২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের এক গভীর রাতে ওমর আব্দুল জাব্বারদের মসুলের বাড়ির প্রধান ফটক থেকে যখন ঘন ঘন কড়া নাড়ার আওয়াজ আসছিল, তখন স্বাভাবিকভাবেই বাড়ির সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। এত রাতে আইএসের প্রহরীরা ছাড়া অন্য কেউ আসার কথা না। কিন্তু দরজা খুলে যখন তারা দেখল আইএস না, বরং আইএসের বন্দী শিবির থেকে পালিয়ে আসা এক তরুণী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে, তখনও তাদের আতঙ্ক বিন্দুমাত্র কমেনি। কারণ শহরটির জায়গায় জায়গায় তখনও জঙ্গি সংগঠন আইএসের চেকপয়েন্ট, এলাকার অনেকেই আইএসের সমর্থক। যেকোনো মুহূর্তে কেউ দেখে ফেললেই তাদের নিজেদের জীবনও হুমকির মুখে পড়তে পারে।
আইএস তথা ইসলামিক স্টেট বা দায়েশের বন্দী শিবির থেকে কারো পালানোর ঘটনা সেটাই প্রথম ছিল না। কিন্তু যারা পালানোর চেষ্টা করেছিল, তাদের অধিকাংশই দুই-এক দিনের মধ্যেই আবার ধরা পড়ে গিয়েছিল। পালিয়ে গিয়ে তারা যাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল, অনেকক্ষেত্রে তারাই আবার তাদেরকে তুলে দিয়েছিল আইএসের হাতে। কেউ সেটা করেছিল নিজেরা আইএসের সমর্থক হওয়ার কারণে, কেউ করেছিল পুরস্কারের লোভে, আর কেউ করেছিল প্রাণের ভয়ে।
কিন্তু ওমর আব্দুল জাব্বার এবং তার বাবার সামনে দাঁড়িয়ে অসহায় ইয়াজিদি মেয়েটি যখন ভয়ে কাঁপছিল, বর্ণনা দিচ্ছিল কীভাবে আইএসের জঙ্গিরা তাকে দাসী হিসেবে বারবার বিক্রি করছিল আর উপর্যুপুরি ধর্ষণ করছিল, তখন সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে তাদের একটুও দেরি হয়নি। মুহূর্তের মধ্যেই তারা সিদ্ধান্ত নেন, নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও মেয়েটিকে বাঁচাতে হবে। সেই মেয়েটি আর কেউ নন, এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নাদিয়া মুরাদ।
নাদিয়া মুরাদ হলেন সেই ইয়াজিদী কিশোরী, যিনি আইএসের বন্দী শিবির থেকে পালিয়ে আসার পর হাজার হাজার নির্যাতিতা নারীর মতো চুপ করে না থেকে সোচ্চার হয়েছিলেন আইএসের বর্বরতার বিরুদ্ধে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রচার চালিয়েছিলেন তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য। এবং তার সাহসিকতার স্বীকৃতি হিসেবেই প্রথমে তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন জাতিসংঘের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে এবং পরবর্তীতে অর্জন করেছেন নোবেল পুরস্কার। তার নির্যাতিত হওয়ার এবং সাহসী ভূমিকার গল্প গণমাধ্যমের কল্যাণে এতদিনে কারো আর অজানা নেই।
কিন্তু অধিকাংশ মানুষের কাছেই অজানা রয়ে গেছে নাদিয়ার জীবন বাঁচানো ওমর আব্দুল জব্বারের কাহিনী। মসুল ছেড়ে আইএসের চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনিই নাদিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। নাদিয়ার মতো তিনিও আইএসের হাত থেকে বাঁচার জন্য দেশ ছেড়েছিলেন। কিন্তু এরপর দুজনের পথ পুরোপুরি দুদিকে বেঁকে গেছে। নাদিয়া যেখানে হয়ে উঠেছেন সাম্প্রতিক বিশ্বের সবচেয়ে সফল প্রতিবাদী নারী, সেখানে চার বছর পর এখনও হত্যার হুমকি মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আব্দুল জাব্বার। টাইম ম্যাগাজিন অবলম্বনে এই লেখাটি ওমর আব্দুল জব্বারের দুঃসাহসিকতার এবং তার পরিণতির অজানা গল্প।
মাত্র কয়েকমাস আগেও ওমর আব্দুল জাব্বারের জীবন ছিল শান্তিপূর্ণ নির্ঝঞ্ঝাট। ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুলে সূত্রধরের কাজ করতেন তিনি। থাকতেন শহরের মধ্যবিত্ত এলাকায় একটি দোতলা বাড়িতে সপরিবারে। পরিবার বলতে তার স্ত্রী রানদা, এক পুত্র, বাবা-মা এবং ছোট চার ভাই-বোন। কিন্তু ২০১৪ সালের জুন মাসে জঙ্গি সংগঠন আইএস যখন মসুলসহ ইরাকের উত্তরাঞ্চলের বিশাল এলাকা দখল করে নেয়, তখন সমগ্র মসুলের সাথে সাথে তাদের জীবনও থমকে যায়।
সুন্নী প্রধান মসুলের মানুষের মধ্যে শিয়া প্রধান ইরাকি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ ছিল। ফলে আইএস যখন প্রথম মসুলে প্রবেশ করে, তখন তাদেরকে খুব একটা বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। কিন্তু মসুলের একাংশের সমর্থন পেলেও জনগণের অধিকাংশই ছিল আইএসের বর্বরতার বিরুদ্ধে। অনেক পরিবারই শহর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। ওমরদের পরিবারও শুরু থেকেই আইএসের কর্মকাণ্ডের বিরোধী ছিল। কিন্তু তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। তাছাড়া ওমরের স্ত্রী সে সময় ছিলেন সন্তানসম্ভবা। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তারা রয়ে গিয়েছিলেন শহরের মধ্যেই।
মসুল সুন্নী প্রধান শহর হওয়ায় সেখানকার মানুষের সাথে আইএসের আচরণ তখনও ছিল সহনীয় পর্যায়ের। কিন্তু মসুল থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরের সিনজার শহরে তারা তাদের বর্বরতার চূড়ান্ত রূপ প্রদর্শন করে। ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে তারা সিনজার আক্রমণ করে। সেখানকার হাজার হাজার ইয়াজিদি ধর্মানুসারীকে কাফের ঘোষণা দিয়ে পুরুষদেরকে হত্যা করে এবং নারী ও শিশুদেরকে দাস-দাসী হিসেবে বন্দী করে নিয়ে যায়। সে সময় ২১ বছর বয়সী নাদিয়া মুরাদ ছিলেন এই বন্দীদের মধ্যেই একজন, যার পরিবারের অন্য সদস্যদেরকে হত্যা করে তাকে দাসী হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
দাসী হিসেবে নাদিয়া একাধিকবার বিক্রি হন এবং প্রতিবারই অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু তিনি তার এ ভাগ্য মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। ফলে তিনি পালানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। প্রথমবার পালানোর চেষ্টা করে ধরা পড়ার পর তার উপর শাস্তি হিসেবে নেমে আসে গণধর্ষণ। কিন্তু তারপরেও তিনি হাল ছাড়েননি। সেপ্টেম্বরের সে রাতে দরজা খোলা পেয়ে তিনি আবারও ঝুঁকি নেন। সাহস করে বেরিয়ে আসেন মসুলের রাস্তায়। চেকপয়েন্টগুলো এড়িয়ে কয়েক ঘন্টা মসুলের অলিগলিতে ঘোরার পর উপায় না দেখে তিনি একটি বাড়ির দরজায় নক করেন। এই বাড়িটিই ছিল ওমর আব্দুল জাব্বারের বাড়ি।
গভীর রাতে দরজায় নক শুনে ওমর এবং তার বাবা ভয়ে ভয়ে দরজা খোলেন। কিন্তু তারা অবাক হয়ে দেখতে পান তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ছোটখাট গড়নের এক তরুণী, যার আপাদমস্তক কালো বোরকায় ঢাকা। মেয়েটি কাতর স্বরে তাদেরকে অনুরোধ করছিল, “আমাকে বাঁচান, ওরা আমাকে ধর্ষণ করছে।” ওমর এবং তার বাবার জন্য সেটা ছিল জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। পলাতক দাসীদেরকে ধরিয়ে দেওয়ার পুরস্কার ছিল ৫,০০০ ডলার। অন্যদিকে আশ্রয় দেওয়ার শাস্তি ছিল অত্যন্ত কঠোর, হয়তো মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু তারপরেও সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে তাদের দেরি হয়নি। কেউ দেখার আগেই তারা আস্তে করে মেয়েটিকে ঘরে ঢুকিয়ে ফেলেন।
নাদিয়াকে ঘরে লুকিয়ে রাখা ওমরদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু তাকে বের করা ছিল আরো ঝুঁকিপূর্ণ। কেউ হয়তো দেখে ফেলেছে, এরকম সন্দেহে তারা তাকে শহরের অপর প্রান্তে ওমরের বোনের বাসায় রেখে আসেন। এর মধ্যে ওমর তার এক কাজিনের মাধ্যমে নাদিয়ার নামে একটি নকল পরিচয়পত্র তৈরি করান। সেখানে নাদিয়ার নাম দেওয়া হয় সুজান এবং তার ঠিকানা হিসেবে উল্লেখ করা হয় ১৬০ কিলোমিটার দূরবর্তী শহর কিরকুকের নাম। নাদিয়ার পরিচয় হয় ওমরের স্ত্রী। নাদিয়া সারা রাত জেগে তার নতুন নাম, পরিচয়, সাজানো গল্প বারবার মুখস্ত করেন। সামান্য একটু ভুলও হতে পারে তাদের মৃত্যুর কারণ।
নির্দিষ্ট দিনে তারা মসুল ছেড়ে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু প্রথম চেকপয়েন্টেেই তাদের গাড়ি থামানো হয়। আইএস সদস্যরা গাড়ি তল্লাশি করতে শুরু করে। তারা ওমর আর নাদিয়ার কাগজপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করে এবং ওমরকে জেরা করতে থাকে- সাথে কে, কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কবে ফিরবে ইত্যাদি। গল্প আগে থেকেই সাজানো ছিল। ওমর উত্তর দেন, স্ত্রীকে নিয়ে তার বাবা-মাকে দেখতে কিরকুক যাচ্ছেন। সন্দেহজনক কিছু না পেয়ে অবশেষে আইএসরা তাদেরকে ছেড়ে দেয়।
পুরো সময়টা নাদিয়া নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে ছিলেন। কারণ চেক পয়েন্টে যখন গাড়ি থামানো হয়েছিল, তখনই তার চোখে পড়েছিল সাইনবোর্ডের উপর। সেখানে অন্য দুটি মেয়ের সাথে ওয়ান্টেড তালিকায় স্থান পেয়েছিল তার ছবিও। আইএস সদস্যরা যদি তার নিকাব সরাতে বলতো, তাহলেই হয়ত তিনি ধরা পড়ে যেতেন। কিন্তু যে কঠোর ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে আইএস তাদের অন্যায়গুলোকে বৈধতা দেয়, তার কল্যাণেই হয়তো শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী সবগুলো চেকপয়েন্টের কোনোটিতেই তাকে নিকাব সরাতে বলেনি কেউ।
শেষপর্যন্ত কোনো ঝামেলা ছাড়াই নাদিয়াকে নিয়ে আইএসের এলাকা থেকে বেরিয়ে কুর্দি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় পৌঁছেন ওমর। পরদিন সকালে ইরাকি কুর্দিস্তানের রাজধানী ইরবিলের একটি হোটেলে তিনি নাদিয়াকে তুলে দেন কুর্দি কর্তৃপক্ষের কাছে। এরপর আবার ফিরে আসেন মসুলে, নিজের পরিবারের কাছে। কিন্তু দুদিন পর আবার যখন মাঝরাতে তাদের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ার ভারী শব্দ হয়, তারা বুঝতে পারেন এবার আর পালিয়ে আসা কোনো মেয়ে না, এবার দরজায় এসেছে খোদ আইএসই, ওমরকে গ্রেপ্তার করার জন্য। কোনোভাবে তারা জেনে গেছে নাদিয়ার পালানোর কথা এবং তাকে পালাতে সাহায্য করার ব্যাপারে ওমরের ভূমিকার কথা।
ওমরের বাঁচার একটাই উপায় ছিল। জানালা দিয়ে তিনি প্রতিবেশীর বাসার ছাদে লাফিয়ে পড়েন। সেখান থেকে অন্যপাশের গলি দিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নেন এক বন্ধুর বাড়িতে। ওদিকে তার বাবা-মা অনেক বাদানুবাদের পরে আইএস সদস্যদেরকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, নাদিয়াকে পালাতে সাহায্য করার ব্যাপারে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না, যা করার ওমর একাই করেছে। আইএসের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার শাস্তি হিসেবে তারা ওমরকে ত্যাজ্য করার ঘোষণা দিয়ে সে যাত্রা নিজেদেরকে রক্ষা করেন।
ওদিকে বন্ধুর বাসায় লুকিয়ে থেকে ওমর তার কাছ থেকে এবং নিজের এক চাচার কাছ থেকে ৭,০০০ ডলার ধার করেন। তিনি তার স্ত্রী এবং পুত্রকে নিয়ে এক খালি গ্যাস ট্যাংকারের ভেতরে করে লুকিয়ে মসুল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তার গর্ভবতী স্ত্রী এবং শিশুপুত্রের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় তাদেরকে ছাড়া তিনি নিজেই মসুল ত্যাগ করেন। ততদিনে ইরাকের অন্য অনেক অংশও আইএসের দখলে চলে গেছে। ফলে ইরাক ছেড়ে ওমর প্রথমে তুরস্কে এবং পরে বুলগেরিয়ায় চলে যান। কিন্তু ওমরের বীরত্ব বা ইরাকে তার জীবনের ঝুঁকির মূল্য বুলগেরিয়ার পুলিশের কাছে ছিল না। বুলগেরিয়ায় তার স্থান হয় পুলিশ হেফাজতে।
ওমর যখন বুলগেরিয়ার জেলে, ততদিনে নাদিয়া ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন। তিনি তার দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরতে শুরু করেন, আইএস সদস্যদের বিচারের দাবি করতে শুরু করেন। ইরাক ছাড়িয়ে তার সাহসী কণ্ঠস্বর পৌঁছতে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। জার্মানির একটি সংগঠনের উদ্যোগে আইএসের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া ১,০০০ ইয়াজিদি নারীর সাথে জার্মানিতে যাওয়ার সুযোগ পান তিনি। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে তিনি নারীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হতে শুরু করেন এবং একপর্যায়ে জাতিসংঘের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে নিয়োগ পান।
একই সময়ে বুলগেরিয়ার জেল থেকে মুক্ত হয়ে জার্মানিতে যাওয়ার সুযোগ পান ওমর আব্দুল জাব্বারও। কিন্তু তার অভিজ্ঞতা ছিল নাদিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইরাকে তার জীবন নিরাপদ না, এই অযুহাতে তিনি জার্মানিতে আশ্রয় প্রার্থনা করেন ২০১৫ সালের মার্চ মাসে। কিন্তু সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও সে আশ্রয় তিনি পাননি। জার্মানি তাকে অস্থায়ী ভিসা প্রদান করেছে, কিন্তু এ বছর সেই ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ভাগ্যে কী ঘটবে, সেটা এখনও জানেন না ওমর।
বর্তমানে ওমর থাকেন জার্মানির তোরগাউ শহরে এক রুমের একটি অ্যাপার্টমেন্টে। সেখান থেকে প্রতিদিন ভিডিও কলে মসুলে পরিবারের সাথে কথা বলেন তিনি। তার স্ত্রী রানদা তার ছোট ছেলে ইয়াহইয়াকে ফোনের স্ক্রিনের সামনে দাঁড় করিয়ে বলেন, “বাবাকে হাই বলো”। কিন্তু তিন বছর বয়সী ইয়াহইয়া কিছু বলে না, শুধু স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবার সামনে সে অস্বস্তি বোধ করে। জন্মের পর থেকে তার বাবার সাথে তার কখনো সরাসরি দেখাই হয়নি। মাঝেমাঝে সে পাল্টা প্রশ্ন করে, “তুমি কি আমার বাবা?”
মসুল আইএস মুক্ত হয় ২০১৭ সালে, কিন্তু অনেক ধ্বংসযজ্ঞের বিনিময়ে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর আক্রমণে মসুলের একটা বড় অংশ পরিণত হয় ধ্বংস্তুপে। আইএসের উপর আক্রমণ করতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এং ইরাকি সেনাবাহিনী শহরের ভেতরে থাকা বেসামরিক জনগণকে রক্ষা করার খুব বেশি চেষ্টা করেনি। শহরের এক প্রান্তে যে বাড়িটিতে ওমর শেষ কয়দিন নাদিয়াকে লুকিয়ে রেখেছিলেন, আইএসের ঘাঁটি সন্দেহে সেই বাড়িটির উপরেও বিমান হামলা চালায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নিহত হয় ওমরের বোনসহ তার সম্পূর্ণ পরিবার।
ওমরের স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা এবং ভাই-বোনেরা এখনও নিরাপদে আছেন, কিন্তু তারা এখনও আইএসের প্রতিশোধের ভয়ে ভীত। আনুষ্ঠানিকভাবে ইরাক আইএস মুক্ত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু স্থানীয় যেসব যুবকরা আইএসে যোগ দিয়েছিল, তাদের সবাই নিহতও হয়নি, গ্রেপ্তারও হয়নি। অনেকেই এখনও আত্মগোপনে আছে। তাদের স্লীপার সেলগুলো এখন সুপ্ত আছে। ওমরের পরিবারের ভয়, সুযোগ পেলেই তারা হয়তো ওমরের উপর এবং তাদের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে।
তাদের ভয় খুব একটা অমূলকও না। ওমরকে ধরতে যে প্রথমবার আইএস অভিযান চালিয়েছিল, সেটা ওমরের পরিচিত স্থানীয় কারো দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই চালিয়েছিল। নাদিয়াকে নিয়ে ওমর যখন কুর্দিস্তানে প্রবেশ করেছিলেন, তখন কুর্দি গোয়েন্দারা তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় ভিডিও ধারণ করেছিল। পরে সেই ভিডিও তারা স্থানীয় টিভি চ্যানেলে প্রচার করে। ওমরের চেহারা যদিও তারা অস্পষ্ট করে দিয়েছিল, কিন্তু মসুলে ওমরের পরিচিত কেউ তাকে চিনে ফেলে আইএসকে জানিয়ে দেওয়ার ফলেই তারা এত তাড়াতাড়ি তার বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে পেরেছিল। সেই ভয় ওমরের পরিবারের এখনও আছে।
ওদিকে জার্মানিতে বসেও ওমর নিরাপদ নেই। গত বছরও তার মোবাইল ফোনে মেসেজে হুমকি এসেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, আইএস জানে তিনি কোথায় আছেন এবং তারা তার উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আসছে। ওমর মোবাইল নাম্বার পাল্টে ফেলেছেন, কিন্তু তার আতঙ্ক কাটেনি। ক্লাস ছাড়া বাইরে কোথাও যাওয়ার সাহস পান না তিনি। স্ত্রী-পরিবার ছাড়া হতাশাময়, একঘেঁয়ে জীবন কাটে তার। তার এক বন্ধুর বর্ণনা অনুযায়ী, অন্তত দুবার তিনি ওমরকে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত থেকে ফিরিয়ে এনেছেন।
তারপরেও ওমর আব্দুল জাব্বার তার সেই রাতের সিদ্ধান্ত নিয়ে আফসোস করেন না। তিনি মনে করেন, নাদিয়াকে বাঁচানোর জন্য তিনি যা করেছেন, সেটাই ঠিক ছিল। তিনি বলেন, নাদিয়ার এবং তার পরিবারের জীবিত সদস্যদের মুখে এখন যে হাসি, তার জন্য যে কারোই উচিৎ ছিল তার জীবন রক্ষা করা।