কিছু মানুষ নাকি পৃথিবীতে আসে ‘ফাটা কপাল’ নিয়ে। অভাগার মতো তারা যেখানে যান সেখানে সাগর, মহাসাগর সব শুকিয়ে যায়, ফুটন্ত গোলাপের পাপড়িগুলোও ঝরে যায়, হাস্যোজ্বল সূর্যটিও গোমড়ামুখো মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়! কে জানে প্রবাদের সেই অভাগাটি ক্যারোলিনই ছিলেন কি না। কিংবা ক্যারোলিনের জন্যই সে প্রবাদ প্রচলিত হয়েছিল কি না! নয়তো শৈশবেই তার কপালে এত দুর্ভোগ কেন?
ক্যারোলিন ছিলেন তার ভাইবোনদের মাঝে কনিষ্ঠতম। কনিষ্ঠ সন্তানের আদর সাধারণত বেশি হয়। কিন্তু কনিষ্ঠ সন্তান যখন সংসারে ৮ম অতিথি, তখন ব্যাপারটা ভিন্ন হয় বৈকি। ক্যারোলিনের ব্যাপারেও তা-ই হয়েছিল। তার পূর্বেই আরো ৭ সন্তানের ভরণপোষণ করে তার মা আনা যেন ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। ক্যারোলিনের কপালে তাই দত্তক সন্তানের মতোই আদর জুটলো। শিশু ক্যারোলিন বড়জোর কয়েকমাসই মাতৃদুগ্ধ পান করতে পেরেছিলেন। সে আদর আরো কমে গেল যখন তার জন্মের পরপরই পরিবার অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল হয়ে পড়লো।
৩ বছর বয়সে ক্যারোলিন স্মলপক্সে আক্রান্ত হন। আরোগ্য লাভ করার পরও তার চেহারায় থেকে গেল কালো কালো দাগ। এই দাগ যেন ক্যারোলিন নিজে বয়ে এনেছিলেন, এমনই ছিল আনার ধারণা। ক্যারোলিনের বাবা আইজ্যাক মেয়েকে শিক্ষিত করার জন্য মনস্থির করলেও আনার তাতে ছিল ভয়ানক আপত্তি। একে তো মেয়েমানুষ, তার অত পড়ালেখা করে কাজ নেই! উপরন্তু চেহারায় তার পক্সের দাগ পড়ে আছে, লোকে কী বলবে? ফলে চার দেয়ালের মাঝে বাবার এনে দেয়া বর্ণপরিচয়ের বইগুলোই ছিল ক্যারোলিনের শৈশবের জ্ঞানচর্চার সঙ্গী।
এরপর ১১ বছর বয়সে তাকে এক ভয়ানক টাইফাস জ্বর পেয়ে বসে। এ জ্বরে তার দেহের বিকাশই বন্ধ হয়ে যায়। মাত্র ৪ ফুট ২ ইঞ্চিতে আটকে যায় তার উচ্চতা। এরপর তো আনা মোটামুটি নিশ্চিতই হয়ে গিয়েছিলেন যে, এই মেয়ে সাক্ষাৎ অলক্ষুণে! লেখাপড়া করাবেন কী, ৪ ফুট উচ্চতার চেহারায় দাগ হওয়া মেয়েকে বিয়ে দেবেন কী করে, সে চিন্তা থেকেই বেরোতে পারতেন না তিনি। ফলে মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন তিনি। ক্যারোলিনের বিয়ে-সংসার কিছুরই প্রয়োজন নেই, সে আজীবন পারিবারিক গার্হস্থ সেবক হয়েই থাকবে, এটাই ছিল তার সিদ্ধান্ত!
আইজ্যাক যখন মারা যান, ক্যারোলিনের বয়স তখন সবে ১২ বছর। বাবার মৃত্যুতে তার ভবিষ্যৎ যেন পুরোপুরি অন্ধকারেই নিমজ্জিত হয়ে গেল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে, বাবা ছাড়াও ক্যারোলিনকে ভালোবাসতেন আরো একজন। তিনি হলেন তার বড় ভাই (ভাইবোনদের মধ্যে ২য়) উইলিয়াম হার্শেল। শৈশব থেকেই ক্যারোলিনের সাথে যে অবিচার হয়ে আসছিল, তা মেনে নিতে পারেননি উইলিয়াম। কিন্তু নিজে প্রতিষ্ঠিত না হয়ে কিছু করতেও পারছিলেন না ছোট বোনের জন্য।
পারিবারিক সেবক (কিংবা দাসীও বলা চলে!) হিসেবে ক্যারোলিনের ভবিষ্যৎ যখন নির্ধারিত হয়ে গেছে, উইলিয়াম তখন অন্ধকারাচ্ছন্ন টানেলের অপর প্রান্তে ক্ষীণ আলোর রেখা হয়ে দেখা দিচ্ছেন। ইংল্যান্ডের বাথ শহরে গিয়ে কয়েকবছর ছোটখাট কাজ করে, খেয়ে না খেয়ে সঙ্গীত চর্চা করেন এবং অর্গ্যান বাজানো শেখেন তিনি। এরপর অর্গ্যানবাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। অবশেষে তিনি একটি চার্চের অর্গ্যানবাদক হিসেবে ভালো বেতনে নিযুক্ত হন। পাশাপাশি সঙ্গীতের শিক্ষক হিসেবেও টাকাকড়ি আয় করতে শুরু করেন। ক্যারোলিনের ব্যাপারে মায়ের সিদ্ধান্ত জানার পর তিনি জার্মানি ভ্রমণ করে ক্যারোলিনকে নিজের সাথে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। আনা মেয়েকে ছাড়তে রাজি হয়েছিলেন ঠিকই, তবে মাসে মাসে দাসীর খরচ প্রেরণ করবার শর্তে!
ইংল্যান্ডে ক্যারোলিন যখন জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করেন, তখন কেটে গেছে তার জীবনের ২২ বছর। না পড়ালেখা, না নাচ-গান, না ধর্মীয় শিক্ষা, কোনোকিছুই ঠিকঠাক শেখা হয়নি তার এই ২২ বছরে। ইংল্যান্ডে গিয়ে তো সবার প্রথমে তাই ভাষার সমস্যায় পড়তে হয় তাকে। কারণ ইংরেজিটাও তো শেখা হয়নি ঠিকমত। অবশ্য উইলিয়ামের মতো ভাই থাকলে যে কেউ নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতেই পারেন। উইলিয়াম প্রতিদিন সকালে ও রাতে ক্যারোলিনকে পড়াতে শুরু করলেন। রাতে ইংরেজি শিক্ষা আর সকালবেলা নাস্তার আগে ঘন্টাখানেক অংক করা, এভাবেই চলতে লাগলো ক্যারোলিনের দিনকাল।
ভাইয়ের কল্যাণে দ্রুতই ইংরেজি ভাষা রপ্ত করে নিলেন ক্যারোলিন। গণিতও শিখতে লাগলেন তরতরিয়ে। এবার তার মাঝে অন্যান্য গুণের ছোঁয়া দিতে চাইলেন উইলিয়াম। নিজে বাড়িতে গান শেখালেন আর নাচ শেখার জন্য ভর্তি করে দিলেন নাচের স্কুলে। ২২ বছর পর্যন্ত যে নারী ছিলেন পৃথিবীর তাবৎ বিষয়াদি সম্পর্কে অজ্ঞ, ২৭ বছরে পা রেখে তিনি হয়ে ওঠেন ভালো নর্তকী, গায়িকা এবং গণিত শিক্ষায় পারদর্শী। ক্যারোলিন আধুনিককালে থাকলে ‘ফাইভ ইয়ার্স চ্যালেঞ্জ’-এ নিশ্চিতভাবেই সেরা বিস্ময় হতেন!
এদিকে ক্যারোলিন যখন সঙ্গীতে পারদর্শী হয়ে উঠছেন, উলিয়ামের ঝোঁক তখন সঙ্গীত ছেড়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানমুখী। কোনো কারণে তার মনে হতে লাগলো যে আকাশটাকে তিনি অন্যদের চেয়ে একটু বেশিই জানেন, ভালোভাবে বোঝেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, আকাশে এমন কিছু আবিষ্কার করবেন যার কথা কেউ আগে শোনেনি। এর জন্য তার প্রয়োজন ছিল একটি শক্তিশালী টেলিস্কোপের। সে টেলিস্কোপ তিনি নিজ হাতেই তৈরি করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। টেলিস্কোপ নিয়ে কিছুকাল তিনি এতোটাই মগ্ন ছিলেন যে ক্যারোলিন নিজ হাতে খাইয়ে না দিলে খেতে ভুলে যেতেন তিনি!
১৭৮১ সালের মার্চ মাসে নিজের তৈরি টেলিস্কোপ দিয়ে সৌরজগতের ৭ম (আবিষ্কারের সময় অনুযায়ী) গ্রহ ইউরেনাস আবিষ্কার করেন উইলিয়াম। বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, এ গ্রহগুলোর নাম তো মানুষ প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই জানতো। সে হিসেবে ইউরেনাসের আবিষ্কার বিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি বৈপ্লবিক ঘটনা। অথচ ইউরেনাস খালি চোখেই দেখা যায় পৃথিবী থেকে! খালি চোখে দেখা যায়, এমন একটি গ্রহ আবিষ্কার করতেই এতদিন লেগে গেল, তাহলে মহাকাশে আরো কত বিস্ময় লুকিয়ে আছে, তা ভাবতেই দিশেহারা হয়ে পড়েন উইলিয়াম। এদিকে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা তৎকালীন রাজা তৃতীয় জর্জের কাছে আবেদন করেন উলিয়ামকে সরকারি ভাতা প্রদানের জন্য। রাজা সে আবেদনে সাড়া দেন যেন অর্থ উপার্জনের জন্য সঙ্গীত চর্চা না করে পুরো সময়টা উইলিয়াম গবেষণায় দিতে পারেন।
রাজভাতায় একজন পূর্ণকালীন জ্যোতির্বিদ হিসেবে কাজ করবার জন্য ছোটবোন ক্যারোলিনকেই নিজের সহযোগী হিসেবে মনোনীত করেন উইলিয়াম। তবে, গায়িকা হিসেবে ততদিনে বাথ শহরে বেশ নাম কামিয়েছেন ক্যারোলিন। তাই তাকে গান ছেড়ে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চায় আসতে বলার সাহস পাচ্ছিলেন না তিনি। অন্যদিকে, ভাইয়ের সাথে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার সাধ জাগে ক্যারোলিনের মনেও, কিন্তু জ্যোতির্বিদ্যায় নিজের দক্ষতা না থাকায় সে কথা বলতে তিনি সাহস পাচ্ছিলেন না! অবশেষে ক্যারোলিনই প্রথমে তার মনের কথা ভাইকে জানান। ক্যারোলিনের মুখে এ কথা শোনার পর হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়েছিলেন উইলিয়াম।
জ্যোতির্বিদ হিসেবে প্রথমে ক্যারোলিনের শুরুটা সাদামাটাই ছিল। ভাইয়ের টুকটাক কাজে সহায়তা করে, অবসর সময়ে টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশপানে অলস দৃষ্টি মেলে সময় কাটাতেন তিনি। কিন্তু এই অলস দৃষ্টিই তাকে ঈর্ষণীয় সাফল্য এনে দেয়। মোট ৮টি ধূমকেতু আর ১৪টি নীহারিকা আবিষ্কারের সাথে নাম জড়িয়ে যায় তার, যার মাঝে ৪টি ধূমকেতু এবং ৬টি নীহারিকা ছিল তার একক আবিষ্কার! এর মাঝে পর্যায়ক্রমিক ধূমকেতু ৩৫পি-হারশেল বিখ্যাত, যেটি ২০৯২ সালে আবার পৃথিবীর আকাশে দেখা যাবে।
১৭৮৩ সালে উইলিয়াম ৬.১ মিটার দৈর্ঘ্যের এক অসাধারণ টেলিস্কোপ তৈরি করেন, যা তার সময়ে সবচেয়ে উন্নত এবং সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ ছিল। এই টেলিস্কোপ দিয়ে উইলিয়াম আর ক্যারোলিন নিরন্তর আকাশ দেখেছেন। কখনো ক্যারোলিন পর্যবেক্ষণ করেছেন আর উইলিয়াম সেগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন। কখনো আবার উইলিয়ামের পর্যবেক্ষণকে সাজিয়ে গুছিয়ে, প্রয়োজনীয় হিসাব নিকাশ যোগ করে কাগজে স্থায়ী করেছেন ক্যারোলিন। আনুষ্ঠানিকভাবে ক্যারোলিন উইলিয়ামের সহযোগী হলেও কর্মক্ষেত্রে তারা দুজনেই দুজনার পরিপূরক ছিলেন। ২০ বছর নিরলস পর্যবেক্ষণ করে তারা ২৪০০’র অধিক নীহারিকা আবিষ্কার করেন এবং ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ জুটি হিসেবে নিজেদের নাম লেখান।
শৈশবের দুর্ভাগ্যকে পেছনে ফেলে আসা ক্যারোলিন সাফল্যের প্রথম স্বীকৃতি পেয়েছিলেন রাজা তৃতীয় জর্জের কাছেই। রাজা তাকে একজন পূর্ণকালীন জ্যোতির্বিদ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেন। আর তাতেই পৃথিবীর প্রথম পেশাদার নারী জ্যোতির্বিদ হিসেবে নাম লেখান তিনি। তার জীবনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য ছিল ‘ব্রিটিশ ক্যাটালগ অব স্টার্স’ এর ত্রুটি সংশোধন করা। এই ত্রুটি সংশোধনের কিছুকাল পরই তিনি অবসর গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভালোবাসা তাকে আবারো ফিরিয়ে এনেছিল। তার ভ্রাতুষ্পুত্র জন হার্শেল নীহারিকার একটি হালনাগাদ তালিকা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। জনকে সহায়তা করার জন্য তিনি মহাযজ্ঞ হাতে নেন। প্রচলিত শ্রেণীভিত্তিক নীহারিকার তালিকাকে পুনরায় অবস্থানের ভিত্তিতে সাজান তিনি। তখন তার বয়স ৭৫! এ কাজের জন্য তিনি ব্রিটিশ রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির স্বর্ণপদক লাভ করেন। তাকে প্রুসিয়ার রাজাও একটি বিশেষ স্বর্ণপদকে ভূষিত করেছিলেন।
ক্যারোলিন লুক্রেশিয়া হার্শেলের জন্য ১৭৫০ সালের ১৬ মার্চ জার্মানির হ্যানোভার শহরে। তিনি কোনোদিন বিয়ে করেননি। ভাইয়ের অনবরত অনুরোধেও বিয়ের প্রতি তার মনে আকর্ষণ জাগেনি। ১৮২২ সালে উইলিয়ামের মৃত্যুর পর তিনি জন্মস্থান জার্মানির হ্যানোভারে ফিরে যান এই ভেবে যে, খুব শীঘ্রই তিনিও মারা যাবেন। অথচ এরও আরো কয়েকবছর পর তিনি নীহারিকার তালিকা পুনর্বিন্যাসের মতো গুরুভার কাজ করেছেন। জন্মের পরই যিনি যাবতীয় অনীহা আর বঞ্চনার শিকার হয়েছেন, সেই ক্যারোলিন হার্শেল ১৮৪৮ সালের ৯ জানুয়ারি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষদের একজন হিসেবে সন্তুষ্টচিত্তে পৃথিবী ত্যাগ করেন।