“When you have to shoot, shoot. Don’t talk.”
উপরের সংলাপটি সার্জিও লিওনির বিখ্যাত ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড এন্ড দ্য আগলি’ সিনেমা থেকে নেয়া। সিনেমাটি যারা দেখেননি তারাও লেখার শিরোনাম দেখেই বুঝতে পারার কথা যে, সংলাপটি একটি ওয়েস্টার্ন সিনেমা থেকে নেয়া। সংলাপ থেকেই বোঝা যায় সিনেমায় রয়েছে অ্যাকশন ও অস্ত্রের ঝনঝনানি।
ওয়েস্টার্ন সিনেমা ও বইগুলোতে একটি সাধারণ ঘটনা সবসময়ই দেখা যায়। এখানে নায়ক থাকে কাউবয় হ্যাট পরা, তার কোমরে বা কাঁধে ঝোলানো থাকে রিভলবার, জনমানবশূন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘোড়া নিয়ে সে ছুটতে থাকে, আদিবাসীদের আক্রমণের শিকার হয়। এছাড়া আরেকটি জিনিস প্রায় সিনেমাতেই থাকে। সেটা হচ্ছে ব্যাংক ডাকাতি। এসব সিনেমা দেখলে বা বই পড়লে মনে হয়, উনবিংশ শতাব্দীর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চল অনেক হিংস্র ও বর্বর ছিল। কিন্তু আসলেই কি এমন ছিল? না, বাস্তবে মোটেও এরকম ছিল না। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনা ছিল উল্টো। ওয়েস্টার্ন সিনেমা দেখে ও বই পড়ে আমাদের যে ভুল ধারণা জন্মেছে, আজ সেসব বিষয় নিয়েই আলোচনা করা হবে।
ব্যাংক ডাকাতি
ওয়েস্টার্ন সিনেমা দেখলে মনে হবে তখন ব্যাংক ডাকাতি ছিল একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ব্ল্যাক বার্ট, দ্য ডালটন গ্যাং, দ্য বুচ ক্যাসিডি এন্ড দ্য সানডেন্স কিড- এরা ডাকাতির জন্য কুখ্যাত ছিল। এটাও দেখা যায়, ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুব একটা মজবুত ছিল না। ভল্ট বলে কিছু ছিল না, আইন বলেও কিছু ছিল না। ডাকাতদের রাজত্বই বুঝি শক্তিশালী ছিল সেখানে। কিন্তু বাস্তবে এমন ছিল না।
ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, সেই সময়ে চল্লিশ বছরে ১৫টি রাজ্যে মাত্র ৮টি ব্যাংক ডাকাতি হয়েছে। অন্যদিকে শুধুমাত্র ২০১০ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে ৫,৬০০টি ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। সিনেমা বা বইয়ের কথা চিন্তা করলে বর্তমান সময়ের চেয়ে ওয়াইল্ড ওয়েস্টের সময়টা ভীতিকর মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন।
তখনকার শহরগুলো ছোট ছোট ছিল। যে কারণে ব্যাংক, পুলিশ অফিস, দোকানপাট- এগুলো একটি আরেকটি থেকে খুব দূরে ছিল না। তাছাড়া তখনকার ভবনগুলো থাকত খুব কাছাকাছি। তাই ব্যাংকে ডাকাতি করতে ঢুকলে দ্রুতই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই ব্যাংক ডাকাতি তখন হতো না বললেই চলে। তবে বুচ ক্যাসিডি ও সানডেন্স কিডদের গল্প সত্য ছিল। তারা পুলিশদের পরোয়া করত না। তাদের নিয়ে একটি সিনেমাও তৈরি হয়েছে। তবে ছোটখাট ডাকাতদের জন্য তা ছিল আত্মহত্যার শামিল। তারা বরং ট্রেন ডাকাতির দিকেই বেশি আগ্রহী ছিল।
হিংস্র আদিবাসী
জি. এ. হেনটির ‘ইন দ্য হার্ট অব দ্য রকিজ’ বইটি যারা পড়েছেন, তারা জানেন শ্বেতাঙ্গরা জনবিরল পশ্চিমে বারবার আদিবাসীদের আক্রমণের শিকার হচ্ছিল। এছাড়া গল্পের বর্ণনায় আদিবাসীদের ভয়ংকরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। তারা যেকোনো সময় অতর্কিতে শ্বেতাঙ্গদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। ওয়েস্টার্ন বই বা সিনেমায় সবসময়ই তাদের এভাবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তারা মোটেও এমন হিংস্র খুনী স্বভাবের ছিল না। বরং তারা অন্যান্য সভ্য মানুষদের মতোই শান্তিপ্রিয় ছিল। তারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়েও যথেষ্ট সচেতন ছিল।
শ্বেতাঙ্গদের ক্যারাভানের ওপর হামলা করত না তারা। বরং নতুন আগতদের সাথে পণ্য আদান-প্রদান করে বাণিজ্য করত এবং বিভিন্নভাবে সাহায্য করত। সংঘর্ষ যে একেবারে হয়নি তা নয়। তবে তা সংখ্যায় নগন্য। নেব্রাস্কায় গমনকৃত হাজার হাজার শ্বেতাঙ্গের মধ্যে আদিবাসীদের সাথে সংঘর্ষে মাত্র ৩০০-৪০০ জনের মৃত্যু হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে প্রচার করা হয়েছে ১০,০০০ জনেরও অধিক মৃত্যু হয়েছে বিভিন্ন সময়ের সংঘর্ষে, যা আসলে ভুল তথ্য।
কাউবয় আমেরিকান সংস্কৃতির অংশ
আমেরিকানরা রাজনৈতিক কোনো র্যালি বা প্রচারণায় নিজেদের দেশপ্রেমিক হিসেবে দেখানোর জন্য অনেকে কাউবয়ের বেশে চলে আসে। কারণ কাউবয়কে মনে করা হয় আমেরিকান সংস্কৃতির প্রকৃত ধারক। লুঙ্গি-শাড়ী যেরকম বাঙালি সংস্কৃতি ধারণ করে, আমেরিকানরাও অনেকে মনে করে কাউবয় এসেছে তাদের কাছ থেকেই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কাউবয় সংস্কৃতি আমেরিকার তৈরি নয়, এটি এসেছে মেক্সিকানদের কাছ থেকে।
মেক্সিকান রাখালরা পুরোদস্তুর কাউবয় বলতে যা বোঝায়, তা-ই ছিল। তাদের মাথায় ব্যবহৃত সমব্রেরো থেকেই সম্ভবত কাউবয় হ্যাট এসেছিল। তারা ‘ভেকেরোস’ নামে পরিচিত ছিল। তারা আমেরিকার স্বাধীনতারও আগে থেকেই ছিল পশ্চিমের দিকে। আমেরিকানরা যখন পশ্চিমাঞ্চলের দিকে যেতে থাকে, তখন এই ভেকেরোসরাই তাদের সবকিছু শিখিয়ে দেয়। আমেরিকানরা তখন সেগুলো শিখে পুরো সংস্কৃতিটাই নিজেদের অংশ করে নেয়। এমনকি ভেকেরোস থেকে নিজেদের জন্য নামটিও নিয়ে নেয় ‘বাকারুস’ নামে। ভেকেরোসরা প্রায় ২০০ বছর টিকে থাকে।
এছাড়া সিনেমা বা উপন্যাসে কাউবয় বলতে শুধু শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে পশ্চিমে শুধু শ্বেতাঙ্গ কাউবয়ই ছিল না। প্রতি তিনজনে একজন ছিল ম্যাক্সিকান ভেকেরো। প্রতি চারজনে একজন ছিল আফ্রিকান-আমেরিকান, যারা দাসপ্রথা থেকে মুক্তি পেয়েছিল। এমনকি আদিবাসীদের মধ্যেও অনেকে কাউবয় ছিল। অর্থাৎ, কাউবয়রা ছিল মিশ্র বর্ণের। তাছাড়া সিনেমায় যে কাউবয় হ্যাট দেখানো হয়, বাস্তবে তাদের হ্যাট আরো ভিন্ন ছিল।
পশ্চিম ছিল নৈরাজ্যপূর্ণ
ওয়েস্টার্ন সিনেমা বা উপন্যাসে দেখায়, কাউবয়দের কোমরে রিভলবার ঝোলানো থাকে। শুধু কাউবয়রাই নয়, সেই অঞ্চলের অন্যান্য পুরুষ-মহিলা এমনকি শিশুদের হাতেও এসব অস্ত্র থাকতো; যা তারা আত্মরক্ষা, শিকার বা কোনো উপলক্ষ উদযাপনে ব্যবহার করত। এসব দেখলে যে-কারো মনে ধারণা জন্মাবে যে, তখন অস্ত্র ব্যবহারে কোনো বিধি-নিষেধ ছিল না। যে কেউই ব্যবহার করতে পারতো আর নৈরাজ্য চলতে থাকত। কিন্তু বাস্তবে এমন ছিল না। বরং পশ্চিমাঞ্চল ছিল অনেকটাই শান্তিপূর্ণ।
প্রকৃতপক্ষে উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে সেখানকার অস্ত্র আইন বর্তমান সময়ের চেয়েও কড়া ছিল। শুরুর দিকে অবশ্যই কিছুটা হিংস্রতা ছিল; কারণ তখন কোনো উপযুক্ত আইন ছিল না। তবে তা বেশিদিন স্থায়ী ছিল না। উনবিংশ শতাব্দীতে যখন শহর গড়ে ওঠতে থাকে, তখন অস্ত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ শুরু করা হয়। দোকানের সামনে অস্ত্র বহনে নিষেধাজ্ঞার কথা লেখা থাকত।
তাছাড়া সিনেমাতে ছয় বুলেটের যে রিভলবারগুলো ব্যবহার করতে দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে ওয়েস্টার্নরা সেগুলো ব্যবহার করত না। তখনকার রিভলবারগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘দ্য অ্যাডামস’। এটি থেকে গুলি ছুড়তে গেলে হাত পুড়ে যাওয়ার ভয় ছিল। তাই এটি তেমন জনপ্রিয় ছিল না। তার চেয়ে বরং শটগান ও রাইফেলই বেশি ব্যবহৃত হতো।
যানবাহনের স্বল্পতা
ওয়েস্টার্ন সিনেমায় আমরা সাধারণত দেখি রুক্ষ জনবিরল অঞ্চলে একটিমাত্র ওয়াগন বা মালবাহী ঘোড়ার গাড়ি চলতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে সেখানকার দৃশ্য এমন ছিল না। বাস্তবে সেখানকার মানুষরা শত শত ওয়াগন নিয়ে একত্রে ধূলাযুক্ত রাস্তায় চলাচল করত। এতে রাস্তায় ধূলার মেঘ সৃষ্টি হয়ে অন্ধকার হয়ে যেত। তাছাড়া রাস্তাগুলো সরু থাকায় সামনের গাড়িকে অতিক্রম করে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। তখন সেখানে যানজটের সৃষ্টি হতো।
উটের অনুপস্থিতি
ওয়েস্টার্ন সিনেমা নির্মাতারা সেখানকার মানুষদের সবসময় ঘোড়ার ব্যবহার দেখালেও উটকে অবহেলা করেছেন। বাস্তবে সেখানকার মানুষ উটও ব্যবহার করত, বিশেষ করে উনবিংশ শতাব্দীতে। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আমেরিকান প্রশাসন উপলব্ধি করে, পশ্চিমের রুক্ষ অঞ্চলে উটই ব্যবহারের উপযোগী প্রাণী। মালামাল বহনের পাশাপাশি খাবার হিসেবেও একে ব্যবহার করা যাবে। এসব কথা বিবেচনা করে ১৮৪৩ সালে মিসর ও মরক্কো থেকে ৬৬টি স্বাস্থ্যবান উট আমদানি করা হয়।
উট আমদানি করার পর পশ্চিমে একে সফলভাবে ব্যবহার করা হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রে যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, তখন বিশাল সংখ্যক উট মারা যায় অথবা হারিয়ে যায়। কিছু উট সার্কাসের মনোরঞ্জন আর মালামাল বহনের উদ্দেশ্যে রাখা হয়। সর্বশেষ পশ্চিমে উট দেখা যায় ১৯৪১ সালে টেক্সাসে।
শেষ কথা
ওয়েস্টার্ন বলতে আমরা যা বুঝি প্রকৃতপক্ষে অনেক কিছুরই কোনো বাস্তব অস্তিত্ব ছিল না। সিনেমা বা বইয়ে এগুলো অতিরঞ্জিত করে বর্ণনা করা হয়েছে। তাই ওয়েস্টার্ন বই বা সিনেমা শুধু বিনোদনের উদ্দেশ্যেই দেখা বা পড়া ভালো। একটি ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল সম্পর্কে ভুল ধারণা বিশ্বাস না করাই ভালো।