পৃথিবী এ পর্যন্ত পাড়ি দিয়েছে চারটি বরফ যুগ ও চারটি আন্তঃবরফ যুগ। প্রতি যুগেই উষ্ণ অঞ্চলে গিয়ে টিকে থাকা প্রাণীদের দেহের আকৃতিতে কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়। এই আকৃতি অন্য প্রাণীদের মতোই মানুষের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। প্রায় দশ লাখ বছর পূর্বে সেই বরফযুগের প্রথম পর্যায়ে জাভা মানব এবং পিকিং মানবদের বসবাস ছিল। নিয়ান্ডারথাল মানবদের কঙ্কাল পাওয়া গেছে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা জুড়ে। তবে হোমো স্যাপিয়েন্সদের সবচেয়ে কাছের মানুষ হচ্ছে ক্রোমেনিয়ন মানবেরা। প্রসঙ্গত, ফ্রান্সের ক্রোমেনিয়ন অঞ্চলের গুহা থেকে এদের ফসিল পাওয়া যায়।
পুরোপলীয় (পুরনো পাথরের যুগ) যুগে মানুষের জীবন ছিল শিকারি যাযাবর জীবন এবং নবোপলীয় (নতুন পাথরের যুগ) যুগে ছিল কৃষিপ্রধান স্থায়ী জীবন। পুরোপলীয় যুগে মানুষের মধ্যে ক্ল্যান এবং টোটেমের (ধর্মবিশ্বাস) চর্চা শুরু হয়। টোটেমের বা ধর্মবিশ্বাসের চর্চা করতে গিয়ে যে সমস্ত বিধিনিষেধ মানা হতো তার নাম ছিল ট্যাবু। পুরোপলীয় যুগের শেষ পর্যায়ে এসে মানুষ ভাঙা ভাঙা শব্দ উচ্চারণ ও অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করতে থাকে। কৃষিপ্রধান জীবনে এসে মানুষের মাঝে নানা প্রাকৃতিক শক্তির পূজা করতে দেখা যায়।
এই কৃষিপ্রধান যুগে এসেই মানুষের সভ্যতার গল্প শুরু হয়।
মিশরীয় সভ্যতা
ইতিহাসের জনক হেরোডেটাস মিশরকে বলেছেন ‘নীলনদের দান’। কেননা নীলনদকে ঘিরেই গড়ে ওঠে মিশরীয় সভ্যতা। মিশরীয়দের প্রধান দেবতা ছিল সূর্যদেবতা, নাম ‘আমন’। মিশরীয় রাজা ফারাওদের ধারণা, তারা সূর্য দেবতার বংশধর। তাই তারা অমর এবং এই বিশ্বাসের দরুন তারা মৃত্যুর পর নিজেদের দেহ মমি করে রাখতো।
আরেকজন দেবতা ছিলেন ‘ওসাইরিস’, তিনি প্রাকৃতিক শক্তি, শস্য ও নীলনদের দেবতা ছিলেন। ফারাও চতুর্থ আমেনহোটেপ বহু দেবতার বদলে এক দেবতা অর্থাৎ সূর্যদেবতার পূজা করার প্রচলন করেন। তিনি সূর্যদেবতার নাম বদলে ‘আতেন’ রাখেন এবং দেবতার নামের সাথে মিলিয়ে নিজের নাম দেন ‘আখেনাতেন’।
মূর্তি নির্মাণে মিশরীয়রা ছিলেন সিদ্ধহস্ত। আখেনাতেন ও রানী নেফারতিতির চুনাপাথরের মূর্তি দেখলে এখনো তাদের জীবন্ত মনে হয়। মিশরের চিত্রলিপির নাম ‘হায়ারোগ্লিফিক’, এটি গ্রিকদের দেয়া নাম, যার অর্থ ‘পবিত্র লিপি’। নলখাগড়া জাতীয় ঝোপ ‘প্যাপিরাস’ থেকে কাগজ তৈরি করে লেখা হতো। সম্রাট নেপোলিয়ন মিশরীয় সভ্যতার ‘রোজেটা’ নামক পাথর খুঁজে পান, যা থেকে পরবর্তীতে হায়ারোগ্লিফিক ভাষার পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের দুনিয়ায় জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতশাস্ত্রের বিকাশ ছিল মিশরীয়দের প্রথম সাফল্য। পাশাপাশি মিশরীয়রা পাটিগণিত ও জ্যামিতির উদ্ভাবন করেছিল বলে ধারণা করা হয়। কারণ ত্রিকোণ পিরামিড তৈরিতে জ্যামিতির জ্ঞান থাকা জরুরি ছিল।
সুমেরীয় সভ্যতা
গ্রিক শব্দ ‘মেসোপটেমিয়া’র অর্থ ‘দুই নদীর মধ্যবর্তী ভূমি’। মেসোপটেমিয়ার পূর্বদিকে টাইগ্রিস বা দজলা নদী, এবং পশ্চিমে ইউফ্রেটিস বা ফোরাত নদী। মেসোপটেমিয়ার অনেকগুলো সভ্যতার মধ্যে সুমেরীয় সভ্যতা সবচেয়ে প্রাচীন। খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে এর জন্ম। এ সভ্যতার লিখন পদ্ধতির নাম ‘কিউনিফর্ম’ (Cuneiform), যা কাদামাটির নরম শ্লেটে লেখা হতো। সুমেরের প্রাচীন শহর নিপ্পুরের এক মন্দিরে চার হাজার মাটির চাকতির একটি লাইব্রেরি পাওয়া গেছে। সুমেরীয়রা অনেক দেবতায় বিশ্বাস করলেও তাদের মধ্যে পরকালের ধারণা ছিল না, তাই এ সভ্যতা থেকে কোনো মমি পাওয়া যায় না। এদের প্রধান দেবতা ছিলেন সূর্যদেব ‘শামাশ’।
প্রাচীন ব্যাবিলন
মেসোপটেমিয় অঞ্চলের এই সভ্যতার পত্তন হয় ২০৫০ খ্রিস্টপূর্বে। অ্যামোরাইট নামে পরিচিত সিরিয়ার মরুভূমি থেকে আসা একদল মানুষ গড়ে তোলে এই সভ্যতা। অ্যামোরাইটদের বিখ্যাত নেতা হাম্মুরাবির নেতৃত্বে এই সভ্যতার জন্ম হয়। তিনি আইন সংকলক হিসেবে বিখ্যাত। ব্যাবিলনের রয়েছে ‘গিলগামেশের মহাকাব্য’। ভাষা কিউনিফর্ম।
আশেরীয় সভ্যতা
মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে টাইগ্রিস নদীর তীর ঘেঁষে ছিল ‘আশুর’ শহর। এই শহর ঘিরেই গড়ে ওঠে আশেরীয় সভ্যতা। এই সভ্যতা প্রথমদিকে কৃষি এবং পশুপালনের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় জনসংখ্যা বাড়ার কারণে এদের প্রাত্যহিক জীবনে নানা সংকট দেখা দেয় এবং ধীরে ধীরে এরা আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে লুটপাট করতে শুরু করে। পরবর্তীতে লুটের মালই এদের অর্থনীতির মূল উৎস হয়ে ওঠে। আশেরীয়দের সে যুগের বিচারে আধুনিক সৈন্যবাহিনী ছিল। তারাই প্রথম লোহার অস্ত্র তৈরি করে গোলন্দাজ বাহিনী গঠন করে এবং যুদ্ধরথের ব্যবহার করে। শেষ সম্রাট ‘আশুরবানিপাল’ কর্তৃক নির্মিত কিউনিফর্ম পদ্ধতিতে লেখা ২২০০টি কাদামাটির শ্লেট সম্বলিত লাইব্রেরি পাওয়া যায় এখানে। তিনশো বছরের স্থায়িত্বকাল শেষে ৬১২ খ্রিস্টপূর্বে ধ্বংস হয় এই সভ্যতা।
ক্যালডীয় সভ্যতা
ব্যাবিলন শহর ঘিরে গড়ে ওঠায় ক্যালডীয় সভ্যতাকে নতুন ব্যাবিলনীয় সভ্যতাও বলা হয়। মেসোপটেমীর সভ্যতার চূড়ান্ত ধাপ ক্যালডীয় সাম্রাজ্য গড়ে তোলার সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল সম্রাট নেবুচাদনেজার। কঠোর শাসক নেবুচাদনেজার তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করায় জেরুজালেম শহর ধ্বংস করে হাজার হাজার হিব্রুকে (ইহুদী) বন্দী করে নিয়ে আসেন যা ব্যাবিলনীয় বন্দীদশা (Babylonian Captivity) নামে পরিচিত।
নেবুচাদনেজারের রানী শখ করে রাজাকে একটি বাগান নির্মাণ করে দিতে বলেন। রানীর আবদার রাখতে রাজা নেবুচাদনেজার নগরীর চারদিকে যে দেয়াল ছিল তারই ছাদে তৈরি করেন বিশাল বাগান, এটিই এখন ‘ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান’ নামে পরিচিত। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় খুব বেশি অবদান না রাখলেও জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাদের অবদান অসামান্য। সর্বপ্রথম সপ্তাহকে সাত দিনে এবং দিনকে ১২ জোড় ঘণ্টায় ভাগ করে ক্যালডীয়রা। এ যুগের বিজ্ঞানীরা ১২টি নক্ষত্রপুঞ্জের সন্ধান পান, যা থেকে ১২টি রাশিরচক্রের সৃষ্টি হয়। এদের প্রধান দেবতা ছিল ‘মারডক’। পারস্য আক্রমণে ধ্বংস হয় এই সভ্যতা।
সিন্ধু সভ্যতা
সিন্ধুনদের তীরে গড়ে উঠেছিল মহেঞ্জোদারো নগরী আর সিন্ধুর উপনদী রাভীর তীরে বিকাশ ঘটেছিল হরপ্পা নগরীর। অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতায় অসাধারণ স্থাপত্যকলার নিদর্শন পাওয়া গেলেও তা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, প্রাসাদ ইত্যাদি নির্মাণের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় রীতিমতো আধুনিক নগর গড়ে উঠেছিল। ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের সড়ক ছিল, পানি সরবরাহের জন্য কূপসহ নানা ব্যবস্থা ছিল, পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য ড্রেন ছিল, স্নানাগার ছিল, রাস্তায় ড্রেন ও সড়ক বাতি ছিল, নগরীতে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ছিল। এই দুই নগরীতে প্রায় ২৫০০টি সীল পাওয়া যায় যার বেশিরভাগে বিভিন্ন চিহ্ন, ষাঁড়, মহিষ প্রভৃতি পশুর প্রতিকৃতি ছিল।
পারস্য সভ্যতা
আরব মরুভূমির উত্তরে একদিকে দানিয়ুব নদীর অববাহিকা থেকে শুরু করে পূর্বমুখী আর অন্যদিকে কৃষ্ণ সাগরের উত্তর প্রান্ত থেকে শুরু করে রাশিয়ার দক্ষিণ সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল পারস্য সভ্যতা। পারস্য সভ্যতায় দুটো সাম্রাজ্য ছিল। মিডীয় সাম্রাজ্য ও পারস্য সাম্রাজ্য। মেডেস রাজ্য বিলাসী ও বেপরোয়া থাকলেও পার্সীয়রা ছিল আদর্শবাদী ও কর্মঠ। বিখ্যাত সম্রাট মহান দারিয়ুস (Darius the Great) শাসন করেছিলেন এই পারস্য সাম্রাজ্য।
দারিয়ুস খুব বুদ্ধিমান সম্রাট ছিলেন। নতুন অঞ্চল দখল করেই ধ্বংসযজ্ঞ না চালিয়ে তিনি বরং সব অঞ্চলের ভালো জিনিসগুলো গ্রহণ করেছেন। যেমন- মিশরীয়দের ১২ মাসে বছর এবং ৩০ দিনে মাস গণনার রীতি বা এশেরীয়দের ডাক ব্যবস্থা। পারসিকরা দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। ষষ্ঠ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জরথ্রুষ্ট (Zoroaster) নামে এক নবী জরথুস্ট্রবাদ (Zoroastrianism) ধর্মের প্রচার করেন। এই ধর্মের ঈশ্বর আহুরামাজদা (Ahuramazda) এবং ধর্মগ্রন্থ ‘আবেস্তা’ (Avesta)।
হিট্টাইট রাষ্ট্র
লোহা তৈরিতে সবচেয়ে দক্ষ ছিল এশিয়া মাইনরের হিট্টাইটরা। খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ অব্দ থেকে ১২০০ অব্দ পর্যন্ত তারা একচেটিয়াভাবে লোহা তৈরি করেছে। এ অঞ্চলে লোহার তৈরি তীরের ফলা, কুঠার, বর্শাসহ নানা ধরনের দ্রব্যাদি পাওয়া যায়। ইন্দো-ইউরোপীয়দের হাতে ধ্বংস হয় এই সভ্যতা।
চীনা সভ্যতা
মূল চীনের সাথে জুড়ে আছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র তিব্বত, সিংকিয়াং, মঙ্গোলিয়া এবং মাঞ্চুরিয়া। চীন দেশের পাঁচভাগের চারভাগ জুড়ে রয়েছে পাহাড়, পর্বত আর মালভূমি। হোয়াংহো-ইয়াংজেকিয়াং নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল চীনা সভ্যতা। চীনারা বিশ্বাস করতো তাদের সমৃদ্ধির পেছনে ড্রাগনের ভূমিকা রয়েছে। চীনের বিভিন্ন শাসনামলের মধ্যে রয়েছে হুয়াংতি রাজা, শাং রাজা, চৌ রাজাদের শাসন। চৈনিক সভ্যতা হলেও এদের প্রত্যেকের কিছু কিছু আলাদা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। চীনের প্রাচীন দার্শনিক ছিলেন লাও জু। তার চিন্তাকে নাম দেয়া হয় তাওবাদ। চীনের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক ছিলেন কনফুসিয়াস। কনফুসিয়াসের প্রধান অনুসারী মেনসিয়াস-ও বিখ্যাত।
চীনাদের মধ্যে পূর্বপুরুষ পূজার রীতি চালু ছিল। চীনা বিশ্বাস মতে, পূর্বপুরুষদের আত্মার প্রভাব পড়ে বংশধরদের উপর। তাই পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তির জন্য তারা খাবার উৎসর্গ করতেন।
হিব্রু সভ্যতা
বর্তমান প্যালেস্টাইন অঞ্চল ঘিরে প্রাচীনকালে গড়ে উঠেছিল এই সভ্যতা। হিব্রু একটি সেমেটিক ভাষা। এই ভাষায় কথা বলা লোকেরাই হিব্রু নামে পরিচিত। হিব্রুরা সারা পৃথিবীর ধর্মবিশ্বাসের এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। এরাই প্রথম সারা পৃথিবীকে একেশ্বরবাদের ধারণা দেয়। সারা দুনিয়ার সমস্ত ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের সূতিকাগার বলা চলে এই হিব্রু সভ্যতাকে।
ইজিয়ান সভ্যতা
গ্রিস ও এশিয়া মাইনরকে পৃথক করেছিল ইজিয়ান সাগর। ইজিয়ান সাগরের দ্বীপমালায় গড়ে ওঠে ইজিয়ান সভ্যতা। এর আগের সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছিলো নদীকে ঘিরে। কিন্তু ইজিয়ান প্রথম কোনো সভ্যতা যা সাগরকে ঘিরে গড়ে ওঠে। এই সভ্যতায় ‘ক্রিট’ দ্বীপকে কেন্দ্র করে ‘মাইনোয়ান’ এবং গ্রিসের মূল ভূখণ্ডকে কেন্দ্র করে ‘মাইসেনীয়’ নামে ভিন্ন দুটো সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। ইজিয়ান সভ্যতা চিত্রশিল্প ও ভাস্কর্যশিল্পে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করে। ডোরীয় ইন্দো-ইউরোপীয় গোত্রের এক আক্রমণকারীর হাতে পতন হয় ইজিয়ান সভ্যতার। ডোরীয় আর ইজিয়ান অঞ্চলের অধিবাসীরা বহুদিন একসাথে বসবাস করতে জন্ম দেয় নতুন সভ্যতার, নাম গ্রিক সভ্যতা।
গ্রিক সভ্যতা
অনেক পাহাড়ের কারণে গ্রিস ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে ভাগ হয়ে যায় এবং অনেকগুলো নগররাষ্ট্র তৈরি হয়। গ্রিসের মূল ভূখণ্ডে ছিল এথেন্স, থিবস ও মেগারা এবং পেলোপনেসাস অঞ্চলে ছিল স্পার্টা ও কোরিন্থ; এশিয়া মাইনরের তীরে ছিল মিলেটাস। এদের মধ্যে নেতৃত্বে ছিল এথেন্স ও স্পার্টা। গ্রিকদের বিশ্বাস দেবতা ডিয়াকোলানের পুত্র হেলেনের বংশধর তারা। হেলেনের বংশধর বলে গ্রিকদের নিজেদের হেলেনীয় বলতো।
স্পার্টা: স্পার্টানরা ছিল গণতন্ত্র ও প্রগতিবিরোধী। এদের আদি নিবাস ছিল পেলোপনেসাস অঞ্চলের পূর্ব দিকে। অস্ত্রের দাপটে এরা স্পার্টা দখল করে নিয়ে আদিবাসীদের ভূমিদাস বানায়। এই দাসদের বলা হতো হেলট (Helot)। দীর্ঘদিন যুদ্ধ করার ফলে এবং হেলটদের বিদ্রোহ ঠেকাতে ঠেকাতে স্পার্টানরা একসময় যোদ্ধা জাতিতে পরিণত হয়। প্রায় সমস্ত নাগরিককে যোদ্ধা হিসেবে তৈরি করা হতো, যেন পুরো স্পার্টা একটা যুদ্ধশিবির।
এথেন্স: এথেন্সে তৈরি হয়েছিল আধুনিক গণতন্ত্রের কাঠামো। স্পার্টার প্রতিবেশী হয়েও এথেন্স সমস্ত নাগরিক সুবিধা দিয়েছিল তার নাগরিকদের। গ্রিসের সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসক পেরিক্লিস এথেন্সের ক্ষমতায় বসেন ৪৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এই যুগকে এথেন্সের স্বর্ণযুগ বলা হয়। কিন্তু একসময় স্পার্টার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা পেলোপনেসীয় ও এথেন্সের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ডেলিয়ান লীগের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায় এবং এথেন্সের পতন হয়। এরপর এথেন্স স্পার্টার অধীনে চলে যায়।
হেলেনীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক
ভৌগলিক দিক থেকে গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলো বিচ্ছিন্ন হলেও ধর্মের কারণে সকলের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল। মানুষ ও পৃথিবীর উৎস সম্বন্ধে ভাবতে গিয়ে গ্রিসে ‘সফিস্ট’ (Sophist) নামের একশ্রেণীর যুক্তিবাদী দার্শনিকের উদ্ভব হয়। বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস এই সফিস্টদের দ্বারাই অনুপ্রাণিত ছিলেন। বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিসকে ৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে শাসকগোষ্ঠী হেমলক লতায় তৈরি বিষ খাইয়ে হত্যা করে। তার ছাত্র দার্শনিক প্লেটো ‘রিপাবলিক’ বইটি লেখেন এবং সক্রেটিসের বক্তব্য ও শিক্ষা নিয়ে লেখেন ‘ডায়ালগস অব সক্রেটিস’ নামের আরেকটি গ্রন্থ। নাট্যকার এসকাইলাস লেখেন ‘প্রমিথিউস বাউণ্ড’ এবং ‘আগামেমনন’ নামের দুটি নাটক। একশোটিরও বেশি নাটক লেখেন সফোক্লিস। হেরোডেটাস হয়ে ওঠেন ইতিহাসের জনক। চিকিৎসাবিজ্ঞানী ছিলেন ‘হিপোক্রেটাস’। চাঁদ যে সূর্যের আলোতেই আলোকিত হয় এই ধারণা দেন এনাক্সোগোরাস। আর ছিলেন এরিস্টটল, পিথাগোরাস এবং টলেমির মতো মহাত্মারা।
হেলেনিস্টিক সভ্যতা
গ্রিসের উত্তরে মেসিডন অঞ্চলে গড়ে ওঠে নতুন সভ্যতা যা হেলেনিস্টিক সভ্যতা নামে পরিচিত। রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ ৩৫৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই ভূখণ্ডের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেন। পারস্যের বিরুদ্ধে গ্রিক শক্তিগুলোকে একত্র করে তিনি হেলেনিক লিগ তৈরি করেন। গুপ্তঘাতকের হাতে ফিলিপ মারা যাওয়ার পর তার ছেলে বীর আলেকজান্ডার পারস্য দখল করেন। মাত্র ৩২ বছর বয়সে ৩২৩ খ্রিস্টাপূর্বাব্দে ব্যাবিলনে মারা যান আলেকজান্ডার। ইতিহাসে তিনি ‘আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট’ নামে পরিচিত। তার মৃত্যুর পর সেনাপতিরা নিজেদের মধ্যে বিশাল সাম্রাজ্য ভাগ করে নেন। হেলেনিস্টিক সভ্যতায়ও প্রচুর জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা হতো।
রোমান সভ্যতা
গ্রিসের উত্তর-পশ্চিমে প্রাচীন রোম নগরী ঘিরে উত্থান ঘটে এই সভ্যতার। ছয়শ বছর টিকে ছিল এই সভ্যতা। পুরোপলীয় যুগ থেকেই রোমে বসতি গড়ে উঠলেও ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় কথা বলা একদল মানুষ রোমে আসে ব্রোঞ্জযুগে। এদের এট্রুস্কান বলা হয়। এট্রুস্কানদের হাত ধরেই রোমান সাম্রাজ্যের সূচনা। আরেক ইন্দো-ইউরোপীয়ভাষী জাতি ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইটালির উত্তরে বসতি স্থাপন করে। এদের বলা হতো ল্যাটিন এবং ক্রমে এদের ভাষাও ল্যাটিন নামে পরিচিত হয়।
ল্যাটিনদের রাজা রোমিউলাস ‘রোম’ নগরীর পত্তন করেন। রোমান শাসনব্যবস্থা বিভিন্ন সময় বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। রোমে দাসদের উপর অমানুষিক অত্যাচার কথা হতো। স্পার্টাকাস নামক একজন দাসের নেতৃত্বে ৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দাসবিদ্রোহ শুরু হয় এবং ৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার মারা যাওয়ার মধ্য দিয়ে দাসবিদ্রোহের অবসান হয়। ১১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পর থেকে রোম জড়িয়ে পড়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। নানা শাসকের উত্থান ঘটে। বিখ্যাত জুলিয়াস সিজার খুন হন ব্রুটাস এবং ক্যাসিয়াসের হাতে। সিজারের মৃত্যুর পর রোমে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এসময় উত্থান ঘটে অক্টাভিয়ান সিজার, মার্ক অ্যান্টনি ও লেপিডাস নামক তিন নেতার। পরবর্তীতে অক্টাভিয়ান সিজার লেপিডাসকে পরাজিত করেন। অ্যান্টোনিও মিশরের রাজকন্যা ক্লিওপেট্রাকে বিয়ে করায় তার শক্তিবৃদ্ধি পায়। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হয়নি, তাকেও পরাজিত করেন অক্টাভিয়ান। এরপর রোমের একচ্ছত্র অধিপতি হন ‘অগাস্টাস সিজার’ নাম নিয়ে।
গ্রিক ধর্মের প্রভাব পড়ে রোমান ধর্মেও। সম্রাটদের দেবতা হিসেবে পূজা করার রীতি ছিল বলে রোমান শাসকরা খ্রিস্টধর্মকে সুনজরে দেখতেন না। সম্রাট কনস্ট্যানটাইনের সময় খ্রিস্টধর্ম রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা পায়। ভার্জিলের মহাকাব্য ‘ইনিড’ লেখা হয়েছে এই সভ্যতায়।
ছোট ছোট কয়েকটি রাষ্ট্র
লিডিয়া: হিট্টাইটদের পতনের পর এশিয়া মাইনরের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল লিডিয়া। বর্তমান তুরষ্কের একটি অংশে গড়ে উঠেছিল এটি। এর মানুষেরা খুব ধনী ছিল এবং এদের বাণিজ্য টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস থেকে ইজিয়ান সাগর পর্যন্ত ছড়ানো ছিল।
ফিনিশিয়া: লেবানন পর্বত এবং ভূমধ্যসাগরের মাঝামাঝি একফালি সরু ভূমিতে ফিনিশীয়দের রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। সমুদ্রতীরবর্তী ছিল বলে এদের অর্থনীতির প্রধান উৎস ছিল বাণিজ্য। দক্ষ ফিনিশীয় নাবিকরা রাতে নক্ষত্র দেখে জাহাজ চালাতো। এভাবে তারা দিক নির্ণয় করতো বলে অনেকেই ধ্রুবতারাকে ‘ফিনিশীয় তারা’ বলতো। সভ্যতার ইতিহাসে ফিনিশীয়দের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে বর্ণমালার উদ্ভাবন। তারা ২২টি ব্যঞ্জনবর্ণের উদ্ভাবন করে। এখান থেকে সূচনা হয় আধুনিক বর্ণমালার। ফিনিশীয়দের উদ্ভাবিত বর্ণমালার সাথে পরবর্তীতে গ্রিকরা স্বরবর্ণ যোগ করে বর্ণমালাকে সম্পূর্ণ করে।
আরামিয়া: দুই হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে এরা মেসোপটেমিয়াতে এসেছিল। এদের প্রধান নগর ছিল দামেস্কে। এরাও বাণিজ্য করতো।
পৃথিবীর সময়কে মোটাদাগে তিনভাগে ভাগ করা হয়। প্রাচীনযুগ, মধ্যযুগ এবং আধুনিক যুগ। ৪৭৬ খ্রিস্টাব্দে রোমান সভ্যতার পতনের মধ্য দিয়ে প্রাচীন যুগের সমাপ্তি ঘটে। প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে কারো জ্ঞান-বিজ্ঞানে দক্ষতা ছিল, কারো ছিল দক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা। তবে যার যা-ই থাক না কেন, সব সভ্যতারই বৃহৎ বা ক্ষুদ্র অবদানে আশীর্বাদপুষ্ট আজকের এই আধুনিক সভ্যতা।
ইতিহাসের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
প্রাচীন সভ্যতা নিয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ
১) প্রাচীন সভ্যতা সিরিজঃ ৮টি বইয়ের রকমারি কালেকশন
২) পৃথিবীর ইতিহাস