১৯৩৮ সাল। জার্মানির মোট ইহুদী জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ হাজারই পোলিশ-ইহুদী। নাৎসী সরকার তখন প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে জার্মানিকে ইহুদীমুক্ত করার জন্য। সরকার ঠিক করল পোলিশ-ইহুদীদের জোর করে পোল্যান্ডে ফেরত পাঠানো হবে। কিন্তু তাতে সায় দিল না পোল্যান্ড। ২৮ অক্টোবর, ১৯৩৮ সালে গেস্টাপো পুরো জার্মানিতে থাকা পোলিশ-ইহুদীদের একসাথে জড়ো করে পোল্যান্ড-জার্মান সীমান্তের পোল্যান্ড অংশে ছেড়ে দিয়ে আসল। খাবার, পানি, আশ্রয় ইত্যাদির অভাবে হাজার হাজার ইহুদী ধুঁকে ধুঁকে মারা গেল।
১৭ বছর বয়সী ইহুদী তরুণ হার্শাল গ্রিন্সজপ্যান তখন ফ্রান্সে পড়ালেখা করছে। জানতে পারল, তার মা-বাবাকেও একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। নভেম্বরের সাত তারিখ হার্শাল প্যারিসের জার্মান দূতাবাসের তৃতীয় সেক্রেটারি আর্নেস্ট ভম রাথকে গুলি করল। দুদিন পর, অর্থাৎ নভেম্বরের ৯ তারিখ রাথ মৃত্যুবরণ করলেন। আর সেই মৃত্যুর সাথে সাথে জার্মানির ইহুদীদের ভাগ্যেও এক ভয়ংকর দুর্যোগ নেমে এল। নাৎসী সরকারের প্রচারণা মন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলস সেদিনই সমগ্র জার্মানির ইহুদীদের বিরুদ্ধে বদলা ঘোষণা করলেন। শুরু হলো সহিংসতা। ইহুদী ধর্মালয়গুলো সাম্প্রদায়িক আগুনে পুড়তে লাগল। ইহুদী দোকানগুলো ভেঙে ফেলা হলো। ইহুদীরা মরলো, ধর্ষিত হলো, গ্রেপ্তার হলো। আর সবকিছুই হলো পুলিশের ছত্রছায়ায়। ‘ভাঙা কাঁচের রাত’ বা Night of Broken Glass [জার্মান ভাষায়, ক্রিস্তালনাহ্ত (Kristallnacht)] নামে পরিচিত দুদিন-দুরাত ধরে চলা এই সহিংসতায় প্রায় ৯১ জন ইহুদী প্রাণ হারাল।
ক্রিস্তালনাহ্ত-এর ঠিক কয়েক মাস আগে জনৈক জার্মান-ইহুদী দম্পতি লুইস ও পলা কিসিঞ্জার তাদের দুই পুত্র হেইঞ্জ আলফ্রেড কিসিঞ্জার ও ভালতার কিসিঞ্জারকে নিয়ে জার্মানি ছেড়ে পাড়ি জমান ইংল্যান্ড হয়ে আমেরিকায়। সেদিন কিসিঞ্জার পরিবার প্রাণে বেঁচে যাওয়ায় পরবর্তীতে বিশ্ব পেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত রাজনৈতিক, কূটনৈতিককে। চলুন পাঠক, জেনে আসা যাক এক ইহুদী উদ্বাস্তু হেইঞ্জ আলফ্রেড কিসিঞ্জার থেকে তামাম দুনিয়ার রাজনৈতিক হিসেবের অংক বদলে দেওয়া দুর্ধর্ষ কূটনীতিবিদ হেনরি কিসিঞ্জারের হেনরি কিসিঞ্জার হয়ে ওঠার গল্প।
প্রাথমিক জীবন
জন্মেছিলেন নাৎসি জার্মানিতে ১৯২৩ সালের ২৭ মে। অর্থাৎ ১৫ বছর বয়সেই তাকে পরিবারসহ মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে ভিনদেশের উদ্দেশে পাড়ি জমাতে হয়। কিসিঞ্জার পরিবার নিউ ইয়র্কে থিতু হন। পরিবারের আর্থিক অবস্থা তখন নিতান্ত করুণ, তাই বাধ্য হয়ে কিশোর কিসিঞ্জারকে শেভিং ব্রাশের ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করতে হয়। পাশাপাশি অবশ্য তিনি জর্জ ওয়াশিংটন হাই স্কুলে নিয়মিত রাত্রীকালীন পড়া চালিয়ে গিয়েছিলেন।
সিটি কলেজ অভ নিউ ইয়র্কে পড়ার সময় ১৯ বছর বয়সে কিসিঞ্জারকে বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য। প্রথমে তিনি ফ্রান্সে একজন রাইফ্যালম্যান এবং পরে জার্মানিতে জি-টু ইন্টেলিজেন্স অফিসার হিসেবে কাজ করেন। ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি সেনাবাহিনীর কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স কোরের সাথে কাজ করেন।
বিশ বছর বয়সে নিজের নাম পাল্টে হেইঞ্জ কিসিঞ্জার থেকে হয়ে যায় হেনরি কিসিঞ্জার। সাথে সাথে জুটে যায় মার্কিন নাগরিকত্বও।
১৯৪৭ সালে কিসিঞ্জার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে ভর্তি হন হার্ভার্ড কলেজে। তিনবছর পর সেখান থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডিস্টিংশন সহ গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে চলে যান উচ্চতর শিক্ষার জন্য। সেখানে ১৯৫২ সালে মাস্টার্স ডিগ্রী এবং ১৯৫৪ সালে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন।
বিতর্কিত রাজনৈতিক জীবন
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সেমিনার পরিচালনার সুবাদে কিসিঞ্জারের সাথে অনেক আন্তর্জাতিক নেতাদের পরিচয় হয়। রকফেলার ব্রাদার্স-এর সাথেও কাজ করেছেন কিসিঞ্জার। ১৯৫৭ সালে তিনি হার্ভার্ডের লেকচারার এবং ১৯৬২ সালে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি হার্ভার্ডে পূর্ণকালীন শিক্ষকতা করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে ভিয়েতনাম বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হিসেবে যোগ দেন। পঁয়ষট্টি থেকে সাতষট্টি সালের মধ্যে তিনি বেশ কয়েকবার ভিয়েতনাম ভ্রমণ করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি রিপাবলিকান মনোনয়নপ্রার্থী নেলসন রকফেলারের হয়ে কাজ করেন, যদিও রকফেলার সেবার নিক্সনের কাছে পরাজিত হন। রিচার্ড নিক্সন প্রেসিডেন্ট হয়ে রকফেলারের অনুরোধে হেনরি কিসিঞ্জারকে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান হিসেবে নিয়োজিত করেন।
নতুন কর্তৃত্ব পেয়েই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন হেনরি কিসিঞ্জার। ঐ সময়ের যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্ক নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না তিনি। কিসিঞ্জারের মনে হয়েছিল, সোভিয়েত প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল আত্মবিরোধী এবং অতিরিক্ত মাত্রায় বন্ধুসুলভ। যদিও কিসিঞ্জার সোভিয়েত ইউনিয়নকে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান শত্রু হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন, তবুও সোভিয়েত ইউনিয়ন পরাশক্তি হিসেবে তার কাছে সমীহযোগ্য মনে হয়েছিল। কিসিঞ্জার সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করেন, যেটা ডেটান্ট (détente) নামে পরিচিত। তার প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কৌশলগত অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি (SALT) সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির অধীনে দেশ দুটি তাদের পরমাণু অস্ত্রসম্ভার কমানোর ব্যাপারে একমত হয়। তিন বছরের দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ মস্কোতে চুক্তিটি স্বাক্ষর করেন।
হেনরি কিসিঞ্জারের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর সাথে ভিয়েতনাম জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। ভিয়েতনামের যুদ্ধে দক্ষিণ ভিয়েতনামের পক্ষে যুদ্ধে নেমেছিল আমেরিকা। ভিয়েতনাম প্রসঙ্গে হেনরি কিসিঞ্জারকে যুদ্ধাপরাধী আখ্যা দিয়েছেন অনেক সমালোচক।
ভিয়েনামে তখন চরম যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, কাতারে কাতারে তরতাজা মার্কিন তরুণের লাশ পড়ছে ভিয়েতনামের পথে-ঘাটে। সরকারের তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই বরং অনিচ্ছুক তরুণদেরকে বাধ্য করা হচ্ছে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বা যুদ্ধে যেতে। হেনরি কিসিঞ্জার এই সময় বারদুয়েক ভিয়েতনাম সফর করে উত্তর ভিয়েতনামের নেতাদের সাথে শান্তিচুক্তির প্রচেষ্টার চালান। উত্তর ভিয়েতনাম থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করার আহ্বান জানানো হলে কিসিঞ্জারের সরাসরি মদদে প্রেসিডেন্ট নিক্সন উত্তর ভিয়েতনামে এয়ার স্ট্রাইকের আদেশ দেন।
শুধু এটুকু করেই ক্ষান্ত হননি কিসিঞ্জার, গোপনে তিনি কম্বোডিয়ার কম্যুনিস্ট ঘাঁটিগুলোতে বোমাবর্ষণের নির্দেশ দেন। কম্বোডিয়ায় কার্পেট বম্বিং চালায় মার্কিন বিমানবাহিনী। প্রায় ২.৭ মিলিয়ন টনের সমপরিমাণ বোমা বর্ষণ করা হয় লাওস ও কম্বোডিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে। পুরো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও এত পরিমাণ বোমা ব্যবহার করা হয়নি। দেড় লক্ষের মতো নাগরিক নিহত হলেও কিসিঞ্জার এই সংখ্যাটিকে পঞ্চাশ হাজার বলে উল্লেখ করেন। পরে কংগ্রেসের হস্তক্ষেপে এই সিক্রেট বম্বিং বন্ধ হয়।
উত্তর ভিয়েতনামের নেতা লি ডাক থো’র সাথে শান্তি আলোচনার ফলাফল হিসেবে ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে প্যারিস শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে টাইম ম্যাগাজিনের ‘ম্যান অভ দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হন হেনরি কিসিঞ্জার।
কিসিঞ্জারের অনেক সমালোচকের মতে, তার কারণেই ভিয়েতনামের যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়েছিল, কম্বোডিয়া পর্যন্ত যুদ্ধ বিস্তৃত হয়েছিল এবং কম্বোডিয়ায় খেমার রুজের উত্থান ঘটেছিল।
খোদ ঘরের পাশের মহাদেশ দক্ষিণ আমেরিকাকেও ছাড়েননি কিসিঞ্জার। চিলির প্রেসিডেন্ট সালভাদর অ্যালেন্দেকে উৎখাতেও ইন্ধন যুগিয়েছিলেন কিসিঞ্জার। ‘কট্টর মার্ক্সবাদী’ সন্দেহে অ্যালেন্দে মার্কিন নেতাদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন। তাকে সরাতে চিলিতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে ১৯৭৩ সালে। আর সেই অভ্যুত্থানের পেছনে বাইরে থেকে কলকাঠি নাড়ে কিসিঞ্জারের আমেরিকা। অ্যালেন্দের স্থলাভিষিক্ত হন মার্কিনমুখী সেনাপ্রধান অগাস্তো পিনোচেত। পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি নিয়ে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানেও কিসিঞ্জার ভূমিকা রেখেছিলেন। এছাড়া আর্জেন্টিনা, সাইপ্রাস, পূর্ব তিমুর ইত্যাদি দেশের সাথেও বিভিন্ন ন্যাক্কারজনক ঘটনায় জড়িত ছিলেন তিনি।
১৯৭৩ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন হেনরি কিসিঞ্জার। এই সময় তার ইচ্ছাতেই যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে পরিবর্তন আসে। ‘শাটল ডিপ্লোম্যাসি’ (একাধিক রাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনা) নামে পরিচিত এই কূটনৈতিক প্রয়াসে কিসিঞ্জার তৃতীয় ব্যাক্তি হিসেবে আরব দেশগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসন সম্পর্কিত আলোচনায় সহায়তা করেন। এই লক্ষ্যে কিসিঞ্জার মিশর, ইজরায়েল, সিরিয়া ইত্যাদি আরবদেশে অনেকবার চক্কর দিয়েছিলেন। প্রায় এগার বার এরকম ‘শাটল মিশন’ পরিচালনা করেন কিসিঞ্জার, যার মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ মিশনটির স্থায়িত্ব ছিল একমাসের মতো।
চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন: বলির পাঁঠা বাংলাদেশ
ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যকার সুসম্পর্কই কিসিঞ্জারকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তিনি ভেবেছিলেন এতে করে উপমহাদেশে সোভিয়েত প্রভাব মারাত্মক বেড়ে যাবে। তাই এই সমস্যা সমাধানে চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর এসব কিছু হয়েছিল কিসিঞ্জারের তত্ত্বাবধানে।
চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়নের ঘটনাটি রিয়ালপলিটিকের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। রিয়ালপলিটিক (realpolitik) হচ্ছে এমন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যেখানে কাগজ-কলমের তত্ত্বের চেয়ে রাজনীতির বাস্তবিক প্রয়োগকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। ‘পিংপং ডিপ্লোম্যাসি’ খ্যাত এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পেছনে মূল কলকাঠি নাড়েন কিসিঞ্জার। পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সহযোগিতায় হেনরি কিসিঞ্জার গোপনে চীন ভ্রমণ করে চীনে নিক্সনের জন্য একটি সরকারি ভ্রমণের ব্যবস্থা করেন, যার ফলশ্রুতিতে নিক্সন ১৯৭২ সালে চীন ভ্রমণ করেন।
চীন-যুক্তরাষ্ট্রের এই সম্পর্ক উন্নয়ন দুই দেশের নেতারাই অনেকদিন থেকে মনে-প্রাণে চেয়ে আসছিলেন। ফলে ১৯৭১ সালে যখন সুযোগটি এলো আর সেখানে পাকিস্তানের সহায়তা ছিল (রোমানিয়ার সরকারও যুক্ত ছিল) তখন নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি মার্চ মাসে পাকিস্তানের বর্বর গণহত্যার বিষয়টিকে নীরবে সমর্থন দিয়ে এলেন। এমনকি আর্চার কে. ব্লাড যখন ২৫শে মার্চের ধ্বংসযজ্ঞকে সরাসরি গণহত্যা বলে অভিহিত করে ওয়াশিংটনে তারবার্তা পাঠান, যেটি ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামে খ্যাত, সেটি সম্পূর্ণভাবে শুধু এড়িয়ে গিয়েই ক্ষান্ত হননি নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি, বরং বাংলাদেশে গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় ব্লাডকে তার ঢাকা অফিস থেকে অব্যাহতি দিয়ে ওয়াশিংটনে স্থানান্তর করা হয়। ঐ সময় দিল্লিতে থাকা মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিটিং পাকিস্তানি গণহত্যার বিরুদ্ধে কথা বললে ‘তার মাথা ভারতীয়রা গুলিয়ে খেয়েছে’ বলে অভিযোগ করেন কিসিঞ্জার। নিজেদের জাতীয় স্বার্থে মানবতাকে প্রকারান্তরে বুড়ো আঙুল দেখান কিসিঞ্জার-নিক্সন জুটি।
২০০৭ সালের ১ এপ্রিল হেনরি কিসিঞ্জারের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন সাংবাদিক কাজী ইনসানুল হক। সরাসরি কিসিঞ্জারকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী বলে প্রশ্ন তোলেন তিনি। আত্মপক্ষ সমর্থন করে কিসিঞ্জার বলেন, “…বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে নয়, ভারতীয় অগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের পলিসি ছিল, যাতে ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে না পড়ে।” কিন্তু এই কিসিঞ্জারই যুদ্ধের শেষ দিকে বঙ্গোপসাগরে ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ পাঠানোর সরাসরি নির্দেশ দেন।
কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ (Bottomless Basket) বলেছেন কি না এই নিয়ে বিতর্ক আছে। বেশিরভাগ তথ্য প্রমাণ নির্দেশ করে যে, তিনি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এই শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেননি, বরং তিনি পরোক্ষভাবে ‘বাস্কেট কেইজ’ (Basket Case) বলেছিলেন। কোনো কারণে এটি বিকৃত হয়ে প্রচারিত হয়েছে। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউজের সিচুয়েশন রুমে ইউএসএইড (USAID)-এর সহকারী প্রশাসক মরিস জে. উইলিয়ামস এর সাথে এক কথোপকথনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রথমবারের মতো বাস্কেট কেইজ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয়। বাস্কেট-কেইজ শব্দটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে প্রচলিত হয়। এটি একটি সামরিক অপভাষা (Slang)। যেসকল সৈন্য যুদ্ধে তাদের চারটি হাত-পা-ই হারিয়েছে তাদেরকে বাস্কেট কেইজ বলে অভিহিত করা হতো। স্বাভাবিকভাবেই এরকম আহত সৈনিকরা পুরোপুরি পরনির্ভরশীল ছিল। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি এমন করুণ ছিল যে কিসিঞ্জার হয়তো ভেবেছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে আর স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব ছিল না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় হেনরি কিসিঞ্জার ইন্দিরা গান্ধীর ওপর নাখোশ ছিলেন। এমনকি তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করেন এবং ভারতীয়দের ‘হারামি’ বলে অভিহিত করেন। অবশ্য পরে তিনি তার মন্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন।
নোবেল পুরস্কার
নোবেল পুরস্কারের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত ঘটনা হচ্ছে কিসিঞ্জারের নোবেল শান্তি পুরষ্কার লাভ। একদিকে মার্কিন বি-৫২ বোমারু বিমানগুলো উত্তর ভিয়েতনামে বোমাবর্ষণ করে চলছে, অন্যদিকে একই সাথে হেনরি কিসিঞ্জার শান্তিচুক্তি আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্যারিস শান্তি চুক্তি কার্যকর হয় ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসে। সেই বছরই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন হেনরি কিসিঞ্জার ও লি ডাক থো।
অবশ্য লি ডাক থো পুরষ্কার গ্রহণে অসম্মতি জানান, কারণ বাস্তবে তখনও ভিয়েতনামে আদৌ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নোবেল শান্তি কমিটির ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কমিটির দুজন সভ্য পদত্যাগ করেন প্রতিবাদ হিসেবে। কিসিঞ্জার নোবেল কমিটিকে লিখে জানান, তিনি পুরষ্কার গ্রহণ করেছেন ‘মানবতা সহযোগে’ এবং পুরো অর্থমূল্য ইন্দোচীন যুদ্ধে আহত বা নিহত সৈনিকদের সন্তানদের দান করে দিয়েছেন।
হোয়াইট হাউজ-পরবর্তী দিনগুলো
জিমি কার্টার ১৯৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে কিসিঞ্জারের সরকারি চাকুরি জীবনের অবসান ঘটে। এ সময় তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কিত একটি কনসাল্টিং ফার্মে ডিরেক্টর হিসেবে কাজ শুরু করেন।
হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান, ‘প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অভ ফ্রিডম’ পদক লাভ করেন। তার ঝুলিতে রয়েছে আরেকটি অনন্য সম্মাননা। ১৯৮৬ সালে তিনি ‘মেডেল অভ লিবার্টি’ পদক লাভ করেন। এই সম্মাননাটি দেওয়া হয়েছিল বিদেশে জন্ম নেওয়া দশজন মার্কিন নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিকে এবং এটি ঐ একবারই দেওয়া হয়েছিল।
নিজের হোয়াইট হাউসের দিনগুলোর ঘটনাবলী স্মৃতিকথায় লিখেছেন হেনরি কিসিঞ্জার। তার বিখ্যাত কয়েকটি বইয়ের নাম হলো ওয়ার্ল্ড অর্ডার, ডিপ্লোম্যাসি, অন চায়না, দ্য হোয়াইট হাউজ ইয়ারস, নিউক্লিয়ার উয়েপন অ্যান্ড ফরেইন পলিসি ইত্যাদি। এসব বইয়ে তিনি তার কর্মজীবনের বিভিন্ন বিতর্কিত ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অবশ্য সেসবে মজেননি অনেক সমালোচক। অনেকেই বিশ্বাস করেন, মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে যথেষ্ট ভুল করেছেন হেনরি কিসিঞ্জার। কেউ কেউ মনে করেন, চীন-যুক্তরাষ্ট্র নীতিতে কিসিঞ্জার এমন সব পদক্ষেপ নিয়েছেন, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হুমকির মুখে পড়েছিল।
যুদ্ধাপরাধী কিসিঞ্জার?
হেনরি কিসিঞ্জারের বিতর্কিত কর্মকান্ডের দরুন তার কপালে জুটে গিয়েছে যুদ্ধাপরাধী খেতাব। কিসিঞ্জারের কট্টর সমালোচক সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচেন্স তার বই ‘দ্য ট্রায়াল অভ হেনরি কিসিঞ্জার‘-এ ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, চিলি, সাইপ্রাস, পূর্ব তিমুর প্রসঙ্গে কিসিঞ্জারের ভূমিকাকে আগাগোড়া যুদ্ধাপরাধের সামিল বলে অভিযোগ করেন। এই বইটিকে ভিত্তি করে পরবর্তী কালে একটি ডকুমেন্টারিও তৈরি হয়েছিল।
২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির এক অনুষ্ঠানে হেনরি কিসিঞ্জার অতিথি হিসেবে উপস্থিত হলে সেখানে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীরা তাকে যুদ্ধাপরাধী বলে অভিহিত করেন। শিক্ষার্থীরা তাকে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, চিলি ও আর্জেন্টিনায় যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত করেন।
“আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনি যুদ্ধাপরাধী নন? আপনার অপরাধের জন্য আপনি জেলে যাবেন না? আপনার যুদ্ধাপরাধের, মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে। আপনার উচিত জেলে যাওয়া এবং নরকে পঁচে মরা”
– এমনটাই ছিল প্রতিবাদকারীদের ভাষ্য।
ব্যক্তিগত জীবন
দুবার বিয়ে করেন হেনরি কিসিঞ্জার। হাই স্কুলের দিনগুলোর বান্ধবী অ্যান ফ্লেইশারের সাথে প্রথমবার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৪৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এই দম্পতির ঘরে দুই সন্তান এলিজাবেথ ও ডেভিড জন্ম নেয়। ১৯৬৪ সালে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
প্রায় এক দশক বাদে, ১৯৭৪ সালের ৩০ মার্চ কিসিঞ্জার দ্বিতীয়বারের মতো ন্যান্সি শ্যারন ম্যাগিনেসকে বিয়ে করেন। ব্যক্তিজীবনে ফুটবল খেলার ভক্ত ছিলেন কিসিঞ্জার। প্রায় ১৮৫ মিলিয়ন ডলারের এই মালিক বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আয়কারী রাজনৈতিকদের মধ্যে একজন।
শেষ কথা
হেনরি কিসিঞ্জার পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম সমালোচিত একজন কূটনীতিবিদ। তার প্রতিটি রাজনৈতিক পদক্ষেপই ছিল বিতর্কিত। তবে তিনি যা করেছেন সবই নিজের দেশের স্বার্থে। কিন্তু তা-ই বলে কি কিসিঞ্জারকে দেশপ্রেমিক বলা যাবে? একজন দেশপ্রেমিক যেমন নিজের দেশকে ভালোবাসেন, তেমনি সমগ্র পৃথিবীকেও ভালোবাসেন। কিন্তু কিসিঞ্জারের বেলায় এই সত্য খাটেনি। কারণ, কোনো দেশপ্রেমিকই তার দেশের জাতীয় স্বার্থে মানবতাকে বুড়ো আঙুল দেখাবে না, নিরীহ জনগণের রক্তে নিজের হাত রাঙা করবে না। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবসময় একজন কলঙ্কিত, ঘৃণ্য ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হবেন হেনরি আলফ্রেড কিসিঞ্জার।