আকাশ পথে যাত্রার নিমিত্তে ২০১৮ সাল ছিল উদ্ভাবন, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও নতুনত্বের বছর। নতুন প্রযুক্তির বিমান থেকে শুরু করে সবচেয়ে দীর্ঘ সরাসরি ফ্লাইটের সূচনা বা অস্ট্রেলিয়া থেকে ইংল্যান্ডের সরাসরি ফ্লাইট শুরুর বছরটি বিমান ভ্রমণের জন্য দারুণ একটি বছর ছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেকটা কমে আসলেও একেবারে বন্ধ হয়নি। তবে নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিমির মুখের আকৃতির বেলুগা এক্সএল ও ভাঁজ করা যায় এমন পাখার বোয়িং ৭৭৭এক্স নিয়ে আগ্রহের কমতি যেমন গত বছরও ছিল না, তেমনি এ বছরও সেই আগ্রহের পালে নতুন হাওয়া লাগতে যাচ্ছে। সব কিছু মিলিয়ে এক নজরে জেনে নিন, আকাশ পথে গত বছরের আলোচিত কিছু মুহূর্ত।
১
২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো আকাশে উড়তে যাচ্ছে বোয়িং ৭৭৭এক্স, যা বেশ কয়েকটি কারণে বিখ্যাত। বিমানটির পাখার একটি অংশ ভাঁজ করা যায় এবং এগুলো তৈরি করা হয়েছে খুবই হালকা ও শক্তিশালী কার্বন ফাইবারে, যা জ্বালানী সাশ্রয়ে ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া ২৫২ ফুট বিমানটির এক পাখা থেকে অপর পাখার দূরত্ব ২৩৫ ফুট ৫ ইঞ্চি, যা ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ। বোয়িং প্রতিষ্ঠানটির দাবি অনুযায়ী, এই বিমানটি এয়ারবাস এ-৩৫০ বিমানের চেয়ে ১২% অধিক জ্বালানী সাশ্রয়ী। বিশাল এই বিমানটি প্রায় ৪০০ থেকে ৪২৫ জন যাত্রী ধারণ করতে সক্ষম।
এমআইটির প্রকৌশলীরা দাবি করেছেন, তারা নতুন ধরনের বিমান উড্ডয়নে সফল হয়েছেন। বিমানটি প্রথম ‘সলিড স্টেট’ বিমান নামে পরিচিত এবং এটির কোনো ‘মুভিং পার্টস’ নেই। সবচেয়ে বড় খবর হচ্ছে, বিমানটি কোনো জীবাশ্ম জ্বালানীর উপর নির্ভরশীল নয়। ‘আয়োনিক উইন্ড’ প্রযুক্তিতে তৈরি বিমানটি ভবিষ্যৎ বিমানের ধারণা বদলে দিতে পারে এবং পরিবেশ-বান্ধব বিমান তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে নতুন এই প্রযুক্তি।
২
সুপারসনিক কনকর্ড বিমানের শেষ যাত্রার ১৫ বছর পর, আবারও গুঞ্জন উঠেছে সুপারসনিক প্রকল্প নিয়ে। বুম টেকনোলোজি ও নাসার এক্স-৫৯ কিউইউইএসএসটি সুপারসনিক জেট প্রকল্পের আওতায় ভবিষ্যতে আবারও এই প্রযুক্তির দেখা মিলতে পারে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এইসব প্রকল্প সাশ্রয়ী হবে কিনা, তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে এখনও। তবুও যদি বাণিজ্যিকভাবে এই সুপারসনিক গতির ফ্লাইট চালু হয়, তাহলে সাংহাই থেকে লস-এঞ্জেলস যেতে সময় লাগবে মাত্র ৫ ঘণ্টার মতো।
পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ত বিমানবন্দর আটলান্টার হার্টস্ফিল্ড জ্যাকসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চালু হয়েছে সম্পূর্ণ বায়োমেট্রিক টার্মিনাল। মুখের গঠন সনাক্তকারী এই প্রযুক্তির দরুন যাত্রীরা পাসপোর্ট ছাড়াই বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে পারবে এবং এখন পর্যন্ত সাফল্যের মাত্রা ৯৮%। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও সিঙ্গাপুর ও নেদারল্যান্ডসের বিমানবন্দরের কিছু গেট ও টার্মিনালে এই বায়োমেট্রিক চেক-ইন সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
৩
আকাশ পথে যাত্রীদের যাতায়াত ক্রমেই বাড়ছে। ২০১৬ সালে প্রায় ৩.৭ বিলিয়ন মানুষ এই পথ ব্যবহার করে তাদের গন্তব্যে পৌঁছেছে। পরের বছরই আবার রেকর্ড ৪ বিলিয়ন যাত্রী আকাশ পথ ব্যবহার করেছেন এবং যাত্রীবাহী বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে ২০১৭ সাল ছিল বাণিজ্যিক ফ্লাইটের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যস্ত ও নিরাপদ বছর।
যাত্রী সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে অনেক ক্ষেত্রে সময়ের হিসাবে গড়মিল হতে দেখা যায়। কিন্তু চ্যালেঞ্জ স্বত্বেও লাটভিয়ান পতাকাবাহী এয়ারবাল্টিক সবচেয়ে সময়নিষ্ঠ এয়ারলাইনের খেতাব নিজেদের করে নিয়েছে। বিমান ভ্রমণ তথ্য সংক্রান্ত কোম্পানি ওয়াজির করা তালিকায় এয়ারবাল্টিকের পরেই রয়েছে হংকং এয়ারলাইন্স ও হাওয়াইয়ান এয়ারলাইন্স। অন্যদিকে, পৃথিবীর সবচেয়ে সময়নিষ্ঠ বিমানবন্দর হলো স্পেনের ক্যানারি দ্বীপের তেনেরিফে নর্থ বিমানবন্দর। যেখান থেকে ৯০ শতাংশ ফ্লাইটই সঠিক সময়ে পৌঁছেছে বা ছেড়ে গিয়েছে। তাছাড়া, গত বছরের জানুয়ারিতে ডেল্টার বোয়িং ৭৪৭ ও ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৪৭এস শেষবারের মতো উড়ে অবসরে গিয়েছে।
৪
ডাচ পাইলট ক্রিস্টিয়ান ভ্যান হেইস্ট বিমানের ককপিট থেকে তোলা মনোমুগ্ধকর ছবিগুলো প্রকাশ করেছেন। সৌন্দর্যের অপার রহস্যের খানিকটা প্রকাশ পেয়েছে তার ছবিগুলোতে, যা দেখে বিস্মিত হয়েছে গোটা পৃথিবী। তার ছবিগুলোতে উঠে এসেছে উত্তরের মেরুপ্রভা থেকে শুরু করে সেইন্ট এলমোর আগুনের বিরল সৌন্দর্য।
ব্যক্তিগত লাউঞ্জের নানাবিধ সুবিধা নিয়ে নিউ ইয়র্কের লাগার্ডিয়া সেন্ট্রাল টার্মিনাল বি’তে স্থাপন করা হয়েছে জাবরবক্স ওয়ার্ক বুথ, যা বিমানবন্দরের গতানুগতিক লাউঞ্জের চেয়ে ভিন্ন ধারার সুবিধা প্রদান করে থাকে। গোপনীয়তার সুবিধা দিয়ে এসব লাউঞ্জে রয়েছে ওয়াইফাই, ইউএসবি চার্জিং, ফ্লাইট ট্র্যাকিং ও অডিও স্পিকার সুবিধা ইত্যাদি। বর্তমানে, এই সুবিধা নিতে প্রতি ১৫ মিনিটের জন্য ১০ ডলার, ৩০ মিনিট ও ১ ঘণ্টার জন্য যথাক্রমে ১৫ ও ৩০ ডলার গুনতে হবে আপনাকে।
৫
টানা ষষ্ঠবারের মতো বিশ্বের সেরা বিমানবন্দর নির্বাচিত হয়েছে সিঙ্গাপুরের চ্যাঙ্গি বিমানবন্দর। এই বিমান বন্দরের অভিনব সব সুবিধা সহজেই নজর কেড়ে নেবে যেকারো। ছাদের উপরে সুইমিং পুল, ২৪ ঘণ্টা ব্লকবাস্টারের বিনামূল্যে সিনেমা উপভোগের সুযোগ ছাড়াও রয়েছে আরও অন্যান্য সুবিধা। ২০১৯ সালে এই বিমানবন্দরে পাঁচ তলা ভবনে যুক্ত হতে যাচ্ছে বাগান ও পানির ফোয়ারা। বোঝাই যাচ্ছে, সেরার খেতাব ধরে রাখতে কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ক্যাঙ্গারু সার্ভিসের নাম শুনেছেন? অস্ট্রেলিয়ার পার্থ থেকে ব্রিটেনের লন্ডনে পৌঁছাতে সময় লাগে চারদিন ও এই সময় ৭টি স্থানে থামতে হতো ফ্লাইটটির। এটিই পরিচিতি পায় ক্যাঙ্গারু সার্ভিস নামে। এই ক্যাঙ্গারু সার্ভিসের দিন শেষ হতে চলেছে। কারণ শুরু হয়েছে পার্থ থেকে লন্ডনের প্রথম সরাসরি ফ্লাইট, যেখানে সময় লাগে মাত্র ১৭ ঘণ্টা!
৬
লন্ডনের হিথ্রু বিমানবন্দরে যুক্ত হতে পারে তৃতীয় আরও একটি রানওয়ে। সম্প্রতি ব্রিটিশ আইনপ্রণেতারা তৃতীয় রানওয়ে স্থাপনের পরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন, এটি কার্যকর হলে লন্ডনের বিমানবন্দরটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবন্দর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। সেই সাথে বছরে যাত্রী সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১০০ মিলিয়নে।
নিউ মেক্সিকোর একটি রানওয়েতে প্রায় ৩৬ বছর ধরে পড়ে থাকা বিশেষায়িত লকহিড জেটস্টার ১৩২৯ প্রাইভেট জেট নিলামে তোলা হয়েছে, যেটি এলভিস প্রাইভেট জেট নামে পরিচিত ছিল।
৭
নতুন ডিজাইনের এয়ারবাস বেলুগা এক্সএল (এয়ারবাস এ৩৩০-৭০০এল) বিমানের পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন গত বছর সম্পন্ন করেছে এয়ারবাস। ১০ মাস ধরে চলা এই পরীক্ষায় প্রায় ৬০০ ঘণ্টা উড়েছে এই বেলুগা এক্সএল। নতুন ডিজাইনের বিমানের সামনের দিক তিমির নাকের মতো চোখা এবং বিমানটির সামনের দিক অনেকটা তিমির মতো করেই সাজানো হয়েছে। সাথে রয়েছে, নতুন ডিজাইনের ইঞ্জিন, কেবিন এবং জ্বালানী সাশ্রয়ের জন্য বাঁকানো উইংটিপস, যেগুলো শার্কলেট নামে পরিচিত। দেখে মনে হবে যেন ‘ফ্লাইং হোয়েল’ বা উড়ন্ত তিমি। এই ডিজাইনের প্রথম ৫টি বিমান তাদের পরীক্ষামূলক উড্ডয়নে সফলতা লাভ করেছে, যেগুলো চলতি বছরে চালু হবে।
উড়ন্ত তিমির পর অন্যতম আকর্ষণ ছিল এমব্রায়ের ‘শার্ক’ এ১৯০-ই২। বিমানটির বহিরাভরণ সাজানো হয়েছে হাঙরের মতো করে এবং ব্রিটেনের ফারনবোরোহ এয়ারশো’তে প্রথম উন্মোচিত হওয়ার পর বিমানটি ৫ মাসের একটি ভ্রমণও সম্পন্ন করেছে।
৮
হ্যামবুর্গের এয়ারক্রাফট এক্সপো ২০১৮ তে উন্মোচিত হয়েছে এয়ারবাসের নতুন স্লিপার বার্থ সুবিধা যুক্তকরণের ধারণা। যেখানে যাত্রীরা আরও আরামদায়ক ভ্রমণের সুবিধা নিতে পারবে। ২০২০ সালের মধ্যেই এয়ারবাস এ৩৩০ জেট বিমানে এই স্লিপার বার্থের সুবিধা যুক্ত করা হচ্ছে।
এমিরেটস তাদের বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর বিমানের প্রথম শ্রেণীতে যুক্ত করতে যাচ্ছে সিলিং স্লাইডিং দরজা, নরম চামড়ার আসন, মনোরম আলো ও ‘ভার্চুয়াল জানালার’ সুবিধা, যেখানে ফাইবার-অপটিক ক্যামেরা প্রযুক্তি যুক্ত থাকবে।
৯
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ায় অনেক বড় প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকসহ নানাবিধ কারণে। সোভিয়েত এয়ারক্রাফট প্রকৌশলের অন্যতম নিদর্শন রূপে এখনও অসম্পূর্ণ অবস্থায় ইউক্রেনের কিয়েভে পড়ে আছে অ্যান্তনোভ এএন-২২৫ ম্রিয়া। ১৯৮৯ সালে বিমানটি তৈরির কাজ শুরু হলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ায় আজও আকাশে ওড়া হয়ে ওঠেনি।
হিমালয় পর্বতের প্রায় ১৪০০ মিটার (৪,৫৯৩ ফুট) উচ্চতায় সেপ্টেম্বরে ভারতের সিকিমে চালু হয়েছে পাকইয়ং বিমানবন্দর, যা শুধু প্রকৌশল বিদ্যার দুর্দান্ত প্রতিফলনই নয়, একরকম পৃথিবীর ছাদে তৈরি বিমানবন্দরটি ভয়ংকর সৌন্দর্যের নতুন আধার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ৩০ মিটার চওড়া ও ১.৭ কিলোমিটার রানওয়ের বিমানবন্দরটি তৈরি করতে খরচ হয়েছে ৬৮.৭ মিলিয়ন ইউএস ডলার। ভুটান ও নেপালের কোল ঘেঁষা এই বিমানবন্দরটির আশেপাশে রয়েছে ২৮টি পর্বত চূড়া, ২১টি হিমবাহ এবং ২০০’র বেশি হ্রদ।
১০
জাকার্তার সুকর্ন-হাত্তা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের অল্প সময় পরই অক্টোবরে লায়ন এয়ার ফ্লাইট ৬১০ বিমানটি সমুদ্রে মারাত্মক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়। প্রাণনাশী এই দুর্ঘটনায় বিমানটি সাগরে পতিত হয় এবং বিমানের পাইলট, কর্মকর্তা ও যাত্রীসহ ১৮৯ জনের সকলেই নিহত হয়। আকস্মিক এই দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে এখন পর্যন্ত। প্রাথমিক ভাবে ধারণা করা হয়েছে, নতুন বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স ৮ বিমানটির স্বয়ংক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিপরীতে পাইলটকে ক্রমাগত যুদ্ধ করতে হয়েছে।
স্বয়ংক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাটির নাম ‘ম্যানুভারিং ক্যারেক্টারিস্টিক অগমেন্টেশন সিস্টেম’ বা এমসিএএস। বিমানটি দুর্ঘটনায় ধ্বংস হওয়ার আগের দিনও এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার কারণে সমস্যায় পড়েছিল আরেকটি ফ্লাইট, তবে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়ে ম্যানুয়াল কন্ট্রোলে বিমানটি চালানো হয়েছিল তখন। যা-ই হোক, দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে অনেক প্রশ্নের সাথে নতুন এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠছে।