সিরিজের আগের পর্ব দেখুন এখানে।
অধিকাংশ সমাজ, সে আধুনিকই হোক আর প্রাচীনই হোক, তারা ধর্মের উপর নির্ভর করে অনেক ক্ষেত্রে। রোমান সাম্রাজ্যও এর ব্যতিক্রম নয়। একদম শুরু থেকেই এই সমাজটি ছিল বহু-ঈশ্বরবাদী। শুরুতে তাদের দেব-দেবীরা ছিল প্রধানত আদর্শ বা ধারণা-ভিত্তিক। পরবর্তী গ্রিক, এট্রুসকান এবং আরো বেশ কিছু বিদেশি দেব-দেবী যোগ দেয় তাদের উপাস্যের তালিকায়।
ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করতে থাকে তাদের সাম্রাজ্য। জয় হতে থাকে বিভিন্ন এলাকা। কিন্তু তাই বলে বিজিত এলাকাগুলোর উপর নিজেদের ধর্মবিশ্বাস চাপিয়ে দেয়নি তারা।
রোমানদের প্রধান দেব-দেবী হলো জুপিটার, জুনো, মিনার্ভা, নেপচুন ও প্লুটো। তবে এসব দেবতার ধারণা জন্ম নেবার আগেও রোমানরা নানা দেব-দেবীর উপাসনা করত। প্রাক-রোমান সময়ে তাদের দেবতারা সংখ্যায় ছিল অনেক। এদের অধিকাংশই পরবর্তীতে একীভূত হয়ে গিয়েছে অন্যান্য দেবতার সঙ্গে।
প্রথম দিককার রোমানরা ছিল সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসী। তারা বিশ্বাস করতো দেবতারা বাস করেন তাদেরই চারপাশের দুনিয়াতে, এমনকি মানুষের মাঝেও। রোমের গোড়াপত্তনের শুরুর দিককার অধিবাসীদের বিশ্বাস ছিল, পূর্বসূরিরা নজর রাখেন তাদের উপর।
একাধিক দেবতার দরকার ছিল সেকালের মানুষের। তারা বিশ্বাস করত, নানা কাজের দায়িত্ব রয়েছে নানা দেবতার উপর। হাজার হলেও, যুদ্ধের দেবতার কাছে নিশ্চয়ই প্রণয়-ঘটিত সমস্যার জন্য প্রার্থনা করা যায় না! আবার প্রেমের দেবীকে ফসল সংক্রান্ত সমস্যার কথা বলে কী লাভ?
এই প্রাক-রোমানরা পেশায় মূলত ছিল কৃষক এবং রাখাল। এসব কাজেই কেটে যেত তাদের সময়ের বেশিরভাগ। তাই তৎকালীন সময়ে কৃষি-সংক্রান্ত দেবতারাই ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এদের মাঝে সবচেয়ে বেশি সম্মানিত ছিল সেরেস। লোকে বিশ্বাস করতো- শস্য বপন ও অঙ্কুরোদগম দেখভাল করার দায়িত্ব তার ওপর ন্যস্ত। ইউরোপ ও আমেরিকায় সকালের নাস্তায় সিরিয়াল (Cereal) খায় অনেকেই। সুস্বাদু ও পুষ্টিকর এই খাবারের একটা কৌটাই যোগায় কাজের নতুন উদ্দীপনা। এই সিরিয়াল শব্দটিও এসেছে সেরেস থেকে। প্রাক-রোমান সাম্রাজ্যে জানুয়ারি মাসে সেরেসকে সম্মান দেখাবার জন্য অনুষ্ঠিত হতো বীজ-বপন অনুষ্ঠান।
প্রাক-রোমান সমাজের বহু-ঈশ্বরবাদীতার আরেকটা প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের কৃষিকাজের সময়। প্রত্যেকটা কাজের আলাদা-আলাদা নাম দিত তারা। যেন কাজটাতে বিশেষ বিশেষ দেবতার কৃপা মেলে। যেমন দেবতা রোবিগাস, যিনি ছিলেন গমের পচন ধরা রোগের প্রতিরূপ। তাই তাকে খুশি রাখতে পারলে শস্য বেঁচে যায়। দেবী ফ্লোরার কারণে ফুটত ফুল; দেবতা কনসাস রক্ষা করতেন শস্যজাত খাবার।
মার্স এবং স্যাটার্নের মর্যাদাও ছিল অনন্য। প্রথমদিকে তারা ছিলেন আলাদা পরিচয়ের অধিকারী। পরবর্তীতে গ্রিক দেবতার সঙ্গে একীভূত হয়ে যান যদিও। মার্স ছিলেন কৃষির দেবতা, পরবর্তীতে তাকে একীভূত করা হয় গ্রিক দেবতা এরিসের সঙ্গে। ফলে তিনি হন কৃষি ও উর্বরতার প্রতীক। স্যাটার্ন ছিলেন কৃষি এবং সময়ের দেবতা। তিনি পরবর্তীতে একীভূত হন গ্রিক দেবতা ক্রোনোসের সঙ্গে। স্যাটার্নালিয়া নামের অনুষ্ঠানটা উদযাপিত হতো স্যাটার্ন এবং তার সঙ্গিনী অপস-এর সম্মানে। অপস ছিলেন ইতালীয় প্রাচুর্যের দেবী। প্রতি বছর ১৭ ডিসেম্বর থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলত এই অনুষ্ঠান। এই এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ হয়ে যেত বাণিজ্য, দাসদের দেওয়া হতো স্বাধীনতা।
রোমান দেব-দেবীর মধ্যেও স্যাটার্ন বেশ রহস্যময় এক চরিত্র। নানা ছবিতে তাকে দেখা যায় মাথার উপর কাপড় দেয়া অবস্থায়। চেহারা দেখা যায় না বললেই চলে। হাতে থাকে কাস্তে। ইতালির আদিবাসীদের মধ্যেও ছিল তার জনপ্রিয়তা। বলা হতো, তিনি ছিলেন প্রথমদিককার দেবতা, যার রাজত্বকালে মানুষ উপভোগ করত প্রাচুর্য এবং আনন্দ।
প্রথমদিকে অনুষ্ঠানটার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র একদিন, যা পরবর্তীতে বেড়ে সাত দিনে রূপ নেয়। রোমান সম্রাট, অগাস্টাস, একে কমিয়ে আনেন তিন দিনে। তার উত্তরসূরি, ক্যালিগুলা, সেটাকে আবার বাড়িয়ে পাঁচ দিন করেন। তবে সাধারণ মানুষজন সবসময়ই সাত দিন ধরে উদযাপন করত এই উৎসবটাকে, সরকার যা-ই নির্দেশ দেক না কেন।
স্যাটার্নালিয়া উৎসবে ছিল অদ্ভুত এক রীতি। এই ক’দিনের জন্য পুরো উল্টে যেত মানুষের সামাজিক ভূমিকা। প্রভুরা পড়ত দাসদের ফেল্ট হ্যাট। শুধু তাই নয়, দাসদের সেবাও কত প্রভুরা (নিদেনপক্ষে একই কামরায় বসে খাবার খেত)। এই বিশেষ ব্যবস্থা সম্ভবত ছিল সামাজিক চাপ কমাবার জন্য, কেননা এই সাত দিন বাদে বছরের অন্য দিনগুলোতে দাসদের মেনে চলতে হতো কড়া নিয়ম-কানুন।
অন্যান্য দেবতারা দেখভাল করতেন দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারিক সব চাহিদা। জ্যানাস, যে রোমান দেবতার কোনো গ্রিক প্রতিরূপ নেই, তিনি দরজায় উপাসনা পেতেন। ভ্রমণে বেরোবার আগে মানুষ তার পূজা করতো। ফিরে আসার পরও মানুষ তার পূজা করতো পাছে কোন অশুভ আত্মা ভেতরে প্রবেশ করে।
খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় এবং চতুর্থ শতাব্দীতে ধনী নগরীতে পরিণত হয় রোম। জ্যানাসও পান অধিক সম্মান। শহরের প্রবেশ পথগুলোর তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে উপাস্য হন তিনি। শান্তির সময়গুলোতে বন্ধ করে রাখা হতো দরজাগুলো, যেন শান্তি পালিয়ে যেতে না পারে। যুদ্ধের সময় আবার রাখা হতো খুলে, যেন রোমান সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সহজেই ফিরতে আসতে পারে।
জ্যানাসের প্রতিকৃতিতে তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে দ্বি-মুখী মানুষ হিসেবে, যার এক মুখ সামনের দিকে ও অন্য মুখ পেছন দিকে। পরবর্তীতে তিনি আবার বনে যান প্রারম্ভের দেবতা, সেই সঙ্গে মহাবিশ্বের রক্ষকও। উপাসনা শুরুই করা হতো তার নাম নিয়ে। দিনের প্রথম ঘণ্টা, মাসের প্রথম দিন এবং বছরের প্রথম মাসের ওপর ছিল তার কর্তৃত্ব। খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতকে রাজা নুমা তৎকালীন দশ মাসের দিনপঞ্জিতে যোগ করেন নতুন দুটি মাস। প্রথম মাসটির নামকরণ করেন জ্যানুয়ারিয়াস, দেবতা জ্যানাসের নাম অনুসারে। আজকের যুগে আমরা সেই মাসটাকে ডাকি জানুয়ারি বলে।
লারস (Lares) প্রকৃতপক্ষে একদল দেবতার নাম, তারা ছিলেন এলাকার রক্ষাকর্তা। মাঠে, রাস্তার পবিত্র মোড়ে এবং খামারে ছিল তাদের বাস। জানুয়ারির শুরুর দিকে, লারসদেরকে সম্মানিত করা হতো। সেই অনুষ্ঠানের নাম ছিল কম্পিটালিয়া। এই সময়টায় কৃষকরা তাদের জমিতে খাড়া করত উঁচু স্থাপনা। এই স্থাপনায় ছিল দরজা, যেগুলো চারপাশের খামারের দিকে মুখ করে বানানো হত। কৃষকরা সেখানে বেদিও বানাত, যাতে খাড়া হয়ে লারসদের প্রতি উৎসর্গ চড়াবার পাশাপাশি দেখতে পারত নিজের জমিও।
লারসরা বিশেষ একটা পরিবারের দেখভাল করলেও, পেনাটেসরা রক্ষা করত বাড়ির প্রধান এবং তার তার পরিবারবর্গকে। লারসদের জন্য মাঠের মাঝখানে স্থাপনা এবং বেদি বসালেও, পেনাটেসদের জন্য বেদি বানানো হত বাড়ির ভেতরে।
কৃষিকাজের পাশাপাশি প্রাক-রোমানরা ব্যস্ত থাকল পশুপালন নিয়েও। তাই পালের রক্ষাকর্তা হিসেবে সম্মান দেখানো হতো পেলসকে। শীতকালে তৃণভূমি থেকে গ্রীষ্মকালে পাহাড়ের তৃণভূমিতে পশুপাল নিয়ে যাবার সময় তাদের দেখভাল করতেন এই পেলস। পালের পশুদের স্বাস্থ্য, ঘাস এবং পানির প্রাচুর্য ইত্যাদির দিকে নজর রাখতেন তিনি। এপ্রিলে পেরিলিয়া অনুষ্ঠানে সম্মান দেখানো হতো তাকে।
এই দেব-দেবীদের বাইরেও, পূর্বপুরুষদের সম্মান দেখাতে কার্পণ্য করত না রোমানরা। মে মাসে লেমুরিয়া অনুষ্ঠানে বাড়িতে ছোট পরিসরে বিভিন্ন রীতি পালনের মাধ্যমে সম্মান এবং স্মরণ করা হতো লেমুরেসদের। এই লেমুরেসরা হচ্ছেন তাদের মৃত পূর্বসূরিদের পথভ্রষ্ট আত্মা, তাদেরকে শান্ত করার জন্য কাঁধের ওপর দিয়ে শস্য পেছনে ছুঁড়ে দিত পরিবারের প্রধান।