সিয়েরা লিওনের রাজধানী ফ্রিটাউন থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার দূরে রোকেল ও সিয়েরা লিওন নদীর মোহনায় সবুজ অরণ্যে ঘেরা জনবিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের নাম বান্স আইল্যান্ড। ছোট্ট এই দ্বীপটির দৈর্ঘ্য মাত্র ৫০৩ মিটার আর প্রস্থ ১০৭ মিটার। আয়তনে অত্যন্ত ছোট হলেও এই দ্বীপের রয়েছে এক দীর্ঘ অথচ অন্ধকারাচ্ছন্ন ইতিহাস।
ব্রিটিশরা তাদের ঔপনিবেশিক শাসনামলে এই দ্বীপে গড়ে তুলেছিল এক ভয়ানক ‘দাস দুর্গ’। যেখানে সমগ্র আফ্রিকা থেকে নিরাপরাধ নারী-পুরুষ ও শিশুদের ধরে এনে বন্দি করে রাখা হতো। তারপর সেখান থেকে তাদের বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হত।
গবেষকরা জানান, শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই এই দুর্গ থেকে ১০ হাজারের অধিক দাস সরবরাহ করা হয়েছিল। যাদের অধিকাংশকে দক্ষিণ ক্যারোলিনা ও জর্জিয়ার বিভিন্ন কৃষিক্ষেত্রে জোরপূর্বক কাজে লাগানো হয়েছিল। কাজের অযোগ্য হয়ে পড়লে তাদের আবার বিক্রি করে দেয়া হতো বা মেরে ফেলা হতো।
ইতিহাস থেকে ব্রিটিশ শোষণের এই অন্ধকার অধ্যায় মুছে ফেলার চেষ্টা করা হলেও সম্প্রতি সেই দুর্গের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হলে তা নতুনভাবে আলোচনায় আসে। গবেষকরা এই দুর্গকে ‘আফ্রো-আমেরিকান’ সম্পর্ক নির্ণয়ের ঐতিহাসিক দলিল আখ্যায়িত করেন।
বর্তমানে বান্স দ্বীপে একদল চৌকশ ইতিহাসবেত্তা ও প্রত্নতত্ত্ববিদ নিরলসভাবে সেই অন্ধকার ইতিহাসের দলিলপত্র উদ্ধার ও গবেষণার কাজ করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি তারা এই দাস দুর্গটিকে পুনর্নির্মাণ ও সংরক্ষণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এরা একটি গবেষণা সংস্থাও গড়ে তুলেছেন; যার নাম ‘বান্স আইল্যান্ড কোয়ালিশন’।
ইতিমধ্যেই সংস্থাটি সমগ্র দ্বীপের মানচিত্র ও দাস দুর্গের একটি ত্রিমাত্রিক নকশা প্রণয়ন করেছে। এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন জোসেফ ওপালা। তিনি বলেন,
আফ্রো-আমেরিকান ইতিহাস এই দ্বীপে ঘুমিয়ে আছে। আমাদের বিশ্বাস, গবেষণার মাধ্যমে আমরা এখান থেকে অনেক অজানা গল্প উদ্ধার করতে পারবো; যা সিয়েরা লিওনের ইতিহাসকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
তবে এখান থেকে অধিকাংশ মানুষকে দক্ষিণ ক্যারোলিনা ও জর্জিয়ায় পাচারের পেছনে একটি ভৌগলিক কারণও ছিল। আর তা হলো, আফ্রিকান অঞ্চলের ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য ও মাটির গুণাগুণের সাথে দক্ষিণ ক্যারোলিনা ও জর্জিয়ার ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য ও মাটির গুণাগুণের অসাধারণ মিল থাকা। ফলে আফ্রিকানমানুষদেরকে দাস হিসেবে নিয়ে গিয়ে ব্রিটিশরা সহজেই কৃষিক্ষেত্রে নিয়োগ করতে পারতো। জোসেফ ওপালা বলেন,
পশ্চিম আফ্রিকান অঞ্চলে এরূপ আরও ৪০টি বৃহদাকৃতির দুর্গের সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু এটি সবার থেকে ভিন্ন; এটির ইতিহাস সবচেয়ে বেশি অন্ধকারচ্ছন্ন; কেননা এটিই একমাত্র দুর্গ যেখান থেকে বিপুল সংখ্যক বন্দিকে বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করা হয়েছিল।
যে স্থানে ইতিহাস ঘুমিয়ে আছে
দ্বীপটিতে পা রাখলেই চোখে পড়বে শুনশান নীরবতায় পরিপূর্ণ জনমানবহীন এক সমতল ভূমির। খুব দ্রুতই আপনি অনুভব করতে পারবেন, এই ভূমির বুকেই লুকিয়ে আছে সময়ের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এক অন্ধকার অতীত। দ্বীপের একপাশে এখনো অবশিষ্ট রয়েছে সেই প্রাচীন স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ; যা গত দুই শতক ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বর্ষণের ফলে ক্রমান্বয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে; আর বর্ষার পানির সাথে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে ‘দাস দুর্গের’ সেই অন্ধকার ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল।
১৬৭০ সালে একটি ব্রিটিশ দাস-বাণিজ্য কোম্পানির দ্বারা এই দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল। কিন্তু এটাও একটি রহস্য যে, ১৮০০ সালের দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই দুর্গ পরিত্যাক্ত হয়ে গেলেও সেখানে এখন পর্যন্ত কোনো জনবসতি গড়ে ওঠেনি। অথচ পশ্চিম আফ্রিকা অঞ্চলের অন্যান্য ব্রিটিশ দুর্গের পাশে ব্রিটিশ পরবর্তী সময়ে জনবসতি গড়ে উঠেছে। সম্ভবত মানুষের এক গভীর আতঙ্ক অথবা ঘৃণা জমে গিয়েছিল এই দুর্গের প্রতি।
তাই এই দাস দুর্গের ক্রমশ ক্ষয়প্রাপ্ত দেয়ালগুলো যেন সবুজ লতাপাতায় আবৃত হয়ে শোকের পোশাক পরিধান করে নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। গাছের শিকড়গুলো যেন ক্ষয়িষ্ণু গাথুনিগুলোকে চেপে ধরেছে- তার অন্ধকার অতীত লুকিয়ে রাখার দাবিতে। জোসেফ ওপালা জানান,
২০১২ সালে সিয়েরা লিওনের স্থানীয় ক্যালেন্ডারে প্রথমবারের মতো বান্স দ্বীপকে ‘ইতিহাস ঘুমিয়ে থাকার দ্বীপ’ বলে উল্লেখ করা হয়। এর চেয়ে কোনো উত্তম বা যথার্থ বর্ণনা এই দ্বীপের হতে পারে না। এটি ছিল শয়তানের অভিশপ্ত ভুতুড়ে দাস বানিজ্যের শহর।
ওপালা বলেন, আধুনিক সময় এসেও সিয়েরা লিওনের অধিকাংশ মানুষ বান্স দ্বীপের এই ঐতিহাসিক দুর্গের কথা জানেন না। ওপালা আরও জানান, বর্তমানে প্রতিবছর হাতেগোনা স্বল্প কিছু মানুষ এই দ্বীপ পরিদর্শন করতে আসেন; যাদের অধিকাংশই বিদেশি পর্যটক বা গবেষক। অর্থাৎ স্থানীয়দের মধ্যে এটি নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই। অজানা কারণে সিয়েরা লিওনের মানুষদের এখনও এটি সেভাবে নাড়া দিচ্ছে না।
অবশ্য ওপালা এর একটি ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন। ওপালা জানান, এই দ্বীপে ভ্রমণ করতে আসা এখনও খুব ব্যায়বহুল। ভালো কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। ওপালা বলেন,
এই দ্বীপে আসতে হলে নৌকা ভাড়া করতে হয়। একটি নৌকা ভাড়া করতে খরচ পড়ে ৫০০ থেকে ৭০০ ডলার পর্যন্ত। এছাড়া কিছু পর্যটনভিত্তিক ট্রলার আছে, যেগুলো জনপ্রতি ৬০ থেকে ৭০ ডলার ভাড়া নিয়ে থাকে। এছাড়া অন্যান্য খরচ তো আছেই। একজন স্থানীয় অধিবাসীর জন্য এটা অনেক ব্যায়বহুল। তবে এটা সত্য যে স্থানীয় জনগণের মধ্যে দ্বীপটি সম্পর্কে এখনো ততটা আগ্রহ গড়ে ওঠেনি। এমনকি অধিকাংশ জনগণ দ্বীপটি সম্পর্কে ভালো করে জানেই না।
তবে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ বান্স দ্বীপে আশার আলো জ্বালতে শুরু করেছে। ‘বান্স আইল্যান্ড কোয়ালিশন’ ইতিমধ্যেই এই দ্বীপটির ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ; বিশেষত দাস দুর্গের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি বড়সড় পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এই সংস্থাটি দ্বীপ থেকে উদ্ধারকৃত নিদর্শনের মাধ্যমে সিয়েরা লিওনের রাজধানী ফ্রিটাউনে একটি যাদুঘরও নির্মাণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে; যা এখানকার অধিবাসীদের ব্রিটিশ শাসন-শোষণ ও তার কালো অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। ওপালা বলেন,
এখন আমরা আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ- সকলকেই বোঝানোর চেষ্টা করছি যে, এটি শুধু আমাদের ঐতিহাসিক জায়গা হিসেবেই গুরুত্বপূর্ণ নয়; বরং এটি আমাদের জাতীয় রাজস্বেরও অন্যতম উৎস হতে পারে। পর্যটন খাত আমাদের অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দিতে পারে এবং এর মাধ্যমে আফ্রো-আমেরিকান ও সিয়েরা লিওনের ঐতিহাসিক যোগসূত্র নতুনভাবে সামনে আসতে পারে। আর সেই অন্ধকার অতীত থেকে যে সিয়েরা লিওন মুক্ত হতে পেরেছে এটিও গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আর এটাই আমাদের ইতিহাস উদ্ধারের বড় সুযোগ।
এই দাস দুর্গ আবিস্কারের পর বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যারোলিনা ও জর্জিয়া অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে রীতিমত হৈচৈ পড়ে গেছে। তাদের অনেকেই মনে করছেন, তাদের পূর্ব পুরুষরা আফ্রিকার অধিবাসী ছিলেন। তারাও তাদের আদি বংশধরদের ইতিহাস জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন। দ্রুতই এই দাস দুর্গের সকল ‘কালো উপাখ্যান’ আমাদের সামনে আসুক; ব্রিটিশ বেণিয়াদের দাস বাণিজ্যের মানবতাবিরোধী ইতিহাস বিশ্ববাসীর সামনে উঠে আসুক, সেটিই আমাদের কামনা।
ইতিহাসের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/