রাতের অন্ধকার ভেদ করে গ্রাম-শহর-নগর, পাহাড়ি সবুজ উপত্যকা পেরিয়ে হু হু করে ছুটে চলেছে দিল্লি-কালকা ট্রেন। নিজের আসনে বসে সুভাষ সহযাত্রীদের একবার দেখে নিলেন। সন্দেহজনক তেমন কাউকে চোখে না পড়ায় কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন। তারপরও সতর্ক থাকার জন্য একটা খবরের কাগজে নিজেকে আড়াল করলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। তারই দৃঢ় সংকল্প রেখা তার পুরো মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। আর পেছনে তাকানো নয়। এখন শুধুই এগিয়ে চলা। মরণপণ সংগ্রামই এখন তার জীবনের মূল লক্ষ্য। ভিক্ষায় স্বাধীনতা আসে না। তার জন্য মূল্য দিতে হয়। ইংরেজদের দু’শো বছরের শাসনে কম মূল্য তো দিতে হয়নি এই ভারতবর্ষের মানুষকে। ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, সত্যেন বোস, চারু বোস, সূর্য সেন, প্রীতিলতা, আসফাকউল্লাহ, ভগত সিং- এমন আরো কত জন। সেই স্বাধীনতার জন্য তাকেও যদি মূল্য দিতে হয়, তবে তিনি প্রস্তুত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় স্বাধীনতা-প্রাপ্তির যে অপূর্ব সুযোগ এসেছে, তা কোনোমতেই হেলায় হারাতে রাজি নন সুভাষ। তার জন্য তাকে যে করেই হোক জার্মান অথবা রুশ সরকারের সাহায্য পেতে হেবে। ভারতবর্ষের সীমানা পার না হওয়ার আগে তার পালানোর খবর কিছুতেই যেন ইংরেজদের কাছে না পৌঁছায়। কোনোভাবেই ধরা পড়া যাবে না!
ট্রেন দিল্লি পৌঁছার পর দেরি না করে সুভাষ উঠে পড়লেন পেশোয়ারের ফ্রন্টিয়ার মেইলে। আসন পেলেন প্রথম শ্রেণীর এক কামরায়। তেমন কোনো ঝামেলা ছাড়ায় ট্রেন পেশোয়ার ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে এসে থামলো। পরিকল্পনামতো উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত ব্লকের ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা মিঞা আকবর শাহের তত্ত্বাবধানে সুভাষকে নিয়ে যাওয়া হলো পেশোয়ার তাজ হোটেলে।
এবার গন্তব্য কাবুল। ভগৎরামও এসে পৌঁছেছেন। তারপরও কাবুলের পথে যাত্রা করতে বেশ কয়েকদিন দেরি হলো। কারণ কীর্তি কিষাণ পার্টির পক্ষ থেকে পূর্বের পরিকল্পনার কিছুটা অদল-বদল আনা হয়েছে। ঠিক হয়েছে যে, আগেকার পথের পরিবর্তে অন্য পথ দিয়ে যেতে হবে। এবারের পথ ঠিক করা হয়েছে পেশোয়ার থেকে জামরোদ হয়ে খাজুরী ময়দান, তারপর ব্রাদার্স মিলিটারি ক্যাম্প হয়ে আফ্রিদি ও শিনওয়ারি পার্বত্য গ্রামের পাহাড়ি আফগান অঞ্চল পেরিয়ে ভাটি কোট পৌঁছতে হবে। সেখান থেকে জালালাবাদ-আড্ডাশরীফ হয়ে আবার জালালাবাদ এবং তারপর কাবুলের শেষ গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হবে।
এ পথ আরও দুর্গম, বেশ বিপদসংঙ্কুলও। নতুন যাত্রাপথটি আবার ভগৎরামের খুব একটা চেনাও নয়। তবে পূর্বের ঠিক করা পথের চেয়ে এ পথ বেশ নিরাপদ। এ পথে গুপ্তচরদের তেমন আনাগোনা নেই। ফলে এ পথের জন্য আবার নতুন করে গাইড খোঁজা শুরু হলো। তাই সুভাষকে পেশোয়ারে কয়েকদিন থেকে যেতে হলো। এর মধ্যে হোটেল থেকে সরিয়ে এনে তাকে রাখা হলো আকবর শাহের বিশ্বস্ত আবাদ খাঁর বাড়িতে।
১৯৪১ সালের ২৬ জানুয়ারি। সূর্য ওঠার আগেই শুরু হল ঐতিহাসিক যাত্রা। দিনটি ভারতবাসীর জন্য ঐতিহাসিকও বটে। ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস। আর কাকতালীয়ভাবে সে দিনটিতেই সুভাষ কাবুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। গাড়িতে পাঁচজন যাত্রী। সুভাষ, ভগৎরাম, আবাদ খাঁ, স্থানীয় গাইড ও ড্রাইভার।
পেশোয়ার মিলিটারি ক্যাম্পের পাশ দিয়ে শহরের সীমানা অতিক্রম করে জামরোদ হয়ে গাড়ি খাজুরি ময়দানের উদ্দেশ্যে চলতে লাগলো। পাহাড়ি পথ আর ঢেউ খেলানো উপত্যকা পেরিয়ে অবশেষে গাড়ি এসে থামলো খাজুরি ময়দানে। এবার পায়ে হেঁটেই দুর্গম গিরিপথের দিকে যেতে হবে। সঙ্গে শুধু গাইড আর ভগৎরাম। বিদায় জানানো হলো ড্রাইভার ও আবাদ খাঁকে।
সবার আগে গাইড, মাঝখানে সুভাষ আর পেছনে অতন্দ্র প্রহরীর মতো বিশ্বস্ত সঙ্গী ভগৎরাম। উপজাতীয় অঞ্চলটি বড়ই দুর্গম ও দুর্ধর্ষ। কখন, কোথা থেকে চোরাগোপ্তা আক্রমণ হবে, আচমকা রাইফেলের গুলি ছুটে আসবে- কেউ বলতে পারে না। তার উপর প্রকৃতিও রুক্ষ, শুধু পাথর আর পাথর। পথ বলে কিছু নেই। এখানে-ওখানে ছড়িয়ে থাকা পাথরের চাঁইগুলোও রীতিমতো বিপজ্জনক। কখন হুড়মুড় করে গড়িয়ে পড়বে, বলা যায় না।
সমতলে বেড়ে ওঠা সুভাষের পক্ষে এ পথ পাড়ি দেয়া সত্যিই দুরূহ। কিন্তু তিনি কিছুতেই তা প্রকাশ করছেন না। তার সারাক্ষণ ভয়, যত দেরি হবে, ততই ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। যত কষ্টই হোক, তাকে ভারতের সীমান্ত পেরোতেই হবে। দু’চোখে তার কেবল স্বাধীনতার স্বপ্ন। কোথাও বিশ্রাম নেওয়ার জো নেই। ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর। দেহ টলছে, পা কাঁপছে। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। তবু যেতে হবে। আর কত পথ পাড়ি দিলে সীমান্তের দেখা মিলবে? দুপুরের টাটকা রোদে দিগন্ত জোড়া অরণ্য অসীম শূন্যতায় খাঁ-খাঁ করছে।
তিনজন এসে থামলেন এক বরফে ঢাকা পাহাড়ের নিচে। এবার খানিক বিশ্রাম। খাজুরি ময়দান থেকে এতক্ষণে মাত্র দেড় মাইল পথ পাড়ি দেয়া সম্ভব হয়েছে। হতাশ সুভাষ জানতে চাইলেন, সীমান্ত পাড়ি দিতে আর কতক্ষণ লাগবে? ভগৎরাম একটু অবাক হয়েই উত্তর দিলেন, “বর্ডার পার হয়ে এসেছি সে তো অনেকক্ষণ হলো।”
পেরিয়ে এসেছি! এতক্ষণে সমস্ত ক্লান্তি, অবসাদ নিমিষে দূর হয়ে গেল সুভাষের। আপাতত বিপদ কেটে গেছে। কিছু সময় বিশ্রাম নেয়ার পর সুভাষ ও তার সঙ্গীরা দুর্গম পাহাড়ি পথ ধরে কাবুলের দিকে আবার রওনা দিলেন। শীতের বিকেল। দেখতে দেখতেই ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেল পাহাড়ি পথ। হাড় হিম করা ঠাণ্ডা আর পথের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকা মরণফাঁদ পেরিয়ে তারা এগিয়ে যেতে লাগলেন। সন্ধ্যা নামতেই অন্ধকারে ছেয়ে গেলো পুরো পাহাড়ি জনপথ। আরও কিছুক্ষণ চলার পর তারা আশ্রয় নিলেন ‘পিশকান ময়না’ নামের এক আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামে। এখানকার এক বাড়িতে আশ্রয় মিলল তিনজনের।
পরদিন সকালে আবার যাত্রা শুরু। কিন্তু এবারের পথ আরও কঠিন ও ভয়ঙ্কর। চারদিকে সব বড় বড় বরফের চাঁই। পিচ্ছিল পথ। বরফ সরিয়ে এগিয়ে চলতে হয়। কোথাও কোনো চোরা ফাটল থাকতে পারে। একটু ভুল হলেই তলিয়ে যেতে হতে পারে অতল গহ্বরে।
হাতের লাঠি দিয়ে বরফের স্তর পরীক্ষা করে তবেই সাবধানে পা ফেলতে হয়। পাশের গাঁয়ে পৌঁছতেই বেলা গড়িয়ে গেল। এখান থেকে আফগান-সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্য একটা খচ্চরের ব্যবস্থা করা হলো। খচ্চরের ওপর সুভাষকে বসিয়ে আবার যাত্রা শুরু হলো।
দীর্ঘ ছত্রিশ ঘণ্টা বরফে ঢাকা দুর্গম পিচ্ছিল পথ পাড়ি দিয়ে পরদির রাতে ‘শিনওয়ারি’ নামের এক পার্বত্য গ্রামে এসে তারা উপস্থিত হলেন। এই দীর্ঘ পথযাত্রায় সুভাষ ও তার সঙ্গীরা অবসন্ন। সারা দেহে অসহ্য যন্ত্রণা। একটু পরিপূর্ণ বিশ্রাম দরকার। কিন্তু তার জো নেই। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর খচ্চরের মালিক তাগাদা দিতে সে রাতেই আবার রওনা হতে হলো। এবার গাইডকে বিদায় দিতে হলো। বাকি পথটুকু ভগৎরামেই ভরসা। পরদিন সকালে তারা গাড়ডি গ্রামে পৌঁছলেন।
এখান থেকে শুরু হলো এক নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ। এখানে পৌঁছেই ভগৎরাম নিজের ছদ্মবেশ নিয়ে নিলেন। এখন থেকে তার পরিচয় ‘রহমত খাঁ’, এক পাঠান যুবক। আর সুভাষ হলেন তার চাচা জিয়াউদ্দীন। জিয়াউদ্দীন শুধু অসুস্থই নন, একাধারে তিনি মূক ও বধির। পেশোয়ার-কাবুল সড়ক ধরে তারা হাঁটা দিলেন জালালাবাদের দিকে।
ঘণ্টাখানেক চলার পর চায়ের বাক্স বোঝাই করা একটা ট্রাকে উঠে পড়লেন দুজন। খোলা ট্রাক। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে হু হু করে। জালালাবাদ পৌঁছতে রাত হয়ে গেলো। দুজনেরই শরীর-মন ক্লান্ত। তারা আশ্রয় নিলেন এক সরাইখানায়।
পরদিন ভোরে তারা বেরিয়ে পড়লেন আড্ডাশরীফ মসজিদ দর্শন করার জন্য। সেখান থেকে লালমা গাঁয়ে। ওখানকার হাজি মহম্মদ আমিন ভগৎরামের পূর্ব পরিচিত। তার কাছ থেকে সাহায্য প্রয়োজন। হাজি সাহেবকে সুভাষের আসল পরিচয় দেয়া হলো না। একজন পলাতক বিপ্লবী হিসেবে তার পরিচয় দেয়া হলো। এই বিপ্লবীকে রুশ দেশে পার করে দেয়ার জন্য হাজি সাহেবের পরামর্শ চাইলেন ভগৎরাম। হাজি সাহেব জানালেন, এজন্য কাবুলের তেরো মাইল আগে ‘বুদখাক’ চেকপোস্টই হচ্ছে সবচেয়ে সঠিক পথ। তবে খুব সাবধান। পথে পথে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন দেশের চর।
আবার যাত্রা শুরু হলো। কাবুল নদী পেরিয়ে সুভাষ আর ভগৎরাম পৌঁছলেন সুলতানপুর। এখন অপেক্ষা কাবুলগামী বাস বা কোনো ট্রাকের জন্য। কিন্তু দুপুর পেরিয়েও কোনো ট্রাক বা বাসের দেখা মিললো না। দুজনে হাঁটতে শুরু করলেন। সন্ধ্যা নাগাদ তারা উপস্থিত হলেন মিমলা গ্রামে। তখন দুজনেরই ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মরণপ্রায় অবস্থা।
খাবারের ব্যবস্থা করার জন্য সুভাষকে এক জায়গায় রেখে ভগৎরাম ছুটলেন পাশের এক সরাইখানায়। খাবার নিয়ে ফিরে এসে তিনি দেখলেন সুভাষ ঘুমে প্রায় অচেতন। ডাক শুনে ধড়মড় করে উঠে বসলেন সুভাষ। ভগৎরামের হাতে খাবার দেখে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন অসীম ব্যগ্রতায়। এই শুকনো রুটি যেন তার কাছে এখন অমৃতের সমান।
কত বড় বাড়ির সন্তান তিনি। পড়াশোনায়ও ছিলেন ভালো। অনায়াসেই পেতে পারতেন বড় কোনো চাকরি। আরাম-আয়েশেই জীবনটা পার করে দিতে পারতেন। অথচ তা না করে দেশকে স্বাধীন করার এক কঠিন ব্রতে আত্মোৎসর্গ করলেন। বেছে নিলেন জীবনের কন্টকাকীর্ণ পথ।
হাতের খাবার হাতেই রয়ে গেলো। সহসাই এক কাবুলগামী ট্রাক এসে থামলো তাদের সামনে। এ সুযোগ হারালে চলবে না। ট্রাকে উঠে পড়লেন দুজন। খুব ভোরে গাড়ি এসে থামলো কাবুলের বুদখাক চেক পোস্টের সামনে।
পরিকল্পনামতো ভগৎরাম একাই এগিয়ে গেলেন চেকপোস্টের সামনে। আর সুভাষ চললেন ড্রাইভারের পেছন পেছন। যেন তিনি ড্রাইভারের কোনো সহযোগী। ভগৎরাম চেকপোস্টের অফিসঘরে গিয়ে দেখেন সবাই ঘুমে অচেতন। কোনো বাধাবিপত্তি ছাড়াই সহজে চেকোপোস্টের ঝামেলা এড়াতে পেরে দুজনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
খুশি, তৃপ্তি আর বিজয়ের প্রসন্নতা তখন দুজনের চোখেমুখে। পেশোয়ার থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল ২৬ জানুয়ারি, আর আজ ৩১ জানুয়ারি। দীর্ঘ এক যাত্রার সমাপ্তি ঘটলো। দুরন্ত দুর্গম পথ পেরিয়ে সুভাষ অবশেষে আফগানিস্তানের কাবুলে এসে পৌঁছলেন। স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য এরপর শুরু হবে তার অন্য এক যাত্রা। তবে সে অন্য এক গল্প।
এ সিরিজের আগের পর্ব: