে ইয়েনের ব্যাপক পতন, যা শেয়ার মার্কেটকে প্রভাবিত করে এবং এতে শেয়ার বিক্রির প্রবণতা বেড়ে যায়।
২০১৫ সালের একই সময়ে সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জেও ২০০০ পয়েন্টেরও বেশি পতন ঘটে। এ সময়কালে আমাদের ডিএসই ৬৫০ পয়েন্ট হারায়। চীনের উপর আমাদের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা দিন দিন বাড়ছে। এখন তারা আমাদের প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জ ডিএসইর সাথে অংশীদার হয়েছে। আসছে সময়ে চীনা শেয়ার বাজারের গতি-প্রকৃতি হয়তো আমাদের মার্কেটের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মার্কেট অ্যানালাইসিস টুলস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মার্কেট ছোট হলেও বর্তমানে আমাদের ডিএসই তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো অবস্থানে আছে। সহজভাবে চিন্তা করলে, চীন আমাদের এই মার্কেটে একটি ব্যবসার সম্ভাবনা দেখেছে এবং সেই হিসেবে হয়তো বিনিয়োগ করতে এসেছে। প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশীয় বড় বিনিয়োগকারীরা কবে এসব সম্ভাবনা দেখতে শিখবেন এবং পুঁজি বাজারকে স্থিতিশীল রাখার জন্য পরিণত ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবেন?