আইপিএলে প্রতি আসরে প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট কিংবা মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ারকে অ্যাওয়ার্ড দেওয়ার পাশাপাশি আসরের সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারকেও অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২০০৮ থেকে শুরু করে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ১১ আসরে মাত্র একবার বিদেশি কোনো ক্রিকেটার অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন। তিনি হলেন বাংলাদেশের পেসার মুস্তাফিজুর রহমান।
আইপিএলে সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ড জেতা ক্রিকেটারদের সম্পর্কে জেনে আসা যাক।
শ্রীবৎস গোস্বামী (২০০৮ সাল)
আইপিএলের প্রথম আসরে এই অ্যাওয়ার্ডের নাম ছিলো ‘বেস্ট আন্ডার-নাইন্টিন প্লেয়ার’। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান শ্রীবৎস গোস্বামী। তিনি মাত্র চার ম্যাচ খেলেই বেস্ট আন্ডার-নাইন্টিন প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্টের অ্যাওয়ার্ড জেতেন।
গোস্বামী ২০০৮ সালে চার ম্যাচের তিন ইনিংসে ব্যাট করে ২৭.৩৩ ব্যাটিং গড়ে ৮২ রান করেছিলেন। উইকেটরক্ষক হিসাবে দু’টি ক্যাচ লুফে নেওয়ার পাশাপাশি দু’টি স্ট্যাম্পিংও করেছিলেন তিনি।
তিনি তার ৮২ রানের মধ্যে ৫২ রান করেছিলেন এক ইনিংসে। আসরের ১৯তম ম্যাচে দিল্লী ডেয়ারডেভিলসের বিপক্ষে ৪২ বলে সাতটি চার এবং একটি ছয়ের মারে ৫২ রান করেছিলেন। উইকেটরক্ষক হিসাবেও ঐ ম্যাচে সফল ছিলেন তিনি, একটি ক্যাচ এবং একটি স্ট্যাম্পিং করেছিলেন গোস্বামী। যার ফলে ব্যাঙ্গালোর ম্যাচ জিততে ব্যর্থ হলেও তাকে ম্যাচসেরার পুরস্কার দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত এই ইনিংসের কল্যাণেই তিনি বেস্ট আন্ডার-নাইন্টিন প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্টের অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন।
রোহিত শর্মা (২০০৯ সাল)
রোহিত শর্মা ২০০৯ সালে সেরা উদীয়মান ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি এই অ্যাওয়ার্ড ২০০৮ সালে আইপিএলের প্রথম আসরেই পেতে পারতেন। কিন্তু তখন সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার যোগ্যতা ছিল শুধুমাত্র অনুর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট খেলা খেলোয়াড়দের। সেইজন্য ২০০৮ সালে রোহিত শর্মা চারটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৪০৪ রান করার পরও সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ড পাননি। ২০০৯ সালে সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয় সর্বোচ্চ ২৩ বছর। অ্যাওয়ার্ডের নাম ছিল ‘বেস্ট আন্ডার-টুয়েন্টি থ্রি প্লেয়ার’।
রোহিত শর্মা ২০০৯ সালে ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত নৈপুণ্য প্রদর্শন করে তার দল ডেকান চার্জারসকে শিরোপা জিততে সাহায্য করেন। তিনি ব্যাট হাতে ১৬ ম্যাচে একটি অর্ধশতকের সাহায্যে ২৭.৮৫ ব্যাটিং গড়ে ৩৬২ রান করার পাশাপাশি ঐ আসরে বল হাতেও বেশ সফল ছিলেন। হ্যাটট্রিকসহ ১১ উইকেট শিকার করেছিলেন মাত্র ১৪.৬৪ বোলিং গড়ে!
সৌরভ তিওয়ারি (২০১০ সাল)
মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বাঁহাতি আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান সৌরভ তিওয়ারি ২০১০ সালে আইপিএলের তৃতীয় আসরে ‘বেস্ট আন্ডার-টুয়েন্টি থ্রি প্লেয়ার’ অ্যাওয়ার্ড জেতেন। মিডল-অর্ডারে ব্যাট করা এই তরুণ ব্যাটসম্যান ঐ আসরে ১৫ ইনিংসে ব্যাট করে তিনটি অর্ধশতকের সাহায্যে ২৯.৯৩ ব্যাটিং গড়ে এবং ১৩৫.৬০ স্ট্রাইক রেটে ৪১৯ রান সংগ্রহ করেছিলেন। এই উদীয়মান ব্যাটসম্যানের দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স আইপিএলের তৃতীয় আসরে ফাইনাল খেলছিল।
ইকবাল আব্দুল্লাহ (২০১১ সাল)
আইপিএলের চতুর্থ আসরে সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ডের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘আন্ডার টুয়েন্টি থ্রি সাকসেস অব দ্য টুর্নামেন্ট’। কলকাতা নাইট রাইডার্সের বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনার ইকবাল আব্দুল্লাহ আসরজুড়ে দুর্দান্ত বোলিং করে আন্ডার টুয়েন্টি থ্রি সাকসেস অব দ্য টুর্নামেন্টের অ্যাওয়ার্ড জিতে নিয়েছিলেন। তিনি ২০১১ সালে ১৫ ম্যাচে ওভারপ্রতি মাত্র ৬.১০ রান খরচ করে ১৬ উইকেট শিকার করেছিলেন।
মানদ্বীপ সিং (২০১২ সাল)
আইপিএলের পঞ্চম আসরে সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের ‘আন্ডার টুয়েন্টি থ্রি সাকসেস অব দ্য টুর্নামেন্ট’ অ্যাওয়ার্ড জেতেন কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের মানদ্বীপ সিং। তিনি পাঞ্জাবের হয়ে ২০১২ সালে ১৬ ম্যাচ খেলে ২৭.০০ ব্যাটিং গড়ে এবং ১২৬.৩২ স্ট্রাইকরেটে ৪৩২ রান সংগ্রহ করেছেন। চেন্নাই সুপার কিংসের বিপক্ষে ৫৬ রান এবং ডেকান চার্জারসের বিপক্ষে ৭৫ রানের ইনিংস খেলে তিনি আলোচনায় আসেন এবং সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ড জিতে নেন।
সাঞ্জু স্যামসন (২০১৩ সাল)
আইপিলের ষষ্ঠ আসরের সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ডের নাম আবারও পরিবর্তন করা হয়। ২০১৩ সালে নাম ছিল ‘রাইজিং স্টার অব দ্য ইয়ার’।
রাজস্থান রয়্যালসের ১৯ বছর বয়সী উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান সাঞ্জু স্যামসন ২০১৩ সালে রাইজিং স্টার অব দ্য ইয়ারের অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন। তিনি ১১ ম্যাচের দশ ইনিংসে ব্যাট করে একটি অর্ধশতকের সাহায্যে ২৫.৭৫ ব্যাটিং গড়ে ২০৬ রান সংগ্রহ করার পাশাপাশি ১৩টি ক্যাচ লুফে নিয়েছিলেন। যার ফলে তিনি সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ড জেতেন।
অক্ষর প্যাটেল (২০১৪ সাল)
আইপিএলের সপ্তম আসরে সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের ‘বেস্ট ইয়াং প্লেয়ার অব দ্য সিজন’ অ্যাওয়ার্ড জেতেন কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের অলরাউন্ডার অক্ষর প্যাটেল। তিনি ব্যাট হাতে খুব একটা সুযোগ না পেলেও বল হাতে আসরজুড়ে দুর্দান্ত পারফর্ম করেছিলেন। ১৭ ম্যাচে মাত্র ৬.১৪ ইকোনমি রেটে শিকার করেছেন ১৭ উইকেট। ব্যাটসম্যান হিসাবে নিজের সামর্থ্যের জানান দিয়েছিলেন আসরের ৪৫তম ম্যাচে দিল্লী ডেয়ারডেভিলসের বিপক্ষে। চার ওভারে মাত্র ১৮ রানের বিনিময়ে এক উইকেট শিকার করে দিল্লীকে ১৬৪ রানে বেঁধে রাখেন অক্ষর। এরপর ব্যাট হাতে অপরাজিত ৪২ রান করে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছান তিনি। বল হাতে ধারাবাহিক নৈপুণ্য প্রদর্শন করার বদৌলতে আসরের সেরা উদীয়মান ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। তার দল কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবও ২০১৪ সালেই প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠেছিল।
শ্রেয়াস আয়ার (২০১৫ সাল)
২০১৫ সালে আইপিএলের অষ্টম আসর থেকে উঠতি তারকাদের অ্যাওয়ার্ডের নাম দেওয়া হয় ‘ইমার্জিং প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার’। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত এই নাম অপরিবর্তিত রয়েছে। ইমার্জিং প্লেয়ার অব দ্য ইয়ারের অ্যাওয়ার্ড জিততে হলে যেসব যোগ্যতা থাকতে হবে, সেগুলো হলো:
-
বয়স পঁচিশের কম হতে হবে।
-
পাঁচটি আন্তর্জাতিক টেস্ট, দশটি ওয়ানডে কিংবা দশটি টি-টোয়েন্টির কম খেলতে হবে।
-
আগে কখনও এই অ্যাওয়ার্ড জিতলে চলবে না।
২০১৫ সালে ইমার্জিং প্লেয়ার অব দ্য ইয়ারের অ্যাওয়ার্ড জেতেন বর্তমানে দিল্লী ক্যাপিটালসের অধিনায়ক শ্রেয়াস আয়ার। তিনি ২০১৫ সালে দিল্লী ডেয়ারডেভিলসের হয়ে ১৪ ম্যাচে চারটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৩৩.৭৭ ব্যাটিং গড়ে এবং ১২৮.৩৬ স্ট্রাইকরেটে ৪৩৯ রান সংগ্রহ করেছিলেন। মুম্বাইয়ের বিপক্ষে ৫৬ বলে ৮৩ রানের ইনিংসটি আসরে তার সর্বোচ্চ রানের ইনিংস ছিল।
মুস্তাফিজুর রহমান (২০১৬)
আইপিএলের নবম আসরে এসে প্রথমবারের মতো কোনো বিদেশি ক্রিকেটার সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন। বাংলাদেশের তরুণ প্রতিভাবান পেসার মুস্তাফিজুর রহমান এই কীর্তি গড়েন। তিনি সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে পুরো আসর জুড়ে দুর্দান্ত বোলিং করেছিলেন। ডেথ ওভারে তার দুর্দান্ত বোলিংয়ের সুবাদে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ ২০১৬ সালে শিরোপা জিতেছিল।
মুস্তাফিজুর রহমান ১৬ ম্যাচে ২৪.৭৬ বোলিং গড়ে ১৭ উইকেট শিকার করেছিলেন। নিয়মিত ডেথে বোলিং করা সত্ত্বেও তার ইকোনমি রেট ছিলো মাত্র ৬.৯০। তিনি তার আইপিএল ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন এবি ডি ভিলিয়ার্সের উইকেট শিকারের মধ্য দিয়ে। এরপর শেন ওয়াটসন, বিরাট কোহলি, শন মার্শ এবং আন্দ্রে রাসেলদের মতো ব্যাটসম্যানদের উইকেটও শিকার করেছেন তিনি। ডেথ ওভারে ভুবনেশ্বর কুমারকে সাথে নিয়ে দুর্দান্ত বোলিং করে দলকে জয় এনে দিয়েছিলেন বহু ম্যাচে।
বাসিল থাম্পি (২০১৭ সাল)
আইপিএলের দশম আসরে ‘ইমার্জিং প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার’ অ্যাওয়ার্ড জিতেছিলেন গুজরাট লায়ন্সের পেসার বাসিল থাম্পি। তিনি ২০১৭ সালে গুজরাট লায়ন্সের হয়ে ১২ ম্যাচে খেলার সুযোগ পেয়ে ১১ উইকেট শিকার করে সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের খেতাব অর্জন করেন। আসরের প্রথম তিন ম্যাচে তিনি উইকেটশূন্য ছিলেন। নিজের চতুর্থ ম্যাচে এসে আইপিএলের প্রথম উইকেট শিকার করেন থাম্পি। আইপিএলে তার প্রথম উইকেটটি ছিলো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ক্রিস গেইলের। এরপর বিরাট কোহলি, হাশিম আমলা, মহেন্দ্র সিং ধোনি, পোলার্ডের মতো ব্যাটসম্যানদের উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি। যার ফলে তাকেই সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়।
ঋষভ পান্ত (২০১৮ সাল)
২০১৬ সালে অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দুর্দান্ত ব্যাটিং করে আলোচনায় এসেছিলেন ঋষভ পান্ত। ঐ বছরেই আইপিএলে দিল্লী তাকে নিলামে কিনে নেয়। আক্রমণাত্মক এই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান গত বছর আইপিএলের একাদশ আসরে এসে সেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের অ্যাওয়ার্ড জেতেন। তার দল দিল্লী ডেয়ারডেভিলস সফলতার মুখ না দেখলেও ব্যাট হাতে বেশ ধারাবাহিক ছিলেন পান্ত। ১৪ ম্যাচে একটি শতক এবং পাঁচটি অর্ধশতকের সাহায্যে ৫২.৬২ ব্যাটিং গড়ে এবং ১৭৩.৬০ স্ট্রাইক রেইটে ৬৮৪ রান সংগ্রহ করেছিলেন। ১৪ ম্যাচের মধ্যে মাত্র দুইবার এক অংকের ঘরে আউট হয়েছিলেন পান্ত। উইকেটরক্ষক হিসাবেও তিনি চারটি ক্যাচ লুফে নেওয়ার পাশাপাশি দু’টি স্ট্যাম্পিং করেছিলেন।