শুরু হয়েছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর, শুরু হয়ে গেছে আরো একটি কাউন্ট-ডাউন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০১৮।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নির্বাচন প্রক্রিয়া একটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়। জনমত ও গণদাবী নির্ভর রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করার অন্যতম মাধ্যম নির্বাচন। রাষ্ট্রের জনগণ এই পদ্ধতির মাধ্যমে পছন্দের ব্যক্তি বা দলকে শাসক হিসেবে যাচাই করার সুযোগ পায়। আবার রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সরকারের নীতি নির্ধারণী পদক্ষেপ, উন্নয়ন ও অন্যান্য বিষয়ে জনগণের মনোভাব যাচাইয়ের সবচেয়ে কার্যকরী উপায়ও হলো নির্বাচন।
সেক্ষেত্রে নির্বাচন প্রক্রিয়া বড় থেকে ছোট– সব ধরনের রাজনীতিবিদদের জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। এজন্যই ব্রিটেনের এককালের ডাকসাইটে প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের কাছে যুদ্ধজয়ের থেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নির্বাচনে জয়লাভ করা। ১৯৪৫ সালে ব্রিটেন চাচির্লের নেতৃত্বে জার্মানদের যুদ্ধে পরাজিত করেছিল। অথচ এমন প্রাপ্তির পরও একই বছর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে চার্চিল প্রতিপক্ষ লেবার পার্টির কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। যদিও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলান সহ আর অনেকেই বলেছেন, এই পরাজয়ে নেভিল চেম্বারলিনের জার্মান প্রীতির সুস্পষ্ট প্রভাব ছিল।
বর্তমান বিশ্বে গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে নির্বাচন ও তার আর্থ সামাজিক প্রভাবের মধ্যে অনেক অভিন্ন ব্যাপার থাকলেও দেশে দেশে এর ভিন্নতা দেখা যায়। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থান, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবেশ, চাপ সৃষ্টিকারী দলের কর্মকান্ড, বৈদেশিক প্রভাব এসবের উপর ভিত্তি করে দেশভেদে নির্বাচনের সামাজিকতা যেমন ভিন্ন হয়, তেমনি অর্থনীতিতেও এর ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র শোভিত যুক্তরাজ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচন তাদের অর্থনীতিতে যে প্রভাব ফেলে, রাষ্ট্রপতি শাসিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন মার্কিন অর্থনীতিতে অবিকল একই প্রভাব না-ও ফেলতে পারে।
আর অল্প ক’দিন পরেই আমাদের দেশে অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নানা দিক থেকে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য এ নির্বাচন দেশের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এবারের নির্বাচনের রাজনৈতিক পরিবেশ ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নির্বাচনী পরিবেশ থেকে অনেক ভিন্ন। জোট-পাল্টা জোট গঠন, জনসংযোগ, প্রচারণা ও সক্রিয়তা সব মিলিয়ে এক জমজমাট নির্বাচনের আভাষ পাওয়া যাচ্ছে।
প্রতি বছর অর্থ মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারী ব্যয় নির্বাহের যে বাজেট প্রণয়ন করে থাকে, এ বছর তা গতানুগতিক ব্যয় নির্বাহের চেয়ে সামান্য ভিন্ন। নির্বাচন সংক্রান্ত সরকারী কার্যক্রম, নির্বাচন কমিশনের জন্য অর্থ বরাদ্দ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন এসব বিভিন্ন কারণে বাজেট বিভাজনে ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে। ২০১৮-১৯ সালের জাতীয় বাজেটে নির্বাচন কমিশনের জন্য সরকারের বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১,৮৯৫ কোটি টাকা, যেখানে বিগত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে নির্বাচন কমিশনের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল ৯৫৩ কোটি টাকা।
নির্বাচন কমিশনের হিসাবে, এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠভাবে সম্পাদনের জন্য ৭০০ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে, যা ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় দ্বিগুণ। এবারের ৭০০ কোটি টাকার মধ্যে ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে। অবশিষ্ট ৩০০ কোটি টাকা নির্বাচনের ভোট গ্রহণসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজে ব্যয় করা হবে।
সারা দেশের ৪০,১৯৯টি ভোটকেন্দ্রে সুষ্ঠভাবে ভোট গ্রহণ করতে এবার সাত লক্ষ জনবলের প্রয়োজন হবে, যার জন্য ১৬০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। ৩০০ আসনের ব্যালেট পেপার ছাপায় ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ কোটি টাকা। ১০ কোটি টাকা ব্যয় হবে অন্যান্য নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রচার-প্রকাশনা এবং ৮ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে স্ট্যাম্প প্যাডসহ বিভিন্ন ভোট গ্রহণ সংশ্লিষ্ট স্ট্যাম্প, সিল ও কালি ক্রয়ের জন্য।
আমাদের নির্বাচনী ব্যয় বাড়ার কারণ একাধিক। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ভোটার সংখ্যা যেমন বাড়ছে, সেই সাথে নির্বাচনে ব্যবহৃত দ্রব্যাদীরও আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। এসেছে ইভিএম পদ্ধতি, যদিও তা এখনও সব জায়গায় ব্যবহার করা হয়নি। প্রতিবন্ধী ভোটারদের জন্য সকল সুযোগ-সুবিধা এখনও নিশ্চিত করা হয়নি। সব মিলিয়ে দিন দিন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন- ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশন সর্বমোট ২৮৩ কোটি টাকা খরচ করেছিল, যার ভেতর ২০০ কোটি টাকা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ব্যয় করা হয়। বাকি ৮৩ কোটি টাকা খরচ হয় ১৪৭টি আসনে ভোট গ্রহণসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কাজে। ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে যাওয়ায় সেসব আসনে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট খরচের প্রয়োজন ২০১৪ সালে হয়নি। আবার ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কমিশন যেখানে খরচ করেছিল ১৬৫.৫ কোটি টাকা, সেখানে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা খরচ করে ৭২.৭১ কোটি টাকা।
বিভিন্ন সূত্রানুসারে, ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে সরকারীভাবে ব্যয় করা হয়েছিল ৮১.৩৬ লক্ষ টাকা। পরবর্তীতে ২য় জাতীয় নির্বাচনে ব্যয় হয় ২.৫২ কোটি টাকা, ৩য় জাতীয় নির্বাচনে ব্যয় হয় ৫.১৬ কোটি টাকা, ৪র্থ জাতীয় নির্বাচনে ব্যয় হয় ৫.১৫ কোটি টাকা, ৫ম জাতীয় নির্বাচনে ব্যয় হয় ২৪.৩৭ কোটি টাকা এবং ৬ষ্ঠ জাতীয় নির্বাচনে ব্যয় হয় ৩৭.০৪ কোটি টাকা।
এসব হিসাব হলো বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ব্যয়ের হিসেব। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, প্রার্থীরা ঠিক কত টাকা নির্বাচনের সময় খরচ করেন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। বড় বড় ব্যবসায়ীরা রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত হওয়ায় এই ব্যয় দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। পোস্টার ছাপানো, প্রচারণা, জনসভা, কর্মীদের খরচ দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধাপে প্রার্থীরা প্রচুর খরচ করে থাকেন। নির্বাচন কমিশন প্রার্থীদের অর্থ খরচের একটা সীমা অবশ্য টেনে দিয়েছে। এবারের নির্বাচনে প্রার্থীরা ভোটার প্রতি সর্বোচ্চ দশ টাকা খরচ করতে পারবেন, তবে তা কখনোই প্রার্থীদের সবোর্চ্চ নির্বাচনী ব্যয় সীমা ২৫ লাখ টাকার উপর যেতে পারবে না।
তবে কে, কীভাবে কত টাকা খরচ করছেন তা হিসাব করার কোনো পদ্ধতি আমাদের দেশে এখনও গড়ে ওঠেনি। যেমন- নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর টিআইবি পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়েছে, কেবলমাত্র ১১ জন প্রার্থী কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত নির্বাচনী ব্যয় সীমার মধ্যে তাদের ব্যয় সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। নির্বাচনের আচরণবিধি লঙ্ঘন সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ বিবরণ জানতে পারবেন এই লিঙ্ক থেকে।
নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক প্রচার প্রচারণার যে জনচাঞ্চল্য তৈরি হয়, তা দেশের অর্থপ্রবাহকে প্রভাবিত করে। যেমন- উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নির্বাচনের সময় আগের চেয়ে চায়ের দোকানে চা বিক্রি বেড়ে যায়। যার ফলে চা পাতা, দুধ, চিনি, বিস্কুটের চাহিদাও বেড়ে যায়। এই বাড়তি চাহিদার জন্য প্রয়োজন হয় বাড়তি উৎপাদন। এভাবে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রায় সব কাজে বিভিন্ন দ্রব্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় তা এর সাথে সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর ব্যবসাকে বাড়িয়ে দেয়। আবার নির্বাচন ও এর পরবর্তী পরিস্থিতি যাচাই বাছাইয়ের লক্ষ্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাঁচামাল আমদানী অনেকাংশে কমে যেতে দেখা যায়। নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা লক্ষ্য করা যায়।
নির্বাচনের সময় দলীয় পর্যায়ে নগদ অর্থ লেনদেনের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। সামাজিক কাজে দানের পরিমাণ বাড়ে। সারা দেশের ৩০০ নির্বাচনী আসনে এভাবে সব মিলিয়ে নির্বাচনকালীন খরচ বেশ বৃহদাকারের অর্থপ্রবাহ তৈরি করে। তবে এ ব্যয়ে সব যে বৈধ টাকা ব্যয় হয় তা বলা যাবে না। নিবার্চনে কালো টাকা ব্যবহারের অভিযোগ বহু পুরাতন। আমাদের দেশে অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ উপভোগ্য নির্বাচনের প্রচারণায় অর্থ খরচের প্রভাব সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর, দৈনন্দিন জীবনকে বেশ প্রভাবিত করে থাকে। সব কিছুর মাঝেই একটা উৎসব উৎসব আমেজ দেখা যায়। আমরা দেশবাসীরা একটি প্রতিযোগিতামূলক সুষ্ঠ ও সুন্দর নির্বাচনের অপেক্ষায় দিন গুনছি।