২০১৯ সালের আগমন ঘটে গেল। নিঃসন্দেহে ২০১৮ সালের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ খবরের মধ্যে একটি খবর ছিল ক্রিপ্টোকারেন্সি এবং ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রতি বিভিন্ন দেশের সদয় দৃষ্টি। বর্তমান যুগ প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের যুগ। যে দেশ যত বেশি নতুন প্রযুক্তি আগলে ধরবে, সেই দেশ তত বেশি সমৃদ্ধশালী হবে। এটাই বাস্তবতা।
শুধু আগলে ধরলেই হবে না, সাথে নতুন প্রযুক্তিকে কীভাবে আরও উন্নত করা যায় সেই বিষয় নিয়েও গবেষণামূলক কাজ করতে হবে। ক্রিপ্টোকারেন্সির যুগে প্রবেশ করার অনেক আগেই বিশ্ব অর্থনীতি কাগজবিহীন লেনদেন শুরু করে। সেই লেনদেন শুরু হয়েছিলো ইলেক্ট্রনিকস এবং তথ্য-প্রযুক্তির উন্নতির ফলে। একবিংশ শতাব্দীর যুগে মানুষ কাগজের টাকা দিয়ে লেনদেন প্রায় ভুলেই যেতে বসেছে। ইলেকট্রনিক লেনদেন করতেই মানুষ বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। বর্তমান যুগ ক্যাশলেস ইকোনোমির যুগ। তথ্য-প্রযুক্তির ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে আজকের যুগে বড় বড় সব লেনদেন ভার্চুয়ালি হয়ে থাকে। দেশি এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোতে ইন্টারনেটভিত্তিক লেনদেন এবং ইলেকট্রনিক লেনদেনের সম্পূর্ণ ব্যবস্থা রয়েছে।
বর্তমান যুগে মানুষ কাগজের টাকা প্রায় ব্যবহার করতে চায় না বললেই চলে। যেকোনো ব্যাংকে ইন্টারনেট ব্যাংকিং এবং ক্রেডিট কার্ড ভিত্তিক লেনদেনের গ্রাহক বেশি পাওয়া যাবে। আজকের এই লেখার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে- যদি সত্যি সত্যি কাগজের নোট আর ব্যবহার করা না হয়, তাহলে তার সুবিধাগুলো কী হবে? কাগজের টাকা কি পুরোপুরি বাদ হয়ে যাবে? আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কাগজের টাকা কি শুধুই জাদুঘরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে?
ইদানিং ভার্চুয়াল বা ক্যাশলেস ইকোনমি নিয়ে হঠাৎ শোরগোল শুরু হয়েছে। বিশেষ করে বিটকয়েনের আবির্ভাবের পর সেটা বেশি জোরদার হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, বিশ্বের ছোট-বড় সব দেশই অনলাইনভিত্তিক লেনদেন শুরু করেছে। উন্নত দেশগুলোতে কাগজের টাকার ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ হারে কমে গিয়েছে। উদাহরণস্বরুপ, ব্রিটেনে কাগজের টাকার প্রচলন মাত্র তিন শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রে দশ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে একটু বেশি হওয়ার কারণ হচ্ছে পর্যটকদের কাছে কাগজের ডলার পাওয়া যায়। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০০৮ সালে তাদের মুদ্রা বণ্টনকারী প্রতিষ্ঠান ছিল ৮৩টি, কিন্তু ২০১২ সালে তা নেমে আসে ৬৮টিতে।
অর্থনীতিবিদদের ধারণা, ক্যাশলেস ইকোনোমির গুরুত্ব অপরিসীম। সবচেয়ে বড় উপকারিতা হচ্ছে কর আদান-প্রদানে সুস্পষ্টতা তৈরি। বিভিন্ন দেশে দেখা যায়, সাধারণ মানুষ কর দিতে চায় না বা পারে না। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্চুয়ালি লেনদেন প্রক্রিয়ায় অনেক বেশি কর আদায় করা সম্ভব। এর ফলে কালো টাকার উপর নজরদারি এবং একটি শক্ত অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারক ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব।
কাগজের টাকার একটি বড় সমস্যা হচ্ছে টাকা জালিয়াতি। কাগজের টাকার মাধ্যমে অবৈধভাবে লেনদেন অনেক বেশি সহজ। কারণ এই ধরনের লেনদেনের কোনো রেকর্ড বা তথ্য থাকে না। তাই কেউ যদি কোকেন কিংবা অন্য কোনো মাদকদ্রব্য ক্রয় করে, সেটার হদিস পাওয়া দুষ্কর। চোরাচালান, অবৈধ অস্ত্র কেনাবেচা, ড্রাগ ডিলিং ইত্যাদির হদিস সরকার দিতে পারে না এবং এগুলো রোধও করতে পারে না। কারণ বেশিরভাগ লেনদেন কাগজের টাকার মাধ্যমে চুপিসারে হয়ে যায়। এই ধরনের আন্ডারগ্রাউন্ড ইকোনমি বা গোপন অর্থনৈতিক কারবার ধরতে ও বন্ধ করতে প্রযুক্তিভিত্তিক লেনদেন বিশেষ সাহায্য করবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে এটা নিশ্চিত করতে হবে যেন সকল লেনদেন ভার্চুয়ালি হয়।
ইলেকট্রনিক লেনদেন যে শুধুমাত্র কালো টাকা ধরতে সাহায্য করবে তা কিন্তু নয়। কিছু কিছু আয়ের উৎস আছে যেগুলো সাধারণত সরকারের নজরে আসে না। যেমন- টিউশনি, শিক্ষকদের বাড়িতে কোচিং নেয়া, বেবি সিটিং ইত্যাদি। এ ধরনের কাজ করে অনেকে লক্ষ্য লক্ষ্য টাকা আয় করে। এই ধরনের অর্থোপার্জন করের আওতায় পড়লেও এগুলো কোনো ঘোষিত আয় না হওয়ায় এই আয় থেকে কোনো কর নেয়া যায় না। এমনকি এ ধরনের উপার্জন সরকারের নজরেও আসে না। সব ধরনের লেনদেন ভার্চুয়াল হলে এসব আয় নজদারির ভেতর আনা সম্ভব। টাফটস ইউনিভার্সিটির গবেষণা থেকে জানা গেছে, যদি যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি কাগজের টাকা পরিহার করে, তাহলে বছরে আরও ১০০ বিলিয়ন ডলার বেশি কর আদায় করা সম্ভবপর হবে।
আমরা হয়তো কখনও ভেবে দেখিনি যে, কাগজের টাকা তৈরি করার জন্যও কিন্তু টাকার প্রয়োজন! কাগজের টাকা বানিয়ে সেটা দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে বণ্টন করা, এটিএম বুথে গচ্ছিত রাখা ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে প্রচুর টাকা খরচ হয়, যেটা ভার্চুয়াল লেনদেনে হয় না। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের হিসাবমতে, প্রতি ১০০ ডলারের নোট তৈরি করতে তাদের ১৪.২ সেন্ট খরচ হয়। আবার ২০ এবং ৫০ ডলারের নোট তৈরি করতে তাদের ১১.২ সেন্ট খরচ হয়।
এটিএম বুথ পরিচালনা করতেও বেশ খরচ এবং ঝামেলা পোহাতে হয়। যেমন- সেখানে টাকা স্টক করে রাখা, সেগুলোর নিরাপত্তা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা ব্যাংকের জন্য একটি বাড়তি খরচ। আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকাতে বুথগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করা বিরাট খরচসাপেক্ষ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া কাগজের টাকা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্যও নিরাপত্তা, জনবল এবং পরিবহন ব্যবস্থার প্রয়োজন। এসবের জন্যও একটি বিরাট অংকের অর্থ খরচ হয়। এতসব কাজ পরিচালনার জন্য বিভিন্নভাবে ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ কেটে নেয়। কিন্তু ক্যাশলেস ইকোনোমির পুরোপুরি প্রচলন শুরু হলে হয়তো বেশ গুরুত্বপূর্ণ পরিমাণ আর্থিক ব্যয় কমে যাবে বলে ধারণা করা যায়।
কাগজের টাকা পরিহার যে সবসময় কল্যাণ বয়ে আনবে তা কিন্তু নয়। কিছু সমস্যা কিন্তু সৃষ্টি হতে পারে। যেমন- মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি। এখনও বিভিন্ন দেশে কিছু মানুষ আছে, যারা ভার্চুয়ালি লেনদেন করা পছন্দ করে না। তারা কাগজের টাকা ব্যবহার করে অভ্যস্ত। এই অভ্যস্ততা থেকে তাদেরকে বের করে আনা কতটুকু সম্ভব হবে সেটা ভেবে দেখার বিষয়। এছাড়া ভার্চুয়াল লেনদেনের ফলে যেকোনো আয় কিংবা অর্থ আদান-প্রদানের উপর নজর রাখা সম্ভব। এরকম হলে সাধারণ মানুষ ব্যক্তিগতভাবে অস্বস্তিবোধ করতে পারে। গণতান্ত্রিক দেশে যদি জনগণের মতামত না নিয়ে রাতারাতি সম্পূর্ণ ক্যাশলেস ইকোনোমিতে প্রবেশ করা হয়, তাহলে সেটার প্রতি জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে সেটা ভেবে দেখার বিষয়। এখানে ভোট একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। অনেকক্ষেত্রে ভোটাররা চটে যেতে পারে। আবার এমনও হতে পারে যে, নিজের দেশে কাগজের টাকা ব্যবহার করতে না পেরে সেগুলোকে অন্য কারেন্সিতে রূপান্তরিত করে ফেলা অথবা বিটকয়েনে রুপান্তর করা।
তবে অনেক অর্থনীতিবিদ এরকম পরামর্শ দিয়েছেন যে, ছোট ছোট কাগজের নোটগুলো সচল রেখে বড় বড় নোট বাদ দিয়ে সেগুলোর ভার্চুয়াল লেনদেন নিশ্চিত করা যেতে পারে। তাহলে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা কিছুটা হলেও নিশ্চিত করা যাবে। কিন্তু এই কথা অনস্বীকার্য যে, সম্পূর্ণভাবে ক্যাশলেস ইকোনমির প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। এরকম ব্যবস্থা সম্পূর্ণরুপে তখনই সম্ভব, যখন আধুনিক যুগের সাথে সাথে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন আসবে। ি
ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ওয়ালেট এবং হালের বিটকয়েন- অর্থনৈতিক লেনদেনকে আকর্ষণীয় এবং আরও বেশি সহজ করতে সময়ে সময়ে এরকম বিভিন্ন মাধ্যম তৈরি হয়েছে। একসময় লেনদেনের মাধ্যম ছিল কাগজের নোট। এখন ধীরে ধীরে মানুষ কাগজের টাকা তৈরি করার খরচ বাঁচিয়ে প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নত মাধ্যমে লেনদেনের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। এরকম পরিবর্তনের মধ্যে খারাপ কিছু নেই। বরং আগের তুলনায় এখন ঘরে বসেই লেনদেন করা যাচ্ছে যার গ্রহণযোগ্যতা অবশ্যই বেশি। এবং এতে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে বিরাট পরিবর্তন আসবে তা একবাক্যে স্বীকার করে নেয়া যায়। তবে এখানে লেনদেনের নিরাপত্তা, মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা এবং সাইবার সিকিউরিটির দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। নতুবা নতুন ধরনের এই লেনদেনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা এবং গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে।