পাঁচ উইকেট পাওয়ার পর বল হাতে উঁচু করে দেখানোর রেওয়াজ আছে ক্রিকেটে, বেশ সম্মানের ব্যাপার। কিন্তু সিলেটে সেই কাজটা তাইজুল ইসলামের মনমতো হলো না। হবে কী করে? দলের ব্যাটিং ব্যর্থতা যে তার ঝলমলে বোলিং পারফরম্যান্সের সূর্যোদয়ের আমুদে আলো টেনে নামিয়ে দিয়েছে। দুর্ভাগ্য এই বাঁহাতি স্পিনারের, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নিজের পারফরম্যান্সের জন্য সতীর্থদের কাছ থেকে সাদামাটা অভিনন্দনটুকুও পাওয়া হলো না তার।
সিলেট টেস্টের প্রথম ইনিংসে জিম্বাবুয়ে তুলেছিল ২৮২ রানের ইনিংস, সেখানে বাংলাদেশের বোলার তাইজুল একাই নিয়েছেন ৬ উইকেট। জিম্বাবুয়ের দ্বিতীয় ইনিংসে নিয়েছেন আরও ৫ উইকেট। সব মিলিয়ে ২০ টেস্টে তার সংগ্রহ দাঁড়িয়েছে ৮০ উইকেট! বাংলাদেশের ইতিহাসে ম্যাচের সংখ্যায় যা দ্রুততম। এগুলো তাকে এনে দিয়েছে একটি মাইলফলকে পা রাখার গৌরব। তাইজুল এখন বাংলাদেশের চতুর্থ বোলার, যার এক টেস্টে ১০ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড হলো। শুধু তা-ই নয়, মাশরাফি বিন মুর্তজাকে পিছনে ফেলে (৭৮ উইকেট) তাইজুল এখন টেস্টে বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী।
কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে বাংলাদেশের ব্যাটিং ব্যর্থতা। উইন্ডিজ টেস্টের সেই ৪৩ রানে গুটিয়ে যাওয়ার অভিশাপ এবার সিলেটের অভিষেক টেস্ট ম্যাচে ধরা দিল ১৪৩ রান হয়ে। দুই ওপেনার তো বটেই, পুরো টপ অর্ডার ধ্বসে গেছে জিম্বাবুয়ের বোলিং লাইনআপের সামনে। পুরো ইনিংসজুড়ে কেবল চারজন দুই অঙ্কের রান ছুঁতে পেরেছেন। শেষ পর্যন্ত আরিফুল হক, যাকে টি-টোয়েন্টির জন্য প্রথম নির্বাচিত করা হয়েছিল, ৪১ রানে অপরাজিত থেকে মান বাঁচানোর মিথ্যে চেষ্টা করে গেলেন। এরপর দ্বিতীয় ইনিংসেও তথৈবচ অবস্থা, এবারও শেষ অবধি দাঁড়ালেন সেই ‘অভিষিক্ত’ আরিফুলই।
বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট অবস্থার উষ্ণতা টের পাচ্ছিল। সে কারণেই কিনা ব্যর্থ ব্যাটিং লাইনআপ থেকে কাউকে সংবাদ সম্মেলনে পাঠানো হলো না, এলেন সফল বোলার তাইজুল। গণমাধ্যমের সামনে নিজের সাফল্যের দিনে দলের ম্লান পারফরম্যান্সের হতাশা লুকোতে পারেননি ২৬ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার।
১.
দ্বিতীয় ইনিংসের শেষ উইকেটে ব্যাট করছিল জিম্বাবুয়ে। ৬৬তম ওভারের চতুর্থ বল, বোলার তাইজুল ইসলাম। টেন্ডাই চাতারাকে বল করলেন, কিন্তু ব্যাটে না লেগে সেটি গিয়ে ছুঁয়ে দিলো চাতারার প্যাড। জোড়ালো আবেদন। আম্পায়ার রড টাকারের শুরুতে মন গলেনি। আবেদনের জোরাজুরি থেকে কী যেন একটু ভাবলেন, তারপর আঙ্গুল তুলে দিলেন।
বোধহয় আম্পায়ারের সিন্ধান্ত দিতে দেরি আর শেষ উইকেটের কথা মাথায় রেখেই রিভিউ আবেদন করে বসলো জিম্বাবুয়ে। সেই আবেদন ধোপে টেকেনি, চাতারা ফিরে গেলেন সাজঘরে, জিম্বাবুয়েও গুটিয়ে গেল ১৮১ রানে। ম্যাচ জিততে বাংলাদেশের সামনে তখন আড়াই দিন, ১০ উইকেটের সঙ্গে প্রয়োজন ৩২১ রান। শেষ পর্যন্ত পারেনি বাংলাদেশ, ব্যাটিংয়ে আরেকবার অসহায় আত্মসমর্পণ করে মাত্র ১৬৯ রানেই যবনিকা পড়লো ইনিংসে। এই নিয়ে টানা আট ইনিংসের দলীয়ভাবে দুইশ’ রান তুলতে ব্যর্থ হলো বাংলাদেশ।
আগের ইনিংসে ৬ উইকেট, এই ইনিংসে ৫ উইকেট – দুইয়ে মিলিয়ে ১১ উইকেট। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাইজুলের এটি সেরা বোলিং ফিগার হয়ে গেল, এর আগে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ ৯টি পর্যন্ত উইকেট নিতে পেরেছিলেন তাইজুল।
এতকিছুর পরও তিনি যে খুশি নন, তা প্রথমদিন শেষ করে জানিয়েছলেন সংবাদ সম্মেলনে। তবে তাকে খুশি করার সুযোগ মুশফিকুর রহিম-ইমরুল কায়েসদের সামনে ছিল। যদি ম্যাচ জিততো বাংলাদেশ, তাহলে তাইজুলের এই সাফল্য হয়তো তিনিও আজীবন ‘জীবনের গল্প’ হিসেবে রাখতে পারতেন।
আদতে তা হয়নি, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাঁচ দিনের টেস্ট শেষ হয়েছে সাড়ে তিন দিনে। তাইজুলের বাংলাদেশ হেরেছে ১৫১ রানের বিশাল ব্যবধানে।
তাইজুলের হতাশার শুরু টেস্টের প্রথম দিনেই। সংবাদ সম্মেলনে এসে বলেছিলেন,
‘ক্রিকেটে কখনও ভালো হবে আবার কখনও খারাপ হবে, এমন সময়ই কিন্তু আসে। সকালে হয়তো (দ্বিতীয় দিন) আমাদের সময়টা ভালো কেটেছে। মধ্যাহ্ন বিরতির পর থেকে দুই সেশন আমাদের পক্ষে আসেনি। আমাদের হাতে আরও তিনটা দিন সময় আছে, আমরা চেষ্টা করবো ওদের দ্রুত অলআউট করার।’
কথাটা তাইজুল রেখেছিলেনও, মেহেদী হাসান মিরাজদের সঙ্গে নিয়ে জিম্বাবুয়ের দ্বিতীয় ইনিংস গুটিয়ে দিয়েছিলেন মাত্র ১৮১ রানের মধ্যে।
সিলেটের ফ্ল্যাট উইকেটে কাজটা যে সহজ নয়, তা আগেই জানতেন তাইজুল। তাই পরিকল্পনাটাও আগেই করা ছিল তার। বলেছিলেন, ‘আসলে উইকেট ফ্ল্যাট হলে ডিসিপ্লিনড বোলিং করতে হয়। অফ স্ট্যাম্পের বাইরে বেশি জায়গা না দিয়ে বল করতে হয়। আমি ওটাই করার চেষ্টা করেছি।’
উদযাপনের মতো পারফরম্যান্স করেও উদযাপন না করতে পারার জ্বালা পুড়িয়েছে তাইজুলকে। প্রথম ইনিংসে ৬ উইকেট নেওয়ার পর বলেছিলেন,
‘৬ উইকেট পাওয়ার অনুভূতিটা ভালোই, কারণ সবসময় তো ৫-৬ উইকেট আসে না। ভালো তো লাগছেই। কিন্তু আমি দলের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে চাইছি। দল ভালো করলে আমারও ভালো লাগবে।’
তাইজুলকে ভালো লাগাতে হলে মুশফিকদের ম্যাচ জিততে হতো। তৃতীয় দিন শেষে কোনো উইকেট না হারিয়ে ২৬ রান তোলা বাংলাদেশের সামনে সেই সুযোগটা ভালোই ছিল। আবার দলের দ্বিতীয় ইনিংসের বিগত ইতিহাসও হয়তো জুজু হয়ে ধরা দিচ্ছিলো। শেষ পর্যন্ত জুজুর কাছে ধরা দিয়েছে স্বাগতিকরা।
পুরনো ইতিহাস কিংবা সম্ভাবনা; দুইয়ে মিলিয়েই স্বপ্ন দেখছিলেন তাইজুল। বলেছিলেন,
‘টেস্ট রেকর্ডের খেলা। টেস্টেই বেশি রেকর্ড হয়। আমরা তাই চাচ্ছি, বাংলাদেশ এমন কোনো রেকর্ড গড়ুক।’
২.
জাতীয় দলে তাইজুল ইসলামের টেস্ট অভিষেক হয় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, প্রতিপক্ষ ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। নিজের সেই অভিষেক টেস্টেই ৫ উইকেট নিয়েছিলেন এই অফস্পিনার। সেই থেকে এ নিয়ে খেললেন নিজের ২০তম টেস্ট ম্যাচ, উইকেট ৮০!
এই টেস্টের আগ পর্যন্ত ১৯ টেস্টেই তাইজুল ৫ উইকেট নিয়েছেন তিনবার, চার উইকেটও নিয়েছেন তিনবারই। সামনের দিনগুলোতে তাইজুলের অভিজ্ঞতা সাদা পোশাকে বাংলাদেশকে সুদিন এনে দেবে, তার প্রমাণ দিচ্ছে তাইজুলের প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ার। এখন পর্যন্ত ৫৬ ম্যাচে তাইজুল নিজের সাফল্যের ঝুলিতে ভরেছেন ২২২ উইকেট!
জাতীয় দলের হয়ে তাইজুল কখনোই বিদেশের মাটিতে ঝলমলে ছিলেন না, কিন্তু দেশের মাঠে তিনি নির্বাচকদের অটোমেটিক চয়েস সবসময়।
জিম্বাবুয়ের সঙ্গে তাইজুলের সাফল্যের গল্প লেখার ক্যানভাসটা বেশ পুরনো। এই যে প্রথমবারের মতো এক টেস্টে ১০ উইকেট পেলেন তা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। এই মুহূর্তে এটি তার ক্যারিয়ার সেরা। আগে ছিল এক ম্যাচে ৮ উইকেট, সেটাও এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই।
বাংলাদেশি হিসেবে এক টেস্টে তাইজুলের চেয়ে এগিয়ে আছেন কেবল দু’জন স্পিনার। ২০০৫ সালে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ২০০ রানে ১২ উইকেট নিয়েছিলেন সিলেটের বাঁহাতি স্পিনার এনামুল হক জুনিয়র। এরপর ২০১৬ সালে মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে মেহেদী হাসান মিরাজ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১২ উইকেট নিয়েছিলেন, খরচ করেছিলেন ১৫৯ রান।
এনামুল জুনিয়র, মিরাজ কিংবা তাইজুল ছাড়া বাংলাদেশের হয়ে এক টেস্টে ১০ উইকেট পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন সাকিব আল হাসান। সেটাও একবার নয়, দুইবার। প্রথমটা ছিল ২০১৪ সালে এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই। দ্বিতীয়টি ছিল গত বছর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। সেবারই প্রথম অস্ট্রেলিয়াকে টেস্টে হারায় বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে ইমরুল কায়েস, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ কিংবা এই তাইজুল ইসলামরা প্রায় একই ঘরানার। তাদের পারফরম্যান্সগুলো যেন পর্দার আড়ালে চাপা পড়ে যায়। কখনও আবার সেই সাফল্যের আলো সব বাধা এড়িয়ে একটুখানি বের হয়ে আসে, সেই একটুখানিতেই ঝলসে যায় সবকিছু। তারকাখ্যাতি কিংবা নামীদামী পণ্যের বিজ্ঞাপনের মোড়কে নয়, তাইজুলরা বিজ্ঞাপন হয়ে থাকেন নিজেদের, দলের। সে কারণেই বড় বড় নামগুলো পারফরম্যান্স করুক বা না করুক, তাইজুলদের করতেই হয়। টেনে তুলতে হয় দলকে। তাইজুলরা ‘আলফা’ হয়ে ওঠেন না, যোদ্ধা হয়ে থাকেন অন্তরের অন্তঃস্থলে।