ইউরোপের চিত্রকলার জগতে রোমান্টিসিজম নিঃসন্দেহে একটি উজ্জ্বল ও ব্যতিক্রমধর্মী আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত। যুগের ব্যথাভরা জটিলতা অগ্রাহ্য করার দুরন্ত বাসনা এই শিল্প আন্দোলনের অন্যতম উৎসাহের দিক ছিলো। প্রকৃতির অভাবনীয় বিশালতা, অপার রহস্যের হাতছানি, নিবিড় আধ্যাত্মিকতা, গভীর ধ্যান ও জীবনের সীমাহীন বিস্ময়ের ছবি এ আন্দোলনের চিত্রকলাকে নতুন রূপ ও সজ্জা দিয়েছিলো। এই আন্দোলনে মানুষের বিশ্বাসের জগৎ নতুনভাবে আলোড়িত হয়েছিলো।
এই যুগের চিত্রকরদের মধ্যে ক্যাসপার ডেভিড ফ্রেডরিখ, ইউজিন দালাক্রোঁয়া, উইলিয়াম টার্নার, জন উইলিয়াম ওয়াটারহাউজ, হেনরি ওয়ালেস, থমাস কোল, উইলিয়াম ব্লেক, থমাস জোনস তাঁদের সৃষ্টিকর্মের জন্য অমর হয়ে আছেন। ছবির আঙ্গিক, বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য, রঙের ব্যতিক্রমী ব্যবহার ও সময়কে নিজ প্রতিভার শক্তিতে ফুটিয়ে তোলার বিচারে স্প্যানিশ শিল্পী ফ্রান্সিসকো দ্য গয়া (১৭৪৬-১৮২৮) নিঃসন্দেহে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী হয়ে আছেন। বিশেষ করে সময়ের অনবদ্য রূপান্তর ও মানসিকতা তাঁর মতো খুব কম চিত্রকরই ধরতে পেরেছেন।
ফ্রান্সিসকো গয়া ১৭৪৬ সালের ৩০ মার্চ স্পেনের আরাগন অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা হোসে বেনিতো দ্য গয়া একজন কারিগর ছিলেন। মা গার্সিয়া দ্য লুসিয়েন্তে সালভাদর বেশ সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য ছিলেন। ফ্রান্সিসকো গয়া ছিলেন বাবা-মায়ের চতুর্থ সন্তান। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। ক্লাসিক সাহিত্য ও ইতিহাসের কিছু পাঠ ছাড়া ধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে তেমন কোনো পড়াশোনা ছিলো না বলেই মনে হয়। এর বাইরে কারিগর বাবার কাছ থেকে হয়তো পেয়েছিলেন শিল্পকলা সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞানের পরিচয়।
১৪ বছর বয়সে শিল্পী হোসে লুজানের কাছে ফ্রান্সিসকো গয়া হাতে-কলমে চিত্রকলা বিষয়ে শিক্ষা নিতে থাকেন। স্প্যানিশ রাজকীয় চিত্রকলার পাঠ নেবার জন্য তিনি মাদ্রিদে যান। শিক্ষকের সাথে মতবিরোধের কারণে ১৭৬৩ ও ১৭৬৬ সালে রিয়েল একাডেমিতে ভর্তির আবেদন করেও সফল হননি। তখন ক্লাসিক্যাল আর্টের কারণে রোম সমগ্র ইউরোপের শিল্পীদের কাছে শ্রদ্ধেয় ছিলো। এজন্য তিনি রোমে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। ইতালি যাবার পথে ১৭৭০ থেকে ১৭৭১ সাল অবধি তিনি অঙ্কনশৈলী নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করেন, যার ফলশ্রুতি ছিলো ‘স্যাক্রিফাইস টু ভেস্তা’ এবং ‘স্যাক্রিফাইস টু প্যান’ এর মতো চিত্রকর্ম।
১৭৭১ সালেই ইতালির ফার্মা অঞ্চলে চিত্রকলা প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। সে বছরই তিনি স্পেনে ফিরে আসেন এবং ‘ব্যাসিলিকা অব আওয়ার লেডি’ ক্যাথেড্রালের জন্য ফ্রেস্কো অঙ্কন করেন। এছাড়া সোব্রাদিয়েল প্রাসাদের জন্যও ফ্রেস্কো এঁকেছিলেন। ধারণা করা হয়, এসময় থেকেই তাঁর চিত্রশিল্পে এক ধরনের বিশেষ অনন্যতা আসতে শুরু করে। ফলে শিল্পী হিসেবে তাঁর খ্যাতি ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে।
১৭৭৫ সাল থেকে ফ্রান্সিসকো গয়া মাদ্রিদে ট্যাপেস্ট্রি কার্টুনিস্ট শিল্পী হিসেবে নতুন কর্মজীবন শুরু করেন। এর আগে স্প্যানিশ অভিজাত সমাজের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে আঁকা তাঁর কিছু ছবি রাজপুরুষদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলো। বৈবাহিক সূত্রের আত্মীয়ের সুপারিশে তিনি স্পেনের পুরনো রাজকীয় চিত্রকর্মগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পান। এতে তাঁর শিল্পীসুলভ ক্ষমতা আরো প্রসারিত হয়েছিলো।
১৭৮৩ সাল থেকে গয়া ছবি আঁকার সূত্রে রাজপরিবার ও রাজকীয় অভিজাত বংশের মানুষের সাথে সংশ্লিষ্ট হতে শুরু করেন। একজন গুণী শিল্পী হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি রাজা তৃতীয় চার্লস ছাড়াও তার আত্মীয়, যেমন- কাউন্ট অব ফ্লোরিডাব্লাংকা, ডিউক ও ডাচেস অব ওসুনা, ম্যানুয়েল দ্য গদয় প্রমুখের কাছে পৌঁছেছিলো। ফলে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া তাঁর জন্য বেশ সহজ হয়ে গিয়েছিলো। তিনি উচ্চ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে রাজপরিবারের ছবি এঁকেছেন। রাজপরিবার ছাড়াও অন্যান্য ধনী ও অভিজাত পরিবারের মধ্যে পেদ্রো তেল্লেজ গিরোন, মারিয়া জোসেফা পিমেন্তেল, মারিয়া দেল পিলার দি সিলভা ও আরো অনেকের ছবি এঁকেছেন। রাজপরিবার নিয়ে তাঁর আঁকা ছবি ‘চার্লস ফোর অব স্পেন অ্যান্ড হিজ ফ্যামিলি’ ছবিটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। ছবিটিতে রানীর অনুগত অকর্মণ্য রাজা ও তার দুর্নীতিগ্রস্ত রাজ্যের প্রতিফলন সহজেই বোঝা যায়।
১৭৯২ সালের শেষ ও ১৭৯৩ সালের শুরুর দিকে অজানা রোগে ফ্রান্সিসকো গয়া অসুস্থ ও বধির হয়ে যান। এসময় তিনি তাঁর আঁকা ছবির ধারা কিছুটা অন্যদিকে নিয়ে যান। বড় পোট্রেইট না এঁকে এ সময় তিনি প্রিন্টমেকিং করা ছবি তৈরি করা শুরু করেন। ১৭৯৭ থেকে ১৭৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি ‘ক্যাপ্রিকো’স’ নামে এ ধরনের প্রায় ৮০টি সিক্যুয়াল ছবি তৈরি করেন। ছবিগুলোতে সভ্য সমাজের অনেক বেখাপ্পা ও অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিভিন্ন ব্যাপার বেশ প্রহসনের সাথে তুলে ধরা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ১৭৯৩ থেকে ১৭৯৪ সাল অবধি গয়া বেশ কিছু ছবি এঁকেছেন, যার বিষয়বস্তু ও ভেতরের কথা আগের ছবিগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। দুঃস্বপ্ন, অমানুষিক ভীতি, উন্মাদনার অনুভূতি, জেলখানার কয়েদী ও তাদের উপর চলা নির্যাতন- এসব অন্য ধাঁচের বিষয়বস্তু নিয়ে কালজয়ী বেশ কিছু ছবি তিনি এঁকেছেন। এদের মধ্যে ‘ইয়ার্ড উইদ লুনাটিকস’ ছবিটা নানা দিক থেকে অসাধারণ। এই ছবিতে ফুটে ওঠা ভয়াবহ একাকিত্ব, স্থবির নির্জীব দুঃখবোধ, মৃত্যুর চেতনা ছবিটিকে অনন্য গুণে ভরিয়ে তুলেছে। এখনকার শিল্পকলার ইতিহাসবিদগণ বলেন, এ ধরনের কালজয়ী চিত্রকর্মের বিষয়বস্তুর প্রাথমিক উৎস ফ্রান্সিসকো গয়া নিজেই! তাঁর নিজের অসুস্থতা ও তার ফলে জন্ম নেওয়া ঘুমহীনতা, মানসিক অনিশ্চয়তা ও দুরন্ত দুঃস্বপ্নই এর উৎস।
১৮০৮ সালে ফ্রান্স স্পেনে আক্রমণ করে এবং কুখ্যাত পেনিনসুলার ওয়ার আরম্ভ হয়। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ভাই প্রথম জোসেফ এই আক্রমণের নেতৃত্ব দেন। মাদ্রিদের জনতা ফরাসি আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, যা ইতিহাসে ‘দোস দ্য মায়ো’ বিদ্রোহ নামে পরিচিত। যুদ্ধ ও মানুষ হত্যার বিভীষিকা নিয়ে ফ্রান্সিসকো গয়া বেশ কিছু ছবি আঁকেন। ইতিহাসবিদদের মতে, গয়ার এসব ছবি যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ ও নরহত্যার ভয়াবহতার বিরুদ্ধে একধরনের ব্যক্তিগত নৈতিক প্রতিরোধ ছাড়া আর কিছুই নয়। এ ধারার ছবির মধ্যে ‘দ্য সেকেন্ড অব মে ১৮০৮’, ‘দ্য থার্ড অব মে ১৮০৮’ এবং ‘দ্য ডিজাস্টার্স অব ওয়ার’ উল্লেখযোগ্য।
১৮১৯ সালের দিকে স্পেনের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একরকম হতাশা ও গভীর দুঃখের শিকার হয়ে গয়া সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ও একাকীত্বের জীবন বেছে নেন। অন্যদিকে তার অসুস্থতা বেড়েই চলেছিলো, কানে শোনার ক্ষমতা একেবারে হারিয়ে ফেলেছিলেন। এর আগেই ১৮১০ সালে মাদ্রিদ থেকে দূরে ‘লা কুইন্তা দেল সোর্দো’ নামে এক ফার্মহাউজ ও স্টুডিওতে বসবাস করতে থাকেন। মানসিক অবস্থার দীনতার কারণে তার চিত্রকর্ম এসময় সম্পূর্ণ অন্যদিকে মোড় নিচ্ছিলো।
১৮১৯ থেকে ১৮২২ সালে তিনি অন্য ধাঁচের ভয়ানক বিষয়ের উপর ভিত্তি করে কিছু ছবি আঁকেন, যা পরে ‘ব্ল্যাক পেইন্টিংস’ নামে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এসবের মধ্যে ‘স্যাটার্ন ডেভোরিং হিজ সন’, ‘টু ওল্ড মেন’, ‘মেন রিডিং’, ‘জুডিথ অ্যান্ড হলোফার্নেস’, ‘উইমেন লাফিং’, ‘ফাইট উইদ কুজেলস’, ‘টু ওল্ড মেন ইটিং স্যুপ’, ‘উইচে’স স্যাবাথ’ ছবিগুলো উল্লেখযোগ্য। এসব ছবির মধ্যে ‘স্যাটার্ন ডেভোরিং হিজ সন’ এবং ‘উইচে’স স্যাবাথ’ এর পরিচিতি সবচেয়ে বেশি। ধারণা করা হয়, গয়া এ সময় মানসিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন অপ্রাপ্তির কারণে ধীরে ধীরে মধ্যযুগীয় বিষয়বস্তুর দিকে ঝুঁকে পড়ছিলেন।
রোমান্টিক যুগের চিত্রকরদের মধ্যে ফ্রান্সিসকো গয়া সবচেয়ে ভিন্নধর্মী ছিলেন। এ আন্দোলনের সংবেদনের সাথে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতি ও ভয়জনিত ব্যথার বোধ সবচেয়ে সার্থকভাবে মিশিয়ে কালজয়ী সব চিত্রকর্ম তৈরি করে গেছেন। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, রোমান্টিক যুগের যে রোমান্টিক শিল্পী এই আন্দোলনের সীমাবদ্ধতার বাইরে প্রথম যেতে পেরেছিলেন, তিনি গয়া। এজন্য দেখা যায়, চিত্রকলায় আধুনিক সংবেদনের আন্দোলন, যেমন- এক্সপ্রেশনিজম ও সুররিয়ালিজমের নেতৃস্থানীয় শিল্পীদের অঙ্কনশৈলী ও বিষয়বস্তুর উপরে ফ্রান্সিসকো গয়ার বেশ প্রভাব আছে। সুররিয়ালিস্ট যে শিল্পী বিশ শতকে রীতিমত সিনেমার নায়কের মতো জনপ্রিয় ছিলেন, সেই সালভাদর দালির ছবির আঙ্গিক ও বিষয়ের উপর গয়ার প্রভাব একেবারে পরিষ্কার।
ফ্রান্সিসকো গয়া ১৮২৮ সালের ১৬ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। এই অমর শিল্পীর চিত্রকর্ম আজও শিল্পপ্রেমীদের অসীম বিস্ময়ের উৎস হয়ে আছে।