কমিক দুনিয়ায় মারভেল বনাম ডিসির লড়াইটা দীর্ঘদিনের। রূপালী পর্দায় তাদের লড়াই তো আরো বেশি আকর্ষণীয়, আরো বেশি দর্শনীয়। তবে গত এক দশকের বেশিরভাগ সময় ধরে একাধারে যেমন চলেছে মারভেলের জয়জয়কার, অন্যদিকে দেখা গেছে ডিসির চরম ব্যর্থতা। ফলে ডিসির চেয়ে মারভেল যে যোজন যোজন ব্যবধানে এগিয়ে গেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমানে তো এমন একটা প্রজন্মও গড়ে উঠেছে, যারা ডিসির কোনো ছবি না দেখেও ডিসিকে নিয়ে উপহাস, রসিকতা করে দিব্যি লোক হাসাতে পারে।
কিন্তু হলিউড এমন একটি ইন্ডাস্ট্রি, যেখানে দৃশ্যপটের রঙ বদলাতে খুব বেশি সময় লাগে না। তাই যে ডিসিকে কয়েক বছর আগেও নিতান্তই মূমুর্ষূ বলে মনে হচ্ছিল, এখন তাদের ভবিষ্যতই মনে হচ্ছে দারুণ উজ্জ্বল। অনেকে তো এমনটাও বিশ্বাস করতে শুরু করে দিয়েছে যে, ডিসির প্রত্যাবর্তনটা হবে রীতিমতো রাজকীয়। কিন্তু এমন বিশ্বাসের ভিত্তি কী? তা কি কেবলই সাম্প্রতিক সময়ে ওয়ান্ডার ওম্যান বা অ্যাকোয়াম্যানের সাফল্য?
না, শুধু এগুলো নয়। এমন বিশ্বাসের নেপথ্যে রয়েছে আরো বেশ কিছু শক্তিশালী কারণ। চলুন, এবার জেনে নিই সেই কারণগুলো সম্পর্কেই।
ডিসি কিন্তু কখনোই খুব বেশি ব্যর্থ ছিল না
মারভেলের সাথে তুলনা করতে গিয়ে ডিসিকে অনেকেই টেনে মাটিতে নামিয়ে আনতে চায়। ক্রিস্টোফার নোলানের ডার্ক নাইট ট্রিলজি পরবর্তী সময়ে ডিসি এক্সটেন্ডেড ইউনিভার্সের ব্যর্থতাকে তারা অনেক বেশি বড় করে দেখাতে চায়। অবশ্য বাস্তবতা কিন্তু সেই চাওয়াকে খুব একটা সমর্থন করে না।
হ্যাঁ, ডিসির ছবিগুলো দর্শকের মন হয়তো ভরাতে পারেনি, তারপরও আর্থিকভাবে সাফল্য কিন্তু সেগুলো ঠিকই পেয়েছে। সত্যি বলতে, ডিসির মতো ধারাবাহিকতা ইতিহাসে খুব কম ফ্র্যাঞ্চাইজিই দেখাতে পেরেছে। তাদের প্রতিটি ছবিই বিশ্বব্যাপী অন্তত ৬৫০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। আর সর্বশেষ অ্যাকোয়াম্যান তো বিলিয়ন ডলারের রেখাও পার করেছে।
ভুলে গেলে চলবে না, সেই তুলনায় মারভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের সূচনা কিন্তু বেশ দুর্বল ছিল। ক্যাপটেন আমেরিকা বিশ্বব্যাপী মাত্র ৩৭০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছিল। দ্য ইনক্রেডিবল হাল্ক তো ঘরোয়া বক্স অফিস থেকে বাজেটটুকুও ফিরিয়ে আনতে পারেনি। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ের অ্যান্ট ম্যান (৫১৯ মিলিয়ন ডলার) কিংবা ডক্টর স্ট্রেঞ্জকেও (৬৭৭ মিলিয়ন ডলার) ডিসির মানদন্ডে ব্যর্থ বলেই মনে হবে।
তারপরও ডিসিকে ব্যর্থতার দায়ভার কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, ওয়ার্নার ব্রোস তাদের পেছনে অনেক বেশি অর্থ ঢেলেছে। কিন্তু বিনিয়োগের তুলনায় ওয়ার্নার ব্রোসের লাভের পরিমাণ খুব আহামরি কিছু ছিল না। এবং দ্বিতীয়ত, মারভেলের ব্লকবাস্টার ছবিগুলো ডিসির একই ধরনের ছবিগুলোর ব্যাপারে যে আকাশচুম্বি প্রত্যাশার পাহাড় গড়ে দিয়েছিল, ডিসি তা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। তা না হলে, সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে সুইসাইড স্কোয়াডের আয় করা প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন ডলারকে কিন্তু বিপুল পরিমাণ অর্থ বলেই মনে হবে।
মারভেলের সামনে রয়েছে নতুন করে শুরু করার চ্যালেঞ্জ
এখন পর্যন্ত মারভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্সের পথচলা বেশ মসৃণই ছিল। পর্দার পেছনে সকলের অক্লান্ত পরিশ্রম, সেই সাথে দারুণ দূরদর্শিতার ফলে ফ্র্যাঞ্চাইজিটি অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম মুক্তির পর তাদেরকে নতুন করে অনেক কিছু শুরু করতে হবে, যা নিঃসন্দেহে সহজ কোনো কাজ হবে না।
এন্ডগেমের মাধ্যমে এমসিইউ’র অধিকাংশ নির্ভরযোগ্য তারকারই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। ক্রিস ইভানস, ক্রিস হেমসওয়ার্থ এবং রবার্ট ডাউনি জুনিয়র, প্রত্যেকেই ইতিমধ্যে ইঙ্গিত দিয়ে দিয়েছেন যে এন্ডগেমের মাধ্যমেই তারা ইতি টানতে ইচ্ছুক।
ফলে মারভেলকে এক কঠিন পরীক্ষার সামনে অবতীর্ণ হতে হবে। এতদিন সুপারহিরো চরিত্রগুলোতে মারভেলের প্রায় প্রতিটি কাস্টিং সিদ্ধান্তকেই একেবারে খাপে খাপ বলে মনে হয়েছে। প্রত্যেক অভিনেতাই নিজেদের চরিত্রের সাথে এত বেশি মানিয়ে গেছেন যে, সাধারণ দর্শক সেসব চরিত্রে অন্য কাউকে কল্পনাই করতে পারে না। যেমন, আয়রন ম্যানের চরিত্রে রবার্ট ডাউনি জুনিয়রের বিকল্প অন্য কাউকে কি ভাবা যায়?
মারভেলের জন্য আরো একটি বড় চিন্তার বিষয় হলো ক্যামেরার পেছনের সৃজনশীল মানুষগুলোর দলত্যাগ। জস হোয়েডন, জেমস গান, আভা ডুভারনেরা ইতিমধ্যেই ডিসিতে নাম লিখিয়েছেন। এখন থেকে তারা কাজ করবেন জেমস ওয়ান, প্যাটি জেনকিনস, ম্যাটস রিভস, ক্রিস ম্যাককের মতো গুণী নির্মাতাদের সাথে। বলাই বাহুল্য, এত ঝুঁট-ঝামেলার মধ্যেও প্রকৃত গুণীদেরকে ঠিকই আকৃষ্ট করতে পারছে ডিসি এক্সটেন্ডেড ইউনিভার্স।
আর-রেটেড সুপারহিরোদের পর্দায় আনতে ডিসি হতে পারে আরো বেশি সাহসী
মারভেলের বিরুদ্ধে একটি বড় অভিযোগ হলো, তারা পিজি-১৩-এর গন্ডি ছেড়ে বের হতে সাহস পাচ্ছে না। তাই ডেয়ারডেভিল কিংবা জেসিকা জোনসের মতো পরিণত সুপারহিরো চরিত্রগুলোকে তারা মূল এমসিইউ’র অংশ হিসেবে নিজস্বতা ধরে রেখে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেয়নি। একই কথা প্রযোজ্য ডেডপুলের বেলায়ও।
ওদিকে ডিসির ভান্ডারে আছে দারুণ সব ‘সাহসী’ সুপারহিরো। অনেকেই হয়তো জানেন না, ডিসির সাম্প্রতিক একটি কমিকে দেখা গেছে ফুল ফ্রন্টাল ব্যাট ন্যুডিটিও। তাছাড়া পরিণত পাঠকদের জন্য তারা কয়েক দশক ধরেই ভার্টিগো বের করে আসছে। ইতিমধ্যেই ভার্টিগো অবলম্বনে ভি ফর ভেন্ডেটার মতো ছবি এবং আইজোম্বি ও প্রিচারের মতো টিভি সিরিজ বের করে গেছে। বড় পর্দায় আগমনের অপেক্ষায় আছে দ্য স্যান্ডম্যান ও ১০০ বুলেটসও। এছাড়া ভুলে গেলে চলবে না ওয়াকিন ফিনিক্সের জোকারের কথাও।
ডিসিও তাদের এসব পরিণত চরিত্রের অধিকাংশকেই মূল ডিসি এক্সটেন্ডেড ইউনিভার্সের বাইরে রাখছে। তবে তারা অন্তত সেই ব্যাপারটি সততার সাথে স্বীকার করছে। মারভেল যেমন আর-রেটেড সিরিজ নির্মাণ করে, শুরুতে এমন ভান করে যেন সেগুলো মূল এমসিইউ’তে খুব বড় ধরনের ভূমিকা পালন করবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব বড় বড় কথা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, ডিসি সেটি করছে না।
ডিসির সামনে আছে আরো বৈচিত্র্যময় ভবিষ্যৎ
একটা লম্বা সময় পর্যন্ত হলিউডে সুপারহিরো চরিত্র বলতেই বোঝানো হয়েছে সাদা চামড়ার, মধ্যবয়সী তারকাদের। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নির্মাতারা ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করেছেন, আর তাতে তারা সাফল্যও পেয়েছেন। তাই এ কথা বলাই যায় যে, ভবিষ্যতে আমরা সামগ্রিক হলিউডি সুপারহিরো ছবিতেই একটি বড় ধরনের পরিবর্তন দেখতে পাব।
তবে ধারণা করে নিতে অসুবিধা হয় না যে, বৈচিত্র্যতাকে কাজে লাগাতে মারভেলের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয় হবে ডিসি। হ্যাঁ, মারভেল ক্যাপটেন মারভেলের মাধ্যমে একটি নারী সুপারহিরো চরিত্র নিয়ে এসেছে বটে, কিন্তু সেজন্য তারা পার করে এসেছে বিশ-বিশটি ছবি। তবুও ঐতিহ্যের দিক থেকে ক্যাপটেন মারভেল ধারেকাছেও আসবে না ওয়ান্ডার ওম্যানের। এমনকি ক্যাপটেন মারভেল এখনো সমতুল্য নয় সুপারগার্ল, ব্যাটগার্ল, ক্যাটওম্যান কিংবা হারলি কুইনেরও।
মূল কথা হলো, ডিসির দখলে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু প্রতিষ্ঠিত বৈচিত্র্যময় চরিত্র আছে। তাই তারা যত সহজে ভবিষ্যতে আরো বেশি বৈচিত্র্যের আমদানি করতে পারবে, মারভেলের জন্য বড় পর্দায় সম্পূর্ণ নতুন কোনো চরিত্র নিয়ে এসে তা করা সহজ কাজ হবে না।
সুপারম্যান-ব্যাটম্যানের ব্যর্থতা শাপে বর হয়েছে ডিসির জন্য
ব্যাটম্যান ও সুপারম্যানকে একে অপরের সামনাসামনি দাঁড় করাতে গিয়ে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন জ্যাক স্নাইডার। তবে এই ব্যর্থতাও কিন্তু কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়।
মারভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স শুরু করার অনেক আগে থেকেই কিন্তু এই দুই চরিত্র বড় পর্দা কাঁপিয়ে আসছে। সেই ১৯৭৮ সালেই সুপারম্যান, এবং ১৯৮৯ সালে ব্যাটম্যান বক্স অফিসে সাফল্য পেয়েছিল। অর্থাৎ আলাদা কোনো ইউনিভার্স না থাকা সত্ত্বেও, ডিসির কিন্তু খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিল না। ব্যাটম্যান ও সুপারম্যানই তাদের ট্রাম্পকার্ড ছিল, আরো ছিল নির্ভরতার প্রতীকও।
কী হতো চিন্তা করে দেখুন, যদি ম্যান অফ স্টিল এবং ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান সমালোচকদের চোখের মণি হতো, এবং দুটি ছবিই আরো কয়েকশো মিলিয়ন ডলার করে বেশি কামাত। সেক্ষেত্রে আমরা কি ২০১৮ সালে বিলিয়ন ডলার আয় করা অ্যাকোয়াম্যান পেতাম? কিংবা ভবিষ্যতে শ্যাজাম!, বার্ডস অফ প্রে, প্লাস্টিক ম্যান, অ্যাকোয়াম্যানের স্পিন অফ কিংবা ওয়াকিন ফিনিক্সের জোকার অপেক্ষা করে থাকত?
সম্ভবত না। কারণ ব্যাটম্যান ও সুপারম্যান দিয়ে কাজ চললে, ডিসি আলাদা করে এক্সটেন্ডেড ইউনিভার্স সৃষ্টির ব্যাপারে এত বেশি মরিয়া হয়ে উঠত না।
যারা এ ব্যাপারে একমত নন, তাদেরকে মনে করিয়ে দিতে চাই, এমসিইউ-ও কিন্তু স্পাইডারম্যান কিংবা এক্সম্যানের মতো মূলধারার সুপারহিরোর হাত ধরে সৃষ্টি হয়নি। এমসিইউ’র আগমন ঘটেছিল মধ্যম মানের আয়রন ম্যানের মাধ্যমে। ঠিক একইভাবে, ব্যাটম্যান ও সুপারম্যান দিয়ে কাজ হচ্ছিল না বলেই ওয়ার্নার ব্রোস সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ডিসি কমিকরাজ্যের আরো গভীরে ডুব দেয়ার। সেটি যে কত যুগান্তকারী একটি সিদ্ধান্ত ছিল, তার প্রমাণ আমরা হাতেনাতে পেয়েছি অ্যাকোয়াম্যানের সাফল্যের মাধ্যমে।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/