আলবাটেগনিয়াস, আলবাটেগনি বা আলবাটেনিয়াস, একাধিক ল্যাটিন নামেও তিনি পরিচিত। আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ ইবনে জাবির ইবনে সিনান আল রাকি আল হারানি আল সাবি আল বাত্তানি তার নাম। খুবই ছোট নাম! তবে চিনতে ভুল করেননি নিশ্চয়ই। তাকে সংক্ষেপে আল বাত্তানি বলেই চিনি আমরা। নিজের সময়ের তো বটেই, পৃথিবীর ইতিহাসেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের উন্নয়নে তাকে অন্যতম একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব বলে গণ্য করা হয়। পাশাপাশি গণিতেও আছে তার বিশেষ অবদান। এসব কাজের পাশাপাশি তিনি বছরের দৈর্ঘ্য নির্ণয় করেছিলেন বেশ সূক্ষ্মভাবে।
তার বিশাল নামের ব্যবচ্ছেদ করা যাক আগে। প্রাচীনকালে রোমানরা যে স্থানটিকে ‘কারহায়ি’ নামকরণ করেছিল, মধ্যযুগে সেখানকার নাম ছিল ‘হারান’। বর্তমান তুরস্কের নিকটে অবস্থিত এই হারানে জন্মগ্রহণ করে তার নামের ‘আল হারানি’ অংশটি যুক্ত হয়। তার পূর্বপুরুষগণ ছিলেন তারকার পূজারী, সাবিয়ান নামের একটি সম্প্রদায়ের সদস্য, যা তার নাম থেকে বোঝা যায়। তবে আল বাত্তানি যে মুসলমান ছিলেন তা সকল ইতিহাসবিদই নিশ্চিত করেছেন তার নামের ‘আবু আবদুল্লাহ মোহাম্মদ’ অংশ থেকে। ‘আল রাকি’ অংশটি এসেছে তার সিরিয়ার রাকায় দীর্ঘদিন বসবাসের কারণে। অন্যদিকে তার বাবার নাম ‘জাবির ইবনে সিনান’ সহজেই অনুধাবনযোগ্য। জাবির হারান শহরের একজন বিখ্যাত বাদ্যযন্ত্র নির্মাতা ছিলেন।
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, আল বাত্তানি সম্পর্কে মধ্যযুগের অপরাপর মুসলিম মনিষীদের তুলনায় অনেক কম তথ্যই জানা যায়। তার জন্মসাল নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও অধিকাংশের মতে তিনি ৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তৎকালীন হারান, আধুনিক তুরস্কের উরফা শহরে জন্মগ্রহণ করে আল বাত্তানি। সে সময় হারান শহরের সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষা বিষয়ক দিকগুলো বাগদাদের সংস্কৃতি দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত ছিল। তথাপি আল বাত্তানির পূর্বপুরুষরা সাবিয়ান সম্প্রদায়ের হওয়ায় তাদের সংস্কৃতির একটি প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল আল বাত্তানির মধ্যে। এক্ষেত্রে তার জ্যোতির্বিজ্ঞানী হওয়া একরকম তার পূর্বপুরুষদের সাবিয়ান বিশ্বাসই নির্ণয় করে দিয়েছিল। কারণ সাবিয়ানরা ঐতিহ্যগতভাবে জোতির্বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিল। বংশের ধারায়ই আল বাত্তানিও জোতির্বিজ্ঞানের দিকে ধাবিত হন এবং বেশ উন্নতি করেন।
আল বাত্তানি ব্যবসা বাণিজ্যে ভীষণ পটু ছিলেন। পাশাপাশি বাবার মতো তিনিও বাদ্যযন্ত্র নির্মাণকৌশল রপ্ত করেন। পরিমাপণে তার হাত ছিল অত্যন্ত পরিপক্ক। ফলে তার তৈরি বাদ্যযন্ত্রগুলো হতো অনেক উন্নতমানের। তিনি ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নয়, শুধুমাত্র নিজের জন্য বাদ্যযন্ত্র তৈরি করতেন। তবে বাদ্যযন্ত্রের চেয়ে বেশি তৈরি করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় যন্ত্রপাতি। তাদের মধ্যে ‘আর্মিলারি স্ফিয়ার’ নামে পরিচিত একটি আধুনিক গ্লোব সদৃশ যন্ত্র তৈরি করেছিলেন, যার উপর বিভিন্ন নভোস্থিত বস্তুসমূহের বিচরণ পথ বিশেষ ধরনের রিং বা বলয় দ্বারা চিহ্নিত ছিল। এসব রিং ঘোরানো যেত, ঘোরানো যেত পুরো স্ফিয়ারটিকেও।
আর্মিলারি স্ফিয়ারের উদ্ভাবক যদিও আল বাত্তানি নন, তথাপি তার তৈরি স্ফিয়ার ছিল পূর্বের সকল যন্ত্রের চেয়ে নিখুঁত এবং উন্নতমানের। এই যন্ত্রের সাফল্য এককথায় অভাবনীয়। তিনি নিজের তৈরি যন্ত্রটি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব সম্বন্ধীয় যুগান্তকারী তথ্য দেন। “পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে”, ১৫৪৩ সালে কোপার্নিকাসের এই আবিষ্কারের আগপর্যন্ত মানুষ জানতো যে সূর্যই পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। অথচ সেই মধ্যযুগে বসে, ভুল সৌরমডেল নিয়ে কাজ করেও আল বাত্তানি সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন যে পৃথিবী এবং সূর্যের মধ্যে দূরত্ব সর্বদা সমান থাকে না, পরিবর্তিত হয়। এই পর্যবেক্ষণ থেকেই তিনি আরো একটি চমৎকার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন যে, যখন সূর্যগ্রহণ হয়, তখন চাঁদ সূর্য ও পৃথিবীর মাঝে অবস্থান নেয়। এবং সূর্য যখন পৃথিবী থেকে সর্বোচ্চ দূরত্বে অবস্থান করে, তখন গ্রহণের সময় চাঁদের চারধারে উজ্জ্বল আলোর রেখার সৃষ্টি হয়।
আল বাত্তানি পৃথিবীর বিষুবরেখার মধ্য দিয়ে যাওয়া কাল্পনিক সমতলের সাথে সূর্য ও পৃথিবীর কক্ষপথের মধ্যে যে সমতল, তা অসদৃশ বলে ব্যাখ্যা করেন। বিস্ময়করভাবে তিনি এই দুই কাল্পনিক সমতলের মধ্যকার কোণ পরিমাপ করেন। এই কোণকে বলা হয় ‘সৌর অয়নবৃত্তের বাঁক’। আল বাত্তানি এর পরিমাপ করেন ২৩ ডিগ্রি ৩৫ মিনিট যা বর্তমানের সঠিক পরিমাপ ২৩ ডিগ্রি ২৭ মিনিট ৮.২৬ সেকেন্ডের খুবই কাছাকাছি। তার এ সকল জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় তথ্য রেনেসাঁর যুগে ইউরোপীয় সকল জোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় ছিল। তারা আল বাত্তানির কাজের উপর ভিত্তি করেই আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেন।
ইউফ্রেতিস নদীর তীরে আল বাত্তানি তার জীবনের ৪০ বছর কাটিয়েছেন। বিশেষ করে তার জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রায় সকল কাজই তিনি সিরিয়ার রাকায় থাকাকালীন করেছেন। রাকায় বসবাসের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে সেখানে সাবিয়ানদের বেশ ক’জন প্রখ্যাত জ্যোতির্বিদ বসবাস করতেন। তাদের সংস্পর্শে যেতেই রাকা গমন করেন আল বাত্তানি। ৪০ বছর পরিশ্রম করে তিনি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ ‘কিতাব আল জিজ’ রচনা করেন। ‘জিজ’ একটি পারসি শব্দ, যার অর্থ ‘কম্বল বুনন করা’। তিনি তার বইয়ের এরূপ নাম রাখার কারণ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। খুব সম্ভবত ৯০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে গ্রন্থটি তিনি প্রকাশ করেন। বইটি প্রকাশের পরপরই তিনি সিরিয়ার অ্যান্টিওক শহরে ভ্রমণ করে এবং সেখানে চন্দ্রগ্রহণ এবং সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে বিস্তর পড়ালেখা করেন। ৯০২ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি বইটির একটি সংশোধিত সংস্করণ প্রকাশ করেন যেখানে চন্দ্রগ্রহণ এবং সূর্যগ্রহণ যোগ করেন।
কিতাব আল জিজে একটি ভূমিকা সহ মোট ৫৭টি অধ্যায় আছে। ভূমিকায় আল বাত্তানি পরবর্তী প্রজন্মের নিকট তার কাজগুলোকে আরো এগিয়ে নেবার অনুরোধ জানান। এই বইয়ে তিনি আকাশে তারকাদের এক বিশাল তালিকা তৈরি করেন এবং ৪৮৯টি তারকার নামকরণ করেন। তার এই কাজকে টলেমির ১০২২টি তারকার নামকরণের চেয়েও মূল্যবান ভাবা হয় এজন্য যে এগুলোর পর্যবেক্ষণ বেশ সূক্ষ্ম ছিল। তিনি সৌরবছরের দৈর্ঘ্য নির্ণয় করেন ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ২৪ সেকেন্ড। সেখানে আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে আজ আমরা জানি সৌরবছরের দৈর্ঘ্য ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড। আল বাত্তানির হিসাবে মাত্র ২১ সেকেন্ডের তফাৎ! বিস্ময়কর নয় কি? কোনোরকম উন্নত টেলিস্কোপ কিংবা আধুনিক জোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় যন্ত্রপাতি ছাড়াই তার এই পরিমাপ সত্যিই বিস্ময়কর।
বইয়ের মাঝপথে এসে আল বাত্তানি গতি নিয়ে আলোচনায় চলে যান। তিনি সূর্য, চাঁদ, পৃথিবী এবং তখনকার সময়ে পরিচিত অন্য পাঁচটি গ্রহের (বুধ, শুক্র, মঙ্গল, শনি ও বৃহস্পতি) গতি নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি জ্যোতিষশাস্ত্রের অনেক জটিল বিষয়েও আলোচনা করেছেন। বইয়ের শেষদিকে আলোচনা করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরির পদ্ধতি নিয়ে, যার মধ্যে রয়েছে একটি সূর্যঘড়িও। মধ্যযুগে তখন আরবে বইয়ের চাহিদা অনেক বেশি ছিল। সে সময়কার একজন বিখ্যাত প্রকাশক এবং বই বিক্রেতা ইবনে আন নাদিম আল বাত্তানির কিতাব আল জিজ সম্পর্কে বলেন, “নক্ষত্র এবং তারকারাজি সম্পর্কে এরকম নিখুঁত পর্যবেক্ষণ সমৃদ্ধ বই আগে আরবের কেউ লেখেনি। এই বই ইউরোপীয় এবং অনারবদের মধ্যেও তুমুল জনপ্রিয়।”
জ্যোতির্বিজ্ঞান ছাড়াও আরো অনেক ক্ষেত্রে আল বাত্তানির রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান, যা পরবর্তীকালের বিজ্ঞানীদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে। বিশেষত তিনি ত্রিকোণমিতি নিয়ে বিস্তর কাজ করেন এবং সাইন, কোসাইন, ট্যানজেন্ট, কোট্যানজেন্ট ইত্যাদি ধারণা নিয়ে কাজ করেন। তিনি গ্রীকদের অনেক মূল্যবান জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় এবং ত্রিকোণমিতি সম্বন্ধীয় কাজের উন্নয়ন ঘটান। তবে এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অবনমিত। তিনি কখনোই তার পূর্বের পণ্ডিতদের সমালোচনা করতেন না। যেমন টলেমির জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় কাজের তুলনায় আল বাত্তানির কাজ অনেক নিখুঁত এবং আধুনিককালেও প্রচলিত। তথাপি তিনি কোথাও টলেমির সমালোচনা করেননি। তিনি বরং টলেমির ভুলগুলোকে শুধরে দিয়েছেন।
৯২৯ খ্রিস্টাব্দের দিকে আল বাত্তানি রাকা থেকে বাগদাদে যাবার জন্য রওনা হন কোনো এক রাজকীয় কর সম্বন্ধীয় প্রজ্ঞাপনের প্রতিবাদে। তবে বাগদাদে তিনি পৌঁছুতে পারেননি। পথিমধ্যে কাসর আল জিস নামক একটি ছোট শহরে মৃত্যুবরণ করেন। শহরটি ইরাকের সামারার নিকট অবস্থিত। সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়। তার মৃত্যুর পর তার কিতাব আল জিজের জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়ে যায়। পরবর্তীকালের সময়ের প্রায় সকল মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীই তার কাজ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। ইসলামের স্বর্ণযুগ বলে পরিচিত মুসলিমদের গৌরবোজ্জ্বল যে সময়কালের কথা ইতিহাসে লেখা আছে, সে সময়ের একজন অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব এই আল বাত্তানি। তার অবদান ধর্ম নির্বিশেষে জোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।